আমরা জানি, গঁগ্যার ছবি থেকে অমৃতা প্রাণিত হয়েছিলেন। তবে সেখানে রবি ঠাকুরের বিষণ্ণবিধুর মেয়েরা কি কোনওভাবেই উঠে আসেনি? রবীন্দ্রনাথ সেই প্রায় কিশোরী অমৃতার প্রসঙ্গে অবহিত ছিলেন না– যিনি কি না পরবর্তীকালে ভারতের অন্যতম সেরা শিল্পী হয়ে উঠবেন। তবে প্যারিসের পরে জার্মানির প্রদর্শনীতে এক বিখ্যাত শিল্পী রবীন্দ্রনাথের ছবি দেখে চমকে উঠেছিলেন, তিনি ক্যাথে কোলভিতৎস। কন্যা মীরাকে লেখা চিঠিতে পাই সে খবর।
১৪.
মাঝে মাঝে একটা প্রশ্ন আমাদের মনের মধ্যে জেগে উঠতে চায়। তা হচ্ছে, বিদেশের শিল্পীরা রবীন্দ্রনাথের ছবিকে কীভাবে গ্রহণ করেছিলেন? পুব দেশের কবির ছবি তাঁদের আগ্রহ আদায় করতে পেরেছিল কি? রবীন্দ্রনাথের ছবি নিয়ে কী ভাবছিলেন পশ্চিমের আধুনিক শিল্পীরা? এ নিয়ে তাঁদের মনে কোনও কৌতূহল দেখা দিয়েছিল কি? তাঁরা ছবি দেখতে এসেছিলেন, নাকি রবি ঠাকুরের ছবির প্রদর্শনীতে ভিড় করেছিলেন কেবল সাহিত্যের মানুষজন, এসেছিলেন দার্শনিক আর ইতিহাসবিদরা? যেমন প্যারিস একজিবিশনের কথাই ধরা যাক।
কাগজের পাতায় এশিয়ার প্রথম নোবেল লরিয়েটের আঁকা ছবির প্রদর্শনীর খবরে প্যারিসের প্রখ্যাত শিল্পীদের মনে কোনও কৌতূহল কি জেগেছিল? কী ভাবছিলেন মাতিস বা পিকাসোর মতো শিল্পী? রবীন্দ্রনাথের ছবির খবরে আদৌ চোখ পড়েছিল তাঁদের বা পড়লেও গুরুত্ব দিয়েছিলেন? সেসব আজ বলা মোটেও সহজ নয়। তবে কি রবি ঠাকুরের ছবি নিয়ে উৎসাহিত হয়েছিলেন শুধুমাত্র সাহিত্য অনুরাগী একদল এলিট বৃত্তের মানুষ? যাঁদের ডেকেছিলেন ভিক্টোরিয়া? প্রদর্শনীতে অধিকাংশই কি তবে প্রবল প্রভাবশালী, ব্যক্তিত্বময়ী এবং ‘লা সুর’-এর মতো পত্রিকার সম্পাদক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর নিমন্ত্রণ উপেক্ষা করতে না পেরে এসেছিলেন? রবীন্দ্রনাথ নিজেই লিখেছেন ভিক্টোরিয়ার অকাতর পরিশ্রমের কথা– ‘ভিক্টোরিয়া অবাধে টাকা ছড়াচ্চে। এখানকার সমস্ত বড়ো বড়ো গুণীজ্ঞানীদের ও জানে– ডাক দিলেই তারা আসে’।
এই ‘গুণীজ্ঞানীদের’ দলে কোনও প্রখ্যাত আর্টিস্ট ছিলেন কি না, জানি না। আবার মনে হয়, মাতিস-পিকাসোর মতো শিল্পীরা সেভাবে অচেনা ভিনদেশি কোনও শিল্পীর কাজ নিয়ে উৎসাহিত হয়েছিলেন বলে মনে হয় না। তবে কারা দেখলেন? রবি ঠাকুরের ছবির যাচাই হল কোন মানদণ্ডে? তাহলে কি এটাই ধরে নেব যে, প্যারিসের ‘সমস্ত বড়ো বড়ো গুণীজ্ঞানী’ মানুষ শুধুমাত্র ভিক্টোরিয়ার আমন্ত্রণে অনেকটা সৌজন্য রক্ষার খাতিরে হাজির হয়েছিলেন? ব্যাপারটা হয়তো এতটা ক্রিটিক্যালি দেখা ঠিক নয়। তবে ছবির ভালো-মন্দ নিয়ে সেই পর্বে রবীন্দ্রনাথ নিজেই খানিক সংশয়ে ছিলেন, সে বেশ বোঝা যায়। প্যারিস প্রদর্শনীর সকালে উদ্বোধনের আগের মুহূর্তেও প্রতিমা দেবীকে চিঠিতে লিখছেন– ‘বস্তুত আমার লেখার স্রোত একেবারে বন্ধ। ছুটি যখন পাই ছবি আঁকি– যারা সমজদার তারা বলে এই হাল আমলের ছবিগুলো সেরা দরের। একটু একটু বুঝতে পারচি এরা কাকে বলে ভালো, কেন বলে ভালো’।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
রবীন্দ্রনাথ সেই প্রায় কিশোরী অমৃতার প্রসঙ্গে অবহিত ছিলেন না– যিনি কি না পরবর্তীকালে ভারতের অন্যতম সেরা শিল্পী হয়ে উঠবেন। তবে প্যারিসের পরে জার্মানির প্রদর্শনীতে এক বিখ্যাত শিল্পী রবীন্দ্রনাথের ছবি দেখে চমকে উঠেছিলেন, তিনি ক্যাথে কোলভিতৎস। কন্যা মীরাকে লেখা চিঠিতে পাই সে খবর। লিখছেন, ‘এখানে (বার্লিন) আসর খুব জমেচে।… ছবিগুলোরও কপাল ভাল বলেই মনে হচ্চে। এখানকার খুব বিখ্যাত মেয়ে আর্টিস্ট Kathe Kollwitz খুবই বিস্মিত হয়েছেন। গ্যালারি-ওয়ালারা বলচে, একেবারে আশাতীত’।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না, প্রদর্শনী উদ্বোধনের দিনে তিনি বেশ মানসিক চাপে ছিলেন। সেটা স্বাভাবিক। তবে তাঁর কথা অনুযায়ী, এই সমজদারের দল কারা, তা স্পষ্ট করে জানা যায় না। প্রদর্শনীর পরের দিন পুপেকে (রথী ঠাকুরের পালিত কন্যা নন্দিনী দেবী) লিখেছেন– ‘বাবাকে বোলো কাল এখানে আমার ছবি দেখানো হল– লোকে খুসি হয়েচে– সে অনেক কথা– লিখতে গেলে অনেকক্ষণ লাগবে– আন্দ্রে খুব বড়ো করে লিখবে বলেছে’। আন্দ্রের লেখার মুদ্রিত চেহারা আমাদের চোখে পড়েনি। এমনকী, প্যারিসের কাগজের রিভিউয়ের ক্লিপিং রবীন্দ্রভবনের ফাইলে সেভাবে পাওয়া যায় না। প্যারিস প্রদর্শনীর খবর প্রসঙ্গে একমাত্র রবীন্দ্রভবন লাইব্রেরির ‘ফরেন কমেন্টস’ অংশে আঁরি বিদুর লেখায় পাওয়া যায়। যা কি না পরে ১৯৪১ সালে প্রকাশিত ‘Visva Bharati Quartarly’-র মে-অক্টোবর (রবীন্দ্র জন্মদিন) সংখ্যায় মুদ্রিত হয়েছে।
তাই রবীন্দ্রনাথ যখন মীরা দেবীকে বলেন, ‘লোকের এত ভালো লেগেচে যে আমি বিস্মিত’ বা কবি সুধীন দত্তকে লেখেন– ‘প্যারিসে আমার চিত্রকীর্তি স্বদেশে শ্রুতকীর্তিরূপে হয়ত এতদিনে পৌঁছেছে’ অথবা ইন্দিরা দেবীকে চিঠিতে জানান– ‘ফ্রান্সের মত কড়া হাকিমের দরবারেও শিরোপা মিলেচে– কিছুমাত্র কার্পণ্য করেনি’– তখন প্রশ্ন জাগে, এই ‘কড়া হাকিমের দরবার’ বলতে কাদের বোঝাচ্ছেন রবি ঠাকুর? তবে কয়েকজনের নাম আমরা তাঁর চিঠিতেই জানতে পারি। যেমন– ‘সার মাইকেল স্যাডলার ছবি সম্বন্ধে সমজদার বলে খ্যাত, তাই তাঁকে আমার ছবি দেখতে ডেকেছিলুম, Muirhead Boneও ছিলেন। ওঁদের খুব ভালো লেগেছে’। এ চিঠি পুত্র রথীকে লেখা। সেখানেই রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, ‘বারমিংহ্যাম পিকচার গ্যালারিতে ওরা একজিবিশন করতে চেয়েচে। ওদিকে রোটেনস্টাইন লিখেচেন লন্ডনে একজিবিশনের ব্যবস্থা হচ্ছে’। ক’দিন পরেই অবনকে লিখেছেন, ‘‘…পোলজাতীয় একজন ভালো আর্টিস্ট… তাকে… ছবিগুলো দেখাতেই সে একেবারে আশ্চর্য হয়ে গেল। তার স্ত্রীকে বললে, আমি তো ত্রিশ বৎসর এই কাজ করে আসছি, ইনি দু’বছরে যা করেছেন আমি করতে পারলে খুসি হতুম।’’ পাশাপাশি সেই চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘প্যারিসে… সেখানকার সমজদারদের দেখানো গেল। তাদের একজন আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললে, …আজ সত্যি বোঝা গেল তুমি কত great. কেউ কেউ বললে এসব ছবি আমাদের আর্টিস্টদের পক্ষে এডুকেশন’।
আমরা রবীন্দ্রনাথের লেখা থেকে জানতে পারি না, এই শিল্প ‘সমজদার’ বলতে তিনি কাদের বোঝাতে চেয়েছেন এবং ‘আমাদের আর্টিস্ট’ বলতেই বা কাদের কথা বলছেন তিনি। পুত্র রথী ঠাকুর সেই সময় কাছে ছিলেন না, ফলে রথীন্দ্রনাথের ডায়েরিতে এ খবর পাওয়া যায় না।
তবে কয়েকজন প্রথিতযশা শিল্পী রবি ঠাকুরের কাজ দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন, সে আমরা জেনেছি। তাঁদের একজন আমাদের দেশের অন্যতম সেরা শিল্পী অমৃতা শেরগিল। রবীন্দ্রনাথের প্যারিস একজিবিশনের সময় তিনিও প্যারিসেই ছিলেন। বছর সতেরোর অমৃতা রবি ঠাকুরের ছবি দেখে মুগ্ধ চমৎকৃত হয়ে উঠেছিলেন। অমৃতার ছবিতে মেয়েদের মুখমণ্ডলে যে গভীর বিষণ্ণ অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে, তার অঙ্কুর কি রোপিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের নারীমুখের চিত্রমালায়? লম্বাটে গড়নের যেসব মেয়েরা অমৃতার ক্যানভাসে ছেয়ে থাকে, তারা আদতে রবীন্দ্রনাথের ছবির ছায়ায় ফুটে উঠেছে– এ প্রশ্ন আমাদের মনে কখনও উঁকি দেয় বইকি!
আমরা জানি, গঁগ্যার ছবি থেকে অমৃতা প্রাণিত হয়েছিলেন। তবে সেখানে রবি ঠাকুরের বিষণ্ণবিধুর মেয়েরা কি কোনওভাবেই উঠে আসেনি? রবীন্দ্রনাথ সেই প্রায় কিশোরী অমৃতার প্রসঙ্গে অবহিত ছিলেন না– যিনি কি না পরবর্তীকালে ভারতের অন্যতম সেরা শিল্পী হয়ে উঠবেন। তবে প্যারিসের পরে জার্মানির প্রদর্শনীতে এক বিখ্যাত শিল্পী রবীন্দ্রনাথের ছবি দেখে চমকে উঠেছিলেন, তিনি ক্যাথে কোলভিতৎস। কন্যা মীরাকে লেখা চিঠিতে পাই সে খবর। লিখছেন, ‘এখানে (বার্লিন) আসর খুব জমেচে।… ছবিগুলোরও কপাল ভাল বলেই মনে হচ্চে। এখানকার খুব বিখ্যাত মেয়ে আর্টিস্ট Kathe Kollwitz খুবই বিস্মিত হয়েছেন। গ্যালারি-ওয়ালারা বলচে, একেবারে আশাতীত’।
এখানে মনে রাখা দরকার, রবীন্দ্রচিত্রকলার মূল অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছিল জার্মান এক্সপ্রেশনিস্ট আর্ট। আর ক্যাথের অজস্র ছবিতে যুদ্ধে মৃত সন্তানের জন্যে অসহায় মায়ের আর্তি দুমড়ে-মুচড়ে দেখা দিয়েছে। আজীবন মৃত্যুমিছিলে চলা রবীন্দ্রনাথের ছবি তাঁকে টানবে, এ তো স্বাভাবিক। আমাদের মনে হয়, প্যারিসের শিল্পীদের উন্নাসিকতার পাশে ক্যাথের মতো চিত্রকররা রবীন্দ্রনাথের ছবির বিষাদকে ছুঁতে পেরেছিলেন অনেক সহজে।
(চলবে)
…পড়ুন ছবিঠাকুর-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৩: আত্মপ্রতিকৃতির মধ্য দিয়ে নতুন করে জন্ম নিচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ
পর্ব ১২: আমেরিকায় কে এগিয়ে ছিলেন? ছবিঠাকুর না কবিঠাকুর?
পর্ব ১১: নন্দলাল ভেবেছিলেন, হাত-পায়ের দুয়েকটা ড্রয়িং এঁকে দিলে গুরুদেবের হয়তো সুবিধে হবে
পর্ব ১০: ১০টি নগ্ন পুরুষ স্থান পেয়েছিল রবীন্দ্র-ক্যানভাসে
পর্ব ৯: নিরাবরণ নারী অবয়ব আঁকায় রবিঠাকুরের সংকোচ ছিল না
পর্ব ৮: ওকাম্পোর উদ্যোগে প্যারিসে আর্টিস্ট হিসেবে নিজেকে যাচাই করেছিলেন রবি ঠাকুর
পর্ব ৭: শেষ পর্যন্ত কি মনের মতো স্টুডিও গড়ে তুলতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ?
পর্ব ৬: রবীন্দ্র চিত্রকলার নেপথ্য কারিগর কি রানী চন্দ?
পর্ব ৫: ছবি আঁকার প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ পরলোকগত প্রিয়জনদের মতামত চেয়েছেন
পর্ব ৪: প্রথম ছবি পত্রিকায় প্রকাশ পাওয়ামাত্র শুরু হয়েছিল বিদ্রুপ
পর্ব ৩: ঠাকুরবাড়ির ‘হেঁয়ালি খাতা’য় রয়েছে রবিঠাকুরের প্রথম দিকের ছবির সম্ভাব্য হদিশ
পর্ব ২: রবীন্দ্রনাথের আঁকা প্রথম ছবিটি আমরা কি পেয়েছি?
পর্ব ১: অতি সাধারণ কাগজ আর লেখার কলমের ধাক্কাধাক্কিতে গড়ে উঠতে লাগল রবিঠাকুরের ছবি