৭০০ বছর আগে লেখা বিজয়গুপ্ত-র ‘মনসামঙ্গল’-এ বিভিন্ন আমিষ আর নিরামিষ পদের বর্ণনার সঙ্গে ‘কটু তৈল’-তে (সরষের তেল) মাছ ভাজার উল্লেখ থেকে বোঝা যায় বাঙালির নোলা আজকের মতো সে সময়েও সকসক করত। অন্যদিকে, তেলেভাজা জগতের আরেক সুপারস্টার– পরোটা কিন্তু ভারতে ঢুকেছে অনেক পরে– মাত্র সাড়ে ৪০০ বছর আগে।
তেলেভাজার সঙ্গে ভারতবাসীর সম্বন্ধ সেই আদ্যিকাল থেকে। তেলেভাজা বলতে আলুর চপ, বেগুনি, ফুলুরি, বোণ্ডা, পাকৌরি শুধু নয়– যে কোনও ভাজা খাবারের প্রতি এদেশের মানুষের সম্পর্ক সেই আবহমানকাল থেকে– সে তেলেই হোক বা ঘি-তে। ঋগ্বেদে ‘ধানা ঘৃতস্নবঃ’-র উল্লেখ পাই, মানে সেই সময়েও মানুষ ঘি-তে চাল ভেজে খাচ্ছে। তবে উত্তর ভারতের মানুষ যেমন ভাজার জন্য ঘি-র ওপর নির্ভরশীল থেকেছে দীর্ঘকাল ধরে, বাঙালির ভাজা খাবারের জন্য ঘিয়ের ওপর শুধু নির্ভর করে বসে থাকেনি। তার কারণ হয়তো বাঙালির সঙ্গে মাছের আত্মীক সম্পর্ক আর বাঙালির জিভ– যার দোষে সব বাঙালি আলতো-বেলি। ইউরোপের মতো করে বাঙালি কোনও দিনই মাছ সেদ্ধ করে বা আগুনে ঝলসে নুন ঘষে খায়নি, আর ঘি-তে মাছ ভাজলে রান্নার বর্ণে-গন্ধে-ছন্দে হৃদয়ে দোলাটা ঠিকঠাক লাগে না– সেটার জন্য এমন তেল লাগবে, যাতে মাছের চরিত্রহানি হবে না। বাঙালি তাই ধানচাষে থেমে না গিয়ে তিল বা সরষে চাষ করেছে, পিষে তেল বের করে তাতে মাছ ভেজেছে আর খেয়ে এসেছে হাজার বছর ধরে। ৭০০ বছর আগে লেখা বিজয়গুপ্ত-র ‘মনসামঙ্গল’-এ বিভিন্ন আমিষ আর নিরামিষ পদের বর্ণনার সঙ্গে ‘কটু তৈল’-তে (সরষের তেল) মাছ ভাজার উল্লেখ থেকে বোঝা যায়, বাঙালির নোলা আজকের মতো সে সময়েও সকসক করত।
আরও পড়ুন: পাড়ার মোড়ের দোকানের চপ-তেলেভাজা হচ্ছে টিভি সিরিয়াল
শুধু কি মাছ ভাজা? যে কচুরি নিয়ে বিভিন্ন রাজ্য আলাদা আলাদা করে কেরামতি দেখিয়ে চলেছে, সেই কচুরি আদতে এক বিশুদ্ধ বঙ্গীয় খাবার। সুশ্রুতের ভেষজ শাস্ত্রের ওপর হাজার বছর আগে যিনি প্রথম ভাষ্য লিখেছিলেন, সেই চক্রপাণিদত্ত ছিলেন বীরভূমের ময়ুরেশ্বরের বাসিন্দা। তাঁর লেখায় কচুরি আর ডালপুরির উল্লেখ রয়েছে। কচুরি (সংস্কৃতে ‘পূরিকা’) উল্লেখ রয়েছে মাষকলাই বেটে তার সঙ্গে নুন, আটা আর হিং মিশিয়ে ময়দার লেচিতে পুর দিয়ে বেলে ঘি-তে ভেজে পূরিকা বানানোর বর্ণনা। চক্রপাণিদত্ত শুধু রেসিপি বলে ক্ষান্ত হননি, এর সঙ্গে ‘পূরিকা’-র গুণাবলিও বর্ণনা করেছেন– ‘মুখরোচক, মধুর রস, গুরু, স্নিগ্ধ, বলকারক, রক্তপিত্তের দূষক, পাকে উষ্ণ বায়ুনাশক ও চক্ষুর তেজহারক’ বলে গুণগান গেয়েছেন কচুরির। বাংলার হেঁশেলের যৌথপরিবারে ঘি আর তেল দু’জনে আলাদা আলাদা ভাবে রসিয়ে চলেছে।
তেলেভাজা জগতের আরেক সুপারস্টার– পরোটা কিন্তু ভারতে ঢুকেছে অনেক পরে– মাত্র সাড়ে ৪০০ বছর আগে। আগুনে সেকা তন্দুরি রুটি মোঘলদের হাত ধরে ঢুকে এদেশে নিজের জায়গা বানাতে গিয়ে দেখেছিল, ভারতবাসীদের ঘি আর তেলেভাজা পুরি আর কচুরির কামাল। মোঘল বাবুর্চিরা আটার লেচি বেলার সময় পরতে পরতে ঘি দিয়ে এক বিশেষ রুটি বানিয়ে, সেটা তাওয়াতে অল্প ঘি ছড়িয়ে সেকে নিয়ে এক মোক্ষম খাবার বানাল– আর পরতে পরতে ঘি দেওয়ার জন্য নাম দিল পরোটা। আর তাদের কারিগররা একেকজন রন্ধনশিল্পী। তাদের শিল্পনৈপুণ্যে বাংলাদেশে বাখরখানি তৈরি হল, আর সেই বাখরখানির ওপরে আরও কাজ করে অউধের রসুইখানা থেকে তৈরি হল শীরমল। মোঘল সাম্রাজ্য ১৮৫৮ সালে অস্ত গেল, কিন্তু তাদের বাবুর্চিদের তৈরি পরোটা শুধু থেকেই গেল না– খানদানি মুসলিম রসুইখানা থেকে বেরিয়ে এসে ঢুকে পড়ল জাত-ধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেকের রান্নাঘরে, আর সেখান থেকে রাস্তায় ঘাটে সমস্ত পেটপুজোর মন্দিরে। যে পরোটা প্রথম যুগে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করতেই শুধু দেখা যেত, নিজগুণে সে মুখ্য চরিত্রে বিভিন্ন মঞ্চে উপস্থিত হল– এমনকী, কিছু জায়গায় আগের আমলের নায়ক-নায়িকাদের ‘to be or not to be’ গোছের প্রশ্নের মধ্যে ফেলে দিল।
আরও পড়ুন: হাজার বছর পার করেও বাসি হয়নি শিঙাড়ার যাত্রা
পরোটার চেয়ে বয়সে অনেক বড় তার দুই তুতোভাই নান আর কুলচা তেলেভাজার দলে শামিল হওয়ার দাবি জানায়, কারণ ভাজা না হলেও তন্দুর উনুনে ঢোকানোর আগে আর বের করার পরে তাদের গায়ে ঘিয়ের চাদর চাপিয়ে দেওয়া হয়– কিন্তু তারা হিসেবমতো তেলেভাজার দলে ঢোকে না, স্ট্যান্ড-বাই হিসেবে তেলেভাজার টিমে থাকতে পারে।
এতক্ষণে লেখা পড়তে পড়তে যাঁরা ভাবছেন, ধান ভানতে শিবের গীত কেন, তাদের জন্যে বলি– মুখ্রা ছাড়া কি ক্লাসিকাল হয় রে পাগলা! পিক্চার আভি বাকি হ্যায়।
শহরের অতীত ও ঐতিহ্য নির্মাণের এক বিশেষ মুহূর্ত ছিল বিশ শতকের গোড়ার বছরগুলি। এই সময়ে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটছে, কলকাতা পুরসভায় ভারতীয় প্রতিনিধিদের গলার জোর বাড়ছে, বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে প্রথমবার শহরের রাস্তায় মানুষ মিছিল বের করছেন– ফলে বোঝাই যাচ্ছিল কলকাতার দাবিদার অনেক, শুধু ব্রিটিশ রাজপুরুষদের নয় এ শহর।