ময়মনসিংহে সেই সময় শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়দের বাড়ির দু’দিকে ছিল দুটো জমিদারবাড়ি। একদিকে গোলোকপুরের জমিদার, অন্য পাশে ভবানীপুরের জমিদার বাড়ি। মাঝখানে তাঁদের বাড়ি। বাড়ি বলতে একটা বড়সড় উঠোনকে ঘিরে চারটে টিনের ঘর। ঘরগুলোর নাম ছিল পশ্চিমের ঘর, দক্ষিণের ঘর, পূবের ঘর, আর উত্তরের ঘরখানাকে বলা হত বড় ঘর। মাটির মেঝে। গোটা বাড়িটা বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা। বাইরের দিকে অনেকটা ফাঁকা জমি এবং মাঠ, সেখানে দাদুর কাছারিঘর। অনেক মক্কেল জড়ো হত বলে ঘরখানা ছিল বেজায় বড়। বাড়ির পিছনে ছিল একটা পুষ্করিণী। উঠোনের এক কোণে ছিল পাতকুয়া, আর বাইরের মাঠের ধারে একটা টিউবওয়েল, তার পাশে গোয়ালঘর। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় জন্ম এই বাড়িতেই।
৮.
‘জগদ্ধাত্রী ভাণ্ডার’ নামে কাপড়ের একটি দোকান ছিল মুখোপাধ্যায় পরিবারের ময়মনসিংহ শহরের মেছোবাজার বা মেছুয়া বাজারে। ময়মনসিংহের ‘মৃত্যুঞ্জয় স্কুল’-এ প্রথম শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে ‘দেশভাগ’ হয়। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের জীবন সুস্পষ্ট দুটো ভাগ। দেশভাগের আগে, আর পরে। যে ভুক্তভোগী নয়, তার বোঝার সাধ্যই নেই যে, পিতৃপুরুষের ভিটে ছেড়ে যাওয়ার বিষাদ কত গভীর হতে পারে।
প্রথম পড়ি ‘দূরবীন’ এরপর ‘মানবজমিন’, ‘ঘুণপোকা’, ‘পার্থিব’, ‘পারাপার’, ‘উজান’, ‘যাও পাখি’– শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাসের ব্লার্বে লেখা আছে তাঁর জন্ম ময়মনসিংহ, তাঁর দেশ ঢাকা জেলার বিক্রমপুর। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের শৈশব-কৈশোরকালের উন্মোচন ‘উজান’ উপন্যাসে। আর ‘দূরবীন’ উপন্যাসটিতে শৈশবের স্বপ্নের শহর ময়মনসিংহের পটভূমি আছে, আছেন তাঁর দাদু, কয়েকজন আত্মীয়, চেনা মানুষ এবং তৎকালীন প্রতিবেশী জমিদারদের বাড়ির কিছু অনুষঙ্গও এসেছে। আর আছে পাবনাস্থিত এক আশ্রমের কতিপয় ঘটনা।
পদ্মার কন্যা ‘রজতরেখা নদী’র পাড়ে পুবের বাজারে বাস থামল। গন্তব্য সুখিগঞ্জ মহকুমার বাইনখাড়া বা বানিখাড়া গ্রামের পণ্ডিত বাড়ি। বর্তমান ঠিকানা– জেলা মুন্সিগঞ্জ, থানা টঙ্গিবাড়ি, কামারখাড়া ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের বাইনখাড়া গ্রাম।
পুবের বাজার থেকে সোজা পশ্চিমে গেলে টঙ্গিবাড়ি বাজার। ডানে নশংকর গ্রামের পথ ধরে চলার শুরুতেই চোখ আটকে যায় পাকা একতলা-দোতলা ফাঁকা বাড়ি-ঘর ও নির্জনতায় দাঁড়িয়ে থাকা সুউচ্চ মঠের দিকে। এইসব ফাঁকা বাড়িঘর দেশভাগের ক্ষতচিহ্ন হিসেবে সাক্ষ্য দেয়। নশংকর গ্রামের পর স্বর্ণগ্রাম পোস্ট অফিস, তার পাশে কামারখাড়া জমিদার বাড়ির বড় দিঘী। আর কিছুটা পথ হাঁটার পর কামারখাড়া ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে খোঁজ করলাম বাইনখাড়া পণ্ডিত বাড়ির। ইউনিয়ন পরিষদ অফিস থেকে দু’জন চৌকিদার বা গ্রাম পুলিশের সহযোগিতায় পরিচিত মাটির পথে সহজেই খুঁজে পেলাম শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ভিটাবাড়ি।
এখন যতটা সহজে অল্প সময়ে ঢাকা থেকে বাসে পুবের বাজার এসে নামলাম। আগে আসার পথ বলতে একমাত্র নৌপথ। ঢাকা থেকে স্টিমারে নারায়ণগঞ্জ হয়ে মুন্সিগঞ্জের ‘বহর স্টিমার ঘাট’ অথবা ‘রাজাবাড়ি স্টিমার ঘাট’ নেমে নৌকায় বাইনখাড়া গ্রামে আসতে হত।
বানভাসি এই অঞ্চল বছরের ছ’মাস জলের তলায় থাকে। বর্ষাকালে এ-ঘর থেকে ও-ঘর যেতে নৌকা লাগে। এখনও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বাড়িতে যেতে বাঁশের সাঁকো লাগল। চারিধার বনের মতো শান্ত। ভিটায় নতুন টিনের ঘর। পাশে ছোট পুকুর পাড়ে একপায়ে একটি তালগাছ দাঁড়িয়ে আছে। উঠোন ঘাসে পূর্ণ। চারপাশ জল, হিজল ও জঙ্গলাকীর্ণ। কোনও সাড়াশব্দ নেই। দূরের একটি বাড়ি থেকে দুপুরের রন্ধনের ধূম এসে নাকে লাগল।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের দাদু রাজকুমার মুখোপাধ্যায় মোক্তারি পাশ ছিলেন। মোক্তারির পসার জমানোর জন্য বিক্রমপুর থেকে চলে যান মহুয়া-মলুয়ার দেশ ময়মনসিংহ। সেই সময়ে ময়মনসিংহ কোর্টে প্রচুর ফৌজদারি মামলা হত। মুক্তাগাছার জমিদার বীরভদ্র বাবুর আগ্রহ ও সহযোগিতায় ময়মনসিংহ গিয়ে বসবাস শুরু করেন রাজকুমার মুখোপাধ্যায়। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বড় হয়েছেন মুড়ির মোয়ার মতো আটবাঁধা একটা যৌথ পরিবারে। দাদু ছিলেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। এরপরই মা গায়ত্রী মুখোপাধ্যায়। আর ব্রহ্মপুত্র নদী। ব্রহ্মপুত্রের ধারে কালীবাড়ি রোডে ছিল তাঁদের বাড়ি। যে বাড়ির অস্তিত্ব এখন নেই কিন্তু কালীবাড়ি রোড এখনও আছে। ‘দূরবীন’ উপন্যাসের অনেকটা জায়গা জুড়ে আছে শীর্ষেন্দুর শৈশবের দেখা ময়মনসিংহের জমিদার, কালীবাড়ি ও ব্রহ্মপুত্র।
ময়মনসিংহে সেই সময় শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়দের বাড়ির দু’দিকে ছিল দুটো জমিদারবাড়ি। একদিকে গোলোকপুরের জমিদার, অন্য পাশে ভবানীপুরের জমিদার বাড়ি। মাঝখানে তাঁদের বাড়ি। বাড়ি বলতে একটা বড়সড় উঠোনকে ঘিরে চারটে টিনের ঘর। ঘরগুলোর নাম ছিল পশ্চিমের ঘর, দক্ষিণের ঘর, পূবের ঘর, আর উত্তরের ঘরখানাকে বলা হত বড় ঘর। মাটির মেঝে। গোটা বাড়িটা বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা। বাইরের দিকে অনেকটা ফাঁকা জমি এবং মাঠ, সেখানে দাদুর কাছারিঘর। অনেক মক্কেল জড়ো হত বলে ঘরখানা ছিল বেজায় বড়। বাড়ির পিছনে ছিল একটা পুষ্করিণী। উঠোনের এক কোণে ছিল পাতকুয়া, আর বাইরের মাঠের ধারে একটা টিউবওয়েল, তার পাশে গোয়ালঘর। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় জন্ম এই বাড়িতেই। সাঁতার শিখেছেন ব্রহ্মপুত্র নদীতে। ব্রহ্মপুত্র তাঁর জন্মের চেনা নদী। ব্রহ্মপুত্রের স্রোত এখনও শীর্ষেন্দুর বুকের ভেতরে বয়ে চলে, বাঁক নেয়।
… দ্যাশের বাড়ি-র অন্যান্য পর্ব …
পর্ব ৭: হাতে লেখা বা ছাপা ‘প্রগতি’র ঠিকানাই ছিল বুদ্ধদেব বসুর পুরানা পল্টনের বাড়ি
পর্ব ৬ : জীবনের কালি-কলম-তুলিতে জিন্দাবাহারের পোর্ট্রেট এঁকেছিলেন পরিতোষ সেন
পর্ব ৫ : কলাতিয়ার প্রবীণরা এখনও নবেন্দু ঘোষকে ‘উকিল বাড়ির মুকুল’ হিসেবেই চেনেন
পর্ব ৪ : পুকুর আর বাঁধানো ঘাটই প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের দেশের বাড়ির একমাত্র অবশিষ্ট স্মৃতিচিহ্ন
পর্ব ৩ : ‘আরতি দাস’কে দেশভাগ নাম দিয়েছিল ‘মিস শেফালি’
পর্ব ২: সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় শৈশবের স্মৃতির নন্দা দিঘি চিরতরে হারিয়ে গেছে হাজীগঞ্জ থেকে
পর্ব ১: যোগেন চৌধুরীর প্রথম দিকের ছবিতে যে মাছ-গাছ-মুখ– তা বাংলাদেশের ভিটেমাটির