Robbar

সিনেমা হলে সন্ত্রাস ও জনগণমন-র দলিল

Published by: Robbar Digital
  • Posted:February 15, 2024 5:13 pm
  • Updated:February 15, 2024 8:32 pm  

ঠান্ডা যুদ্ধ শেষের পশ্চিমি উদারনীতিবাদকে শিখণ্ডী খাড়া করে ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা বলেছিলেন, ইতিহাসের যাত্রাপথ এবার বুঝি শেষ। সেই ইতিহাসহীন ঔদার্যর কাল থেকে যদি আমরা একটু পিছনদিকে হাঁটি, যখন ওটিটি কোন ছার, ভিসিডি-ডিভিডি দূরস্থান, টরেন্ট ও ডাউনলোড প্রায় ভিনগ্রহী শব্দ, এমনকী, ঘরে ঘরে টেলিভিশন নামক খানিক স্থূল চারচৌকো আয়তাকার বস্তুও কিছুটা নীরব আত্মীয়র মতো ঢুকে পড়েনি, তখন জনপ্রিয় সিনেমার হিসেবনিকেশ হয়েছে সিনেমা হলেই। আজ কলকাতা জুড়ে যে যে হল প্রায় দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না বা যাদের নটে গাছসুলভ অস্তিত্ব রূপকথাটি ফুরতেই বিলীন হয়েছে, তার আলোআঁধারেই নির্মিত হয়েছে সিনেমা নামক গণস্মৃতির দলিল। শুরু হল প্রিয়ক মিত্র-র নতুন কলাম ‘জনতা সিনেমাহল’। আজ প্রথম পর্ব।

প্রিয়ক মিত্র

এমনই বছর শুরুর শীত। কলকাতায় সে বড় সুখের সময় নয়, বড় আনন্দের সময় নয়। থমথমে চাপা, দমবন্ধ সন্ত্রাস-বদলার আবহে খান্না সিনেমায় তখন চলছে ‘প্রেম পূজারী’। দেব আনন্দ পরিচালিত ছবি। দেব আনন্দ নায়ক, নায়িকা ওয়াহিদা রহমান। ‘ফুলো কি রং সে/ দিলকি কলাম সে/ তুঝকো লিখি রোজ পাতি…’, কিশোর কুমারের গলা। ট্রেনের মধ‍্যে দেব আনন্দের সেই দৃশ্য। আবার লতা মঙ্গেশকরের গলায় ‘রঙ্গিলা রে, তেরে রং মে…’, সেই মদের গেলাসের র‌ংচঙে জেল্লা, সঙ্গে ওয়াহিদার বেসামাল নাচ। আবার লতা-কিশোরের ডুয়েট কণ্ঠে ‘সখিয়োঁ মে ঘোলা যায়ে…’, খড়ের গাদার পাশে বার্ড ক‍্যাচার কাঁধে, পরিচিত টুপিতে দেব আনন্দ, আর লাল পোশাকে ওয়াহিদা আখ কামড়াচ্ছেন‌। এসবের মাঝেই ভারত-চিন যুদ্ধ ছিল বটে, তবে প্রেম আর গানের দাপটে তা চাপাই পড়ে ছিল। সেই ছাইচাপা আগুনেই হঠাৎ ধক করে জ্বলে উঠল খান্না সিনেমার বড় পর্দা। জ্বলে খাক হয়ে গেল সেলুলয়েডে রঙিন হয়ে ওঠা দেব আনন্দ-ওয়াহিদার প্রেম। ওই যুদ্ধের অ‌ংশে চিন-বিরোধিতার আভাস ছিল কোথাও‌। উত্তর কলকাতার এই অধুনায় প্রায়-লুপ্ত সিনেমা হলের একটি ম‍্যাটিনি শো-এ তারই প্রতিরোধ জ্ঞাপিত হয়েছিল সোচ্চারে।

Prem Pujari Movie: Review | Release Date (1970) | Songs | Music | Images | Official Trailers | Videos | Photos | News - Bollywood Hungama
দেব আনন্দ-ওয়াহিদা রহমান অভিনীত ‘প্রেম পূজারী’

চেনা মুখে শোনা, ওই সময় পাড়ায় পাড়ায় গুপ্ত নকশাল পার্টি ক্লাসে বুধবার রাত আটটায় শুরু হত উসখুস। ‘বিনাকা গীতমালা’ শুরু হত ঠিক ওই সময়ই। তাই হয়তো লেনবেয়াওয়ের তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা যখনই গভীর হচ্ছে, চারু মজুমদারের গোপন ইস্তেহার যখন পড়ে শোনানো হচ্ছে, তখনই হয়তো ‘আয়ে দিন বাহার কে’-র ‘শুনো সজনা পাপিহে নে কাহা সবসে পুকারকে’ বেজে উঠছে প্রতিবেশী ঘরে। একটু একটু ক‍রে বিপ্লবী মন আনমনা হচ্ছে এইসব গানের ছোঁয়া লেগে। আবার সেই মনেরই একাংশে হয়তো জ্বালা ধরিয়েছে ‘প্রেম পূজারী’-র ‘প্রতিক্রিয়াশীলতা’, যেখানে প্রলেপ দিতে পারেনি শচীন দেব বর্মণের অমন কালজয়ী সুরও। আড়ে-বহরে যে ছবির মধ্যে কোথাও সমকালীন রাজনীতির ছোঁয়াচটুকু ছিল না, তা রাজনৈতিকভাবে গনগনে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছিল অন্তত সেদিন, খান্না সিনেমায়। দেশজুড়ে ‘প্রেম পূজারী’ নিয়ে সেই উতরোল ছিল না, যা এই স্থানিক স্তরে জেগে উঠেছিল হঠাৎ। এই একটি নাশকতা এই বিশেষ ছবিটিকে উত্তর কলকাতায় যে আলোড়ন দিল, তা হয়তো তখন দেশের অন‍্যত্র পৌঁছয়ওনি‌।

Aaye Din Bahar Ke (1966) - IMDb
ধর্মেন্দ্র-আশা পারেখ অভিনীত ‘আয়ে দিন বাহার কে’

জনপ্রিয় ছবি, বা পপুলার সিনেমা বলতে আমরা তাত্ত্বিকভাবে কী বুঝব, তার ছানবিনে যাওয়ার আগে তাই গল্পকথা, অর্থাৎ জনশ্রুতি ও ক্ষেত্রবিশেষে নথি মারফত চালান হওয়া ইতিহাসেই মন দিতে হয়। আর সেসব ইস্তেহার গোপন ইতিহাসের মতো চালান হয়েছে সিঙ্গল স্ক্রিনের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে। এপিসি রোড ধরে হাঁটতে গেলে যেখানে এখন প্রায় কালচে পোড়ো বাড়িটা চোখে পড়বে, বিধান সরণিতে যেখানে এখন আধুনিক বাজার, পাশে প্রায় ধ্বংসস্তূপ, সেসব জায়গায় কোথাও ‘খান্না’, কোথাও ‘মিত্রা’, কোথাও ‘দ‍র্পণা’ ছিল। ‘রূপবাণী’ নামটা যদি কোনও স্মৃতিকাতরের খানিক চোখে পড়েও যায়, তাহলেও তার কি মনে পড়বে, এই তল্লাটের প্রায় একা কুম্ভ সিঙ্গল স্ক্রিন ‘স্টার থিয়েটার’-এর পাশে একসময় জৌলুস উপচে পড়ত? দেখতে পাবে সে মানসচক্ষেও, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এর মতো, জীবন্ত সেই সিনেমা দেখার ইতিহাসকে? টিমটিম করে জ্বলা ‘মিনার’, দক্ষিণে পরিত‍্যক্ত বৃদ্ধের মতো ‘ইন্দিরা’, ‘বিজলী’-দের পাশে ভূতের মতো ফিসফাসে কি বায়বীয় হয়ে ঘোরে ‘ছবিঘর’-এর আত্মারা?

সিনেমা পাড়া' হাতিবাগান
‘মিত্রা’ সিনেমাহল

না, সিঙ্গল স্ক্রিনের মৃত‍্যু ঘোষণা এখনও সম্পূর্ণ হয়নি, তবে ইতিহাসের তো হয়েছে। তত্ত্ব-নিরিখে অন্তত। ঠান্ডা যুদ্ধ শেষের পশ্চিমি উদারনীতিবাদকে শিখণ্ডী খাড়া করে ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা বলেছিলেন, ইতিহাসের যাত্রাপথ এবার বুঝি শেষ। সেই ইতিহাসহীন ঔদার্যর কাল থেকে যদি আমরা একটু পিছনদিকে হাঁটি, যখন ওটিটি কোন ছাড়, ভিসিডি-ডিভিডি দূরস্থান, টরেন্ট ও ডাউনলোড প্রায় ভিনগ্রহী শব্দ, এমনকী, ঘরে ঘরে টেলিভিশন নামক খানিক স্থূল চারচৌকো আয়তাকার বস্তুও কিছুটা নীরব আত্মীয়র মতো ঢুকে পড়েনি, তখন জনপ্রিয় সিনেমার হিসেবনিকেশ হয়েছে সিনেমা হলেই। আজ কলকাতা জুড়ে যে যে হল প্রায় দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না বা যাদের নটে গাছসুলভ অস্তিত্ব রূপকথাটি ফুরতেই বিলীন হয়েছে, তার আলো-আঁধারেই নির্মিত হয়েছে সিনেমা নামক গণস্মৃতির দলিল। যে দলিলের রক্তমাংস কেবল তথ‍্যে, তত্ত্বে ভরেনি, যার মর্ম তৈরি করেছে কল্প-ইতিহাস, কথনের আড়ালে লুকনো আখ‍্যানের কুমিরডাঙা খেলা।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

রিচার্ড ডায়ার হলিউডের মিউজিক্যালকে দেখতে চেয়েছিলেন এমন এক অবধারিত ইউটোপিয়া হিসেবে, যা বাস্তব থেকে মুখ ফেরাতে চাওয়া জনসমষ্টিকে সহজেই সাহায্য করে। এই একই কথা উত্তমকুমারকে নিয়েও সূর্য বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় প্রমুখদের লেখায় উচ্চারিত। দেশভাগধ্বস্ত কলোনিমুখর বাঙালি ওই নাতিদীর্ঘ রোমান্টিক বটতলার ছায়া তো পেয়েছেন, আন্ডারগ্রাউন্ড বটতলা তা ছিল না কোনওকালেই। যে যুগে ডেয়ারডেভিল গোয়েন্দা দেবেন্দ্রবিজয়রা কলকাতা ছাড়লেই পেয়ে যায় পাহাড় ও ঝরনার নিসর্গ, বা আরও কিছু পরে সাহেবি কোটপ‍্যান্ট পরা দীপক চ‍্যাটার্জী সঙ্গী রতনলালকে নিয়ে জাহাজে চড়ে রওনা দেয় বার্মা প্রদেশে, সে যুগে বাঙালির সে অর্থে সুপারম‍্যান‍রা খুব খোলামেলা জনরুচির উপভোগ্য ছিলেন না। তখন তাই প্রয়োজন ছিল প্রেমের সদর্প উপস্থিতি।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

এবার একটু প্রস্তাবনাটা খোলসা করা যাক। ফরাসি চিন্তকরা ‘ফিল্ম’ ও ‘সিনেমা’– এই দুই শব্দের ব‍্যাপ্তির যে মেরুকরণ তৈরি করছিলেন, মার্কিন ইংরেজির ‘মুভিজ’ তাকে বাঁধল অর্থনীতির গণ্ডিতে। অর্থাৎ, মুভি হল গিয়ে একটি ভোগ‍্যবস্তু। ফিল্ম সেখানে সামাজিক, ও সিনেমা নন্দনতাত্ত্বিক ব‍্যঞ্জনা বহন করছে দৃশ্য-যোগাযোগের। জেমস মোনাকো এই মোদ্দা বিষয়টার প্রবণতা বা ঝোঁককে বললেন ‘বিস্ফোরক’, কারণ, তা সহজেই বহু মানুষের সঙ্গে তৈরি করছে সংলাপের সেতু। একই সঙ্গে মোনাকো এই দৃশ‍্যমাধ‍্যমের উৎস সন্ধানে গেলেন সাংবাদিকতার গোড়ায়। অবশ্য ‘জার্নালিজম’ শব্দটাই এক্ষেত্রে বেশি ব‍্যবহারযোগ‍্য, কারণ মোনাকো রেকর্ড বা নথি রাখার কথা বলছেন। তাই জনপ্রিয় ছায়াছবিকে সেইসব ইতিহাস ও নথির আধার হিসেবে দেখাই হবে এইসব মুসাবিদার মূল মকসদ।

‘এলিট’ সিনেমাহল

রিচার্ড ডায়ার হলিউডের মিউজিক্যালকে দেখতে চেয়েছিলেন এমন এক অবধারিত ইউটোপিয়া হিসেবে, যা বাস্তব থেকে মুখ ফেরাতে চাওয়া জনসমষ্টিকে সহজেই সাহায্য করে। এই একই কথা উত্তমকুমারকে নিয়েও সূর্য বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় প্রমুখদের লেখায় উচ্চারিত। দেশভাগধ্বস্ত কলোনিমুখর বাঙালি ওই নাতিদীর্ঘ রোমান্টিক বটতলার ছায়া তো পেয়েছেন, আন্ডারগ্রাউন্ড বটতলা তা ছিল না কোনওকালেই। যে যুগে ডেয়ারডেভিল গোয়েন্দা দেবেন্দ্রবিজয়রা কলকাতা ছাড়লেই পেয়ে যায় পাহাড় ও ঝরনার নিসর্গ, বা আরও কিছু পরে সাহেবি কোটপ‍্যান্ট পরা দীপক চ‍্যাটার্জী সঙ্গী রতনলালকে নিয়ে জাহাজে চড়ে রওনা দেয় বার্মা প্রদেশে, সে যুগে বাঙালির সে অর্থে সুপারম‍্যান‍রা খুব খোলামেলা জনরুচির উপভোগ্য ছিলেন না। তখন তাই প্রয়োজন ছিল প্রেমের সদর্প উপস্থিতি। আর সেই প্রেমকে পুঁজি করে তৈরি হওয়া ‘মহানায়ক’ সত্তাকেই সূর্য বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় একেবারে আদিম সমাজের ‘মহাযোদ্ধা’-র সঙ্গে তুলনা করলেন। কাজেই সেই সুপারম‍্যান আদতে চিরকালীন ভালোবাসার বাঘও বটে‌, আবার কোনও শ্রেণিবিন‍্যাসের জটিল অঙ্কে তিনি ‘সূর্যতোরণ’-এর রাগী মজুর হয়ে কালিঝুলিও মাখেন। যদিও সেই ছবির শেষে গিয়ে সম্মান ফিরে পাওয়া ভদ্রলোকও হয়ে ওঠেন তিনি। কিন্তু বিশ শতকের স্বাধীনতা-পরবর্তী দেশজ সংকটে বিদীর্ণ বাঙালি গণমনের স্রোত যেখানে ‘ছিন্নমূল’-এর মতো ছবির থেকেও বেশি করে আঁকড়ে ধরছিল ‘সাড়ে চুয়াত্তর’-কে, সেখানে উত্তমকুমার হয়ে উঠতেনই বাঙালির ইউটোপিয়া-র অক্লান্ত সৈনিক।

Shaarey Chuattar (1953) | Dustedoff
‘সাড়ে চুয়াত্তর’ সিনেমার একটি দৃশ্যে উত্তম-সুচিত্রা

কিন্তু উত্তমকুমারকে বাদ দিয়ে হিন্দি ছবি বা স্পষ্ট কথায় বলিউডের নায়কদের বিবর্তনের দিকে তাকালেও কি একই সমীকরণ মিলবে? এই প্রশ্ন যেমন সোজা নয়, তেমন এই ভাবনামোকামও বিশেষ মসৃণ নয় যে, বেলোয়াড়ি বাস্তবতাই কি জনপ্রিয় ছবিতে শেষ কথা বলে গেল? না চিমনির ধোঁয়া আর হরতাল করা মজদুর বা কুলির গল্প, খাদানশ্রমিকের গল্পও হয়ে উঠল উপমহাদেশের সিনেমামনের খোরাক? মনোবিশারদ সুধীর কক্কর ভারতীয়ত্বকে এক সূত্রে গাঁথার বিষয়টাকে নেহাতই কষ্টকল্পিত মনে করেননি, এবং খুব গুরুত্ব না দিয়েও বলিউডের সিনেমা দেখতে একজোট হওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছিলেন। ‘দেয়া নেয়া’-য় যেমন আমরা দেখি, দম্পতির সেজেগুজে নাইট শো-এ সিনেমা দেখতে যাওয়ার একান্ত পরিসরে ঢুকে পড়ে বন্ধুও, কিঞ্চিৎ বিনা আপত্তিতেই, তেমনই এই বিশাল ভূখণ্ডের সমষ্টিগত অচেতনের সাংস্কৃতিক সাঁকো হয়তো বা পাওয়া যাবে জনপ্রিয় সিনেমাতেই, কে বলতে পারে!

(চলবে)