বাবার কথা মেনে আমরা বই করিনি নিজের খরচায়। কিন্তু এ-ও ভাবতে পারিনি, শুভাদা ছিলেন সেই লোক, যে বাবার বই নিয়ে এতটা উৎসাহ দেখাবেন। আমি বাবার ওপর কোনও বই হয়নি বলে তো দিব্যি চলে গিয়েছিলাম মধ্যপ্রদেশে। জানতাম না যে, শুভাদা গোঁ ধরে রেখেছেন। গৌতম ঘোষের ইন্দো-ইটালিয়ান প্রোজেক্টের কাজে আমি তখন বেজায় ব্যস্ত, ফোন করলেন শুভাদা। বাবার নানা খুঁটিনাটি জানতে চাইলেন, চাইলেন কিছু মেটিরিয়ালও। বললাম, ‘আমি তো মধ্যপ্রদেশে। তবে আপনি যা চাইছেন দিতে পারব, ফিরেই দেখা করছি।’
১৯.
শুভাদার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল সম্ভবত নয়ের দশকের শুরুতে। আমেরিকান কনস্যুলেটের কিছু কিছু পার্টিতে দু’জনেরই নেমতন্ন থাকত, যেখানে মাঝে মাঝেই ১৬ এমএম-এ সিনেমা দেখানো হত। সেসময় থেকেই আমি ‘আর্টস একর’-এর নাম শুনতাম। আর্টস একরের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল সুরিন্দর পালের। তিনি আমার বাবা বসন্ত চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ বন্ধুও। সেই সূত্রেই ওই জায়গার কথা উঠে আসত বারবার। বাবার সঙ্গেই ছোট কোনও কাজ বা প্রদর্শনী দেখতে যেতাম সেখানে। পরে আর্টস একর অন্য রূপ নেয়, জায়গাও বদল হয়, চলে আসে নিউটাউনে।
আমার প্রিন্টের একটা বড় এগজিবিশন হয়েছিল বিড়লা অ্যাকাডেমিতে। কিউরেট করেছিলেন তপতী গুহ ঠাকুরতা। সেই নাইনটিনথ সেঞ্চুরি প্রিন্টসের কিছু ডুপ্লিকেট আমি দিয়েছিলাম আর্টস একরকে। একদিন কথায় কথায় জানালেন যে, একটা স্থায়ী ফোটোগ্রাফির গ্যালারি হয়েছে আর্টস একরে। সেখানে রাখবেন বলে আমার দুটো ছবি ওঁর চাই। ভাবতে অবাক লাগে, এই স্থায়ী ফোটোগ্যালারিতে রঘু রাইয়ের ছবিও ঠাঁই পেয়েছে।
আমি সেদিন শুভাদাকে বলেছিলাম, এখানে ভালো ছবি প্রিন্ট করে, এমন কাউকে তো আমি চিনি না। শুভাদা সর্বজয়ের নাম বললেন, আমি গেলাম তাঁর কাছে– কঞ্জিলাটা মোমেন্টো ফোটোগ্রাফি স্টুডিওতে। সর্বজয়কে বুঝিয়ে দিলাম প্রিন্টে আমি ঠিক কতটুকু চাইছি। বিসমিল্লা খাঁ এবং হুসেনের ছবি দুটো প্রিন্ট করিয়েছিলাম।
মাঝে মধ্যে দেখা হয়ে চলেছিল শুভাদার সঙ্গে। আমিও আর্টস একরে যাই, আড্ডা হয়। একদিন শুভাদা বললেন, ‘তোমার বাবা, বসন্ত চৌধুরীর ওপরে কি কোনও বই হয়েছে?’ বললাম, ‘না, ২২ বছর হতে চলল, কেউ তো কিছু করেনি। হয়তো প্রয়োজন হয়নি। অভিযোগ করছি না।’
মনে আছে, বাবা যখন ক্যানসার আক্রান্ত, শেষদিকে, আমাকে একদিন ডেকেছিলেন। বললেন, ‘‘শোনো, আমি মারা গেলে কোনও মিডিয়াকে খবর দিও না। নানা জায়গায় নিয়ে যাবে, হয়তো নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওতে , ১৯৫২ সালে যেখানে আমি প্রথম ছবি করি ‘মহাপ্রস্থানের পথে’, লোকজন জড়ো-টড়ো হবে, এসব আমি চাই না। আমি ভোরবেলায় মারা যাব, দাহ করে দিও গিয়ে। আর শ্রাদ্ধশান্তি করো না।’’ বললাম যে, ‘বেশ, তাই হবে।’ ‘আরেকটা কথা, আমার ওপর যেন কোনও বই করো না।’ এইবার আমি খানিক অবাক হয়েই বললাম, ‘এটা কেন বলছ?’ বাবা বলল, ‘রবি (ঘোষ) তো মারা গেল, অত বড় অভিনেতা, ওর ওপর বইও করল বারীন রায়, কিন্তু কী হল? যথেষ্ট মান পায়নি! তবে আর কেউ করতে চাইলে বই করতে পারে।’
বাবার কথা মেনে আমরা বই করিনি নিজের খরচায়। কিন্তু এ-ও ভাবতে পারিনি, শুভাদা ছিলেন সেই লোক, যে বাবার বই নিয়ে এতটা উৎসাহ দেখাবেন। আমি বাবার ওপর কোনও বই হয়নি– এইটুকু বলে দিব্যি চলে গিয়েছিলাম মধ্যপ্রদেশে। জানতাম না যে, শুভাদা গোঁ ধরে রেখেছেন। গৌতম ঘোষের ইন্দো-ইটালিয়ান প্রোজেক্টের কাজে আমি তখন বেজায় ব্যস্ত সেখানে, ফোন করলেন শুভাদা। বাবার নানা খুঁটিনাটি জানতে চাইলেন, চাইলেন কিছু মেটিরিয়ালও। বললাম, ‘আমি তো মধ্যপ্রদেশে। তবে আপনি যা চাইছেন দিতে পারব, ফিরেই দেখা করছি।’
বাবাকে নিয়ে সে বইতে লিখেছিলেন অনেকে। ছিল ফিল্মোগ্রাফিও। বইয়ের কাজ যখন শেষ হয়ে এসেছে প্রায়, শুভাদা ফোন করলেন একদিন। বললেন, ‘তোমাকে একটা জিনিস চাইব, না করতে পারবে না।’ বললাম, ‘কী, বলুন?’ ‘বসন্তদার বইয়ের প্রচ্ছদটা আমি আঁকব।’ আমার আপত্তি করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না! শুভাপ্রসন্ন, জগদ্বিখ্যাত শিল্পী, তিনি নিজে থেকে প্রচ্ছদ করবেন বলেছেন, এর থেকে ভালো কী-ই বা হতে পারত!
শুভাদা প্রচ্ছদটা এঁকে ফেললেন। এপ্রিল, ২০২৩-এ প্রকাশিত হয় সেই বই আর্টস একরেই। মাধবী মুখোপাধ্যায়, গৌতম ঘোষ, শুভাপ্রসন্ন ছাড়াও অনেকে ছিলেন সেই বই প্রকাশে। দাদা সৃঞ্জয় চৌধুরী চলে এসেছিল সকালের ফ্লাইটে। আমার বাবা, বসন্ত চৌধুরীর মৃত্যুর ২২ বছর পরে, বইটা উদ্যোগ নিয়ে প্রকাশ করেছিলেন শুভাদা।
বইটা প্রকাশিত হওয়ার পর বিখ্যাত ইতিহাসবিদ অশোক দাস আমার থেকে বইয়ের একটা কপি চেয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম, ‘অশোকদা, আপনি যা খুঁজছেন, তা কিন্তু এই বইতে নেই। এ শুধুই বাবার সিনেমার কাজ নিয়ে লেখা।’ অশোক দাস বইটা নেড়েচেড়ে পরে বলেছিলেন, ‘সত্যিই তো তাই! কিন্তু বসন্ত চৌধুরীর একটা বড় জায়গা তিনি হিস্টোরিয়ান ও রিসার্চার। সেসবের কোনও উল্লেখ প্রায় নেই। আমি কি একটা লেখা লিখতে পারি এই অধরা বিষয়টা নিয়ে?’ বলেছিলাম, ‘অবশ্যই!’ পরে, বাবার জন্মদিনে, ৫ মে-তে এক বহুল প্রচারিত পত্রিকায় বসন্ত চৌধুরীকে নিয়ে সেই লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। চেনা গিয়েছিল আরেকরকম বসন্ত চৌধুরীকে।
অনেক দিন পর বাবাকে নিয়ে নতুন করে কথাবার্তা, নানাজনের ফোন, উত্তেজনা। এসবই সম্ভব হয়েছিল শুভাদার জন্য, বইটা না হলে ২২ বছর পর বসন্ত-কাল আবারও ফিরে আসত না।
…পড়ুন ফ্রেমকাহিনি-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৯। মৃণালদার মুদ্রাদোষগুলো আবারও দেখতে পেলাম অঞ্জন দত্তর সৌজন্যে
পর্ব ১৮। ১৭টা রাজ্য ঘুরে ১০৫৫টা পুরনো সিনেমা হলের ছবি তুলেছে হেমন্ত
পর্ব ১৭। এক বাঙালি বাড়ি আসবে বলে দু’রকমের মাছ রেঁধেছিলেন নানা পাটেকর
পর্ব ১৬। সুব্রত মিত্র ও সৌম্যেন্দু রায়ের মধ্যে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না
পর্ব ১৫। ১০ বছর বয়সেই ব্রাউনি ক্যামেরায় ছবি তোলা শুরু করেছিল রিনামাসি
পর্ব ১৪। তাল ও সুর দিয়ে তৈরি এক গ্রহে থাকতেন উস্তাদ বিসমিল্লা খাঁ
পর্ব ১৩। মৃণাল সেনকে এক ডলারেই গল্পের স্বত্ব বিক্রি করবেন, বলেছিলেন মার্কেস
পর্ব ১২: পুরনো বাড়ির বারান্দায় মগ্ন এক শিল্পী
পর্ব ১১। প্রায় নির্বাক গণেশ পাইন আড্ডা মারতেন বসন্ত কেবিনে
পর্ব ১০। আজাদ হিন্দ হোটেল আর সুব্রত মিত্রর বাড়ির মধ্যে মিল কোথায়?
পর্ব ৯। শান্তিনিকেতনের রাস্তায় রিকশা চালাতেন শর্বরী রায়চৌধুরী
পর্ব ৮। পুরনো বইয়ের খোঁজে গোয়েন্দা হয়ে উঠেছিলেন ইন্দ্রনাথ মজুমদার
পর্ব ৭। কলকাতার জন্মদিনে উত্তম-সুচিত্রার ছবি আঁকতে দেখেছি মকবুলকে
পর্ব ৬। বিয়ের দিন রঞ্জা আর স্যমন্তককে দেখে মনে হচ্ছিল উনিশ শতকের পেইন্টিং করা পোর্ট্রেট
পর্ব ৫। আলো ক্রমে আসিতেছে ও আমার ছবি তোলার শুরু
পর্ব ৪। মুম্বইয়ের অলৌকিক ভোর ও সাদাটে শার্ট পরা হুমা কুরেশির বন্ধুত্ব
পর্ব ৩। রণেন আয়ন দত্তর বাড়ি থেকে রাত দুটোয় ছবি নিয়ে বেপাত্তা হয়েছিলেন বসন্ত চৌধুরী
পর্ব ২। ইশকুল পার হইনি, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত একটা ছোট্ট রামের পেগ তুলে দিয়েছিল হাতে
পর্ব ১। ঋতুর ভেতর সবসময় একজন শিল্প-নির্দেশক সজাগ ছিল
হজমের গোলমাল সারাতে বাঙালি পশ্চিমে ‘চেঞ্জে’ যেতে শুরু করল, কিন্তু নিজেদের দৌড় সীমাবদ্ধ রাখল নিজের রাজ্যের সীমারেখার ১০০ মাইলের মধ্যে। চেঞ্জারদের ভিড় দেখে মধুপুর, শিমূলতলা, ঘাটশিলার স্থানীয় মানুষ দুটো বাড়তি পয়সা রোজগার করার তাগিদে বাংলা শিখে নিল, তাতে বাঙালির হল পোয়াবারো!