টিকিট কাউন্টারে পৌঁছতেই দেখা গেল, কাউন্টারের ওপাশের ভদ্রলোক আর দম্পতির মহিলা একে অপরের পরিচিত। মহিলা ডাকছেন ‘দাদা’ বলে, অপরজন ডাকনামে। দু’টাকা পঁচিশের টিকিট ওরা পেল পাক্কা এক টাকা কনসেশনে। স্বামী অবাক হয়ে স্ত্রীর কাছে জানতে চাইল, ‘কী ব্যাপার? এত ডিসকাউন্ট দিলে, চেনা না কি!’ ফিক করে হেসে স্ত্রী জানাল, ‘পাড়ার বাবলুদা। বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল বাড়িতে। সেই বিয়ে হয়নি, কিন্তু এখনও আমার মুখ চেয়েই এত কমে টিকিট দিল!’ কাল্পনিক ঘটনা নয়, গত প্রজন্মের থেকে শোনা সত্যি ঘটনা, অথচ মনে হয়, কী আশ্চর্য সেই জাদুবাস্তবতা! কী আশ্চর্য বাঙালির সেই সময়।
১০.
‘হাতি মেরে সাথী’ দেখতে গিয়েছিল ঘোষদা, রমেন ঘোষ, খিদিরপুরের ‘চিত্রপুরী’-তে। স্কুল বাঙ্ক করে সেই সিনেমা দেখতে যাওয়ার ফল অবশ্য ভুগতে হয়েছিল। লুকিয়ে লুকিয়ে সিনেমা দেখা, ঠিক সময় বাড়ি ফিরে আসা, কোনও কিছুতেই লাভ হল না। পকেটে রয়ে গেল পঁচাত্তর পয়সার টিকিটের টুকরো। ফলে বাড়ি ফিরতেই চলল উত্তম মধ্যম! কিন্তু সেই ঘটনার বাহান্নটি বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর, পানশালা-ফেরত সওয়ারিদের নিয়ে নিজের ট্যাক্সিতে বসে ঘোষদার আর কোনও খেদ নেই, সেদিনের সেই মারের সাগর পাড়ি দেওয়া নিয়ে। ঘোষদার কথায়, ‘‘হলে বসে ‘নফরত কি দুনিয়া কো ছোড় কে’ শুনে সেই যে হাউহাউ করে কেঁদেছিলাম, তাতেই ওসব মারধর আর গায়ে লাগল না। এত সেন্টিমেন্টাল হয়ে গেছিলাম ছবিটা দেখে, টিকিটটা যে ফেলতে হবে বাড়ি যাওয়ার আগে, সেটা খেয়ালই ছিল না!’’
টিকিটের ভেতর এমন কত গল্প জমে! ব্যালকনি, রিয়ার স্টল, ড্রেস সার্কলের টিকিটের দাম উঠত ধাপে ধাপে। দেড় টাকা, দু’টাকা, দু’টাকা পঁচিশ। স্কুল-কলেজ সীমাবদ্ধ থাকত যদিও পঁচাত্তর থেকে দেড়-এর মধ্যেই। অফিসযাত্রীরা কখনও কখনও হয়তো দু’টাকায় পৌঁছে যেত, দম্পতি বা যুগল হলে দুই পঁচিশও হতে পারত। শিয়ালদহের বিখ্যাত হল ‘প্রাচী’-তে, তেমনই এক দম্পতি একবার গিয়ে হাজির হয়েছে, পকেটে সম্বল পাঁচ টাকার নোট, দু’টাকা পঁচিশ করে দুটো টিকিট মানে সাড়ে চার টাকা। বাকি আট আনায় চিনেবাদাম হয়ে যাবে। যাওয়া-আসা হাঁটা পথে। সেদিনই কী হল, টিকিট কাউন্টারে পৌঁছতেই দেখা গেল, কাউন্টারের ওপাশের ভদ্রলোক আর দম্পতির মহিলা একে অপরের পরিচিত। মহিলা ডাকছেন ‘দাদা’ বলে, অপরজন ডাকনামে। দু’টাকা পঁচিশের টিকিট ওরা পেল পাক্কা এক টাকা কনসেশনে। স্বামী অবাক হয়ে স্ত্রীর কাছে জানতে চাইল, ‘কী ব্যাপার? এত ডিসকাউন্ট দিলে, চেনা না কি!’ ফিক করে হেসে স্ত্রী জানাল, ‘পাড়ার বাবলুদা। বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল বাড়িতে। সেই বিয়ে হয়নি, কিন্তু এখনও আমার মুখ চেয়েই এত কমে টিকিট দিল!’ কাল্পনিক ঘটনা নয়, গত প্রজন্মের থেকে শোনা সত্যি ঘটনা, অথচ মনে হয়, কী আশ্চর্য সেই জাদুবাস্তবতা! কী আশ্চর্য বাঙালির সেই সময়!
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
বিনোদ খান্না-বিনোদ মেহরা অভিনীত সেই কল্পবিজ্ঞান-মিশ্রিত অ্যাকশন থ্রিলারের চেহারা দেখলেই বোঝা যাবে, তার মধ্যে জেমস বন্ড থেকে ইন্দ্রজাল কমিকস– কীভাবে মিশে আছে। ফেমে ফাতাল থেকে শুরু করে দুর্ধর্ষ ভিলেন, সমুদ্রের প্রাসাদ থেকে শুরু করে ছদ্মবেশে দস্যু ধরা, গুপ্তকক্ষ থেকে গুলিগোলা, এবং সম্পূর্ণ পাল্পীয় রঙের ব্যবহার– সব মিলিয়ে জমজমাট সেই ছবি! সেই ছবির ভেতর বিচিত্র সব কাণ্ডকারখানা ছিল, যেমনটা স্বপনকুমারের গল্পে পাওয়া যেত।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ওই সময়েই একটি আশ্চর্য ছবি মুক্তি পায়, ‘এলান’ নামে। বিনোদ খান্না-বিনোদ মেহরা অভিনীত সেই কল্পবিজ্ঞান-মিশ্রিত অ্যাকশন থ্রিলারের চেহারা দেখলেই বোঝা যাবে, তার মধ্যে জেমস বন্ড থেকে ইন্দ্রজাল কমিকস– কীভাবে মিশে আছে। ফেমে ফাতাল থেকে শুরু করে দুর্ধর্ষ ভিলেন, সমুদ্রের প্রাসাদ থেকে শুরু করে ছদ্মবেশে দস্যু ধরা, গুপ্তকক্ষ থেকে গুলিগোলা, এবং সম্পূর্ণ পাল্পীয় রঙের ব্যবহার– সব মিলিয়ে জমজমাট সেই ছবি! সেই ছবির ভেতর বিচিত্র সব কাণ্ডকারখানা ছিল, যেমনটা স্বপনকুমারের গল্পে পাওয়া যেত। একদিন এক রাশভারী অধ্যাপক ক্লাস নিতে এসেছেন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে। এসেই আদ্যশ্রাদ্ধ শুরু করেছেন হিন্দি ছবির। ছাত্রছাত্রীদের ভর্ৎসনা করছেন, এবং বলছেন, এসব ছবি দেখে সময় নষ্ট না করে বরং বিশ্বসিনেমার দিকে মন দেওয়া উচিত। দেখা উচিত বার্গম্যানের ‘দ্য সেভেন্থ সিল’-এর মতো ছবি, অথবা গোদারের ‘পিয়ের লো ফ্যু’-এর মতো ছবি। আর থ্রিলার দেখতে হলে দেখা উচিত আলফ্রেড হিচককের ছবি। হঠাৎই এমন খড়গহস্ত কেন তিনি হিন্দি সিনেমার ওপর? এই প্রশ্ন ভেসে আসতেই সবেগে তিনি পকেট থেকে বের করে প্রায় ছুড়ে দিলেন ‘বিজলী’ সিনেমার একটি টিকিট, রিয়ার স্টলের, ‘এলান’ ছবির। তারপরেই শুরু হল বিনোদ মেহরার, চলিত বাংলায় যাকে বলে, গুষ্টির তুষ্টি! ‘অমন নায়ক গড়িয়াহাটে সেকেন্ড হ্যান্ডও কিনতে চাইবে না কেউ! ক্যালাস!’ ইত্যাদি বলে ভর্ৎসনা করে ক্লাস ছেড়ে যাওয়ার আগে কোনও এক ছাত্র বলে উঠল, ‘আর স্যর হিরোইন?’, ইংরেজি সাহিত্যের স্যর একটু থমকালেন, তারপর বললেন, ‘ওর সম্ভাবনা আছে।’
সম্ভাবনার কথাটা সেই অধ্যাপক খুব ভুল বলেননি, তখন চেহারাও তাঁর অন্যরকম, অনন্য সেই তারকা জুটিও তৈরি হয়নি, যে জুটিকে ঘিরে বিতর্ক ও গুঞ্জন এখনও চালু বলিউডে, এবং দশ বছর পর যে জুটির একটি ছবি কেচ্ছাবিলাসী দর্শককে প্রায় তাঁদের সম্পর্কের অন্দরমহল খুলে দেখিয়ে দেবে। থ্রিলারপ্রেমী সেই অধ্যাপক অবশ্য আবারও পরবর্তীতে ‘খুন খুন’ দেখতে গেলেন। ক্লিন্ট ইস্টুডের ‘ডার্টি হ্যারি’-র রিমেক সেই ছবির টিকিট এবার ভুলবশতই অধ্যাপকের পাঞ্জাবির পকেট থেকে পড়ে গিয়েছিল ক্লাসরুমে। এবারও কি নেহাত থ্রিলারের লোভে, না কি সেই সম্ভাবনাময় নায়িকার একটু হলেও ফ্যান হয়ে উঠেছিলেন সেই অধ্যাপক? আর কিছুদিন পরেই ‘নমকহারাম’-ও কি তিনি দেখতে গিয়েছিলেন?
আমেরিকার বিখ্যাত নিকেলেডিয়ান যুগে বন্ধ দোকান হয়ে উঠেছিল ভিডিও পার্লার, যেখানে এক নিকেলে দেখা যেত ছবি। সেসব ছবি নীরব জমানার! ‘দ্য গ্রেট ট্রেন রবারি’-র মতো কিছু ছবি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল কেবলই নিকেলেডিয়ান থিয়েটারের জোরে। ‘বায়োস্কোপ’ দেখার বিস্ময় বাঙালির কাছে অটুট থেকেছে বহুদিন পর্যন্ত, তখন বোদ্ধাদের সংখ্যাও ছিল কম। ওই এক নিকেলের মতোই পঁচাত্তর থেকে দুই পঁচিশের স্মৃতির ধুলোয়, বন্ধ দোকানে জমে ওঠা সিনেমা হলের মতো বন্ধ হয়ে যাওয়া সিনেমা হলে জমে ওঠা শপিং মলের আড়ালে কিছু কিছু টিকিট প্রমাণ হিসেবে থেকেই যায়। অধ্যাপক ‘নমকহারাম’ আর দেখতে গেলেন কি না, টিকিটে তার সাক্ষ্য মেলেনি হয়তো! কিন্তু কিছুদিন বাদে ‘জোরো’ নিয়ে যখন হিন্দিতে ছবি হল, নবীন নিশ্চল হল তার হিরো, সেই ছবি হলে দেখতে গিয়ে কিছু ছাত্র আবিষ্কার করেছিল, সেই অধ্যাপক বসে আছেন। ওদের দেখেই যদিও মুখটা ঘুরিয়ে নেন।
‘জোরো’-র নায়িকার দেশজোড়া জনপ্রিয়তা পেতে যদি তখনও কিছুটা দেরি ছিল। আর কয়েক বছর পর, ‘ঘর’, ‘মুকাদ্দর কা সিকান্দর’, আরও পরে ‘খুবসুরত’ তাঁকে পরিচিতি দেবে। কিন্তু রেখা কি কোনও দিনও জানতে পারবেন, তাঁর কেরিয়ারের প্রথমদিকের সেই ভক্ত অধ্যাপকটির কথা?
…পড়ুন জনতা সিনেমাহল-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৯। খান্না সিনেমায় নাকি পৌরাণিক সিনেমা চলছে
পর্ব ৮। পাড়াতুতো ট্র্যাজেডিতে মিলে গেলেন উত্তমকুমার আর রাজেশ খান্না
পর্ব ৭। পাড়ার রবিদা কেঁদেছিল ‘কাটি পতঙ্গ’ আর ‘দিওয়ার’ দেখে, সাক্ষী ছিল পাড়ার মেয়েরা
পর্ব ৬। যে কলকাতায় পুলিশ-পকেটমার মিলেমিশে গেছে, সেখানে দেব আনন্দ আর নতুন করে কী শিরশিরানি দেবেন?
পর্ব ৫। হিন্দি ছবির পাপ ও একটি অ্যাডাল্ট বাড়ির গল্প
পর্ব ৪। দেব আনন্দ, একটি বোমা ও অন্ধকারে হাত ধরতে চাওয়ারা
পর্ব ৩। অন্ধকারে ঢাকা পড়ল কান্না থেকে নিষিদ্ধ স্বপ্ন!
পর্ব ২। ‘জিনা ইঁয়াহা মরনা ইঁয়াহা’ উত্তর কলকাতার কবিতা হল না কেন?
পর্ব ১। সিনেমা হলে সন্ত্রাস ও জনগণমন-র দলিল