Robbar

পথের কুকুর, আকাশের কাক-চিল, মাটির পিঁপড়েরও অন্নের ভাবনা গৃহস্থের

Published by: Robbar Digital
  • Posted:September 17, 2025 4:49 pm
  • Updated:September 17, 2025 4:49 pm  

সেদিন দেখলাম সেই একই আধময়লা শাড়ি পরে বসে আছেন সেই একই মৃত্যুঞ্জয় ভবনের রোয়াকে। এখন এই সকাল এগারোটায় কী করছেন উনি এখানে? আজ হেঁটে যাচ্ছি, তাই কৌতূহলী হয়ে দাঁড়াতে বাধা নেই। একটু এগিয়ে গেলাম। রোয়াকের ওপর ওঁর পিছনে একটা বালতি। প্লাস্টিকের বালতি আসেনি তখনও, আমাদের ছোটবেলার পরিচিত সেই টিনের বালতি। তার মধ্যে সাদা মতো কিছু তরল। কাছে যেতে অতি পরিচিতের মতোই দু’-এক কথা হল– এইগুলি? ‘ভাতের মাড়। আমার ঘরের না গো মা। দুইটা মানুষের ভাতে কী আর… এ চাইয়া আনি। এই পাড়ার বউগুলা বড় ভালো, ভাত রান্ধন শ্যাষ হইলে নিজেরাই ফ্যানটুক গড়াইয়া দিয়া যায়।’ কার জন্য?

প্রচ্ছদের ছবি: শান্তনু দে

জয়া মিত্র

২.

আমাদের ছোট শহরে তখনও রাস্তাঘাট অনেক ফাঁকা ফাঁকা ছিল কার কার গাড়ি আছে, শহরের সকলেরই মোটামুটি জানা ছিল কিন্তু পুরনো আমলের বড় বাড়ি ছিল বেশ কিছু আর বড় মাঝারি বেশিরভাগ পাকাবাড়িরই সামনে ছিল উঁচু রোয়াক বেনারসি কায়দায় তাকে আমরা বলতাম ‘চৌতারা’ মানে চবুতরা

স্টেশন থেকে যে রাস্তাটা সটান চলে আসছে, সেটা এসে পড়ত নীলকুঠিডাঙায় ছোটবেলায় কখনও এই অদ্ভুত নামটা মনে কোনও প্রশ্ন জাগায়নি সেই পাড়ায় বেশ বড় বড় দোতলা বাড়িগুলোর কোনওটা ফাঁকা, কোনওটায় লোক থাকে– কিন্তু, দু’-একজন মস্ত দোতলা নাচের স্কুল, পশুপতি গঙ্গাধর সংগীত বিদ্যালয় কে জানে কতকালের পুরনো নাম কেই বা ছিলেন সেই পশুপতি গঙ্গাধর! আমাদের সেই ছোটবেলায় সেখানে নাচ শেখাতে সপ্তাহে একদিন কলকাতা থেকে আসতেন কেলু নায়ার। একটু এগিয়ে এসে রাস্তার উল্টোদিকে পুলিশ-লাইন তার পিছনের বড় বড় গাছওয়ালা পাড়াটার নাম সিন্দারপট্টি কেন এমন নাম? মানে কী ওই শব্দটার? অনেক পরে শহরের মাস্টারমশাই সত্যেনবাবু বলেছিলেন, নতুন রেললাইন হওয়ার পর স্টেশনের পাশের ওই এলাকাটাতে ইঞ্জিনের বয়লার থেকে জলন্ত কয়লার ছাই ঢেলে দেওয়া হত সেই সিন্ডার্স থেকে ‘সিন্দারপট্টি’

পুরনো বেনারসের চালচিত্র

পুলিশলাইন অবধি আসার আগেই বড় অথচ ফাঁকা, প্রায় ফাঁকা, বাড়িগুলোর নিচে একটা রোয়াকে দুপুর রোদ্দুরে দেখলাম এক মহিলাকে, ভাদ্রমাসের রোদে বসে আছেন এক কলসি জল নিয়ে পাশে একটা পরিষ্কার মাজা ঘটি ওই পাড়ার দুই মাথায় দুটো প্রাইমারি স্কুল, হাইস্কুল একটু দূরে আমি পার হয়ে যাওয়ার আগেই রহস্য ধরা পড়ল কোনও একটা স্কুলে টিফিনের ঘণ্টা পড়েছে রাস্তা দিয়ে পনপন করে ছুটে আসছে ছোট ছেলেমেয়েরা, সক্কলের লক্ষ ওই রোয়াকে বসা মহিলার মাটির কলসিখানা। ‘দিদু জল’, ‘ঠাম্মা জল’ গোলমালে ক্যাচর-ম্যাচরে ভরে গেল জায়গাটা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এসে পড়েছে অন্য প্রাইমারির কুচোগুলোও ধৈর্য ধরে, একটুও ব্যস্ত না হয়ে ঘটি থেকে জল ঢেলে দিচ্ছেন যে ছোট্ট হাঁ-খানা সামনে আসছে তার মধ্যে, আর হাতে দিচ্ছেন একটি করে নকুলদানা

অবাক কাণ্ড যে, সেই কিচিরমিচিরদেরও মধ্যে কিন্তু একরকম শৃঙ্খলা আছে তারা মোটামুটি লাইন করেই খাচ্ছে, জল আর নকুলদানা বোঝাই যাচ্ছে, এই নকুলদানাটার স্বাদ ওদের বাড়িতে একা একা খাওয়া কালাকাঁদ কিংবা নিখুঁতির চেয়ে বেশি ভালো মহিলার শাড়িটি মলিন, স্পষ্টতই সেটার রিটায়ারমেন্টের কাল অনেক দিন হল পেরিয়েছে মাথার সাদা চুলগুলিতে তেল আর চিরুনি– দুটোরই কিছুটা অভাব শাড়ির পাড় দেখে বোঝা যায়, সঙ্গে আরও একজন আছেন কোথা থেকে এসেছেন ইনি? বোঝাই যাচ্ছে যে বাড়ির রোয়াকে বসে আছেন, সেটা ওঁর বাড়ি নয় তবে?

মনে রইল ছবিটা মাকে জিজ্ঞেস করলাম বাড়ি এসে না, মা চেনেন না ওপাড়া বেশ দূর আমাদের বাড়ির থেকে

অন্য একদিন সকাল প্রায় ১১টা নাগাদ পার হচ্ছি নীলকুঠিডাঙা দিয়ে, উল্টোদিকের গলিতে এক পরিচিতের বাড়ি যাব একটা বইয়ের জন্য সেদিন দেখলাম একই আধময়লা শাড়ি পরে সেই মহিলা বসে আছেন একই মৃত্যুঞ্জয় ভবনের রোয়াকে এখন এই সকাল ১১টায় কী করছেন উনি এখানে? আজ হেঁটে যাচ্ছি, তাই কৌতূহলী হয়ে দাঁড়াতে বাধা নেই একটু এগিয়ে গেলাম রোয়াকের ওপর ওঁর পিছনে একটা বালতি প্লাস্টিকের বালতি আসেনি তখনও, আমাদের ছোটবেলার পরিচিত সেই টিনের বালতি তার মধ্যে সাদা মতো কিছু তরল কাছে যেতে অতিপরিচিতের মতোই দু’-এক কথা হল– এইগুলি? ‘ভাতের মাড় আমার ঘরের না গো মা দুইটা মানুষের ভাতে কী আর… এ চাইয়া আনি এই পাড়ার বউগুলা বড় ভালো, ভাত রান্ধন শ্যাষ হইলে নিজেরাই ফ্যানটুক গড়াইয়া দিয়া যায়।’ কার জন্য? ‘অই দ্যাখ, আইয়া পড়ছে সব দেখি রাস্তার কুকুরদের একটা দল হালকা পায়ে দৌড়ে আসছে, ওই একইভাবে, খানিকটা ব্যস্ততা আর কিছুটা খেলা।’ সেই অন্নদাত্রী দেখি সকলকে দিচ্ছেন একহাতা করে আর মুখে ওই চতুষ্পদদের সঙ্গে কথা বলছেন অনর্গল, ‘‘কই গেছিলা তুই? দুইদিন দেখি নাই যে? আরে, তুমি দেখি বড় ষণ্ডা হইছ, ওরে ঠেলিস না কইলাম, দেখিস না প্যাটে বাচ্চা আছে দ্যাখ, চোখগুলি কীর’ম কইরা চাইয়া আছে।’’

যাদের উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে তারা কিছু বুঝতে পারছে না, এমন আমার একবারও মনে হল না তারপর যেতাম, প্রায়ই পাশে বসে থাকতাম একদিন বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন দুটো বড় বাড়ির মাঝখানে একটু পিছনদিকে প্রায় চোখে না-পড়া একটি জীর্ণ ইটের ঘর ঢালু ছাদ যে কীসের, তা আজ আর মনে নেই খাটিয়ায় শুয়েছিলেন ঘরেরই মতো জীর্ণ একজন ধুতিপরা মানুষ একপাশে মাটিতে একটি হাঁড়ি আর একটি ঢাকা দেওয়া কড়াই দেওয়ালের দড়িতে দু’-একটা শাড়ি আর ঘরময় একটি উজ্জ্বল প্রসন্ন মুখ

শিল্পী: শান্তনু দে

রাস্তার উল্টোদিকে যে পরিচিতের বাড়ি, তাঁদের কাছ থেকে শুনেছি টুকরো টুকরো কিছু, যেমন খুব অনেক দিন আগে আসেননি ওঁরা, আবার একেবারে সদ্যও নন ভদ্রলোক আগে কিছুটা চলাফেরা করতেন কোনও দোকানে সামান্য কিছু কাজ করতেন বোধহয় রাস্তায় রিকশার সঙ্গে কাপড় জড়িয়ে কী করে যেন পড়ে যান, হাড় ভেঙে যায় ওঁদের ছেলেপুলে আছে কি না, কেউ জানে না কোনও দিন কাউকে আসতেও দেখা যায়নি খুবই দারিদ্রে থাকেন, কিন্তু তবু ওইরকম, প্রতিদিন সকালে পাড়ার সকলের বাড়ি থেকে জোটানো ফ্যান দিয়ে রাস্তার কুকুরদের খাওয়ানো আর দুপুরে ইশকুলের বাচ্চাদের জন্য ওই জলের কলসি আর নকুলদানা

পাড়ার একটু দূরে থাকা জনেদেরও একরকম কিছু শ্রদ্ধা আর কিছু সমর্থন মেশানো ‘ভালো মানুষগুলো’ স্বীকৃতি আছে। হাইস্কুলের একজন অ-সংসারী মাস্টারমশাই নাকি ওঁকে ‘মা’ বলে ডেকেছেন মা তাই ছেলের জন্য দু’বেলা ভাত-তরকারি রেঁধে দেন তিনজন একই সঙ্গে খাবেন এই শর্তে ছেলে রাজি হয়েছেন, না হলে তিনি আগের মতোই ছাতু খেয়ে ক্লাসে যাবেন ‘মানুষ কী কখনও একা হয় রে মা? তুমি আর পাঁচজনেরটা ভাবো, তোমারটা যাঁর ভাবার তিনি ভাববেন’– এই পরম নিশ্চিন্তি কেউ অভ্যাস করতে পারেন, এমন আগে দেখিনি পরেও দেখিনি বেশি 

আমাদের যে মহাকাব্য মানুষের জীবনযাপনের নানাকথা বলে চলে, কতদিন পরে জেনেছি সেখানে বলা আছে গৃহস্থের অবশ্য পালনীয় পাঁচটি যজ্ঞের কথা– দেব যজ্ঞ, পিতৃযজ্ঞ, নৃযজ্ঞ, ভূতযজ্ঞ, বেদযজ্ঞ প্রতিদিন দেবতাকে প্রণতি জানানো এই জীবনের জন্য, পূর্বজদের প্রণাম জানানো নিজের জন্মের জন্য, নৃযজ্ঞ হল পরিবারের বাইরের কোনও একজন মানুষকে প্রতিদিন অন্ন দেবেন গৃহস্থ, ভূত হল মানুষ ব্যতীত সমস্ত প্রাণধারী ভূতযজ্ঞে গৃহস্থের ধর্ম তাই প্রতিদিন না-মানুষ কোনও একজনকে অন্নে প্রতিপালন করা তাই গৃহস্থনিবাসে আসা ভিখারিরা, বৃত্তিজীবীরা, সন্ন্যাসী, পথিক– সকলের অন্নের যে কোনও ব্যবস্থা গৃহস্থেরই ধর্ম তাই তো পথের কুকুর, আকাশের কাক-চিল, মাটির পিঁপড়েরও অন্নের ভাবনা গৃহস্থের আর বেদযজ্ঞ? গৃহস্থ প্রতিদিন কিছু অধ্যয়ন করবেন এবং কাউকে একটু পড়াবেন এই যজ্ঞের কথা সমাজ মানত, কাক-কুকুরকে নিয়মিত নিজের এতটুকু একমুঠো উদ্বৃত্ত অন্নের ভাগ দেওয়া তাই স্বাভাবিক ছিল শিশুদের কাছেও।

আজ এই শরতের পরিষ্কার আকাশের হালকা মেঘে প্রকৃতি একইরকম সাজ নেয় যেমন সে সাজত ৫০ বছর আগে পথের পাশে পাশে কাশের ঝালর নদীর বন্যা ভাঙনকে আড়াল করে দোলে চেয়ে থাকলে হয়তো মনে পড়ে সেই পুরনো কথা যে, প্রকৃতিতে কোনও কিছুর অভাব নেই, সকলের জন্যই যথেষ্ট আছে, যদি তুমি লোভ না করো। আর সেই শৃঙ্খলাভাঙার কাজ করলে তার শাস্তিও সে শৃঙ্খলারই আবশ্যিক অঙ্গ।

শারদ শুভেচ্ছা সকলকে।

…………………………….

রোববার.ইন-এ পড়ুন জয়া মিত্র-র অন্যান্য লেখা

…………………………….