কবি, নাস্তিক কবি, প্রথমে তাকায় ‘নিখিলেশ’ শব্দটির দিকে। তারপর তার দৃষ্টি প্রজাপতির মতো উড়ে গিয়ে বসে ‘যীশু’-র ওপর! একই স্তবকে ঈশ্বর ও তাঁর সন্তান, এই অবিকল্প অন্বয় কি নাস্তিক কবি নিজেই ঘটিয়েছে? নাকি এই জাদু অন্বয়ের পিছনে কাজ করে চলেছে তার লেখার টেবিলটার অদৃশ্য শক্তি? উত্তর জানে না কবি। আজ তাকে পেয়েছে শব্দের শক্তি। সে আজ শব্দের পুলকিত ক্রীতদাস।
৪.
তরুণ কবিটি সম্পূর্ণ অনীশ। এক টুকরো ভগবান নেই তার জীবনে। বেয়াদপ অনীশ্বরবাদে কিংবা অস্তিত্ববাদী ঈশ্বর-অনীহায় সে কাটাচ্ছে এমন এক জীবন, যাকে সে মানুষজন্ম বলতে যেন অনুজ্ঞাত সংশয়ী। তার আঁকড়ে ধরার একটি মাত্র জায়গা কবিতা। অক্ষরকে নিবেদন করেছে সে তার প্রত্যয় ও প্রকাশ। এবং তার একমাত্র বন্ধু বলতে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যে-একজনকে বলতে পারে সে মনের কথা, সে নিখিলেশ। অবিকল্প আয়রনি যোগে ‘নিখিলেশ’ শব্দটি ভ্রূণের মতো সাঁতার কাটে ঈশ্বর-তারল্যে!
ঘোলাটে মন নিয়ে তরুণ কবির ঘুম ভেঙেছে সাতসকালে। কিন্তু গত রাত্রের খোঁয়াড়ি কাটেনি এখনও। আচ্ছন্ন মন নিয়ে, এক কাপ কফির উত্তপ্ত সান্নিধ্যে, সে বসল ঘরের বিষণ্ণতম কোণে, তার অনাসক্ত উদাসীন নির্বিণ্ণ লেখার টেবিলে। এবং ভোরবেলার স্বপ্নে আকস্মিক চমকে ওঠা পঙক্তিটি সে মনে করার চেষ্টা করল। কোথায় তলিয়ে গেল সেই প্রার্থিত পঙক্তি? অসহায় আবেগ কবির সকালবেলার খোঁয়াড়ির মধ্যে কাঁপছে। কিন্তু কিছুতেই তার মনে পড়ছে না হারিয়ে-যাওয়া স্বপ্নের গায়ে সেই আশ্চর্য লাইন, যা লেখেনি, লিখতে পারেনি, পৃথিবীর অন্য কোনও কবি!
একবুক উত্তপ্ত কফির চড়া গন্ধের মধ্যে কবি চুপ করে তাকিয়ে তার লেখার টেবিলটির দিকে। টেবিলে ঠাসাঠেসি, স্তূপাকৃত ভিড়। থই-থই বই-বই। তার বন্ধু তারাপদ রায়ের খাটের মতো। কবি এখনও চালচুলোহীন। তখনও ছিল। সে নিরাসক্তভাবে ভেবে দেখেছে, তার জীবনে চালচুলোহীনতার কোনও এখন-তখন নেই। এবং সে একথাও ভেবে দেখেছে, তারাপদকে সে ঈষৎ ঈর্ষা করে। কারণ, তারাপদ একটি নিজস্ব বাড়ির অধিশ্বর। যেমনই বাড়ি হোক, নিজের বাড়ি তো। কালীঘাটের মহিম হালদার স্ট্রিটে তারাপদর এই বাড়িতে, বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে কবি বহু দিনরাত অনেক হুটোপাটি করেছে। কেননা তারাপদ নিজের বাড়িতে একা থাকে। এই বাড়িতেই কবি তারাপদ আর শক্তির সঙ্গে এলএসডি সেবনও করেছে। তখন চলছে এলএসডি-প্রেরণার যুগ। অল্ডাস হাক্সলি একাধিক একই লেখা এলএসডি সেবনের আগে ও পরে লিখে পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। কবি বুঝেছে, এলএসডি মতিচ্ছন্নতা আচমকা লেখাকে পৌঁছে দিতে পারে কোন অবিশ্বাস্য পারমিতায়!
কবি টেবিলের দিকে এখনও তাকিয়ে। সমস্ত টেবিল জুড়ে এলোমেলো বইয়ের হুড়মুড় ভিড়। এক চিলতে জায়গা আছে টেবিলের এক পাশে। ওইটুকু জায়গাই যথেষ্ট, কবি জানে, লেখার খাতাটি রেখে কলম চালানোর জন্য। কিন্তু ভোরের স্বপ্নে দেখা পঙক্তিটা হারাল কোন অতলে! মনে পড়ছে না কিছুতেই। বরং মনে এল, কিছুদিন আগের এক রাত। কালীঘাটের মহিম হালদার স্ট্রিটে তারাপদর বাড়ি। নেশাচ্ছন্ন তিন লেখক শোবার খাটের সামনে। খাটময় বই। তিনজনে মিলে এই খাটে রাত্রি যাপন করতে হলে যে-কোনও বই অপসারণ যোগ্য। কবি এতদিনে ঠাওর করতে পেরেছে, যে তার নিজস্ব দর্শন মুছে দিয়েছে এই কুসংস্কার যে, হাতের তুলনায় পা বেশি অপবিত্র। সত্যি বলতে, শরীরের সব অঙ্গই সমান। অতএব মার লাথি, বলল কবি। আর কবি দেখল, শক্তি, তারাপদ, আর নিজের– তিনজোড়া লাথির ঘায়ে তারাপদর খাট নিমেষে বইমুক্ত হল। এবং কবি, ঘুমিয়ে পড়ার আগে আরও দেখল, ‘তিন জোড়া লাথির ঘায়ে রবীন্দ্র-রচনাবলী লুটোয় পাপোশে।’ টেবিলের দিকে তাকিয়ে কবির মনে পড়ে গেল কীভাবে বাঘের মতো পঙক্তিটা লাফিয়ে পড়ল তার বুকের ওপর, নখের আঁচড়ে রক্তের অক্ষরে লিখে রেখে গেল কয়েকটি শব্দের এই বেতমিজ বাক্য।
আর তখুনি ঘটল তড়িচ্চালিত তোলপাড়!
………………………………………………
কবি গভীরভাবে বোধ করে, টেবিলটা কাঁপছে এক অব্যক্ত ভাবনায়। টেবিলটার ঘনপিনদ্ধ কাঠের ওপর দেখা দিচ্ছে গভীর মননের মগ্ন পিনাকেশ। কবি কলম ধরে, টেবিলটার চিলতে বুকে ন্যস্ত খাতাটার ওপর। ঝরে পড়ে অক্ষরের সারি: ‘এ কী মানুষজন্ম? নাকি শেষ পুরোহিত কঙ্কালের পাশাখেলা!’ তারপর, পাশাখেলার সঙ্গে অমল অন্বয়ে এসে পড়ে ‘সন্ধ্যেবেলা’ শব্দটি এমনই এক অনুভবের অবাক প্রকাশে: ‘প্রতি সন্ধ্যেবেলা আমার বুকের মধ্যে হাওয়া ঘুরে ওঠে।’ কবি ভাবে বিস্ময়ে– এ কী আমারই লেখা!
………………………………………………
বইয়ের ভিড় ঠেলে স্বপ্নে দেখা, অতলে হারিয়ে-যাওয়া পঙক্তিটি জ্বলে উঠল টেবিলের এক চিলতে জায়গাটিতে রাখা কবির লেখার খাতায়: ‘আমি কীরকমভাবে বেঁচে আছি, তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ। এই কি মানুষজন্ম?’ কেন এমন হয়? ‘তিন জোড়া লাথির ঘায়ে রবীন্দ্র-রচনাবলী লুটোয় পাপোশে’– এই লাইনটার সঙ্গে কোন নাড়ির টানে অতল থেকে ভেসে উঠল ‘আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ’? কবি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকে বাক্যটির দিকে। ভেবে কুলকিনারা পায় না। সিগারেট ধরায়। চুমুক দেয় কফিতে। বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে তার নাস্তিক সত্তায়। তারপর সিগারেটে বুকভরা টান দিয়ে তাচ্ছিল্যে বলে, ‘নিখিলেশই জানে!’ আর তখুনি টেবিলটা আবেগে থরথর করে কাঁপতে থাকে। কবি গভীরভাবে বোধ করে, টেবিলটা কাঁপছে এক অব্যক্ত ভাবনায়। টেবিলটার ঘনপিনদ্ধ কাঠের ওপর দেখা দিচ্ছে গভীর মননের মগ্ন পিনাকেশ। কবি কলম ধরে, টেবিলটার চিলতে বুকে ন্যস্ত খাতাটার ওপর। ঝরে পড়ে অক্ষরের সারি: ‘এ কী মানুষজন্ম? নাকি শেষ পুরোহিত কঙ্কালের পাশাখেলা!’ তারপর, পাশাখেলার সঙ্গে অমল অন্বয়ে এসে পড়ে ‘সন্ধ্যেবেলা’ শব্দটি এমনই এক অনুভবের অবাক প্রকাশে: ‘প্রতি সন্ধ্যেবেলা আমার বুকের মধ্যে হাওয়া ঘুরে ওঠে।’ কবি ভাবে বিস্ময়ে– এ কী আমারই লেখা! তারপর, অবাকের ওপর অবাক! ‘হৃদয়কে অবহেলা করে রক্ত’। ‘অবহেলা’ শব্দটির মধ্যে কি প্রতিধ্বনিত হল না ‘সন্ধ্যেবেলা’? তারপর আবার এক প্রতিধ্বনি, ‘পাশাখেলা’, মিলিয়ে গিয়েও যেন থেকে গেল দূরের আকাশে! কবি কি নিজেই ঘটাচ্ছে এই শব্দলীলা, অনায়াসে, নিজের ইচ্ছেয়? ‘নিখিলেশই জানে’, বিড়বিড় করে নাস্তিক তরুণ কবি। কবি এরপর লেখে একতোড়ে:
‘আমি মানুষের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে
থাকি– তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখব বলে।
আমি আক্রোশে
হেসে উঠি না, আমি ছারপোকার পাশে ছারপোকা
হয়ে হাঁটি,
মশা হয়ে উড়ি একদল মশার সঙ্গে, খাঁটি
অন্ধকারে স্ত্রীলোকের খুব মধ্যে ডুব দিয়ে দেখেছি
দেশলাই জ্বেলে –
(ও-গাঁয়ে আমার কোনও ঘরবাড়ি নেই!)’
কোন গাঁয়ে? বুঝবে কি সবাই? যে-বুঝবে, ভাববে কি– কী অসভ্য! তা ভাবুক। পছন্দ করবে হয়তো কোনও কোনও নারী! যারা পাকাপোক্ত, রসবতী, তারা হয়তো দেবে প্রশ্রয়, ভাববে না অশ্লীল। কিন্তু বর্তমান পঙক্তিটি, যা এখুনি উগরে দিল তার কলম, সে নিজেই লিখেছে? নাকি অন্য কেউ জনক, এই পঙক্তি কবির জারজ সন্তান? কেননা, আগে তো সে লেখেনি এমন? কিংবা হয়তো লিখবে না পরেও। বলে বলে কোন শকুনি ফেলতে পারে এমন পাশার দান? এই প্রসর্পিত প্রশ্নের চূড়ায় কবি অনুভব করে, তার লেখার ঘনপিনদ্ধ কাঠের টেবিলে ব্যাখ্যার অতীত এক পিনাকেশ-শক্তির সঞ্চার। সেই শক্তি নিক্ষেপ করে অবিশ্বাস্য বাক্যরাশি, অর্জুনের লক্ষ্যভেদী অব্যর্থনিশানা কল্লোলিত কলম্ব যেন তারা!
‘আমি স্বপ্নের মধ্যে বাবুদের বাড়ির ছেলে সেজে গেছি রঙ্গালয়ে,
পরাগের মতো ফুঁ দিয়ে উড়িয়েছি দৃশ্যলোক,
ঘামে ছিল না এমন গন্ধক
যাতে ক্রোধে জ্বলে উঠতে পার।
নিখিলেশ, তুই একে কী বলবি?
আমি শোবার ঘরে নিজের দুই হাত
পেরেকে বিঁধে দেখতে চেয়েছিলাম
যীশুর খুব বেশি লেগে ছিল কি না,
আমি ফুলের পাশে ফুল হয়ে ফুটে দেখেছি,
তাকে ভালবাসতে পারি না।’
কবি, নাস্তিক কবি, প্রথমে তাকায় ‘নিখিলেশ’ শব্দটির দিকে। তারপর তার দৃষ্টি প্রজাপতির মতো উড়ে গিয়ে বসে ‘যীশু’-র ওপর! একই স্তবকে ঈশ্বর ও তাঁর সন্তান, এই অবিকল্প অন্বয় কি নাস্তিক কবি নিজেই ঘটিয়েছে? নাকি এই জাদু অন্বয়ের পিছনে কাজ করে চলেছে তার লেখার টেবিলটার অদৃশ্য শক্তি? উত্তর জানে না কবি। আজ তাকে পেয়েছে শব্দের শক্তি। সে আজ শব্দের পুলকিত ক্রীতদাস:
‘আমি সর্বস্ব বন্ধক দিয়ে একবার
একটি মুহূর্ত চেয়েছিলাম, একটি… ব্যক্তিগত
জিরো আওয়ার;
ইচ্ছে ছিল না জানাবার
এই বিশেষ কথাটা তোকে। তবু ক্রমশই বেশি করে আসে শীত,
রাত্রে এ-রকম জলতেষ্টা আর কখনও পেত না,
রোজ অন্ধকার হাতড়ে
টের পাই তিনটে ইঁদুর না মূষিক?
তা হলে প্রতীক্ষায় আছে অদূরেই
সংস্কৃত শ্লোক?
পাপ ও দুঃখের কথা ছাড়া আর এই অবেলায়
কিছুই মনে পড়ে না।’
কবি এবার নিশ্চিত, এই অনির্বাণ স্তবক, এই সমুদ্র-গভীর শব্দরাশি যুগপৎ তার এবং তার নয়। ‘ব্যক্তিগত জিরো আওয়ার’– নিখিলেশের কাছে এই নাস্তিক প্রার্থনার দিকে তাকিয়ে কবি বুঝতে পারে, ভগবানের সাধ্যি নেই এই প্রার্থনা মঞ্জুর করার। তাহলে কাঁচকলা কীসের ভগবান?
কবি আরও এক সত্যের সামনে। এ নেহাত ফেলনা সত্য নয়। রাতের ক্রমবর্ধিত জলতেষ্টার মতো এই সত্য কবিকে দেয় বুকফাটা যন্ত্রণা। কিন্তু বুকের মধ্যে এই তেষ্টার চারপাশে ঘিরে আছে আদিম অন্ধকার। কবি জলের কুঁজো খুঁজতে হাত বাড়ায়। হাত পড়ে প্রতি রাতে অন্ধকারে ইঁদুর কিংবা মূষিকের গায়ে। ফারাক কি আছে কিছু ইঁদুর-মূষিকে? আছে তো বটেই। ইঁদুর নেহাতই আটপৌরে ঘরোয়া বাংলা। মূষিক বিশুদ্ধ সংস্কৃত। আদি অন্ধকারে বুকফাটা জলতেষ্টা নিয়ে কবির জলসন্ধানী হাত প্রথমে ইঁদুরের গায়ে আঙুল ঠেকায়। ‘মূষিক’ শব্দটি জাগে তার মনে? কে নিয়ে এল এই শব্দ এবং সংস্কৃত শ্লোকের অনুষঙ্গ? মৃত্যুর সংস্কৃত মন্ত্র শুনতে পায় কবি। এবং কবি যে এবার জীবন প্রান্তে কর্ণের মতো। ক্রমশ স্মৃতিভ্রষ্ট। ‘পাপ ও দুঃখের কথা ছাড়া এই অবেলায় কিছুই মনে পড়ে না’ তার। বিদ্যুৎ ঝলকে কারও-কারও মনে পড়তে পারে মৃত্যু মুহূর্তের শার্ল বোদলেয়রকে, মায়ের কোলে মাথা রেখে মাকেও চিনতে পারছে না সেই ফরাসি কবি।
কিন্তু জীবনের শেষ অবেলায় কোন পাপ ও দুঃখের কথা মনে পড়ে বাঙালি কবির? এই অবিস্মরণীয় স্বীকারোক্তি তার:
‘আমার পূজা ও নারী-হত্যার ভিতরে
বেজে ওঠে সাইরেন। নিজের দুহাত যখন
নিজেদের ইচ্ছে মতন কাজ করে
যেন মনে হয় ওরা সত্যিকারের।
আজকাল আমার
নিজের চোখ দুটোও মনে হয় এক পলক
সত্যি চোখ। এরকম সত্য
পৃথিবীতে খুব বেশি নেই আর।’
………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার.ইন
………………………………………………
তরুণ কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর খুপরি ঘরে পাংশু লেখার টেবিলে কবিতাটি শেষ করে কলম বন্ধ করে। আপাতত খুব বেশি কি কিছু লেখার আছে তার? আর হয়তো না লিখলেও চলে, মনে হয় অনীশ কবির। সে গিয়ে দাঁড়ায় আবছা জানলার ধারে। কলকাতা শহরে সকাল না হতেই বড্ড বেশি উনুনের ধোঁয়া।
…………………….. পড়ুন কাঠখোদাই-এর অন্যান্য পর্ব ……………………
পর্ব ৩: টেবিলের গায়ে খোদাই-করা এক মৃত্যুহীন প্রেমের কবিতা
পর্ব ২: লেখার টেবিল ভয় দেখিয়েছিল টি এস এলিয়টকে
পর্ব ১: একটি দুর্গ ও অনেক দিনের পুরনো নির্জন এক টেবিল