ইডেনে গত ৫ নভেম্বরের ভারত বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা। খেলার পরদিন ইডেন কিউরেটরের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ভারতীয় টিমের কেউ গ্রাউন্ডসম্যানদের কিছু দিয়ে-টিয়ে গেলেন কি না? সে ম্যাচে বিরাট কোহলি ওয়ান ডে সেঞ্চুরি সংখ্যায় শচীন তেণ্ডুলকরকে ছুঁয়েছিলেন। ইডেনে নীল জার্সির প্রবল প্রতাপ দেখেছিল দেশ, দেখেছিল পরাক্রমী দক্ষিণ আফ্রিকার গো-হারা হেরে নতমস্তকে মাঠ ছাড়া। শহরের পূর্ব দীপাবলি আকাশ বাজিতে-বাজিতে ছেয়ে গিয়েছিল। আলো ফোটেনি কেবল মাঠকর্মী নামক জনা পনেরো ‘না-মানুষ’-এর জীবনে। ক্রিকেট-দীপাবলিতে গা ভাসানোর বদলে ওঁরা ফিরে গিয়েছিলেন তেলচিটে বিছানার, মশার কামড়ের বিলাসিতায়। না, কেউ কিছু দেননি ওঁদের। এক টাকা না। আইসিসিও দৃকপাত করেনি।
‘কেউ দেয় না রে, কেউ এখন আর একটা টাকা দেয় না। আমিও বলে দিয়েছি, কারও থেকে একটা পয়সা চাইবি না। ভালোবেসে কেউ দিলে আলাদা। কিন্তু কারও থেকে কিছু প্রত্যাশা করবি না। কিছু লাগলে আমায় বলবি। আমি যতটা পারব, করব।’
ইডেন গার্ডেন্সে যাঁদের নিত্য যাতায়াত আছে, সৌম্যকান্তি, দোহারা চেহারার এই ভদ্রলোককে এক ডাকে চিনবেন। সুজন মুখোপাধ্যায়। ইডেন গার্ডেন্স কিউরেটর। এককালে সিএবি যুগ্মসচিব ছিলেন। সময়ের নিয়মে পদের মেয়াদ ফুরিয়েছে ঠিকই। কিন্তু সুজনের মাঠের প্রতি ভালোবাসা ফুরোয়নি। বেঙ্গালুরু ছুটে, পিচ নিয়ে রীতিমতো পড়াশোনা করে, নতুন মাঠ সৃষ্টির দক্ষযজ্ঞে নেমে পড়েছিলেন ইডেনের দ্বিতীয় মুখুজ্জ্যেমশাই! পিচ। ঘাস। আউটফিল্ড। সব নতুন করে গড়েপিঠে নিতে হত। আসলে ইডেনের প্রথম মুখুজ্জ্যেমশাই যা যা রেখে গিয়েছিলেন, কিছুই আর রাখা চলত না। আধুনিকতাকে বরণ করতে হলে পুরাতন পরিত্যাগ করা ছাড়া আর উপায় কী?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও খেলাইডোস্কোপ: খণ্ড-অখণ্ড ভারতবর্ষ মিলিয়েও ক্রিকেটকে সম্মান জানাতে ইডেনতুল্য কোনও গ্যালারি নেই
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ইডেনের প্রথম মুখুজ্জ্যের সঙ্গে দ্বিতীয়-র অমিলই অধিক, তবু সাযুজ্যও রয়েছে জায়গায়-জায়গায়। প্রথম মুখুজ্জ্যে, ওরফে প্রয়াত কিউরেটর প্রবীর মুখোপাধ্যায় হুটহাট চটে যেতেন! সামান্য বেচাল দেখলে প্লেয়ারের নাকের ডগায় ক্রিকেট-আইনের বই দুলিয়ে মাঠ থেকে পত্রপাঠ বের করে দিতেন! সুজন অত রাগী নন। এ সমস্ত করেন না। কিন্তু প্রবীরের মতো তিনিও বিশ্বাস করেন, মাঠই মন্দির। মাঠই মসজিদ। মাঠই গির্জা। উপাসনার আপন আলয়। আর বিশ্বাস করেন, মাঠকর্মীরা তাঁর এক-একজন সন্তান। আত্মজ। মাঠকর্মীদের কেউ কিছু বললে, উপেক্ষা করলে, ছ্যাঁত করে লাগে সুজনের। গলা চড়তে থাকে। আর তখন তাঁকে অবিকল প্রথম মুখুজ্জ্যের মতো দেখায়!
দেখানোও উচিত। দিন-রাত্তির রোদে পোড়া, জলে ভেজা, মিশমিশে অবহেলার অবয়বদের মাথার ওপর আর আছেটা কে? তাঁদের নিয়ে আর ভাবে কে? অথচ কী আশ্চর্য, দিন শেষে ওঁদেরও খিদে পায়! ঘুম পায়। খাটতে-খাটতে ক্লান্ত লাগে। মাঝে-মাঝে আবার একটু সম্মানপ্রাপ্তির বাসনাও জাগে!
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও খেলাইডোস্কোপ: ২০২৩-এর আগে আর কোনও ক্রিকেট বিশ্বকাপ এমন ‘রাজনৈতিক’ ছিল না
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এই যে দেশে ঘটা করে ওয়ান ডে বিশ্বকাপের আসর বসল। দেড় মাস জুড়ে রোহিত শর্মার ভারত দাপিয়ে বেড়াল। নিয়মিত এ মাঠ-ও মাঠ, হিল্লি-দিল্লি করল। ফাইনাল খেলল। পিচ নিয়ে এত লেখালেখি হল। কিন্তু দেশজুড়ে বিশ্বকাপ কেন্দ্রের পিচ-আউটফিল্ডের নীরব দেখভাল-পরিচর্যা করে গেলেন যাঁরা, ক’টা শব্দ লেখা হল তাঁদের নিয়ে? ক’পয়সা পেলেন ওঁরা? ক’জন ভারতীয় ক্রিকেটার খেলা শেষে তাঁদের ক’টাকা দিয়ে গেলেন? হুঁ, সম্মান তাঁরা পেয়েছেন বটে। গত বিশ্বকাপে খেলা শেষে সেরা ফিল্ডারের পুরস্কার চালু করেছিল ভারত। যা নির্বাচন করতেন মাঠকর্মীরা। ফলাও করে তা নিয়ে কাগজে বিস্তর লেখালেখিও হয় সে সময়। কিন্তু সম্মান দেখিয়ে পেট চলে তো? ভারতীয় ক্রিকেটারদের সঙ্গে ছবি দেখালে মুদিখানা বিনাপয়সায় চাল দেবে তো?
দেবে না। আর তাই দেশে ক্রিকেট বিশ্বকাপের আতর যতই আসমুদ্রহিমাচলকে বিমোহিত করে ছাড়ুক, এঁদের ফুটো কপালে শেষে একটা জিনিসই জুটেছে। লবডঙ্কা।
লেখার শুরুতে সুজনের মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিত ইডেনে গত ৫ নভেম্বরের ভারত বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা। খেলার পরদিন ইডেন কিউরেটরের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ভারতীয় টিমের কেউ গ্রাউন্ডসম্যানদের কিছু দিয়ে-টিয়ে গেলেন কি না? সে ম্যাচে বিরাট কোহলি ওয়ান ডে সেঞ্চুরি সংখ্যায় শচীন তেণ্ডুলকরকে ছুঁয়েছিলেন। ইডেনে নীল জার্সির প্রবল প্রতাপ দেখেছিল দেশ, দেখেছিল পরাক্রমী দক্ষিণ আফ্রিকার গো-হারা হেরে নতমস্তকে মাঠ ছাড়া। শহরের পূর্ব দীপাবলি আকাশ বাজিতে-বাজিতে ছেয়ে গিয়েছিল। আলো ফোটেনি কেবল মাঠকর্মী নামক জনা পনেরো ‘না-মানুষ’-এর জীবনে। ক্রিকেট-দীপাবলিতে গা ভাসানোর বদলে ওঁরা ফিরে গিয়েছিলেন তেলচিটে বিছানার, মশার কামড়ের বিলাসিতায়। না, কেউ কিছু দেননি ওঁদের। এক টাকা না। আইসিসিও দৃকপাত করেনি।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও খেলাইডোস্কোপ: রোহিত শর্মার শৈশবের বাস্তুভিটে এখনও স্বপ্ন দেখা কমায়নি
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ভাবলে মনে অপার ঘৃণা ছাড়া কিছু আর জন্মায় না। ভারতীয় ক্রিকেটের দৌলতে আইসিসি-র কোষাগারে এখন হাজার-হাজার কোটি রক্ষিত। বিশ্বকাপের সময় ১৫-৩০ সেকেন্ডের বিজ্ঞাপনী স্লট ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ামক সংস্থা বিক্রি করেছে কোটি-কোটি টাকায়। ক্রিকেটারদের দিয়েছে কিছু, বাকিটা পাঠিয়েছে সংস্থার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দিয়েছে। পায়নি কিছু শুধু এ মানুষগুলো। খেলার মাঠ তৈরি করলেন যাঁরা, মাঠে খেলা হল যাঁদের জন্য। এঁরা তাই এখন অপেক্ষা করে আছন, কবে আসবে একটা আইপিএল? যা শেষে বোর্ড টাকা পাঠাবে। ভাল-মন্দ দুটো খাওয়া যাবে। এঁরা অপেক্ষা করে আছেন, মহম্মদ সিরাজের মতো কোনও মহানুভবের। যিনি ম্যাচ সেরার পুরস্কার তুলে দিয়ে যাবেন তাঁদের হাতে। শুনলাম, ইডেনে মাঠের কাজ করেন যাঁরা, তাঁদের এক-একজনের মাসিক আয় ১৫-১৬ হাজার। বলুন না, চলে তাতে? অথচ যতদূর জানি, সিএবির ফিক্সড ডিপোজিটে কোটি-কোটি মজুত! শুধু তাই নয়, প্রায়ই যে সেরা মাঠের পুরস্কার পায় ইডেন, তা থেকে প্রাপ্ত অর্থের এক-তৃতীয়াংশ পান এঁরা। বাকি দুই-তৃতীয়াংশ যায় ঠান্ডা এসি ঘরে বসে দিন গুজরান করা স্টাফদের! টাকা ছেড়ে দিন, ইডেনে খেলা পড়লে একটা টিকিটেও অধিকার নেই এঁদের! কোনও ‘কোটা’ নেই। নেহাত বর্তমান সিএবি প্রেসিডেন্ট স্নেহাশিস গঙ্গোপাধ্যায় বিশ্বকাপের সময় খেলা পিছু প্রত্যেক মাঠকর্মীকে একটা করে টিকিট দিয়েছিলেন বলে, এঁদের পরিবারের অন্তত একজন মাঠে এসে খেলা দেখতে পেরেছিলেন। নইলে তা-ও জুটত না।
আর দেখতে গেলে, দোষ এঁদেরই, আর কারও নয়, এঁদেরই। কে বলেছিল, রোদ-ঝড়-জল গায়ে না মেখে দিনের পর দিন মাঠে পড়ে থাকতে? কে বলেছিল, মাঠকে এতটা ভালোবাসতে? এ লেখার সঙ্গে তেমন সম্পর্কিত নয় হয়তো। কিন্তু দিন কয়েক আগের একটা খবর খেয়াল করেছেন নিশ্চয়ই। ইডেন গ্যালারিতে এক যুবকের আত্মহত্যার খবর। ইডেনের এক মাঠকর্মীর ছেলে। যিনি কি না বাবার মতো মাঠকর্মী হতে এসেছিলেন। কিন্তু শেষে গিয়ে চাকরিটা আর পাননি। কী করা যাবে, মাঠ বোঝা যে অত সহজ নয় যে। তার জন্য নির্দিষ্ট জ্ঞান লাগে। চাইলেই মাঠকর্মী হওয়া যায় না। কিন্তু যুবকের অবুঝ মন তা বোঝেনি হয়তো। এক্ষেত্রে দ্রষ্টব্য বিষয়, তাঁর চাকরি না পাওয়া নয়। দ্রষ্টব্য, তাঁর ভালোবাসা। খেলার মাঠের প্রতি ভালোবাসা। কাঠখড় পোড়ালে ১৫ হাজারের চাকরি জোগাড় করে ফেলা অসম্ভব নয় এখনও। কিন্তু যুবক সে চেষ্টাই করতে যাননি। আর তাই যা হওয়ার, এ দুনিয়ায় যা হওয়া স্বাভাবিক, তাই হচ্ছে। আসলে নরম মাটি কোপানো সহজ। লাঙলের সামনে সে কোনও প্রতিবাদ করে না। তাই তাকে কেউ আমলও দেয় না। মাঠকর্মীদের দশাও হয়েছে তাই। কী দায় পড়েছে আইসিসি-র তাঁদের নিয়ে ভাবতে? কী দায় পড়েছে ক্রিকেটারদের, তাঁদের একটু পয়সা দিতে?
ভালোবাসা পাগলপারা হলে যে বড় শস্তা হয়ে যায়!