Robbar

আমাকে দেখাও সেই বন্দিকক্ষ

Published by: Robbar Digital
  • Posted:June 29, 2024 6:28 pm
  • Updated:June 29, 2024 6:59 pm  

কারাবন্দি অমিয়র প্রতিবাদী চরিত্র কিন্তু অটুট ছিল। অন্যায় দেখলেই রুখে দাঁড়াতেন, পালটা মার দিতেও কসুর করতেন না। জেল কর্তৃপক্ষের চোখে বিষ হয়ে উঠতে সময় লাগেনি মোটে। অমিয়র বউদি জেলে জেতেন দেখা করতে, গোপনে পার্টির চিঠি পৌঁছে দিতেন, নিয়েও আসতেন। তাঁকেই অমিয় বলেছিলেন, “মনে হচ্ছে আমাদের মেরে ফেলবে। আর মারলে আমাকেই আগে মারবে।” জেলের ডাক্তার খুব ভালোবাসতেন অমিয়কে। বারবার চেষ্টা করেছিলেন জেল হাসপাতালে তাঁকে সরিয়ে নিতে। কিন্তু সহযোদ্ধাদের ছেড়ে অমিয় নিজের নিরাপত্তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

শুদ্ধব্রত দেব

১৯.  

অমিয় চট্টোপাধ্যায়। ভারত

 

আমাকে দেখাও সেই দুঃখের নীল নদী

আমাকে দেখাও সেই ভীত হরিণটি

আমাকে দেখাও সেই গভীর অরণ্য

আমি তোমাকে দেখাব সূর্য ওঠার সময়। 

বেহালার ছেলে অমিয় সাগর নামেও পরিচিত ছিলেন। সাগরের মতোই চওড়া মনের এই তরুণটি তাঁর এলাকায় অসম্ভব জনপ্রিয়। জেদি ও খামখেয়ালি ছিলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে বলা দরকার মনে হয়েছিল বলে মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে বসে গল্প করতে করতে আচমকা সিদ্ধান্ত নিয়ে নির্দল প্রার্থী হয়ে পুরসভা নির্বাচনে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন (যদিও জানতে পেরে সিপিএম তড়িঘড়ি নিজেদের প্রার্থী তুলে নেয়)। জিতেও ছিলেন বিপুল ভোটে– সাউথ সাব-আরবান মিউনিসিপ্যালিটিতে সর্বকনিষ্ঠ এই পুরপিতার বয়স তখন ২৩! কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতি নয়, তাঁকে টেনেছিল ক্ষমতা-দখলের রাজনীতি।

সত্তরের বিদ্রোহী যৌবন: ল্যুই ম্যালের তথ্যচিত্রে

চারুচন্দ্র কলেজে পড়তেন। নিউ আলিপুর কলেজে ছাত্র ভর্তি করতে গিয়ে চিনলেন ছাত্র ইউনিয়নের সংগঠক মীনা দাশকে। সেই প্রথম দেখা। মীনা স্মৃতিচারণ করছেন, “আলিপুর কলেজের জেনারেল সেক্রেটারী ছিলাম। উনি ছাত্র ভর্তির ব্যাপারে এসেছিলেন। যখন জানলাম কাউন্সিলর তখন ভর্তির ব্যবস্থা করা হয়। কলেজে থাকাকালীনই আমি অনন্ত সিংহের দলে ভিড়ে যাই। আসলে তখন খুঁজে বেড়াচ্ছি কোন পথে এগোব। MMG গ্রুপও (আসল নাম ‘রেভল্যুশনারি কম্যুনিস্ট কাউন্সিল অভ ইন্ডিয়া’) জনপ্রিয় লোকেদের নিজেদের দলে আনতে চাইত। সেখানে আবার অমিয় চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। বিভিন্ন আলোচনা, মিটিং হতো, একসাথে বিভিন্ন জায়গায় যেতাম।

দু-ভাই ছিলেন ওঁরা; মা, বৌদি। বাবা মারা গেছেন। ভাগের বাড়ি। দাদা কাজ করতেন জে স্টোন ফ্যাক্টরিতে (অমিয় নিজেও তিন বছর কারখানায় শ্রমিক ছিলেন– মূলত রং করার কাজ করেছেন)। সেই আয়ে কষ্টে চলত সংসার। বাড়িতে বেশি থাকতেন না। কিন্তু বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ভাল ছিল। সাধারণ মানুষ খুব ভালবাসত। কেউ চিকিৎসা করাতে পারছে না, উনি চললেন; কেউ মেয়ের বিয়ে দিতে পারছে না, উনি লেগে পড়লেন। এছাড়া বস্তি উন্নয়ন ইত্যাদি কাজে ব্যস্ত থাকতেন। একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যে। লোকে এতটাই ভালবাসত যে পাড়ার এক পুলিশ গোপন খবরাখবর দিয়ে যেতেন।

MMG মাস লীডারদের তুলে এনে আইসোলেট করে রেখে দিত, যাতে পুলিশ ধরতে না পারে। অমিয়কে রেখেছিল একটা বোর্ডিং-এ; আমাকে একটা হস্টেলে, আমাদের আত্মত্যাগের কথা বলত, বলত সুইসাইড স্কোয়াড তৈরীর কথা। এরপর অনন্ত সিংহের সঙ্গে কনট্রাডিকশন হয় আমাদের কয়েকজনের। আমরা বলেছিলাম গ্রাম দিয়েই শহর ঘিরতে হবে। শুধু শহরে আপসার্জ হলে হবে না। এই ব্যাপারে অমিয় চ্যাটার্জি একটা ভালো ভূমিকা নিয়েছিলেন। ওই দল আমরা ছেড়ে দিলাম। (এরপর তাঁরা দু-জনেই সিপিআই (এমএল)-এ যুক্ত হয়ে পড়েন।

১৯৬৮-তেই বিয়ে হয় আমাদের৷ দাদা ব্যবস্থা করেছিলেন। রেজিষ্ট্রি ইত্যাদি হয়নি। কমলেশ সেনরা ক-জন বন্ধুবান্ধব ছিলেন। বিয়ের তিন চার দিন পর গ্রামে চলে যাই– বিহারের চক্রধরপুরের পাশে এক সাঁওতাল গ্রামে। ওখানে দেখেছি কৃষকদের সঙ্গে মিশে যেতে।”

‘এ-সবুজ কঙ্কন খুলে নিতে আসবে

তোমার বুকের কাপড় ছিঁড়ে ফেলবে

ক্ষুধা তৃষ্ণা হাহাকার

তখন তুমি বন্দুক তুলো।’

আরো বলেছিলে:

‘তুমি মানুষ

সেই হবে তোমার সুন্দরতম বিস্ফোরণ’

পুরুলিয়ার গ্রামাঞ্চল থেকেই ধরা পড়েছিলেন। মীনাও ধরা পড়েছিলেন একই সময়ে, শহরে ফেরার পথে। মীনার বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি, তিনি আটমাস বাদে ছাড়া পান। অমিয়কে নিয়ে আসা হয় আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। মীনা আন্ডারগ্রাউন্ড জীবনে ফিরে যান।

 

আলিপুর সেন্ট্রাল জেল

কারাবন্দি অমিয়র প্রতিবাদের ঝাঁজ কিন্তু মিইয়ে যায়নি। অন্যায় দেখলেই রুখে দাঁড়াতেন, পালটা মার দিতেও কসুর করতেন না। জেল কর্তৃপক্ষের চোখে বিষ হয়ে উঠতে সময় লাগেনি মোটে। অমিয়র বউদি জেলে যেতেন দেখা করতে, গোপনে পার্টির চিঠি পৌঁছে দিতেন, নিয়েও আসতেন। তাঁকেই অমিয় বলেছিলেন, ‘মনে হচ্ছে আমাদের মেরে ফেলবে। আর মারলে আমাকেই আগে মারবে।’ জেলের ডাক্তার খুব ভালোবাসতেন অমিয়কে। বারবার চেষ্টা করেছিলেন জেল হাসপাতালে তাঁকে সরিয়ে নিতে। কিন্তু সহযোদ্ধাদের ছেড়ে অমিয় নিজের নিরাপত্তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর। জেলে তাঁর সহবন্দি অতুলন ভট্টাচার্য বলছেন– “২৬শে নভেম্বরের কিছুদিন আগেই আমরা টের পেয়েছিলাম যে আমাদের উপর আক্রমণ নেমে আসছে। জেলকর্মীদের মধ্যে বেশ কয়েকজন আমাদের সহমর্মী ছিল। ওদের হাত ঘুরেই কাগজ, চিঠিপত্র, পত্র-পত্রিকা আমরা পেতাম। ওরাই আমাদের খবর দেয় যে নকশালদের বেশ কয়েকজনকে মেরে ফেলার লিস্ট তৈরী হয়েছে। ঘটনার আগের দিন অর্থাৎ ২৫শে নভেম্বর সন্ধ্যার দিকে লকআপ বন্ধ করার আগে একটা গণ্ডগোল পাকানোর চেষ্টা করে। কিন্তু আমরা আগেই গোপন সার্কুলার দিয়েছিলাম। ফলে কেউই প্ররোচনায় পা দেয়নি। ২৬ তারিখ সকালে নাস্তার পরে হঠাৎই জেল কর্তৃপক্ষের পেটোয়া কিছু কুখ্যাত কয়েদি আমাদের অশ্রাব্য গালাগালি দিতে আরম্ভ করে। ওরা নেশা করে তৈরীই ছিল। রড, লাঠি নিয়ে আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। একেবারে বিনা কারণে, এই ছুতোতে কর্তৃপক্ষ ‘পাগলী’ অর্থাৎ পাগলা ঘণ্টা বাজিয়ে দেয়। তখন পুলিশও নেমে পড়ে এই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডে। অমিয়দের সেলের উপরেই বেশি আক্রমণ করে। যারা সেদিন মারা যায় সবাই-ই ওদের সেলের। আমাদেরও মারতে শুরু করে। তখন তিন-চার জন মিলে এক-এক জনকে টার্গেট করে মারছে। চারদিকে বীভৎস চিৎকার চেঁচামেচি। আশপাশের বাড়ি থেকে লোকজন দেখেছে দিনদুপুরে খোলা আকাশের নীচে জেলের চৌহদ্দির মধ্যে অসহায় অপ্রস্তুত সব তরুণদের পুলিশ আর কুখ্যাত কয়েদিরা মারছে। তাতেও ওরা থামেনি। আহতদের সংলগ্ন জেল হাসপাতালে তুলে নিয়ে যায়। সেখানে বেছে বেছে যাদের মেরে ফেলতে হবে তাদের শেষ অবধি মেরে গেছে। কিছু ডাক্তার আর হাসপাতালকর্মীও এই হত্যালীলায় অংশ নেয়। তবে বিপরীতে কিছু ডাক্তার আমাদের সাহায্যও করেছিল। অচৈতন্য দেহ লুকিয়ে ফেলেছিল। না হলে হত্যার সংখ্যা আরও বাড়ত। যতদূর মনে পড়ছে অমিয়-সহ সবাইকেই হাসপাতালেই মেরে ফেলা হয়।”

অমিয়কে মারা সবচেয়ে জরুরি ছিল বোধহয়। জেল হাসপাতালের সামনে তাঁর সংজ্ঞাহীন শরীরটাকে ফেলে গলায় বাঁশ রেখে, তাতে দু-দিকে চারজন উঠে নেচে নেচে চাপ দিয়ে তাঁর মৃত্যু– না কি তাঁর অমরত্ব– নিশ্চিত করা হয়।

মীনা লড়াইয়ে থেকে যান। তাঁর স্মৃতিতে অটুট থাকেন অমিয়। “ভারি ভালো চেহারা ছিল। এই চেহারার জন্য MMG গ্রুপে সবাই ‘পাঠান’ বলে ডাকত। খুব আবেগপ্রবণ, উদাসীন ধরনের মানুষ ছিলেন। কবিতা লিখতেন। বিয়ে হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সংসার করার বা পারিবারিক জীবনের বাসনা আমাদের ছিল না।… মারা যাওয়ার আগে শুনেছি প্রলয়েশকে বলেছিলেন, ‘আমি বোধহয় বাঁচব না। দেখো, কাজ যেন এগোয়।’ মৃত্যুর পর ওঁর দাদা, মা আমাকে নিয়ে যেতে এসেছিলেন। আমি এইসব কাজেই থাকব বলে আর ফিরে যাইনি।”

আমাকে দেখাও সেই বন্দিকক্ষ

আমাকে দেখাও সেই বন্দিকে

আমাকে দেখাও সেই লোহার গরাদ

আমি তোমাকে দেখাব এক যুবককে

         তার কারণ অনেক আছে। 

পুনশ্চ: অমিয় চট্টোপাধ্যায় ছাড়াও আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে ২৬ নভেম্বর শহিদ হয়েছিলেন—

  • নিমাই দাস
  • রাজকুমার বৈদ্য
  • গৌর দাস
  • সহোদর বৈদ্য
  • নীরজউদ্দিন ঘরামি
  • স্বপন (পদবি জানা নেই)
  • অজ্ঞাত আরেকজন

……………………………………………………..

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল

……………………………………………………..

ঋণস্বীকার

১) এবং জলার্ক: সত্তরের শহীদ লেখক শিল্পী; ২) সত্তরের শহীদ; ৩) বর্শামুখ প্রকাশিত ‘মুঠোয় যে সূর্য’। এটিই অমিয় চট্টোপাধ্যায়ের একমাত্র কবিতা-সংকলন।

গ্রাফিক ও ছবি-সংশোধন– এষা।

 

…পড়ুন কবি ও বধ্যভূমি

পর্ব ১৮: কতটা দীর্ঘ হলে জনযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়? (২য়)

পর্ব ১৭: কতটা দীর্ঘ হলে জনযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়? (১ম)

পর্ব ১৬: পারো যদি বজ্র হয়ে এসো

পর্ব ১৫: কামানের মুখে কলহাস্যে এ কী ভালোবাসা!

পর্ব ১৪: গান্ধিনগরে রাত্রি

পর্ব ১৩: সিলারের পাপড়ি অথবা একজন পেশমেরগার মৃত্যু

পর্ব ১২: ডানার পালকে সূর্যকে নিয়ে…

পর্ব ১১: প্রিয় কমরেড, এসো একসাথে মরি

পর্ব ১০: প্রাণভিক্ষা? বেছে নিই মৃত্যুর অহংকার বরং!

পর্ব ৯: তিমিরের অন্তে যদি তিমিরবিনাশ

পর্ব ৮: অক্সিজেন মৃতদের জন্য নয়!

পর্ব ৭: আকাশে তারারা জ্বলছে, ফ্যলাস্তিনকে ভয় দেখিও না!

পর্ব ৬: কোথায় লুকোবে কালো কোকিলের লাশ? 

পর্ব ৫: আমার দুঃখের কথা কি পাথরকে বলব?

পর্ব ৪: আমি সেই মেয়ে, যে আর ফিরবে না

পর্ব ৩: আমাকে পোড়াতে পারো, আমার কবিতাকে নয়!

পর্ব ২: এস্তাদিও চিলে আর চল্লিশটা বুলেটের ক্ষত

পর্ব ১: বিপ্লব, প্রেম ও কবিতাকে আমৃত্যু আগলে রেখেছিলেন দ্রোণাচার্য ঘোষ