১৯৪৬-এর নোয়াখালি দাঙ্গার সময় থেকেই হিন্দু পরিবারগুলি ধীরে ধীরে পূর্ব বাংলা ছেড়ে পশ্চিমে চলে আসা শুরু করেন। এবং এই চলাচল দেশভাগের পরের প্রায় আড়াই দশক ধরে চলেছিল। দেশভাগের পরপরই কলকাতা শহরের জনবিন্যাসে বিপুল পরিবর্তন হয়। হিন্দু রিফিউজি পরিবারগুলি শহরের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয়ের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। যাঁদের কিছু পূর্ব পরিচিত আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব এপারে ছিল, তাঁরা ঠাঁই নেন সেইসব পরিবারে। যাঁদের কিছু পুঁজি ছিল তাঁরা একত্রিত হয়ে গড়ে তোলেন বিভিন্ন কলোনি– উত্তর আর দক্ষিণ শহরতলিতে।
১৯৫১ সালের সেন্সাস রিপোর্টে উল্লেখ করা হয় যে, সুকিয়া স্ট্রিট, কলুটোলা, ফেনউইক বাজার, মানিকতলা, বেলেঘাটা, বেলগাছিয়া আর কাশীপুরের মতো ওয়ার্ডগুলিতে ১৯৫০এর দাঙ্গার আগে হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষেরই বাস ছিল। দাঙ্গার সময়ে লোকজন প্রাণভয়ে এলাকা ছেড়ে পালায়, বস্তিগুলি ফাঁকা হয়ে যায়। ’৫০-এর ডিসেম্বর থেকে ’৫১-র মার্চের মধ্যে এই অঞ্চলের বেশিরভাগ জায়গায়ই ভরে ওঠে পূর্ব বাংলা থেকে আসা হিন্দু শরণার্থীদের ভিড়ে। মুসলমানরা কলকাতা ও হাওড়ার অন্য কিছু জায়গায় সরে যায়। দাঙ্গা পরবর্তী শান্তি স্থাপিত হয় মিশ্র এলাকা নির্মূল করে, সম্প্রদায় ধরে নির্দিষ্ট অঞ্চল তৈরি করে। শহরের এই চরিত্র বদলের ঘটনা কোনও বিচ্ছিন্ন, একমাত্র উদাহরণ নয়।
বিশ শতকের গোড়ার দশক থেকেই নানা বিক্ষিপ্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও চাপা উত্তেজনা কলকাতার জনপরিসরে ছাপ ফেলেছিল। মুসলমান-প্রধান বাংলা প্রদেশে কলকাতা ছিল হিন্দু-প্রধান শহর। জাতীয় ও প্রাদেশিক রাজনীতির জটিলতা, ১৯৪৬-এর আগস্ট মাসের ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ থেকে শুরু করে দেশভাগ-পরবর্তী বেশ কয়েক বছর সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা কলকাতার নগর-জীবনকে বিপর্যস্ত করেছিল।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
তবে শুধু বস্তি নিয়েই চিন্তিত ছিলেন না সি.আই.টির চেয়ারম্যান। তাঁর কাছে মধ্য ও দক্ষিণ কলকাতায় বাড়তে থাকা বহুতল বাড়ির সংখ্যাও সমস্যাজনক ছিল। যে কোনও বহুতল বাড়িই সেই এলাকার জনবসতির ঘনত্ব বাড়িয়ে দেয়। একসঙ্গে বহু লোক একটা জায়গায় জড়ো হলে নগর প্রশাসনের বিশেষ চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নগর-পরিকল্পনা ও সুষ্ঠু নাগরিক পরিষেবা বজায় রাখার ক্ষেত্রে এই বহুতল বাড়ি বিশেষ সমস্যার ছিল। কিন্তু বিশ শতকে দুনিয়া জুড়েই শহুরে নাগরিকের সংখ্যা বাড়তে থাকলে অফিস-কাছাড়ি বা বসবাসের জন্য স্কাইস্ক্র্যাপার, অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাট অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। কলকাতার সীমানা যেমন বাড়তে থাকে ১৯২০-’৩০-এর দশক থেকে, তেমনই শহর ‘খাড়াখাড়ি’ বেড়ে চলে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
১৯৪৬-এর নোয়াখালি দাঙ্গার সময় থেকেই হিন্দু পরিবারগুলি ধীরে ধীরে পূর্ব বাংলা ছেড়ে পশ্চিমে চলে আসা শুরু করেন। এবং এই চলাচল দেশভাগের পরের প্রায় আড়াই দশক ধরে চলেছিল। দেশভাগের পরপরই কলকাতা শহরের জনবিন্যাসে বিপুল পরিবর্তন হয়। হিন্দু রিফিউজি পরিবারগুলি শহরের বিভিন্ন স্থানে আশ্রয়ের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। যাঁদের কিছু পূর্ব পরিচিত আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব এপারে ছিল, তাঁরা ঠাঁই নেন সেইসব পরিবারে। যাঁদের কিছু পুঁজি ছিল তাঁরা একত্রিত হয়ে গড়ে তোলেন বিভিন্ন কলোনি– উত্তর আর দক্ষিণ শহরতলিতে। এরকম বেশ কিছু ক্ষেত্রে এলাকার মুসলমান বাসিন্দাদের সঙ্গে হিন্দু উদ্বাস্তুদের হাতাহাতি, জমির লড়াই, বা দৈনন্দিন উত্তেজনা এই অঞ্চলগুলির চরিত্র বদলে দেয় ১৯৫০-এর দশক থেকে। দক্ষিণ কলকাতার সেলিমপুরে একশো বছরের পুরনো মুসলমান কবরস্থান ধীরে ধীরে দখল করে নেয় হিন্দুরা। সাম্প্রদায়িক আবহাওয়া পুরনো বাসিন্দাদের ভীত করে, তাঁরা এলাকা ছেড়ে চলে যান অন্যত্র।
অন্যদিকে, নিতান্ত হতদরিদ্র রিফিউজিরা সরকারের মুখাপেক্ষী ছিলেন– বাধ্য হয়েছিলেন ক্যাম্পে যেতে, বা দিনের পর দিন শিয়ালদহ স্টেশনে রাত কাটাতে। উদ্বাস্তু মানুষজনের বেশিরভাগই কলকাতা বা তার আশপাশে থাকার চেষ্টা করতেন, কারণ তাতে চাকরি বা লেখাপড়ার সুযোগ বেশি। অন্যদিকে সরকারের মাথাব্যথা ছিল যে কী করে শহরের পরিকাঠামোর ওপর এই বিপুল চাপ কমানো যায়। আন্দামান বা দণ্ডকারণ্যে বাঙালি উদ্বাস্তুদের পাঠানোর নীতি খুব একটা জনপ্রিয় বা সফল হয়নি।
কলকাতার থেকে খানিক দূরে কল্যাণী বা দুর্গাপুরের (আর খানিক পরে সল্ট লেক) মতো জায়গায় নতুন শহর তৈরি করার প্রয়াস নেওয়া হয়। কলকাতার আশেপাশের জমির দামও হু হু করে বাড়তে শুরু করে। আর শুধু যে পূর্ব বাংলা থেকে বাস্তুহারা মানুষদের ভিড় ছিল শহরে তা নয়, বরং অনেকসময়েই অন্য রাজ্য থেকে কাজের খোঁজে আসা লোকের সংখ্যা ছিল বেশি। এই সবের সম্মিলিত ফল ছিল নাগরিক পরিষেবার ওপর অবিশ্বাস্য চাপ। সি.আই.টি এবং কলকাতা কর্পোরেশনের কর্তাব্যক্তিরা এই নিয়ে নানা চিন্তাভাবনা করতে বাধ্য হন। ১৯৫৮-’৫৯ সালে স্টেট স্ট্যাটিস্টিক্যাল ব্যুরোর একটি সার্ভে অনুযায়ী, কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার ৩০ লক্ষ মানুষের মধ্যে প্রায় ৭ লক্ষ বস্তিবাসী ছিলেন, ১৭০০ একর জমি জুড়ে। এই পরিসংখ্যানকে সি.আই.টি-র চেয়ারম্যান শৈবাল গুপ্ত ব্যাখ্যা করে বললেন যে, দেখা যাচ্ছে কলকাতার ২৫ শতাংশ মানুষ শহরের জমির ১/১৪ অঞ্চল অর্থাৎ ৭ শতাংশ এলাকায় বাস করেন। মানে, একর প্রতি ৪০০ লোকের উপস্থিতি! কিন্তু এঁরা প্রত্যেকেই যে গরিব দুঃস্থ ছিলেন, তা নয়। শৈবাল গুপ্তের মতে, অনেক বস্তিবাসীই আসলে ছিলেন, ‘মধ্যবিত্ত সংস্কৃতির কিন্তু নিম্ন মধ্যবিত্ত আয়ের’ মানুষ। জমি-বাড়ির অবিশ্বাস্য দাম আর সংকটের ফলে তাঁরা বাধ্য হয়েছেন বস্তি-জীবন বেছে নিতে।
স্বাভাবিকভাবেই এই বস্তিগুলিতে নিকাশি ব্যবস্থা, জল সরবরাহ ব্যবস্থা, বা রাস্তাঘাটের অবস্থা ভালো ছিল না। অনেকসময়েই রাস্তা দখল করে নতুন নতুন ঘর বানিয়ে নেওয়া হত। এই বস্তি অঞ্চলে জমি-বাড়ির মালিকানা কার, এবং কে ভাড়াটে, কাকেই বা সে মাসান্তে ঘর ভাড়া দিচ্ছে– এইসব জটিল অথচ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরকারের কাছে থাকত না। ফলে এগুলো ভেঙে নতুন বাড়ি বানানো প্রায় অসম্ভব ছিল। তবুও বিভিন্ন সময়ে নতুন নতুন ‘গৃহ নির্মাণ প্রকল্প’ চালু করা হত শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা থেকে বস্তি সরানোর জন্য, কিন্তু পুরো শহরকে বস্তি-মুক্ত করা ১০০ বছরেও সম্ভব নয় বলে মনে করতেন সরকারি কর্তারা। শৈবাল গুপ্ত লিখছেন, সব বস্তি সরানো একটা অবাস্তব ভাবনা; বরং দেখা উচিত যে কোন কোন বস্তি খানিক হলেও বসবাসের উপযুক্ত, আর কোনগুলির অবস্থা বেশ খারাপ। এই ভাগ করার পর প্রথমগুলিকে আরও খানিক উন্নত করার দিকে নজর দেওয়া উচিত, আর দ্বিতীয় ভাগের বস্তিগুলোকে সরিয়ে নতুন করে গড়ে তোলা দরকার। কিন্তু এই অনুযায়ী নীতি নির্ধারণ করে রূপায়ণে প্রচুর টাকা আর অনেক সময় প্রয়োজন, যা সরকারের কাছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থাকত না। ফলে নানা জোড়াতালি দেওয়া সমাধান দিয়েই খাপছাড়া কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে এসেছে বছরের পর বছর।
তবে শুধু বস্তি নিয়েই চিন্তিত ছিলেন না সি.আই.টির চেয়ারম্যান। তাঁর কাছে মধ্য ও দক্ষিণ কলকাতায় বাড়তে থাকা বহুতল বাড়ির সংখ্যাও সমস্যাজনক ছিল। যে কোনও বহুতল বাড়িই সেই এলাকার জনবসতির ঘনত্ব বাড়িয়ে দেয়। একসঙ্গে বহু লোক একটা জায়গায় জড়ো হলে নগর প্রশাসনের বিশেষ চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নগর-পরিকল্পনা ও সুষ্ঠু নাগরিক পরিষেবা বজায় রাখার ক্ষেত্রে এই বহুতল বাড়ি বিশেষ সমস্যার ছিল। কিন্তু বিশ শতকে দুনিয়া জুড়েই শহুরে নাগরিকের সংখ্যা বাড়তে থাকলে অফিস-কাছাড়ি বা বসবাসের জন্য স্কাইস্ক্র্যাপার, অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাট অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। কলকাতার সীমানা যেমন বাড়তে থাকে ১৯২০-’৩০-এর দশক থেকে, তেমনই শহর ‘খাড়াখাড়ি’ বেড়ে চলে। দেশভাগের পর কলোনি এলাকা তৈরি হয়, কলকাতার এক নতুন চেহারা তাতে প্রকাশ পায়। একইসঙ্গে শহরের মানচিত্রে যোগ হয় বহুতল আবাসন। শৈবালবাবুর মনে হয়েছিল যে, মধ্যবিত্তের গৃহ সমস্যা মেটাতে গিয়ে নাগরিক পরিকাঠামোর উপর অভাবনীয় চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করবে কলকাতায় ফ্ল্যাট বাড়ির বাড়বাড়ন্ত।
বিশ শতকের দ্বিতীয় অর্ধে কলকাতাকে ‘আর্বান ডিসাস্টার’ বলে অভিহিত করেন বেশ কিছু গবেষক। হু হু করে বাড়তে থাকা জনসংখ্যা, বেকারত্ব, আর শহর এলাকার ঘন জনবসতি কলকাতার নাগরিক পরিষেবাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। প্রশাসন নানা চেষ্টা করেও এর প্রতিকার বিশেষ করে উঠতে পারেনি। রাজনৈতিক আন্দোলন, রিফিউজি সমস্যা, ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদ আন্দোলন, শিক্ষকদের অবস্থান, খাদ্য সংকট– সব মিলিয়ে যেন কলকাতার নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা! প্রশাসকের ‘আদর্শ শহর’ আর সাধারণ মানুষের ‘শহরের অধিকার’-এর চিরকালীন দ্বন্দ্ব কলকাতাকে দীর্ণ করে দেয় এই কয়েক দশক। উনিশ শতকের বিভিন্ন টানাপড়েন, নগর পরিকল্পনার নানা ঔপনিবেশিক ধ্যান-ধারণা ছাপিয়ে গণতান্ত্রিক এক সদ্য-স্বাধীন রাষ্ট্রের জনগণের সঙ্গে প্রশাসনের বোঝাপড়ার সাক্ষ্য বহন করে পঞ্চাশ-ষাটের কলকাতা। এর কয়েক বছরের মধ্যেই ‘মিছিলের শহর’ বা ‘মুমূর্ষু নগরী’র মতো আখ্যা জুটবে তিলোত্তমার কপালে।
একুশ শতকে পড়েছি আমরা। নব্য-উদারনৈতিক অর্থনীতির ঢেউ এসে লেগেছে শহরের গায়ে। বহিরঙ্গে বেশ কিছু বদল ঘটে গেছে গত ৩০ বছরে। ‘মুমূর্ষু নগরী’ যে নয় কলকাতা, সে আমরা মানি। কিন্তু একটু তলিয়ে ভাবলে দেখা যাবে যে, উনিশ-বিশ শতকের নগর-পরিকল্পনার রেশ, শ্রেণি বৈষম্য, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, বা পুঁজির গতিবিধি কীভাবে এখনও আমাদের শহরকে চালিত করছে। কীভাবে শহরের বিশেষ কিছু অঞ্চলকে চিহ্নিত করা হয় অনুন্নত, অস্বাস্থ্যকর, বা বিপজ্জনক বলে; কীভাবে আমরা নতুন নতুন নজরদারি ব্যবস্থা প্রবর্তন করে চলেছি প্রতিনিয়ত; আর কীভাবে নিরাপত্তার নামে মানুষের শ্রেণিগত, জাতিগত, বা ধর্মীয় পরিচিতিকে উপলক্ষ করে সামাজিক বিপর্যয় ঘটিয়ে চলেছি, প্রতিদিন।
…কলিকথার অন্যান্য পর্ব…
প্রথম পর্ব: চেনা কলকাতাকে না পাল্টেই বদল সম্ভব, পথ দেখাতে পারে একটি বাতিল রিপোর্ট
দ্বিতীয় পর্ব: ‘জল’ যেভাবে ‘জমি’ হল এ কলকাতায়
তৃতীয় পর্ব: ঔপনিবেশিক কলকাতায় হোয়াইট টাউন-ব্ল্যাক টাউনের মধ্যে কোনও অলঙ্ঘনীয় সীমানা
চতুর্থ পর্ব: ঔপনিবেশিক নগর পরিকল্পনার বিরুদ্ধ মত প্রকাশ পেয়েছিল যখন প্লেগ ছড়াচ্ছিল কলকাতায়
পঞ্চম পর্ব: কলকাতা শহর পরিকল্পনাহীনভাবে বেড়ে উঠেছে, একথার কোনও বিশেষ ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই