পাপে পৃথিবীর ইমেন্স ইন্টারেস্ট। সাহিত্য-দর্শন, শিল্পের সমস্ত ধারা– সব কিছুর সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে অন্যায়। তুমি যাকে পাপ বলছ। বৈষ্ণব পদাবলি ভাবো, অবৈধ প্রেমের তো সোনালি ফসল বৈষ্ণব পদাবলি। আর প্রেম মানে তা অসতীর স্তনমর্দন। যে-মর্দনের জন্য কুঞ্জবনের আড়ালে অপেক্ষা করছে প্রেমিকের দু’টি আগ্রহী হাত!
২৮.
জ্ঞানদার ক্রমশ মনে হচ্ছে, তার নতুনকে বুঝি ভূতে পেয়েছে! ঘাড়ে ভূত না চাপলে সদ্য বিবাহিত জ্যোতি এমন কাজ করবে কেন? জ্যোতিরিন্দ্র সারাক্ষণ লিখছে কিংবা পড়ছে। কিংবা পিয়ানোতে নতুন নতুন সুর ভাঁজছে। জ্ঞানদার মনে হয়, এইসব কথাহীন সুর এক নিঃসঙ্গ মানুষের হৃদয়ের কান্না। এই কান্না কেউ কি বোঝে এই বাড়িতে? তার নতুনের এই কথাহীন কান্না জ্ঞানদা বুকের মধ্যে সারাক্ষণ সব কাজের মধ্যেও নিবিড় করে জড়িয়ে থাকে।
হঠাৎ দুপুরবেলা জ্যোতি ঝড়ের মতো ঢুকল জ্ঞানদার ঘরে। দরজা ভেজানো ছিল। কিন্তু ছিটকিনি তোলা ছিল না। নতুন কখনও দরজায় শব্দ না করে এ-ঘরে আসে না। আজ এল। এই প্রথম।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
থিওথ্যানাটোলজি। এই দর্শনে বিশ্বাস করলে দ্য হোল অফ আওয়ার কনভেনশানাল মোর্যালিটি ইজ বাউন্ড টু কোল্যাপ্স। ভেবে দেখো, পৃথিবী জুড়ে এত যে প্রেমের বই, প্রেমের কবিতা থেকে প্রেমের চিঠি– সবই তো অবৈধ প্রেম। অসতীর কথা। বিবাহিত নারী-পুরুষের প্রেম নিয়ে ক’টা লেখা আছে সারা জগতে?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
জ্ঞানদা ধড়মড় করে উঠে বসল! আঁচল পড়ে গেল। খোঁপা-খোলা এলো চুল। পাতলা সেমিজের তলায় তার সবে-সন্তান-হওয়া ভরা বুক। জ্ঞানদা সব জানে। তবু সে এই আলো আড়াল করল না। সে শুধু হেসে বলল, ‘এমন উদ্ভ্রান্তের মতো ঢুকে এলে কী বার্তা নিয়ে? নতুন বউ ঘর থেকে তাড়িয়ে দিল না কি?’
‘তার থেকে অনেক ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে!’ বলল জ্যোতিরিন্দ্র।
জ্ঞানদা দেখল, নতুনের দৃষ্টি থেকে ঝরে পড়ছে অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তির ঝলক– তার রূপ দু’টির ওপর। একই সঙ্গে কেঁপে উঠল তৃষ্ণা ও আহ্বানের শিখা জ্ঞানদার নিহিত বহতায়।
জ্ঞানদার মুখে শুধু একটি শব্দ, ‘তাই!’
‘হ্যাঁ বউঠান, আমি আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছি!’
‘এই বয়সে তোমার এত বড় সর্বনাশ কে করল ঠাকুরপো?’ বলল জ্ঞানদা। তারপর টিপ্পুনি কেটে এই উক্তি: ‘এ তো তোমার নতুন বিয়ের পাকাধানে মই দেওয়া গো? একদিকে কাদম্বরী। অন্যদিকে আদি ব্রাহ্মসমাজ। সামলাবে কী করে?’
‘তাই তো তোমার কাছে ছুটে এলাম। তবে সমস্যাটা তুমি যেভাবে দেখছ, আমি দেখছিনে।’
জ্ঞানদা তার নতুনের দৃষ্টিপাতের দিকে তাকিয়ে বুকের আঁচল মৃদু হেসে তুলতে-তুলতে বললে, ‘সমস্যাটিকে তুমি কোন দৃষ্টিতে দেখছ তা হলে ঠাকুরপো?’
‘সমস্যাটা আমার একদিকে ব্রাহ্মসমাজ আর অন্য দিকে আমার বউ– অত সামান্য নয়’, বলল জ্যোতি।
‘তাহলে?’
জ্যোতি জ্ঞানদার খাটের ওপর বসে পড়ে বলে, ‘সমস্যাটা হল, একদিকে আমার ভালবাসা আর অন্যদিকে আদি ব্রাহ্মসমাজের প্রতি আমার কর্তব্য– বুঝেছ বউঠান?’
‘বিন্দুমাত্র বুঝিনি’, বলে জ্ঞানদা।
‘ভালবাসার নতুন নতুন সুর তৈরি হচ্ছে আমার মনে। আর্তির সুর। আহ্বানের সুর। আশ্লেষের সুর।’
“‘আর্তি’র ঠিক মানেটা কী? আর ‘আশ্লেষ’ বলতেই বা কী বোঝায় নতুন?”
হঠাৎ জ্যোতির বুকের ওপর হাত রেখে জানতে চায় জ্ঞানদা।
“‘আর্ত’ শব্দটা নিশ্চয়ই জানো বউঠান।”
‘তা আর জানিনে? তাহলে তো নিজেকেই জানিনে, চিনিনে!’
জ্ঞানদার এ কথায় হেসে ফেলে জ্যোতি। জ্ঞানদার মনে হয়, নতুন হাসলে যেন দেবদূত হয়ে ওঠে ‘আরও দেবদূত!’ কোনও মানুষ এত সুন্দর হতে পারে?
“‘আর্তি’ হল একজন পীড়িত, দুঃখিত, ক্লেশিত মানুষের যন্ত্রণা, কাতরতার প্রকাশ।”
‘আর আশ্লেষ?’ আবার জিজ্ঞেস করে জ্ঞানদা। তারপর বলে, “‘শ্লেষ’ মানে জানি, আড়াল-করা বিদ্রুপ, তোমার ভাষায় ঠাকুরপো, টাং-ইন-চিক!”
“ঠিক, ঠিক, এক্কেবারে ঠিক! কিন্তু সংস্কৃত ভাষার সৌন্দর্য হল, শব্দালংকার! একই শব্দের ভিন্ন ভিন্ন রূপ। ‘শ্লেষ’ শুধু বিদ্রুপ বোঝায় না।”
‘তাহলে? অন্য অর্থটা কী?’
হঠাৎ, বলা নেই কওয়া নেই, নিবিড় আবেগে জ্ঞানদাকে জড়িয়ে ধরে জ্যোতিরিন্দ্র। তাকে আদর করে চুমু খেতে থাকে। জ্ঞানদা দ্যাখে, দরজাটা শুধুমাত্র ভেজানো। কেউ ঠেললেই খুলে যাবে। তবু সে প্লাবনে ডুব দেয়। বাধা দেওয়ার ইচ্ছে বা শক্তি– কিছুই নেই তার। এই মৃত্যু কী সুন্দর! মোমবাতির মতো গলতে গলতে মনে হয় জ্ঞানদার। জ্ঞানদা বুঝতে পারে, নতুনের হাতের স্পর্শে পিয়ানোর মতো সুর উঠেছে তার রূপ দু’টির অন্তরে। মিশে যাচ্ছে আর্তি ও আশ্লেষ। সে দ্রব হচ্ছে। কত প্রাচীন এই আগুন, কোন গুহার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসছে লাভার মতো! সব বাধা, ভয়, লজ্জা পুড়িয়ে, ছারখার করে!
কতক্ষণ সময় যে বিন্দুতে পরিণত হল, জানে না জ্যোতি, জানে না জ্ঞানদা।
ধ্বস্ত জ্ঞানদার বুকের ওপর শুয়ে ক্লান্ত দেবদূত বলল, “‘আশ্লেষ’ শব্দটির অর্থ শুধু আদর নয় মেজবউঠান। ‘আশ্লেষ’-এর অর্থ ‘মিলন’ পর্যন্ত গড়িয়েছে।”
জ্ঞানদা কিছু বলল না। সে জানল, ‘আশ্লেষ’ মানে বিস্ফোরণ, ‘আশ্লেষ’ মানে বারবার কম্পন, ‘আশ্লেষ’ মানে গলন– চাওয়ার শেষ, এখন আর কিচ্ছুটি না, যতক্ষণ না আবার আসছে বান। আবার ডুবতে জাগছে জ্বলন্ত বাসনা!
অনেক বছর পরে। অমাবস্যার রাত। ছাদ জুড়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দু’টি মানুষ বিশাল ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে। পাশাপাশি। পরস্পরের সঙ্গে মিশে আছে তারা। আলাদা করে চেনার উপায় নেই। তাদের সংলাপ:
নারী: আমরা পাপ করেছি।
পুরুষ: পাপ?
নারী: পাপ নয়?
পুরুষ: পাপ বলেই তো কিছু নেই। সমাজের চোখে ন্যায়-অন্যায় আছে। আইনের চোখেও ন্যায়-অন্যায়, অপরাধ আর অপরাধহীনতা– এসব। কিন্তু পাপ-পুণ্য আবার কী?
নারী: পাপ-পুণ্য নেই!
পুরুষ: পাপ-পুণ্য থাকলে তো ঈশ্বরকেও মানতে হবে।
নারী: ঈশ্বরকে মানতে হবে মানে? তুমি ঈশ্বর মানো না?
পুরুষ: বিজ্ঞান এখনও ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারেনি।
নারী: জ্ঞান মেনে নিয়েছে ঈশ্বরের অস্তিত্ব।
পুরুষ: যে-জ্ঞান বিজ্ঞানের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়, সেই বিজ্ঞানবিহীন জ্ঞানের বিশ্বাসে আমার বিশ্বাস নেই। তাছাড়া…
নারী: তাছাড়া কী?
পুরুষ: তাছাড়া পুণ্যে আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই।
নারী: আর পাপে?
পুরুষ: ইমেন্স ইন্টারেস্ট। সাহিত্য-দর্শন, শিল্পের সমস্ত ধারা– সব কিছুর সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে অন্যায়। তুমি যাকে পাপ বলছ। বৈষ্ণব পদাবলি ভাবো, অবৈধ প্রেমের তো সোনালি ফসল বৈষ্ণব পদাবলি। আর প্রেম মানে তা অসতীর স্তনমর্দন। যে-মর্দনের জন্য কুঞ্জবনের আড়ালে অপেক্ষা করছে প্রেমিকের দু’টি আগ্রহী হাত!
নারী: চুপ করো। নির্লজ্জের মতো কথা বোলো না। আমার লজ্জা করছে।
পুরুষ: একটুও ভালো লাগছে না?
নারী: সত্যি পাপ বলে কিছু নেই?
পুরুষ: থাকবে কী করে? গড ইজ ডেড। কথাটা আমার নয়। সবে বলেছেন জার্মান দার্শনিক ফ্রিডরিখ নিৎসে। তাঁর ঈশ্বরহীনতার চরম দর্শন। এই দর্শনের নাম জানো?
নারী: তুমি কি জানিয়েছ যে জানব?
পুরুষ (হেসে): থিওথ্যানাটোলজি। এই দর্শনে বিশ্বাস করলে দ্য হোল অফ আওয়ার কনভেনশানাল মোর্যালিটি ইজ বাউন্ড টু কোল্যাপ্স। ভেবে দেখো, পৃথিবী জুড়ে এত যে প্রেমের বই, প্রেমের কবিতা থেকে প্রেমের চিঠি– সবই তো অবৈধ প্রেম। অসতীর কথা। বিবাহিত নারী-পুরুষের প্রেম নিয়ে ক’টা লেখা আছে সারা জগতে?
নারী: শোনো, থিওথ্যানাটোলজি নামটা কিন্তু বেশ। সাউন্ডস্ ইন্টারেস্টিং। কিন্তু সঠিক মানেটা কী?
পুরুষ: তোমাকে আমার এই জন্য ভালো লাগে। এই যে শাবল নিয়ে খুঁড়ে দেখার ঝোঁক, এইটে তোমার মধ্যে আছে বলেই এত বছর তোমার প্রেমে পড়ে আছি।
নারী: আঃ, আগে মানেটা বলো তো!
পুরুষ: ‘থিওস্’ হল গ্রিক শব্দ। মানে, ভগবান। আর ‘থানাটস’ মানে ‘মৃত্যু’। অর্থাৎ ভগবান মরেছে।
নারী: বাঁচা গেছে। তাহলে তো শয়তানও মরেছে।
পুরুষ: ঠিক, একবারে ঠিক। ভগবান নেই তো শয়তানও নেই।
নারী: কিন্তু সত্য? তার তো একটা হিল্লে করতে হবে।
পুরুষ: সত্য আছেই আছে। তার হিল্লে বাসা বেঁধেচে আমাদের সন্ধানে।
নারী: কিন্তু তাকে খুঁজব কোথায়?
পুরুষ: নিৎসে তারও ইশারা দিয়েছেন। তাকে খুঁজতে হবে, ‘বিয়ন্ড গুড অ্যান্ড ইভিল্’।
নারী: (একটি ছায়া অন্য ছায়াকে জড়িয়ে ধরে) আমাকে সঙ্গে নেবে তো?
পুরুষ: নেব। আমার একটা স্বপ্ন আছে। তুমি যাকে পাপ মনে কর, যাকে অন্যায় বলো, সেই কাজটি আমরা করবই। আমরা পালাব। আমরা একটা পাহাড় কিনব। আর সেই পাহাড়ের আদিমতায় আমরা আদিম পাপ করব খোলা আকাশের নীচে। রোজ-রোজ।
নারী: সত্যি বলছ?
পুরুষ: এর চেয়ে সত্যি আর হতে পারে না। আমাদের ভাগ্যই আমাদের নিয়ে যাবে সেই পথে।
নারী: কে বলবে ভাগ্য না নিয়তি! অনিবার্য?
পুরুষ: অমোঘ, অনিবার্য! হবেই। তুমি দেখো!
(চলবে)