আমাদের সমসময় একটা রোস্ট্রাম লাগে। আমরা যখন বলি, যদি তোমরা নিজেকে প্রকাশ করতে চাও, তুমি যদি নিজেকে দেখাতে চাও, তাহলে তোমাকে উন্মুক্ত হতে হবে। আর উন্মুক্ত হতে গেলে একটা উঁচু জায়গায় উঠতে হবে। যাতে তোমার সমস্তটা অন্য লোকে দেখতে পায়। যে ভঙ্গিমাই করো, যে মায়া তৈরি করার জন্য শরীরী মায়া তৈরি করো, তা সবটাই ওই রোস্ট্রামের জন্য। আর তুমিই পারো রোস্ট্রামটাকে বদলে দিতে। যেই ওটা পাল্টে যায়, তুমিও পাল্টে যাও।
৪.
‘রোস্ট্রাম’ শব্দটা আমাকে আপ্লুত করে, আচ্ছন্ন করে। থিয়েটারের লোক বা যাত্রার লোকেরা এই শব্দটি সম্বন্ধে অবগত। রোস্ট্রাম আসলে একটা উঁচু পাটাতন। যাত্রার তিনদিক খোলা মঞ্চে মাঝখানে বসানো থাকে, যার ওপরে উঠে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা বিভিন্ন সময়ে নানা আচরণ করে। সেই উঁচু পাটাতন বদলে বদলে যায়। কখনও তা জাহাজ হয়ে যায়, কখনও সিংহাসন হয়ে, কখনও মরুভূমি। অথচ সেটা একটা সবুজ বা নীল বা ধূসর রঙের পাটাতন। এটা লাতিন শব্দ। এর অর্থ, একটা উঁচু জায়গা, যেখান থেকে জনগণকে উদ্দেশ্য করে কথা বলা যায়, ঘোষণা দেওয়া যায়। যেখানে দাঁড়ালে সবাই তাকে দেখতে পায়, পুরোটা দেখতে পায়। সেই রোস্ট্রাম সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চেহারা বদলায়। কল্পনার রং মেশে তাতে। যে কারণে থিয়েটারকে বলা হয় সবচেয়ে বড় জাদু, মায়া। যে কোনও অবস্থায় যে কোনও জায়গাকে পাল্টে দিতে পারে।
পিটার ব্রুক-এর ‘দ্য এম্পটি স্পেস’ বইটির শুরুতে বলা হচ্ছে, একটা ফাঁকা জায়গায় একটা মানুষ আসে, তারপর এমন কিছু আচরণ করে, যা দিয়ে সে জায়গাটাকে পুরো বদলে দেয়। শুধু যে নিজেকে বদলাচ্ছে, তা নয়, গোটা জায়গাটা বদলে যাচ্ছে। হতে পারে তা ঘরের ভেতরের চাতাল, বা উঠোন, বা বারান্দা, বা ধু ধু প্রান্তর, এই চিহ্নিত জায়গাগুলোকে সে পাল্টে দেয় তার আচরণ দিয়ে। কখনও উঠোনকে করে দেয় প্রান্তর, কখনও প্রান্তরকে করে দেয় বারান্দা। তার মানে শরীরী ভাষা দিয়ে একটা জায়গাকে বদলে দেওয়া।
নিরাভরণ মঞ্চ, কোথাও কিছু নেই, চারিদিক খোলা, তার মাঝখানে শুধু তিনধাপের রোস্ট্রাম। ওপরের ধাপটা চওড়া। সেখানে সংসারও পাতা যায়। সেখানে জয়সালমিরের প্রাসাদও তৈরি করে ফেলা যায়। সেই ধাপগুলো হয়তো বিস্তৃত সিড়ি। এভাবে ওই রোস্ট্রামটাকে বদলে দিতেন অভিনেতা, অভিনেত্রীরা।
যেহেতু ছোট থেকেই বাবার সঙ্গে যাত্রা দেখতে গিয়েছি মাঠে, সেখানে ওই খণ্ড খণ্ড কাঠগুলোকে জুড়তে দেখেছি। যা জুড়ে জুড়ে একটা সময় রোস্ট্রাম হয়ে উঠত। মঞ্চের চারধার জুড়ে বসত অর্কেস্ট্রা। ক্ল্যারিওনেট, বাঁশি, ঢোল, কর্তাল, হারমোনিয়াম। আর একদিকে থাকত আলোর সরঞ্জম। পরে শুনেছি ওগুলোকে বলত ডিমার, যা দিয়ে আলো কমানো যায়, বাড়ানো যায়। ওই ডিমারগুলো থরে থরে সাজানো থাকত। একটা মানুষ ওখানে বসে থাকতেন, তিনি দু’হাতে ও দু’পায়ে ওই ডিমারগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। ক্লাইম্যাক্সের সিনে, যেখানে ওঠাপড়া চলছে, তখন আলোগুলোকে উনি নড়িয়ে দিতেন। মনে হত, আলোগুলোও যেন সংলাপ বলত। শুরু হত সংগীতযজ্ঞ। আমার ওঁদের দিকে তাকিয়ে মনে হত, ওঁরাই জাদুকর। এঁরা প্রত্যেকেই মঞ্চের পাটাতনে বসতেন।
দেখতাম বাবার পরিচিত, বন্ধুরা সবাই মেয়েদের চরিত্রে অভিনয় করছেন। তাঁকে আমি চিনি। তিনি সকালবেলা লুঙ্গি পরে আমাদের বাড়িতে চা খেয়েছেন। কিন্তু তিনি এই মুহূর্তে এত সুন্দর সেজে উঠেছেন যে, আমার বোঝার উপায় নেই। তিনি একই শরীরে অন্য এক শরীরকে ধারণ করেছেন। তিনি কিন্তু অভিনয় করছেন মঞ্চের ওপর।
আমাদের সবসময় একটা রোস্ট্রাম লাগে। আমরা যখন বলি, যদি তুমি নিজেকে প্রকাশ করতে চাও, তুমি যদি নিজেকে দেখাতে চাও, তাহলে তোমাকে উন্মুক্ত হতে হবে। আর উন্মুক্ত হতে গেলে একটা উঁচু জায়গায় উঠতে হবে। যাতে তোমার সমস্তটা অন্য লোকে দেখতে পায়। যে ভঙ্গিমাই করো, যে মায়া তৈরি করার জন্য শরীরী ভাষা তৈরি করো, তা সবটাই ওই রোস্ট্রামের জন্য। আর তুমিই পারো রোস্ট্রামটাকে বদলে দিতে। যেই ওটা পাল্টে যায়, তুমিও পাল্টে যাও।
বাসের মাথা থেকে ওই খণ্ড খণ্ড কাঠগুলো নামত, তারপর তৈরি হত হাতছানি দেওয়া মঞ্চ, একটা ভূমি। ওটার ওপর উঠে যেতে ইচ্ছে করত ছোট থেকেই। আমি তো তখন অভিনেতা নই, তবুও ওটা আমাকে ডাকত। এটা এখন অনুভব করতে পারি খুব বেশি করে। আজ বুঝি ওই ডাকটা শুরু হয়ে যায় অনেক আগে থেকেই।
আমাদের বাড়ির উঠোনে, যদিও ওটাকে উঠোন বলতাম, আসলে ছিল দুটো মাত্র গাছ– একটা হাসনুহেনা গাছ, আরেকটা টগর গাছ– সেখানে আমরা অবধারিতভাবে পড়ার ঘর থেকে একটা চৌকি নিয়ে এসে মাঝখানে রাখতাম। ওটা ছিল আমাদের রোস্ট্রাম। ওটার ওপর উঠে দাঁড়ালেই আমার চরিত্র সাজা হবে। নিজেরাই নাটক বানাতাম, সংলাপ তৈরি করতাম। আমাদের সদর দরজায় যে চিঠির বাক্স, তার ফুটোটা হয়ে যেত টিকিট কাউন্টার। আমরা নিজেদের হাতে টিকিট বানাতাম। বন্ধুবান্ধবদের সেগুলো দিয়ে দিতাম। বলতাম ওই টিকিটটা লেটারবক্সে ফেলার পর এদিকে আসার অনুমতি মিলবে।
যে জলচৌকিতে শুয়ে আমরা ওম পেয়েছি, যে জলচৌকিতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি, সেখানে আমরা পড়াশুনো করেছি, যে জলচৌকিতে আমরা ফাঁকি দিয়েছি, সেটার ওপরেই উঠে দাঁড়িয়ে আমরা সংলাপ বলেছি। সেখানে উঠে দাঁড়ালেই মনে হত আমি রাজা, আমি আমি নই, অন্য কেউ, আমি আমার সবটা বদলে দিচ্ছি, আমি আমার আশপাশের নিয়ন্ত্রক। সেই রোস্ট্রাম অন্য কোনও সরঞ্জাম নয়, আমারই চৌকি, আমার স্বপ্ন দেখার যান। নিজের বাড়ির দালান বদলে দেওয়ার যে অনুশীলন শুরু করলাম আমরা, সেটাই বোধহয় গেঁথে গেল আমার মধ্যে।
পাল্টে দেওয়ার খেলাটা একটা অমোঘ খেলা।
…পড়ুন নাটুয়া-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৩। আমার অভিনয়ের গাড়িতে আমি অন্য সওয়ারি চড়িয়ে নিয়েছি আমার জন্যই
পর্ব ২। অন্যের চোখে দেখে নিজেকে রাঙিয়ে তোলা– এটাই তো পটুয়ার কাজ, তাকে নাটুয়াও বলা যেতে পারে
পর্ব ১। বাবা কি নিজের মুখের ওপর আঁকছেন, না কি সামনে ধরা আয়নাটায় ছবি আঁকছেন?