ভারতবাসীর দুর্ভাগ্য যে, আজ পর্যন্ত তারা মহেন্দ্র সিং ধোনিকে বুঝতেই পারল না! আইপিএলের উদ্বোধন-পর্ব থেকে চেন্নাই সুপার কিংসের ওই যে হলুদ জার্সি, সেই জার্সির সমার্থক হয়ে গিয়েছে ‘ক্যাপ্টেন কুল’-এর সঙ্গে। এমন হাইভোল্টেজ টুর্নামেন্টে এই প্রথম যে ন’নম্বর বা লোয়ার অর্ডারে ব্যাট করলেন ধোনি, তা কিন্তু নয়। গত আইপিএল চলাকালীনও ধোনি আট নম্বরে ব্যাট করেছেন। ক্রমাগত নিজের ব্যাটিং অর্ডার পিছিয়েছেন। সেটা কি নেহাত খামখেয়ালিপনা?
১৮.
যে বিষয় সম্পর্কে জনমানসের সম্যক জ্ঞান নেই, যা বোধগম্যের অতীত, তাই সময়ের ঘাত-প্রতিঘাত সামলে একসময় ‘ইজম’ বা মতবাদে পরিণত হয়। মানুষ তখন সেই অগম্যকে আত্মস্থ করতে শুরু করে, সৃষ্টি হয় মতবাদ। যা পরবর্তীতে মিথে পরিণত হয়। মার্কসবাদ থেকে শুরু করে বস্তুবাদ– এরকম অনেক ‘ইজম’-ই আমাদের চোখের সামনে ডালপালা মেলে রয়েছে। জীবনপুরের পথিক সেই ইজমের নিরালা আশ্রয়ে বসে জীবনের অর্থ খুঁজে বেড়ান বইকি! ক্রিকেটেও সেইরকম এক জনপ্রিয় ‘ইজম’ অর্থাৎ মতবাদ আছে। জনতা যাকে ডাকে ‘ধোনিবাদ’ নামে।
তা, সেই ‘ধোনিজম’ কী? ধোনিবাদ বলে– গাড়ি যতক্ষণ না খারাপ হচ্ছে, ততক্ষণ গাড়িকে সারাতে যেও না। কিন্তু সাধারণ মানুষ, যাঁরা সোশ্যাল মিডিয়ার নুন খেয়ে বেঁচে থাকেন, আদা-জল পান করে তিলকে তাল করে শান্তি পান, তাঁরা ধোনির ক্রিকেট মতবাদকে সহজে অনুধাবন করতে পারেন না। তাঁরা হুমড়ি খেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরে আরাম-কেদারায় দু’পা নাচিয়ে বলেন– “ধোনি কেন ন’নম্বরে নামবে! অ্যাঁ? আগে কেন নামবে না?”
আসল কথা কী জানেন? ভারতবাসীর দুর্ভাগ্য যে, আজ পর্যন্ত তারা মহেন্দ্র সিং ধোনিকে বুঝতেই পারল না! আইপিএলের উদ্বোধন-পর্ব থেকে চেন্নাই সুপার কিংসের ওই যে হলুদ জার্সি, সেই জার্সি সমার্থক হয়ে গিয়েছে ‘ক্যাপ্টেন কুল’-এর সঙ্গে। এমন হাইভোল্টেজ টুর্নামেন্টে এই প্রথম যে ন’নম্বর বা লোয়ার অর্ডারে ব্যাট করলেন ধোনি, তা কিন্তু নয়। গত আইপিএল চলাকালীনও ধোনি আট নম্বরে ব্যাট করেছেন। ক্রমাগত নিজের ব্যাটিং অর্ডার পিছিয়েছেন। সেটা কি নেহাত খামখেয়ালিপনা?
এমনটা ভাবলে মশাই, আপনি গোল্লা পেয়েছেন। ফুল মার্কস পেতে গেলে একটু সমস্যার গভীরে যাওয়া প্রয়োজন। গত বছর কী যুক্তি ছিল ধোনির? এমএস স্পষ্ট করে বলেছিলেন যে, সামনে টি-টোয়েন্টি ওয়ার্ল্ড কাপ আছে। আমার টিমে এমন প্রচুর প্লেয়ার বিদ্যমান, যাদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলার সম্ভাবনা প্রবল। অতএব, আমি তাদের অগ্রাধিকার দেব। তাদের আগে ব্যাট করার সুযোগ করে দেব। যাতে তারা রান-টান করে, জাতীয় নির্বাচকদের কাজ বাড়িয়ে দিতে পারে! শিবম দুবে, রবীন্দ্র জাদেজাদের সেই থিয়োরি মেনেই নিজের আগে ব্যাটিং অর্ডারের ওপরে তুলে এনেছিলেন ধোনি। সিএসকে-র লিডার হিসেবে, সিনিয়র রূপে ‘ক্যাপ্টেন কুল’-এর সেই সিদ্ধান্ত সর্বজনগ্রাহ্য, অবশ্য পালনীয়।
এবার অর্থাৎ ২০২৫-এর আইপিএলের কথায় ফিরি। মুম্বই ইন্ডিয়ান্সকে হারিয়ে সদ্য আইপিএলের দ্বিতীয় ম্যাচ খেলতে নেমেছিল সিএসকে। ঘরের মাঠে ম্যাচ। প্রতিপক্ষ বিরাট কোহলিদের রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু। চিপকে যে ম্যাচে টানা ১৭ বছর হারেনি সিএসকে। এবার হারল! ২০০৮-এর পর এই প্রথম। লজ্জার হার নিঃসন্দেহে। কিন্তু একটা হারে ‘গেল গেল’ রব তোলার কি কিছু আছে? নেই। অথচ একটা ম্যাচে হারের পরেই চিরাচরিত সমালোচনার বাঘনখগুলো বেরিয়ে পড়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার জনারণ্যে ‘হালুম, হুলুম’ শোনা যাচ্ছে! নয় নম্বরে ব্যাট করতে নামার জন্য ধোনির শাপ শাপান্ত-বাপ বাপান্ত হচ্ছে পালা করে। যেন প্রতিযোগিতা! কে কত ট্রোল-বন্যায় মাহি-বিগ্রহে কাদালেপন করতে পারে! আস্ফালন করে গ্রীবা ফুলিয়ে তারা বলছেনও, ‘আরে, নাম ধোনি হলেই যা-কিছু করা যায় নাকি! দলের জয়টা কিছু নয়? কেন ধোনি নয় নম্বরে নামবে? আগে নামলে সিএসকে জিততেও পারত।’ এসব নানা কথায় আইপিএল চৈত্রের ভরা গরমে সরগরম! বোদ্ধা গন্ধগোকুলরা মাথা দুলিয়ে আওড়াচ্ছেন, ‘ধোনি যখন নেমেছে, তখন ম্যাচ ফিনিশ! ব্যাট চালিয়ে, হেলিকপ্টার হাঁকিয়ে কী লাভ!’
হে ঈশ্বর, তুমি ক্রিকেটপ্রেমী হলে এই অবোধদের ক্ষমা করো। জনতা যা বোঝে না, তা হল– লেগ্যাসি একটা প্রবহমান প্রক্রিয়া, একটা নিয়ত প্রসেস, যা ধারাবাহিকতার তালিমে করে যেতে হয়। একটা দল তৈরি করা অসম্ভব কিছু নয়, কিন্তু সফল অধিনায়ক? সেটা রাতারাতি তৈরি হয় না। ধোনি যতদিন সিএসকের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ ছিলেন, ততদিন তিনি ফিনিশারের ভূমিকা পালন করে গিয়েছেন। যেদিন থেকে বুঝেছে এই টিমের আর তিনি ভবিষ্যৎ নন, তখন থেকে নিজের ভূমিকা বদলে ফেলেছেন।
এটা তো সত্যি যে, আজ থেকে দু’বছর পর ধোনি আর খেলবেন না। তখন এমএস-এর অবর্তমানে এই যে প্রেশারটা, এই ফিনিশিং রোলের অনন্ত চাপ, তা বর্তমান প্রজন্মের প্লেয়ারদের কাঁধে তুলে নিতে হবে। সেই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই সিএসকে টিমটাকে চালিত করছেন ‘থালা’। ধোনি আজকে নিয়ে ভাবেন না, বর্তমান নিয়ে ভাবেন না। নিজেকে নিয়ে তো ভাবেনই না। ধোনি চাইলে এখনও ফিনিশারের ভূমিকা পালন করতে পারেন, অক্লেশে। বল গ্যালারিতে ফেলতে পারেন, অবলীলায়। কিন্তু সেই রেজাল্টটা তাৎক্ষণিক, যা সাময়িক সাফল্য দেবে সিএসকে-কে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় তা অর্থহীন।
আরসিবি-র বিরুদ্ধে ধোনি চাইলেই ছয় নম্বরে নামতে পারতেন, হয়তো খেলাটা ঘুরে যেত তাতে। সিএসকে ম্যাচটা জিতত, কিংবা জিততে পারত না হয়তো-বা। তবু ধোনি-ধামাকা দেখে পাব্লিক ঊর্ধ্ববাহু হয়ে নেত্য করত। পোড়া এ দেশের জনতা মরাকান্না গেয়ে বলত, ‘ধোনিকে অবসর ভেঙে টিম ইন্ডিয়ায় ফেরানো হোক।’ এসবই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। মহেন্দ্র সিং ধোনির এসবে কিস্সু যায়-আসে না, এসবের ত্রাহ্যগুণ তাঁকে স্পর্শ করে না।
ম্যাচটা না জিততে পারলেও আরসিবি-র বিরুদ্ধে ধোনি দেখিয়ে দিয়েছেন, তাঁর মধ্যে এখনও কিছু দেওয়ার আছে। খিদে মরেনি। যা রসদ পুঞ্জীভূত হয়ে আছে, তা থেকে আগুন জ্বলতে পারে। সেই দাবানল নিয়ে ছেলেখেলা করা ধোনিকেই মানায়। এখনও আইপিএলের মতো মঞ্চে বুক চিতিয়ে খেলে যাওয়ার দক্ষতায় মরচে পড়েনি এমএসডি-র।
এটাই ধোনি। এটাই ধোনিজম। এটাই তাঁর ক্রিকেটমন্ত্র। তাঁকে বুঝতে গেলে তাঁর ক্রিকেট-ফিলোজফিকে বুঝতে হবে। ওপেন সিক্রেট হল, এ পোড়া দেশের কোনও ক্রিকেট-অনুরক্ত ধোনিকে, তাঁর ক্রিকেট প্রজ্ঞাকে অনুধাবন করতেই পারল না। তাদের কাছে ধোনি আসলে ধাঁধার চেয়েও জটিল। ফলে ২২ গজে মাহির ব্যাট জ্বলে উঠলে, হেলিকপ্টার-শট আছড়ে পড়লে, দুর্দান্ত স্টাম্পিং করলে সোল্লাসে তারা বলেন, ‘ধোনির ব্রেন ম্যাপিং করো। এক্ষুনি!’ বলে তারা ক্ষান্ত দেয়। গভীরে যেতে চায় না। কিংবা পারে না। সাধ্যে কুলোয় না।
…………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………..
ধোনি নিঃসন্দেহে ‘থালা’। কিংবদন্তি। ক্ষিপ্র স্টাম্পিং করছেন এই ৪৩-এও, চিতা-গতিতে। মাত্র ০.৯ সেকেন্ডে! জনতা তাই দেখছে, গিলছে, বিগলিত হচ্ছে, উন্মাদগ্রস্তের মতো নাচছে, ‘জয়-ধোনি’ দিচ্ছে। আবার সেই জনতাই ধোনিকে আক্রমণ করতে ছাড়ছে না, যখন দেখছে সে ন’নম্বরে নেমে দলকে জেতাতে পারছে না।
সত্যি, বড় আশ্চর্য এ দেশ! বড় আশ্চর্য এ দেশের শতকোটি জনতা! তবে অবাক হবেন না পাঠক, যুগে যুগে এটাই দস্তুর। ঋষি-মুনিদের দেশ এ ভারতবর্ষে যুগে যুগে মহামানব জন্মেছেন, চলেও গেছেন। জীবদ্দশায় তাঁদের কীর্তি, কর্মকাণ্ড সাধারণের বোধাতীত হয়েই থেকেছে। পাব্লিকের তেলচিটে লোলচর্মে মহামানবদের দর্শন চিরকালই ধাঁধা। ধোনিজমই বা বাদ যাবে কেন!
…………………… পড়ুন ওপেন সিক্রেট-এর অন্যান্য পর্ব …………………….
পর্ব ১৭: সাদা সাদা কালা কালা
পর্ব ১৬: গতবারের বিক্রি প্রতিবারই ছাপিয়ে যায় বইমেলা, কারণ দামবৃদ্ধি না পাঠকবৃদ্ধি?
পর্ব ১৫: সেন ‘মায়েস্ত্রো’কে ভুলে বাঙালি দেখিয়েছে, সে আজও আত্মবিস্মৃত
পর্ব ১৪: শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসই বাঙালির প্রকৃত সান্তা
পর্ব ১৩: প্রবাসে, দোতলা বাসে, কলকাতা ফিরে আসে
পর্ব ১২: না-দেখা সেই একটি শিশিরবিন্দু
পর্ব ১১: ঘোর শত্রুর বিদায়বেলায় এভাবে বলতে আছে রজার ফেডেরার?
পর্ব ১০: অভিধানের যে শব্দটা সবচেয়ে বেশি মনুষ্যরূপ ধারণ করেছে
পর্ব ৯: জোট-অঙ্কে ভোট-রঙ্গ
পর্ব ৮: দক্ষিণ বিসর্জন জানে, উত্তর জানে বিসর্জন শেষের আগমনী
পর্ব ৭: পুজো এলেই ‘সর্বজনীন’ নতুবা নিঃসঙ্গ?
পর্ব ৬: এক্সক্লুসিভের খোয়াব, এক্সক্লুসিভের রোয়াব
পর্ব ৫: শাসন-সোহাগের দ্বন্দ্বসমাস
পর্ব ৪: পাঁকাল সাধনায় নাকাল
পর্ব ৩: দেখা ও না-দেখার সিদ্ধান্ত
পর্ব ২: মহাবিশ্বে যে টোকে না, সে বোধহয় টেকেও না
পর্ব ১: অফিসে দৈবের বশে প্রেমতারা যদি খসে