ঘর শুধু কড়িবরগার মেলবন্ধন নয়, খোলা আকাশের নিজে ঘাসের পৃথিবীও। সেই ঘরের আদল নিয়ে সে স্নেহসিঞ্চন করে। করে বলেই কখনও কখনও শূন্য হৃদয়ে মন ছুটে যায় কালীঘাট মন্দিরে, মায়ের সান্নিধ্য পেতে। কখনও ক্লান্ত শরীর হাঁটু-মুড়ে বসে ওই নরম ঘাসে, মোহনবাগান লনে। ভালোবাসার অলিন্দ-নিলয়ের গতিপথ জানে ওই লন। ইতিহাসের গল্পে সেখানে ভালোবাসার ওম পাওয়া যায়। সেই উষ্ণতায় একাকিত্ব কাটে। ঘরের দরজা বাকিটা ব্যক্তিগতর শেষ ছায়াপথ। সাবালকত্বে সহজপাঠ শেখায় ঘর, হাতেখড়ি দেয় লুকোচুরির নান্দীপাঠে।
চার দেওয়ালের মধ্যে নানা দৃশ্য, সেই খণ্ড-বিখণ্ড জুড়ে এক পশলা জীবন। সেই একরত্তি জীবনের ঘুঘু বাসাকেই কি ‘ঘর’ বলে? ঘর বলতে যে মনে পড়ে এক ছেলের কথা।
বাপ-মা মরা এক ছেলে। বিয়োগের ব্যথা বোঝে না সে। কে জানে হয়তো তাই তার মুখে বিরাজ করে গভীর এক ভরাট হাসি। পড়ন্ত বিকেল তাকে আপন করে নেয়। ঘরে ফেরার মন নিয়ে পসরা সাজিয়ে হাঁক দেয় ধানের শিস। দূরের পাহাড়। তার বক্ষলগ্ন হয়ে বয়ে চলা সুবর্ণরেখা। জনমানবশূন্য প্রান্তরে, সেই সুবর্ণরেখার তীরে দাঁড়িয়ে সে তার একমাত্র সঙ্গী মানুষটিকে প্রশ্ন করে– ‘ওই তো দূরে নীল নীল পাহাড়। সেখানে বড় বড় শূন্য ঘর। বাগানে প্রজাপতিরা ঘোরে, আর গান হয়।’ ওটাই সেই নিষ্পাপ বালকের একলার দেশ, একলার ঘর। ‘সুবর্ণরেখা’ সিনেমায় ঋত্বিক ঘটক বিছিয়ে রেখেছেন যে, স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা, যে রিক্ত শূন্যতা, তার পাশে ওই ফুটফুটে ছেলের ঘরে ফেরার ডাক যেন গুমট আবহাওয়ায় বসন্ত বাতাস, বিষাদঘন মুখে আশাবাদের মায়াকাজল। সেই দৃশ্যের জন্ম মনের কোণে তৈরি করে এক দুর্নিবার টান। ঘরে ফেরার গান।
বিলেতে পড়াশোনার ফাঁদে বছরখানেক কাটিয়ে বেশ বুঝেছি, ঘর হল আলুসেদ্ধ ভাত, মায়ের হাত। পরবাসের সঙ্গে সহবাস করলে অনুধাবন করা যায়, ঘর কী? বাসা কাহারে কয়? লন্ডনে থাকার সময় মাঝে মাঝেই এক বাঙালি রেস্তরাঁয় খেতে চলে যেতাম। পোস্ত অর্ডার করতাম। রুই-কাতলা পাতে দিতে বলতাম। প্রথমে ভাবতাম, রসনা ও তার পরিতৃপ্তি এ অমোঘ আমন্ত্রণের নেপথ্যে বোধহয়। পরে বুঝেছি, না। আসলে ঘর। ঘরের মোহ। তার ঘরোয়া নেশা। তার দৈনন্দিন খাবার। ঘুম। পাশবালিশ। পাখার ডাক। সন্ধের শাঁখ। নিত্য পুজোর ধূপ। ঘর মানে শুধু যে বাবা-মা-আত্মীয়-পরিজন নয়। ঘর মানে স্বয়ং আমি, ভালো-খারাপ মিশিয়ে আমার আমিত্বের আশ্রয়। মনখারাপের বিকেলে, মন ভালো করার বিশল্যকরণী থাকে যার জিম্মায়। নিশ্চিন্তে আত্ম-অন্বেষণ করা যায় যেখানে। বিদেশ-বিঁভুই বড় নাছোড়। বারবার খালি আত্মজনের সুগন্ধি বয়ে আনে। অক্লেশে খুলে দেয়, স্মৃতির হাজারদুয়ারি। তাতে কত অজস্র ছেলেমানুষি, একলা ভুলের কারসাজি।
কী জানেন, ‘ঘর’ শব্দটাই আদতে এক জাদু-বাস্তবতা। অনর্গলের পৃথিবীতে নীরবে বয়ে চলা অনেক না-বলার কথার সাক্ষী থাকে যে। খোলা জানলার বাইরে যে মস্ত পৃথিবী, তাকে টেনে রাখে ঘর। সুতো বাঁধা থাকে মনের গভীরে। ছিড়লে পড়ে রক্তহীন ব্যথা দুমড়ে দেয়, কাঁদায়। ঘর শুধু কড়িবরগার মেলবন্ধন নয়, খোলা আকাশের নিজে ঘাসের পৃথিবীও। সেই ঘরের আদল নিয়ে সে স্নেহসিঞ্চন করে। করে বলেই কখনও কখনও শূন্য হৃদয়ে মন ছুটে যায় কালীঘাট মন্দিরে, মায়ের সান্নিধ্য পেতে। কখনও ক্লান্ত শরীর হাঁটু-মুড়ে বসে ওই নরম ঘাসে, মোহনবাগান লনে। ভালোবাসার অলিন্দ-নিলয়ের গতিপথ জানে ওই লন। ইতিহাসের গল্পে সেখানে ভালোবাসার ওম পাওয়া যায়। সেই উষ্ণতায় একাকিত্ব কাটে। ঘরের দরজা বাকিটা ব্যক্তিগতর শেষ ছায়াপথ। সাবালকত্বে সহজপাঠ শেখায় ঘর, হাতেখড়ি দেয় লুকোচুরির নান্দীপাঠে।
……….
ইডেনে নিঝুম রাতে হারের যন্ত্রণায় ঘর দূরত্বের যোগফলে পরিণত হয় নাইট-ভক্তের হৃদয়ে। দেখছেন না, ইডেনে প্রতিকূল পিচ পেয়ে কেমন নাইটরা কাঁদছেন, নাইটভক্তরা কাঁদছেন। আসলে ঘরের আচার-আচরণ বেঘোরে বিপথগামী হয়ে গেলে বুকে লাগে বড়! দিন শেষে সবাই যে ঘরের পথ খোঁজে। আমি খুঁজি, আপনি খোঁজেন, পরিশ্রান্ত পরিযায়ী পাখির দল খোঁজে।
……….
আপন ঘরের এই সহজতাই আসলে ‘হোম অ্যাডভান্টেজ’। সেই ‘অ্যাডভান্টেজ’-এর আশা-প্রদীপে আলো কমে এলে তথাগতরা ঘর ছেড়ে বের হয় চিরকালের জন্য। ধুলোমাখা জানলায় হাত রেখে অনন্ত অপেক্ষা জাগে কোনও এক মায়ের, তার সুভাষের ঘরের ফেরার অপেক্ষায়। ইডেনে নিঝুম রাতে হারের যন্ত্রণায় ঘর দূরত্বের যোগফলে পরিণত হয় নাইট-ভক্তের হৃদয়ে। দেখছেন না, ইডেনে প্রতিকূল পিচ পেয়ে কেমন নাইটরা কাঁদছেন, নাইটভক্তরা কাঁদছেন। আসলে ঘরের আচার-আচরণ বেঘোরে বিপথগামী হয়ে গেলে বুকে লাগে বড়! দিন শেষে সবাই যে ঘরের পথ খোঁজে। আমি খুঁজি, আপনি খোঁজেন, পরিশ্রান্ত পরিযায়ী পাখির দল খোঁজে।
ঠিক যেমন করে ঘরের পথ খুঁজেছিল ‘সোনার কেল্লা’র মুকুল কিংবা খুঁজে চলে আজকের ফিলিস্তিনি বালক, নিঃস্ব দৃষ্টিতে! ঘর আসলে আমাদের মনের প্রকোষ্ঠ। স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার নিঃসঙ্গ ঘাট। অতীতের জলতরঙ্গে ক্ষণিক পা ডুবিয়ে আমরা বর্তমানের সিঁড়ি ভাঙি, ভেঙে এসে দাঁড়াই ভবিষ্যতের চাতালে। কত কিছুই তো পুরনো হয়ে যায় জীবনে। ঘড়ি। ছাতা। কলম। পাড়া। প্রেমিকা। হয় না শুধু ঘর। কখনও হবেও না। কারণ সে একলা হোক, একরত্তি হোক, প্রাসাদ হোক, তার কাছে চিরগচ্ছিত থাকে মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। কেউ বলেন মন, কেউ বা হৃদয়। এলভিস সাহেব তা বুঝেছিলেন। বুঝে বছর ষাট আগে, যা লেখার, লিখে গিয়েছিলেন।
হোম ইজ, হোয়্যার দ্য হার্ট ইজ!
…………………… পড়ুন ওপেন সিক্রেট-এর অন্যান্য পর্ব …………………….
পর্ব ১৮: ধোনিবাদ: ধাঁধার চেয়েও জটিল তুমি…
পর্ব ১৭: সাদা সাদা কালা কালা
পর্ব ১৬: গতবারের বিক্রি প্রতিবারই ছাপিয়ে যায় বইমেলা, কারণ দামবৃদ্ধি না পাঠকবৃদ্ধি?
পর্ব ১৫: সেন ‘মায়েস্ত্রো’কে ভুলে বাঙালি দেখিয়েছে, সে আজও আত্মবিস্মৃত
পর্ব ১৪: শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসই বাঙালির প্রকৃত সান্তা
পর্ব ১৩: প্রবাসে, দোতলা বাসে, কলকাতা ফিরে আসে
পর্ব ১২: না-দেখা সেই একটি শিশিরবিন্দু
পর্ব ১১: ঘোর শত্রুর বিদায়বেলায় এভাবে বলতে আছে রজার ফেডেরার?
পর্ব ১০: অভিধানের যে শব্দটা সবচেয়ে বেশি মনুষ্যরূপ ধারণ করেছে
পর্ব ৯: জোট-অঙ্কে ভোট-রঙ্গ
পর্ব ৮: দক্ষিণ বিসর্জন জানে, উত্তর জানে বিসর্জন শেষের আগমনী
পর্ব ৭: পুজো এলেই ‘সর্বজনীন’ নতুবা নিঃসঙ্গ?
পর্ব ৬: এক্সক্লুসিভের খোয়াব, এক্সক্লুসিভের রোয়াব
পর্ব ৫: শাসন-সোহাগের দ্বন্দ্বসমাস
পর্ব ৪: পাঁকাল সাধনায় নাকাল
পর্ব ৩: দেখা ও না-দেখার সিদ্ধান্ত
পর্ব ২: মহাবিশ্বে যে টোকে না, সে বোধহয় টেকেও না
পর্ব ১: অফিসে দৈবের বশে প্রেমতারা যদি খসে