এক ঝলমলে রোদ্দুরে ভরা গ্রীষ্মের সুন্দর দিনেই নাকি বাজি রাখা হয়েছিল কোনও এক আড্ডায়। ছুটিতে মেরি, শেলি এবং কবি বায়রন জেনেভাতে মহানন্দে আছেন, এমন সময় ফরাসি ভাষায় অনূদিত কতগুলো জার্মান ভুতুড়ে গল্প তাঁদের হাতে পড়ে। ওই দুঃসহ কাল্পনিক গল্পগুলো পড়ার পর বায়রন মহা উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, বললেন, ‘আমরাও প্রত্যেকেই এক-একটি ভূতের গল্প লিখব।’ এ যেন চ্যালেঞ্জ! তিনজনেই সম্মত হয়ে লিখতে শুরু করেন, কিন্তু একমাত্র মিসেস শেলির ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’ ছাড়া আর দু’জনের লেখা লোকচক্ষুর অন্তরালেই রয়ে গেল। শুরু হল যশোধরা রায়চৌধুরী-র নতুন কলাম ‘সায়েন্স-ফিকশনারী’। আজ প্রথম পর্ব।
১.
গা ছমছমে একটা ভূতের গল্প শুরু করছেন বলেই পাঠক ভাববেন। আর অমনি পড়বেন সেই ফাঁদে! মেরি শেলির কাহিনির শুরুই কবরের মধ্যে মাটি ফেলার শিউরে ওঠার মতো খপাৎ-ছপাৎ শব্দে। কবরে মৃতদেহ শুইয়ে দেওয়ার পর কফিন সুদ্ধ আবার খুঁড়ে তুলছে কারা? তারা বৈজ্ঞানিক, নাকি ধর্মের বিপরীতে পিশাচ উপাসক, শয়তানের দাস? ডক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের সেই শব চুরির গল্প দিয়ে একটা কাঁটা হয়ে ওঠা উপাখ্যান আকার পায়। ব্যাকড্রপ বা চালচিত্রে তো আছেই মধ্য ইউরোপের পাহাড়ি শহরের উঁচু উঁচু দেওয়ালের দুর্গপ্রতিম বাড়িঘর। আর সবার অলক্ষে, মানবকল্যাণে গোপন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা ডক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের গোপন ল্যাবরেটরি! আধেকবোঝা আধেকজানা একরকমের রহস্য শিরশিরানি। মানে একটা জম্পেশ গথিক নভেলের সবরকমের উপকরণ হাজির। ভয়, অতিপ্রাকৃত, ভূতুড়ে আবহ, অন্ধকার– যা যা মশলা থাকলে পাঠকের চারিপাশে দিনের বেলাও রাত নেমে আসে, বা রাতের বেলা আগুনের ধারে দোলনা চেয়ারে বসে বসে পড়তে পড়তে ঘাড়ের রোঁয়া খাড়া খাড়া হয়ে ওঠে– মনে হয় পাশে এসে কেউ দাঁড়াল।
‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন– দ্য মডার্ন প্রমিথিউস’ কীভাবে লেখা হল? তার চমকপ্রদ বিবরণটাও প্রায় গপ্পেরই মতো। মিসেস শেলি ডায়েরিতে তাঁর স্বকীয় ভঙ্গিতে লিখে গিয়েছেন। এক ঝলমলে রোদ্দুরে ভরা গ্রীষ্মের সুন্দর দিনেই নাকি বাজি রাখা হয়েছিল কোনও এক আড্ডায়। ছুটিতে তিনি, শেলি এবং কবি বায়রন জেনেভাতে মহানন্দে আছেন, এমন সময় ফরাসি ভাষায় অনূদিত কতগুলো জার্মান ভুতুড়ে গল্প তাঁদের হাতে পড়ে। ওই দুঃসহ কাল্পনিক গল্পগুলো পড়ার পর বায়রন মহা উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, বললেন, ‘আমরাও প্রত্যেকেই এক-একটি ভূতের গল্প লিখব।’ এ যেন চ্যালেঞ্জ! তিনজনেই সম্মত হয়ে লিখতে শুরু করেন, কিন্তু একমাত্র মিসেস শেলির ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’ ছাড়া আর দু’জনের লেখা লোকচক্ষুর অন্তরালেই রয়ে গেল। সঠিক জানা যায়নি যে, বায়রন এবং শেলি ভূতের গল্প লিখেছিলেন কি না!
উইলিয়ম গডউইনের মেয়ে মেরি ওলস্টোনক্রাফ্ট জন্মগ্রহণ করেন ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দের ৩০ আগস্ট লন্ডন শহরে। ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে কবি শেলি প্রথম স্ত্রী হ্যারিয়েট ওয়েস্টব্রুকের মৃত্যুর পর মেরি শেলিকে বিয়ে করেন। তাঁর প্রথম বই ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’ প্রকাশিত হয় ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে। শেলির মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ইটালিতেই ছিলেন, কিন্তু পরে ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন। মিসেস শেলি ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দের ২১ মে মারা যান।
কে এই ডক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন? গল্পের গরুকে গাছে চড়াবেন ঠিক করেও, শেষাবধি ছোটখাটো একটা বিপ্লব করেই ফেললেন মেরি শেলি। ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের বয়ানে জানান দেওয়া হল তাঁর জীবনের গতি ও প্রকৃতি, এইভাবে:
‘ছেলেবেলা থেকে আমার কলকব্জা এবং বিজ্ঞানের দিকে অত্যন্ত ঝোঁক। অবাক হয়ে দেখতাম কেমন দম দিলে রেলগাড়ি ছুটে চলে, ছোট পুতুল প্রভৃতি নাচে। দিন দিন বিজ্ঞানের ওপর আমার শ্রদ্ধা বেড়ে যেতে লাগল। তারপর যখন বড় হলাম, তখন এক চিন্তা আমাকে পেয়ে বসল– কলকব্জা দিয়ে যদি পুতুল চালানো সম্ভব হয়, মানুষ গড়া কি অসম্ভব হবে? মানুষ যদি মানুষের প্রাণ নিতে পারে, তবে চেষ্টা করলে কি প্রাণ দিতে পারে না? দিনরাত শুধু ভাবতাম, কী করে মানুষ তৈরি করব।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
বস্তুত মানবসভ্যতার কিছু আদি ও মৌলিক প্রশ্নই উঠে গেল মেরি শেলির কলমের কালির আঁচড়ে। আর রচিত হল বিশ্বসাহিত্যের প্রথম কল্পবিজ্ঞানের লক্ষণাক্রান্ত, কল্পগল্পের বা ফ্যান্টাসির ছাঁচের মধ্যে বিজ্ঞানকে ঢেলে ফেলে তৈরি করা এক রসালো ভিয়েন। চোখ বড় বড় করে বিস্ময় আর ভয় নিয়ে গিলবে পাঠক সেই গল্প তার পরের ২০০ বছর । আশ্চর্যভাবে এই ‘হলেও হতে পারত ভূতের গল্প’ রচিত হয়ে গেল নারীকলমে। টেক এ বাও, মেরি শেলি!
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
শুধু সেইজন্যই বাবার শত অমতে, বন্ধু ক্লেরভালের নিষেধ সত্ত্বেও মা’র চোখের জল অগ্রাহ্য করে ইঙ্গলস্টাট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান পড়তে গেলাম। আমার অধ্যাপকদের মধ্যে দু’জন– প্রফেসর ক্রেম্প আর প্রফেসর ওয়াল্ডমান– ঠিক আমার মতোই অদ্ভুত প্রকৃতির ছিলেন। তাঁদের দু’জনের কাছে আমি শুনতাম অ্যালকেমির যুগের অসাধ্যসাধনের প্রচেষ্টার কাহিনি, কত অলৌকিক ঘটনা– সে যুগের বিজ্ঞান যার কারণ দেখাতে পারেনি, অথচ অনেক বিস্ময়কর ঘটনা সম্ভব হয়েছে। বিশেষ করে প্রফেসর ওয়াল্ডমান আমার এই পাগলামির প্রধান সহায়ক হয়ে উঠলেন। পড়াশোনা শেষ হয়ে গেল, বাড়িতে ফিরে গেলাম– কিন্তু মাথায় সেই একই চিন্তা– কী করে মৃতে জীবন সঞ্চার করা যায়, কী করে নতুন মানুষ সৃষ্টি করা যায়– যে মানুষ জ্ঞানে, বুদ্ধিতে, কর্মশক্তিতে সাধারণ মানুষের চেয়েও বড় হবে। যাকে দিয়ে নতুন এক সুন্দর পৃথিবী সৃষ্টি করা যাবে।’
বস্তুত মানবসভ্যতার কিছু আদি ও মৌলিক প্রশ্নই উঠে গেল মেরি শেলির কলমের কালির আঁচড়ে। আর রচিত হল বিশ্বসাহিত্যের প্রথম কল্পবিজ্ঞানের লক্ষণাক্রান্ত, কল্পগল্পের বা ফ্যান্টাসির ছাঁচের মধ্যে বিজ্ঞানকে ঢেলে ফেলে তৈরি করা এক রসালো ভিয়েন। চোখ বড় বড় করে বিস্ময় আর ভয় নিয়ে গিলবে পাঠক সেই গল্প তার পরের ২০০ বছর । আশ্চর্যভাবে এই ‘হলেও হতে পারত ভূতের গল্প’ রচিত হয়ে গেল নারীকলমে। টেক এ বাও, মেরি শেলি! আজ্ঞে হ্যাঁ, সাই-ফাই বা সাই-ফি-র আদি মাতা মেরি শেলিই। আর এখান থেকে একটা রাস্তা তৈরি হয়ে যাচ্ছে মানব সভ্যতার। স্পেকুলেটিভ ফিকশনের।
একটা কথাই আছে, যে সায়েন্স ফিকশন বা কল্পবিজ্ঞান (‘কল্পবিজ্ঞান’ এই শব্দযুগল কিন্তু অদ্রীশ বর্ধনের তৈরি এবং বেশিদিনের নয়। সাতের দশকের মাত্র। ইংরেজি সায়েন্স যুক্ত ফিকশন এই সন্ধিকে তিনি ধড়েমুড়ো উল্টে দিলেন, কল্পনাকে প্রাধান্য দিয়ে বিজ্ঞানকে নজরবন্দি রাখলেন। অদ্রীশের উদ্দেশ্য ছিল, বিজ্ঞান আগে নয়, বরং একটা সঠিক ও নিটোল গল্প বলাই বেশি করে জরুরি আদর্শ সাই-ফাই লেখকের!) আসলে সেই সেই প্রশ্নেরই উত্তর দিতে চায়, ধর্ম যে যে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে চায়। ওই যে আগেই বললাম আদি ও মৌলিক প্রশ্ন। যেমন– ‘এলেম আমি কোথা হতে?’, মানুষের উৎস কী?, মানবতার সংজ্ঞা কী?, বিজ্ঞান ভাল না মন্দ?, আশীর্বাদ না অভিশাপ? আর হ্যাঁ, মানবসভ্যতার অন্তে কী আছে? প্রগতি একরৈখিক না হাজারমুখো। সব শেষ ভালোতে, না কি মন্দে? ধর্মের বিক্রি করা আইডিয়া স্বর্গ নরকের বদলে, সাই-ফাই দেখতে চায় মানবসভ্যতার গন্তব্য কি ইউটোপিয়ায় না ডিসটোপিয়ায়?
আর তাই, মেরি শেলিও তাঁর অনবধানেই রচে ফেলেন পৃথিবীর প্রথম সাই-ফাই নভেলটি। যেখানে বিজ্ঞানকে মানুষের উপকারার্থে ব্যবহার করতে গিয়েও শেষাবধি ভয়াল এক ডিসটোপিয়ায় গিয়ে শেষ হয় সবটা।
কিন্তু ১৮১৮-র সেই নারীলিখিত কল্পগল্পের পরে, আমাদের মেয়ে বাংলার বেগম রোকেয়া ইউটোপিয়া লিখলেন ১৯০৫ সালে। যে টেক্সট শুধু কল্পবিজ্ঞান লক্ষণাক্রান্তই নয়, তা আবার নারীবাদী টেক্সটের লক্ষণেও আক্রান্ত।
কেন? পরের কিস্তিতে বলব সে কথা।
(চলবে)
যথাসম্ভব নো মেকআপ লুক নিয়ে ফ্লোরে গিয়ে বসলাম আমার নির্দিষ্ট জায়গায়। তরুণ চক্রবর্তী ঢুকল। অন্যান্য দিন কুশল বিনিময় হয়, আজ কেবল স্তব্ধতা। শুরু করলাম অধিবেশন, চিরাচরিত হাসিটি আজ মুখে নেই। তারপরেই তরুণের মুখে উচ্চারিত হল প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর নিহত হওয়ার সংবাদ। ঘোষিত হল রাষ্ট্রীয় শোক।