‘গীতা’ গ্রন্থটির প্রতি রবীন্দ্রনাথের শ্রদ্ধা গভীর। গীতা যে হিন্দুত্ববাদীদের জড় মন্ত্রের সংকলন মাত্র নয়, তা যে অনুধাবনের উপলব্ধির উচ্চারণ, তা রবীন্দ্ররচনায় নানা ভাবে ফিরে-ফিরে এসেছে। আমরা গীতা পড়ি না, অনুধাবনও করি না। তবে ‘গীতা’ নামক গ্রন্থটিকে ধর্মীয় লোকাচারের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারকারী। সে ব্যবহারের জন্য বঙ্গদেশের বইপাড়ায় নানা আকারের গীতা পাওয়া যায়। সে গীতা পড়ার জন্য নয়, শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে দান করার জন্য। না-খুলে না-পড়ে তা অর্থলিপ্সু ব্রাহ্মণকে দান করে হিন্দুত্বের লোকাচারের শিকড়ে জল দান করি।
সমবেত কণ্ঠে গীতা পাঠ করার মধ্যে আর যাই থাক চিন্তা আর বিবেচনা যে নেই, তা রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়লেই বোঝা যায়। তা অবশ্য পড়ছেই বা কে আর শুনছেই বা কে? আমরা গীতা পড়ি না, অনুধাবনও করি না। তবে ‘গীতা’ নামক গ্রন্থটিকে ধর্মীয় লোকাচারের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারকারী। সে ব্যবহারের জন্য বঙ্গদেশের বইপাড়ায় নানা আকারের গীতা পাওয়া যায়। সে গীতা পড়ার জন্য নয়, শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে দান করার জন্য। না-খুলে না-পড়ে তা অর্থলিপ্সু ব্রাহ্মণকে দান করে হিন্দুত্বের লোকাচারের শিকড়ে জল দান করি। সেই শিকড় রয়েছে বলেই লক্ষ কণ্ঠে ময়দানে গীতা পড়ার রাজনৈতিক আয়োজন। তাতে গীতা উস্কানিমূলক ধর্মধ্বজীদের জড়মন্ত্রে পরিণত হতে পারে, গীতার ভাবদর্শন তাতে প্রকাশ পাবে না। হিন্দুত্ববাদীরা তাই চান। গীতার সামঞ্জস্যের দর্শনে ও আচরণের ধর্মে তাঁদের মতি নেই। ‘গীতা’ বলতে তাঁরা কেবল যুদ্ধের হুংকার আর একজন সর্বময় দেবতার হুংকারকে বোঝেন। দেবতার বদলে এখন তাঁদের চাই হিন্দুত্ববাদী সর্বময় নেতা।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
ছাতিমতলা। পর্ব ১৭: ক্রিকেটের রাজনীতি ও সমাজনীতি, দু’টি বিষয়েই তৎপর ছিলেন রবীন্দ্রনাথ
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
‘গীতা’ গ্রন্থটির প্রতি রবীন্দ্রনাথের শ্রদ্ধা গভীর। গীতা যে হিন্দুত্ববাদীদের জড় মন্ত্রের সংকলন মাত্র নয়, তা যে অনুধাবনের উপলব্ধির উচ্চারণ, তা রবীন্দ্ররচনায় নানা ভাবে ফিরে-ফিরে এসেছে। ‘গোরা’ উপন্যাসে জানিয়েছিলেন তিনি, ‘সে সময়ে বাংলাদেশে ইংরেজিশিক্ষিত দলের মধ্যে ভগবদ্গীতা লইয়া আলোচনা ছিল না। কিন্তু পরেশবাবু সুচরিতাকে লইয়া মাঝে মাঝে গীতা পড়িতেন– কালীসিংহের মহাভারতও তিনি প্রায় সমস্তটা সুচরিতাকে পড়িয়া শুনাইয়াছেন।’ ব্রাহ্ম পরেশবাবুর এই আচরণে দলচর-ব্রাহ্ম হারানবাবু বিরক্ত হতেন। তাতে অবশ্য পরেশবাবু অবিচলিত। কারণ, ‘পরেশবাবু … তাঁহার শাস্ত্রচর্চা এবং ছোটোখাটো নানা বিষয়ে ব্রাহ্ম-অব্রাহ্মের সীমা রক্ষা করিয়া চলিতেন না …।’ রবীন্দ্রনাথও পরেশবাবুর মতো– কোনও ধর্মীয় দার্শনিক গ্রন্থ বিচারের ক্ষেত্রে তিনি একেবারেই সংকীর্ণমনা নন। কোনও গ্রন্থকে যখন ধর্মীয় দল-বিশেষ বিচার না করে বোধহীন কুক্ষিগত মন্ত্রের অবয়ব বলে প্রচার করতে চায় তখন সেই মন্ত্রতন্ত্রের অচলায়তন ভেঙে ফেলার পক্ষপাতী রবীন্দ্রনাথ।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ছাতিমতলা। পর্ব ১৬: রবীন্দ্রনাথ কি ক্রিয়েটিভ রাইটিং শেখানোর কিংবা কপি এডিটিং করার চাকরি পেতেন?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
গীতার কোন বিষয়গুলি তাঁকে আকর্ষণ করত? খেয়াল করলে দেখা যাবে রবীন্দ্রনাথ কখনও গীতাকে যুদ্ধের প্রচারগ্রন্থ হিসেবে বিচার করেননি, সর্বময় অবতারত্বের অস্তিত্ব প্রচারই যে এই গ্রন্থের উদ্দেশ্য তাও তিনি বিশ্বাস করতেন না। রবীন্দ্রনাথকে গীতার প্রতি আগ্রহী করে তুলেছিলেন পিতা দেবেন্দ্রনাথ। শান্তিনিকেতন আশ্রমের রূপ ও বিকাশের কথা বলতে গিয়ে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘ভগবদ্গীতা-গ্রন্থে কতকগুলি শ্লোক তিনি চিহ্নিত করে দিয়েছিলেন, আমি প্রতিদিন কিছু কিছু তাই কপি করে দিতুম তাঁকে।’ বালক রবির কাছে কপি করা মানে তো দেখে-দেখে লেখা মাত্র নয়– লিখতে লিখতে সেই ভাবে ডুবে যাওয়া, বিচার করা। শৈশবে যার সূত্রপাত তাই পরবর্তী কালে রবীন্দ্রচিত্তে বিশেষ পরিণতি লাভ করেছিল। রবীন্দ্রনাথ গীতার ভাবনাকে নানা ভাবে সম্প্রসারিত করে নিতে পেরেছিলেন, এখানেই তাঁর মৌলিকত্ব। প্রকৃতপক্ষে আদি-সনাতনের মধ্যে বদ্ধ থাকা যে ধর্মাচরণ নয়, ভাব বিশেষকে নব নব ব্যাখ্যায় সম্প্রসারিত করাই যে যথার্থ ধর্মাচারণ, তা নিয়েই তো লিখেছিলেন ‘অচলায়তন’-এর মতো নাটক।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ছাতিমতলা। পর্ব ১৫: কবি রবীন্দ্রনাথের ছেলে হয়ে কবিতা লেখা যায় না, বুঝেছিলেন রথীন্দ্রনাথ
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
রবীন্দ্রনাথ খেয়াল করেছিলেন গীতার শিক্ষা মহাত্মা গান্ধীর জীবনবীক্ষার মধ্যে নতুন ভাষ্যরূপ লাভ করেছে। রবীন্দ্রনাথ গান্ধীর জীবনের সূত্রে মনে করতেন, ‘ধর্মযুদ্ধ বাইরে জেতবার জন্য নয়, হেরে গিয়েও জয় করবার জন্য। অধর্মযুদ্ধে মরাটা মরা। ধর্মযুদ্ধে মরার পরেও অবশিষ্ট থাকে; হার পেরিয়ে থাকে জিত, মৃত্যু পেরিয়ে অমৃত।’ একথা বিশ্বাস করতেন বলেই তো গান্ধী অহিংস ধর্মের প্রচারক। মেরে জেতা যায় না, সাময়িক আধিপত্য কায়েম করা যায় মাত্র। যখন রবীন্দ্রনাথ গান্ধীর সূত্রে এই কথাগুলি লিখছিলেন, গীতার ‘ধর্মযুদ্ধ’ শব্দটির অন্তর্গত ব্যাখ্যা করছিলেন গান্ধীর জীবন দর্শনের সূত্রে তখনও তিনি জানতেন না অনাগত ভবিষ্যতে গান্ধীকে হত্যা করা হবে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গান্ধী ধর্মান্ধ হিন্দুর হাতে নিহত হলেন, তার অনেক আগেই রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ হয়েছে। তবু রবীন্দ্রনাথের অনেক আগে লেখা কথাগুলি তাৎপর্যবাহী হয়ে উঠল– ধর্মযুদ্ধে গান্ধীর সেই মৃত্যু পরাভব নয়, ‘ধর্মযুদ্ধে মরার পরেও অবশিষ্ট থাকে; হার পেরিয়ে থাকে জিত, মৃত্যু পেরিয়ে অমৃত।’ খণ্ডিত দাঙ্গা-বিধ্বস্ত ভারতবর্ষে সম্প্রীতিপন্থীরা আজও গান্ধীর কথা মনে রাখেন।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ছাতিমতলা। পর্ব ১৪: ছোট-বড় দুঃখ ও অপমান কীভাবে সামলাতেন রবীন্দ্রনাথ?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ভারতবর্ষের ইতিহাসের গতির সঙ্গে গীতার ভাবনাকে মিলিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারা সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলার ধারা। পাশ্চাত্য ঔপনিবেশিক শক্তি বিভিন্ন দেশে এই সামঞ্জস্য বিনষ্ট করেছে বলে মনে করতেন রবীন্দ্রনাথ। লিখেছিলেন সকলকে আইন করে বলের দ্বারা একরকম করতে হবে এই অলীক ঐক্যের বাহুবলী বিলাস এ দেশের ইতিহাসে চোখে পড়ে না। প্রকৃতপক্ষে পার্থক্য স্বাভাবিক ও অনিবার্য। সেই পার্থক্যকে স্বীকার করতে হবে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘ভারতবর্ষ বিসদৃশকেও সম্বন্ধবন্ধনে বাঁধিবার চেষ্টা করিয়াছে। যেখানে যথার্থ পার্থক্য আছে, সেখানে সেই পার্থক্যকে যথাযোগ্য স্থানে বিন্যস্ত করিয়া– সংযত করিয়া তবে তাহাকে ঐক্যদান করা সম্ভর। ’ কীভাবে এটা সম্ভব হল? ‘ভারতবর্ষ সমাজের সমস্ত প্রতিযোগী বিরোধী শক্তিকে সীমাবদ্ধ ও বিভক্ত করিয়া সমাজকলেবরকে এক এবং বিচিত্রকর্ম্মের উপযোগী করিয়াছিল– নিজ নিজ অধিকারকে ক্রমাগতই লঙ্ঘন করিবার চেষ্টা করিয়া বিরোধ-বিশৃঙ্খলা জাগ্রত করিয়া রাখিতে দেয় নাই।’ এই যে সামাজিক সাম্য ও সামঞ্জস্য এ রয়েছে গীতার ধর্মের মধ্যেও। ‘গীতায় জ্ঞান, প্রেম ও কর্ম্মের মধ্যে যে সম্পূর্ণসামঞ্জস্য-স্থাপনের চেষ্টা দেখি, তাহা বিশেষরূপে ভারতবর্ষের।’ জ্ঞান, প্রেম ও কর্মের সামঞ্জস্য বলতে কী বোঝায়? এর কোনও একটিই চূড়ান্ত নয়– হৃদয়হীন জ্ঞানী কিম্বা জ্ঞানহীন হৃদয়বিলাসী মানুষ অসম্পূর্ণ। আবার জ্ঞানবিলাস ও হৃদয়বিলাস যদি কর্মবিমুখ করে তাহলেও চলবে না।
রবীন্দ্রনাথের এই সামঞ্জস্যের ভাবনা রাজনৈতিক ময়দানে অর্থহীন। ভয় করে। যা বিবেচনার বিষয় তাকে চিৎকারের ও ঘোষণার জড়বস্তু করে তোলার রাজনৈতিক মেঘ আবৃত করে ফেলবে না তো!