‘পাও’ মানে যেখানে রুটি, আমরা তাতে আবার রুটি শব্দটা জুড়ে খাবারের ছন্দে ব্যাঘাত সৃষ্টি করলাম। যুক্তি দিলাম, পা দিয়ে ময়দা মেখে রুটি বানানো হয় বলে নাম পাউরুটি, যেটা এক্কেবারেই ভুল কথা। বরং তার চেয়ে সহজ লজিক হল, পাউরুটির ওজন পাউন্ডে মাপা হত বলে সেখান থেকে পাউরুটি। কিন্তু কে মাথার দিব্বি দিয়েছিল বাঙালিকে ওজন আর ভোজন এক করতে! ‘ডিম-পাউরুটি’ নামের বদলে যদি নামটা ‘ডিমপাও’ হত, হলফ করে বলতে পারি সে খাবার সুপারহিট হয়ে যেত সারা বিশ্বে।
অনির্বাণ হালদার বলে এক পাঠক দুঃখ করে লিখেছেন, ডিম-পাউরুটি এত জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও আর চাহিদা থাকা সত্ত্বেও ‘কাল্ট’ স্ট্যাটাস পেল না বলে। সেই এক সমস্যা– নামের।
‘পাও’ কথাটা আদপে পর্তুগিজ। পর্তুগিজরা এদেশে এসে খাবার নিয়ে বিস্তর ঝামেলায় পড়েছিল কিন্তু ক্রমে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছিল। একটা জায়গায় কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছিল না তারা, তা হল ওদের রুটি। উত্তর ভারতের মানুষ মূলত আটার রুটি খায়, যেটা তাদের পোষায় না। আরব থেকে ময়দা এসে পড়লেও সেই ময়দা দিয়ে তৈরি নান বা পরোটায় ইস্ট নেই, যার জন্য যে ধরনের রুটিতে তারা অনেক শতাব্দী ধরে অভ্যস্ত, যে রুটি ওদের মূল খাবার, সেই রুটি ওরা পাচ্ছে না। পূর্ব ভারতের মানুষদের যেমন দীর্ঘদিন ভাত ছেড়ে থাকতে একটু ‘চাপ’ হয়ে যায়, ইউরোপের মানুষদের রুটি ছাড়া একই অবস্থা হয়। এতটাই সেখানে রুটির প্রতি ভালোবাসা যে, শুধু জার্মানিতেই তিনশো রকমের পাউরুটি পাওয়া যায়। অস্ট্রিয়াতে পাউরুটির একটা আস্ত মিউজিয়াম আছে। কিন্তু ওখানে কি পাউরুটি বলে? মোটেও না, বললে এই কৌলীন্য পেত না! জার্মানি আর অস্ট্রিয়াতে ব্রত্ বলে, ফ্রান্সে প্যাঁ, স্প্যানিশে প্যান্ আর পর্তুগিজে পাও। খেয়াল করার মতো ব্যাপার, নামে একটা সুর, একটা আভিজাত্য আছে। পর্তুগিজরা যখন ইস্টের পরিবর্তে কয়েক ফোঁটা টডির রস দিয়ে তাদের স্বাদের রুটি বানাল, সেই রুটিকে স্বাভাবিকভাবেই ‘পাও’ নাম দিল। এই পাও প্রথমে হিন্দুদের কাছে বিধর্মীদের খাবার হলেও শিল্প বিপ্লবের সময়ে পরিস্থিতি বদলে গেল। সুতোর মিলগুলো তখন উৎপাদন বাড়িয়ে বেশি লাভ করতে চাইছে, শ্রমিকরা দৈনিক উৎপাদনের ভিত্তিতে মাইনে পায়। দেখা গেল, হিন্দু শ্রমিকরা রোজগারে পিছিয়ে পড়ছে, কারণ তাদের ঘর থেকে নিয়ে আসা টিফিন খেতে অনেক বেশি সময় লাগে। তাদের মুসলমান আর খ্রিস্টান সহকর্মীরা সেখানে আশপাশের কিছু দোকান থেকে মাংসের ঝোল আর এই পাও খেয়ে অনেকটা সময় বাঁচিয়ে নিয়ে, ফের কাজে লেগে যাচ্ছে, কারণ তাদের খাবারের ওপর ছুঁৎমার্গ নেই। অগত্যা হিন্দুরা পাওয়ের শরণাপন্ন হল। দোকান থেকে কেনা নিরামিষ সবজির তরকারির সঙ্গে পাও খেতে শুরু করলে, তাদের অনেকটা সময় বেঁচে গেল। আর তাদের খাওয়া সেই মশলাদার সবজির সঙ্গে পাও একত্রে ‘পাওভাজি’ নামে জনপ্রিয় হয়ে উঠল। আর তার সঙ্গে জনপ্রিয় হল ‘বড়াপাও’– পাওয়ের মধ্যে বড়া দিয়ে খেয়ে নিলে হাত ধোয়ার সময় অবধি বেঁচে যায়। আর সময়ের সঙ্গে এই পাওভাজি আর বড়াপাও এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠল যে, শুধু দেশের সমস্ত কোণে নয়, বিদেশেও সমানভাবে জনপ্রিয়।
আর আমরা কী করলাম? ‘পাও’ মানে যেখানে রুটি, আমরা তাতে আবার রুটি শব্দটা জুড়ে খাবারের ছন্দে ব্যাঘাত সৃষ্টি করলাম। যুক্তি দিলাম, পা দিয়ে ময়দা মেখে রুটি বানানো হয় বলে নাম পাউরুটি, যেটা এক্কেবারেই ভুল কথা! বরং তার চেয়ে সহজ লজিক হল, পাউরুটির ওজন পাউন্ডে মাপা হত বলে সেখান থেকে পাউরুটি। কিন্তু কে মাথার দিব্বি দিয়েছিল বাঙালিকে ওজন আর ভোজন এক করতে! ‘ডিম-পাউরুটি’ নামের বদলে যদি নামটা ‘ডিমপাও’ হত, হলফ করে বলতে পারি সে খাবার সুপারহিট হয়ে যেত সারা বিশ্বে। ফ্রেঞ্চ-টোস্ট তো আদপে ডিম-পাউরুটিই– কিন্তু সমস্ত পাঁচতারা হোটেলে প্রাতরাশের বুফেতে জ্বলজ্বল করে। সেই নামের জোরে। এক্কেবারে ডিমসাম আর মোমোর গল্প। ডিমসাম খাবারটায় কী আছে? সব মোমোই তো একপ্রকারের ডিমসাম! আর ডিমসামও আদপে পথচলতিদের খাবার। কিন্তু নামের কৌলীন্যের জোরে ডিমসাম যেখানে বড় বড় রেস্তরাঁয় বহাল তবিয়তে রাজকীয় কেতায় ট্রলিতে চেপে ঘুরে বেড়াচ্ছে, নামের ফেরে মোমো পাড়ার মোড়ের দোকানে আর পাহাড়ি রাস্তাতেই আটকে গিয়েছে। ডিম-পাউরুটির গল্প আরও করুণ। অফিস পাড়া বা কলেজ ক্যান্টিন, সব জায়গায় মধ্যবিত্তের রসনাকে সন্তুষ্ট করেও হিন্দি গানের তাল হয়ে গিয়েছে, ডিম-পাউরুটি/ ডিম-পাউরুটি/ ডিম-পাউরুটি।
আগেই বলেছি না, নামে অনেক কিছু এসে যায়!
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved