গয়াধাম যাত্রার আগে পর্যন্ত শুধু নবদ্বীপে নয়, শ্রীহট্টেও অধ্যাপনার কাজে গিয়েছিলেন চৈতন্য। তারপর তাঁর আমূল পরিবর্তন ঘটে, তখন শুধু কৃষ্ণ প্রেমরসে তিনি সিক্ত, সদা ভাব গদগদ। পাণ্ডিত্যের অভিমান রহিত, নয়নে কৃষ্ণ বিরহে জর্জর। শাস্ত্রের পাঠ ছেড়ে শুধু কৃষ্ণকথা। এমনই একদিন ছাত্রদের সঙ্গে তাঁর উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের পরে, লাঠি হাতে তেড়ে গেলেন নিমাই, তারা কৃষ্ণকথা শুনতে আগ্রহী না হওয়ায়। ছাত্রেরাও সম্মিলিত ভাবে প্রতি আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে থাকে। এমতাবস্থায় সন্ন্যাস নেওয়ার পরিকল্পনা নিলেন তিনি।
১০.
নবদ্বীপ হেন গ্রাম ত্রিভুবনে নাই।
যথা অবতীর্ণ হইলা চৈতন্য গোঁসাই।।
চৈতন্য ভাগবত-এর প্রণেতা বৃন্দাবন দাসের এই উক্তিতে কোনও অতিকথন নেই।
কি আধ্যাত্মিক, কি ঐতিহাসিক দিক থেকে, নবদ্বীপ বাস্তবে গুরুত্বপূর্ণ ও অনন্য। নবদ্বীপ কিন্তু আদতে কোনও পৃথক গ্রাম নয়, নয়টি দ্বীপের সমষ্টি। দ্বীপগুলি হল যথাক্রমে অন্তদ্বীপ (মায়াপুর এলাকা), সীমন্তদ্বীপ (সরডাঙ্গা, সিমলা এলাকা), গোদ্রুমদ্বীপ (গাদিগাছা ইত্যাদি), মধ্যদ্বীপ (মাজিদিয়া, ভালুকা প্রমুখ), কোলদ্বীপ (ফুলিয়া, সমুদ্রগড়), ঋতুপুর (রাতপুর, বিদ্যানগর প্রমুখ), মোদদ্রুম দ্বীপ (মামগাছি, মহতপুর), জহ্নুদ্বীপ (জাননগর), ও রুদ্রদ্বীপ (রাদপুর)। প্রথম চারটি দ্বীপ গঙ্গার পূর্বপাড়ে আর শেষের পাঁচটি গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত। কোনও এক সময়ে এই ন’টি দ্বীপ ঘিরে থাকত গঙ্গা আর জলঙ্গী নদীদ্বয়। পরে চরভূমি বিস্তৃত হতে থাকে।
নদীয়া রাজ্য মানেই একদা লোকে বুঝত বল্লাল সেনের গোটা বাংলা। গৌড়েশ্বর বল্লাল একাদশ শতাব্দীর মাঝ বরাবর সময়ে বঙ্গের সিংহাসনে আসীন হন। আদিশূরের আমলে আনীত পঞ্চব্রাহ্মণ নিতান্ত জৈবিক কারণেই এদেশীয় ব্রাহ্মণ ও কায়স্থদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে রক্ত তথা আচরণের শুদ্ধতায় বিচ্যুত হয়েছিলেন। বল্লাল সেন তাঁদের ওই বিচ্যুতি অনুযায়ী কৌলিন্য দান করে সামাজিক বিবর্তন এনেছিলেন। কিছু ঐতিহাসিক অবশ্য বল্লাল সেনের অন্য উদ্দেশ্যও প্রমাণ করেছেন। তাঁর মৃত্যু হলে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন তাঁর ছেলে লক্ষ্মণ সেন। বড় বিচিত্র চরিত্রের মানুষ এই লক্ষ্মণ সেন। বাপের মতোই বিদ্যোৎসাহী, রাজসভায় বাঘা বাঘা কবি, পণ্ডিতদের ভিড়। জয়দেব, ধোয়ী, উমাপতি ধরের মতো কবি, ছিলেন হলায়ূধের মতো পণ্ডিত প্রবর। বৈষ্ণব হয়েও শাক্ত-তান্ত্রিক মতে দীক্ষা নিয়েছিলেন। তবে কি না বৃদ্ধ বয়সে বখতিয়ার খিলজি যখন অতর্কিত আক্রমণে নদীয়া জয় করলেন, তখন অসহায় লক্ষ্মণ সেন বিনা যুদ্ধে হার স্বীকার করে পালিয়ে প্রাণে বেঁচেছিলেন। সেই দিক থেকে দেখলে এই নদীয়াতেই মুসলমান রাজত্বের সূচনা হল, তবে কি না গোটা বঙ্গ বিজয় করতে তাদের আরও ১০০ বছরের বেশি সময় লেগে গিয়েছিল।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
তাই শুধু বৈষ্ণব ভক্তেরা নয়, নবদ্বীপে সারা বছর ভর যাঁরা আসেন, তাঁরা চৈতন্যের টানেই আসেন বললে বিশেষ ভুল হবে না বোধ করি। নবদ্বীপ জুড়ে প্রায় সর্বত্রই চৈতন্যের স্মৃতি বিজড়িত নানান অঞ্চল, ভবন। একাধিক বাড়িকেই চৈতন্যের আদি নিবাস, জন্মস্থান বলে বাণিজ্যের চেষ্টাও রয়েছে অবশ্য। কিন্তু কোথায় জন্মেছিলেন শ্রী চৈতন্য? পণ্ডিতেরা বলেন, নবদ্বীপের যে অংশে তাঁর জন্ম হয়েছিল, সেই নবদ্বীপ আজ গঙ্গাগর্ভে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
তারও আগে পাল রাজাদের আমলেও নবদ্বীপ ছিল তাঁদের রাজধানীর অংশ, এবং সেই আমলে বৌদ্ধ প্রভাব ছিল যথেষ্ট। লক্ষ্মণ সেনের পরাভবের প্রায় ৩০০ বছর পরে এই নদীয়াতে আবির্ভূত হন নবদ্বীপচন্দ্র বিশ্বম্ভর মিশ্র, উত্তরকালে শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য ভারতী। একদা শ্রীহট্ট থেকে অদ্বৈত আচার্যের নেতৃত্বে একদল বৈষ্ণব এসে জড়ো হয়েছিলেন নবদ্বীপে। নবদ্বীপ তখন গোটা বাংলায় জ্ঞানচর্চার অন্যতম কেন্দ্র। অধিকাংশ আধিবাসীই ব্রাহ্মণ কুলোদ্ভব, সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত। শাস্ত্র ও ধর্মের গূঢ় বিষয়গুলি অধ্যয়নের জন্য দেশ-বিদেশ থেকে ছাত্রেরা আসত নবদ্বীপে। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে চিহ্নিত করেছেন কোনও কোনও পণ্ডিত নবদ্বীপকে। বাসুদেব সার্বভৌম, রঘুনাথ শিরোমণি, পরে স্মার্ত রঘুনন্দন নবদ্বীপ আলো করে তখন বিরাজমান। কাশী, মথুরা, মিথিলা থেকে শিক্ষার্থীরা নবদ্বীপে এসে শাস্ত্রের পাঠ নিতেন। নিমাই নিজেও সেকালের অন্যতম বিখ্যাত পণ্ডিত রূপে দেশ-দেশান্তরে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তাঁর নিজস্ব একখানি টোলও ছিল। বৃন্দাবন দাস লিখেছেন,
নানা দেশ হইতে লোকে নবদ্বীপে যায়।
নবদ্বীপে পড়িলে সে বিদ্যারস পায়।।
গয়াধাম যাত্রার আগে পর্যন্ত শুধু নবদ্বীপে নয়, শ্রীহট্টেও অধ্যাপনার কাজে গিয়েছিলেন তিনি। তারপর তাঁর আমূল পরিবর্তন ঘটে, তখন শুধু কৃষ্ণ প্রেমরসে তিনি সিক্ত, সদা ভাব গদগদ। পাণ্ডিত্যের অভিমান রহিত, নয়নে কৃষ্ণ বিরহে জর্জর। শাস্ত্রের পাঠ ছেড়ে শুধু কৃষ্ণকথা। এমনই একদিন ছাত্রদের সঙ্গে তাঁর উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের পরে, লাঠি হাতে তেড়ে গেলেন নিমাই, তারা কৃষ্ণকথা শুনতে আগ্রহী না হওয়ায়। ছাত্রেরাও সম্মিলিতভাবে প্রতিআক্রমণের প্রস্তুতি নিতে থাকে। এমতাবস্থায় সন্ন্যাস নেওয়ার পরিকল্পনা নিলেন তিনি। কাটোয়ায় গিয়ে কেশব ভারতীর মতো অখ্যাত এক বৈষ্ণবের কাছে সন্ন্যাস নিলেন, নাম হল শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য ভারতী। ভারতের কোণায় কোণায় নব উদ্দীপনায় জাগ্রত হল আত্মশক্তি, কেননা শ্রীচৈতন্য দিলেন ভরসা– ভক্তের কোনও জাত হয় না। জাতি ও বর্ণবিভক্ত ভারতে ভক্তিবাদের স্রোতে সেই বিভেদের স্রোত হল স্তিমিত। বিশেষ করে সেইসব মানুষ এই আধ্যাত্মিক গণতন্ত্রের পতাকা তলে এসে দাঁড়ালেন, যাঁরা এতদিন হিন্দু হয়েও মূল স্রোতে তাচ্ছিল্য, আর অবমাননার শিকার হতেন প্রতিনিয়ত।
তাই শুধু বৈষ্ণব ভক্তেরা নয়, নবদ্বীপে সারা বছর যারা আসেন, তারা চৈতন্যের টানেই আসেন বললে বিশেষ ভুল হবে না বোধ করি। নবদ্বীপ জুড়ে প্রায় সর্বত্রই চৈতন্যের স্মৃতি বিজড়িত নানান অঞ্চল, ভবন। একাধিক বাড়িকেই চৈতন্যের আদি নিবাস, জন্মস্থান বলে বাণিজ্যের চেষ্টাও রয়েছে অবশ্য। কিন্তু কোথায় জন্মেছিলেন শ্রীচৈতন্য? পণ্ডিতেরা বলেন, নবদ্বীপের যে অংশে তাঁর জন্ম হয়েছিল, সেই নবদ্বীপ আজ গঙ্গাগর্ভে। জলঙ্গীর একদিকে নবদ্বীপ, অপর পাড়ে মায়াপুর। সেখানে বল্লালঢিপি নাকি বল্লাল সেনের রাজবাটীর ভগ্নস্তূপ। আবার একদল দাবি জানিয়ে আসছেন, এই মায়াপুরই নিমাইয়ের সত্যিকারের জন্মস্থান। কৃষ্ণনগরের একদা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট কেদারনাথ দত্ত, যিনি তাঁর ভক্ত মহলে ‘কেদারনাথ ভক্তি বিনোদ’ নামে পরিচিত, ১৮৮৬ সাল নাগাদ এমন দাবিটি প্রথম তুলে ধরেন। প্রথমে কান্তিচন্দ্র রাঢ়ী ও পরে ব্রজমোহন দাস তাঁর সেই দাবিকে নস্যাৎ করেন। মিঞাপুরের নাম বদল করে মায়াপুর করার কৃতিত্বও কেদারনাথ দত্তেরই। মিঞাপুরে ছিল সেই কাজির ভিটা, যে কাজিকে নিমাই দলন করেছিলেন বলে প্রমাণ করেছেন কান্তিচন্দ্র ও ব্রজমোহন দাস।
তবে বর্তমানে মায়াপুর বিখ্যাত ইসকনের বিরাটাকার মন্দিরের জন্য। সারা পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে প্রত্যহ এই মন্দির দর্শনে হাজার হাজার মানুষ আসেন, অনেকে থেকেও যান। ইসকন বা ‘আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃৎ সঙ্ঘ’-র স্থাপনা করেন প্রভুপাদ অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরে ১৯৬৬ সালে। আর তার পরের বছরই মায়াপুরে চন্দ্রোদয় মন্দিরটি নির্মিত হয়। আজ সেই মন্দিরটি পৃথবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মন্দির বলে স্বীকৃত।
নবদ্বীপ ধামে দর্শনীয় স্থানের অধিকাংশই চৈতন্য নামাশ্রিত ও স্মৃতিবিজড়িত। তবে পোড়ামাতলায় পোড়ামা-র মন্দির, ভবতারণ ও ভবতারিণীর মন্দির ও মূর্তি বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। দেওয়ান কার্ত্তিকচন্দ্র রায় লিখিত ‘ক্ষিতীশ বংশাবলী’ অনুযায়ী নদীয়া রাজ রাঘব রায় নবদ্বীপে একখানি গণেশ মন্দির তৈরি করিয়ে গণেশের একখানি মূর্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়ার কথা আছে, যদিও তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে রুদ্র রায় সেটি সম্পূর্ণ করেন। পরে সেই মূর্তি ভেঙে গেলে রাজা গিরিশচন্দ্র রূপ পরিবর্তন করে ভবতারিণী ও রাঘবেশ্বর শিব প্রতিষ্ঠা করেন। অসাধারণ সেই ভবতারিণী মূর্তি, দেবী পদ্মাসনে উপবিষ্টা মহাকালের বক্ষোপরি আসীন। তবে রাঘবেশ্বর শিবের মন্দিরটি মন্দির-স্থাপত্যে উৎসাহীজনেদের কাছে বিশেষ আকর্ষণীয়, অষ্টকোণাকৃতি এই শিখর মন্দিরটির জুড়ি অত্যন্ত বিরল। নবদ্বীপের পোড়ামা এক লৌকিক দেবী, নিত্য পূজিতা। বটগাছের তলায় আজও একটি ঘটে দেবীর আরাধনা হয়ে থাকে। এছাড়া সোনার গৌরাঙ্গ মন্দির, অদ্বৈতাচার্যের বাড়ি ও অসংখ্য বৈষ্ণব আখড়া ও মন্দির নবদ্বীপ শহরের আনাচ কানাচ ভরে রয়েছে।
প্রসঙ্গত অনেকের মতে, বঙ্গে কালী সাধনার অন্যতম পথিকৃত ও ‘তন্ত্রসার’ গ্রন্থের প্রণেতা কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ ও চৈতন্য সমসাময়িক ছিলেন। উভয়েই নবদ্বীপবাসী হওয়ার কারণে পরস্পর পরস্পরকে চিনতেন ও দু’জনের বন্ধুত্বও ছিল। যদিও একে অপরের সাধন পথ নিয়ে কখনও বিবাদ করেননি। মুসলমান শাসন কালে এখানে আসা ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কারণেই গড়ে ওঠে বেশ কিছু মসজিদ। এই সমস্ত কিছু একত্রে মিলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, নবদ্বীপে সর্বধর্মের সমাহার আজও বর্তমান।
নরহরি চক্রবর্তী ‘নবদ্বীপ পরিক্রমা’ নামে একখানি বইতে নবদ্বীপের ‘ঐশ্বর্য’ বর্ণনা করেছিলেন পদ্যছন্দে। বিষ্ণুপুরাণ উদ্ধৃত করে নবদ্বীপের মহিমা কীর্তন করে, তিনি উপসংহারে লিখেছিলেন,
ভারতের বর্ষ ভেদ শ্রীনবদ্বীপ হয়।
বিস্তারিয়া শ্রীবিষ্ণুপুরাণে নিরূপয়।।
কী সেই বর্ষভেদ, ব্যাখ্যা করে তিনি লিখেছেন,
ইথে যে বিশেষ বিষ্ণুপুরাণে প্রচার।
সর্ব্বধামময় এ মহিমা নদীয়ার।।
(চলবে)
…পড়ুন তীর্থের ঝাঁক-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৯। দেবী কামাখ্যার পুজোর নেপথ্যে রয়েছে আদিবাসীদের কৃষিকাজের উৎসব
পর্ব ৮। শতবর্ষ আগে বাংলার প্রথম সত্যাগ্রহ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তারকেশ্বর মন্দিরকে ঘিরে
পর্ব ৭। বামাক্ষ্যাপার টানে তারাপীঠে এসেছিলেন বিবেকানন্দ, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ
পর্ব ৬। তান্ত্রিক, কাপালিক এবং ডাকাতদের থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কালীঘাটে পুজো দিতেন যাত্রীরা
পর্ব ৫। কপিলমুনির আশ্রম খুঁজে না পেয়ে ‘শতমুখী’ হয়েছিল গঙ্গা
পর্ব ৪। কোন উপায়ে লুপ্ত বৃন্দাবনকে ভরিয়ে তুললেন রূপ-সনাতন?
পর্ব ৩। পুত্র রাম-লক্ষ্মণ বিদ্যমান থাকতেও পুত্রবধূ সীতা দশরথের পিণ্ডদান করেছিলেন গয়ায়
পর্ব ২। এককালে শবররা ছিল ওড়িশার রাজা, তাদের নিয়ন্ত্রণেই পুজো পেতেন জগন্নাথদেব
পর্ব ১। ছোটবেলায় ছবি দেখেই কাশীধামে যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন ম্যাক্সমুলার সাহেব