মেগাস্থিনিসের ভারত ভ্রমণ বিবরণেও গঙ্গাসাগরের উল্লেখ পাওয়া যায়। পরে পর্তুগিজ জলদস্যুরা বাংলায় এসে এই অঞ্চলে ব্যাপক লুঠতরাজ করায় যাত্রীদের আনাগোনা দীর্ঘকাল বন্ধ প্রায় ছিল। ইংরেজ আমলে পুনরায় সেসব উপদ্রব বন্ধ হলে মকর সংক্রান্তি দিবসে পুণ্যস্নান ও বিরাট এক মেলা চালু হয়। বস্তুত, ১৮১৯ সালে ওয়ারেন হেস্টিংসের ব্যবস্থাপনায় ধীরে ধীরে সাগরদ্বীপে জনবসতি গড়ে উঠতে থাকে। ক্রমে রাস্তাঘাট ও টেলিগ্রাফ অফিস তৈরি হয়।
৫.
কথায় বলে ‘সব তীর্থ বারবার, গঙ্গাসাগর একবার’। সে কি এই তীর্থের দুর্গমতার জন্য? মনে হয় না, কারণ ভারতে আরও এমন অনেক তীর্থ আছে, যেখানে পথ বিপদসঙ্কুল, পদে পদে মৃত্যু আশঙ্কা, তবু গঙ্গাসাগরের অভিনবত্বই তাঁর মূল আকর্ষণ। স্পষ্টতই সগর রাজার ভস্মীভূত ৬০,০০০ ছেলে এখানে গঙ্গার পুত পবিত্র সলিল স্পর্শে মুক্তি লাভ করে স্বর্গবাসী হতে পেরেছিলেন যে তীর্থে সেটি ‘মুক্তিতীর্থ’ রূপেই পরিচিত। ফলে অন্যান্য তীর্থ বারবার দর্শনে যে পুণ্য হয়, তার তুলনায় এই তীর্থে একবারেই সকল পাপের মোচনে মোক্ষলাভ নিশ্চিত হয়। কিংবা হয়তো সকল তীর্থের সার গঙ্গাসাগর, তাই একবারেই সকল তীর্থ-দর্শনের ফল লাভ হয়ে যায়।
সগর রাজা মনস্থ করেন দশাশ্বমেধ যজ্ঞ করবেন, যা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলে সসাগরা পৃথিবীর একচ্ছত্র অধীশ্বর হতে পারবেন তিনি। ঘোড়া ছুটল দিগ্বিদিকে, সঙ্গে গেলেন তাঁর ৬০,০০০ পুত্রসন্তান। প্রত্যেকেই বীর যোদ্ধা, রণপণ্ডিত, কে রোখে তুরগের গতি! এমনিভাবে ঘুরতে ঘুরতে ঘোড়া কপিলমুনির আশ্রমের কাছে এসে কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল। সগর তনয়রা এসে দাঁড়ালেন কপিলের আশ্রমের দ্বারে। মুনিবর তখন ধ্যানমগ্ন, মৌনী। সগরপুত্ররা বারংবার প্রশ্ন করলেও মুনি নীরব হয়েই রইলেন। অহংকারী রাজপুত্ররা বিষম কোলাহল করতে শুরু করলেন। সেই উৎপাতে ধ্যানভঙ্গ হল মুনির, ক্রোধ-কষায়িত নয়ন দু’টি মেলে তাকালেন তাদের দিকে। নিমেষে ভষ্ম হয়ে গেল পুত্রদল। ওদিকে, অনেকদিন পার হয়ে গেলেও ছেলেদের কোনও খবর না পেয়ে উদ্বিগ্ন রাজা চারদিকে চর পাঠালেন, কিন্তু কোথাও কোন খবর পাওয়া গেল না। তারপর কত যুগ কেটে গেল। সগর রাজার উত্তরপুরুষরা তপস্যায় বসলেন, পিতৃপুরুষের আত্মার উদ্ধারকল্পে। অবশেষে এলেন ভগীরথ। সগর রাজার নাতি অংশুমান, তাঁর নাতি ভগীরথ। অংশুমান কপিলমুনির আশ্রমে এসেছিলেন, নানাভাবে বন্দনা করে কপিলমুনিকে তুষ্ট করে ঘোড়াটিকে উদ্ধার করে ফিরেছিলেন, জেনে নিয়েছিলেন পূর্বপুরুষদের উদ্ধারের উপায়– স্বর্গের অলকানন্দাকে মর্ত্যে আনতে হবে, কেবল পুতপবিত্র গঙ্গার স্পর্শেই উদ্ধার পেতে পারেন দগ্ধ ৬০,০০০ সগর-তনয়।
কিন্তু স্বর্গের নদী গঙ্গাকে মর্ত্যে আনা সহজ কাজ নয়, হাজার হাজার বছর ধরে তপস্যা করতে করতে, তবে গিয়ে শেষে গঙ্গা ব্রহ্মার আদেশে মর্ত্যে যাবেন স্থির হল। কিন্তু তাতেও নানা বাধা, নানা দেবতার তপস্যা করে, তাঁদের সন্তুষ্ট করে তবে গঙ্গা চললেন ভগীরথের সঙ্গে। রামায়ণ, মহাভারতের মতো মহাকাব্যে তো বটেই, কত না সাধু-ঋষি, পণ্ডিত, কবি পরিব্রাজকের কথায়, লেখায় ধরা আছে গঙ্গানদীর যাত্রাপথের কথা। এমনকী, বিদেশি পরিব্রাজক, যাঁরা এদেশে নানা সময়ে, নানা কারণে এসে নিজেদের ভ্রমণ বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করেছেন, তাঁরাও গঙ্গা নদীর কথা, তার তীরে গড়ে ওঠা নানা শহরের কথা, গঙ্গার মাহাত্ম্যের কথা ব্যক্ত করে গেছেন।
আসলে গোটা ব্যাপারটাই যে ইন্দ্রের চক্রান্ত কিংবা মর্ত্য-জীবের উদ্ধারে গঙ্গার নিযুক্তি, ঈশ্বরের ইচ্ছানুক্রমে ঘটেছিল, সে-কথা অনেক পরে জানা যায়। কিন্তু সগর রাজার ছেলেদের উদ্ধারের জন্য ভগীরথের গঙ্গা-আনায়ন পৌরাণিক কাহিনি হলেও ভারতীয় সংস্কৃতির এক অনন্য অভিধা খুঁজে পেতে সাহায্য করে। বস্তুত গঙ্গার ওই প্রবাহের কারণে গড়ে ওঠে জনপদ, বিকশিত হয় ভারতীয় সভ্যতা।
দেবতাদের আদেশে গঙ্গা তো মর্ত্যে যাবেন, সেখানে পাপক্লিষ্ট মানুষদের পাপহরণ করবেন, কিন্তু সেই পুঞ্জীভূত পাপের বোঝা থেকে কিভাবে মুক্ত হবে গঙ্গা? বিষ্ণু জানালেন,
‘শ্রীহরি বলেন যত বৈষ্ণব জগতে।
তাহারা আসিয়া স্নান করিবে তোমাতে।।
বৈষ্ণবের সঙ্গতি বাসনা করি আমি।
বৈষ্ণবের সঙ্গতে পবিত্র হবে তুমি।।’
এদিকে, বিষ্ণুর আশ্বাস পেয়ে ভগীরথের অনুসরণ করে চলেছেন গঙ্গা। দিন যায়, মাস পেরিয়ে বছর ঘোরে, চলতেই থাকেন দু’জনে। শেষে একদিন গঙ্গা জিজ্ঞেস করেন ভগীরথকে, কোথায় তাঁর পূর্বপুরুষেরা? ভগীরথ উত্তর করেন কপিলমুনির আশ্রমে যেতে হবে। অরণ্যময় বাংলার কোন জায়গায় কপিলমুনি তাঁর আশ্রম গড়ে ছিলেন তা কিন্তু জানা ছিল না তাঁদের দু’জনেরই। কেননা সাংখ্য-দর্শন প্রণেতা কপিলই যদি এই কপিলমুনি হন, তবে তো তাঁর হদিশ জানার কথাও নয়, কেননা তিনি যে বেদবিরোধী নাস্তিক বলেই পরিচিত ছিলেন। পরে অবশ্য আস্তিক্য মতাবলম্বী বলেও স্বীকৃত হন। উত্তর ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদী-অধ্যুষিত এলাকায় তাঁর স্থান হয়নি। কিন্তু এই হল ভারতবর্ষ, কাউকে পরিপূর্ণভাবে ব্রাত্য করে না, সাদরে সকলকেই কাছে টানে, ধরে রাখে। আত্মস্থ করে নেয়– নয়া ভাব ও তার জনককে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
রামায়ণ, মহাভারতের মত মহাকাব্যে তো বটেই, কত না সাধু-ঋষি, পণ্ডিত, কবি পরিব্রাজকের কথায়, লেখায় ধরা আছে গঙ্গানদীর যাত্রাপথের কথা। এমনকী বিদেশি পরিব্রাজক, যাঁরা এদেশে নানা সময়ে, নানা কারণে এসে নিজেদের ভ্রমণ বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করেছেন, তাঁরাও গঙ্গা নদীর কথা, তার তীরে গড়ে ওঠা নানা শহরের কথা, গঙ্গার মাহাত্ম্যের কথা ব্যক্ত করে গেছেন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
কৃত্তিবাসের রামায়ণে এরপর সন্ধান মেলে এক অদ্ভুত তথ্যের। কপিলমুনির আশ্রম খুঁজে না পেয়ে গঙ্গা ‘শতমুখী’ হয়েছিলেন। তারপর গঙ্গার স্পর্শ পেয়ে ভগীরথের পূর্বপুরুষেরা স্বর্গধামে যাত্রা করলেন। কৃতজ্ঞ ভগীরত গঙ্গাকে প্রণতি জানালেন। গঙ্গা বললেন,
‘গঙ্গা বলে দেশে যাও রাজার নন্দন।
সাগরের সাথে আমি করিব মিলন।।
মহাতীর্থ হইল সেই সাগর সঙ্গম।
তাহাতে যতেক পুণ্য কে করে বর্ণন।।’
তার মানে কি গঙ্গা কপিল আশ্রমের থেকে আরও এগিয়ে তবেই সাগরের সাথে মিলিত হয়েছিলেন, নতুবা সগর পুত্রদের উদ্ধারের পরে আরও এগিয়ে কেন যাবে গঙ্গা? মহাভারতেও গঙ্গাসাগরের উল্লেখ আছে। যুধিষ্ঠির এসেছিলেন সাগরসঙ্গমে স্নান করতে। সেখানে পথে ‘পঞ্চশত’ নদী দেখেছিলেন। তবে এক অদ্ভুত কথা পাওয়া যায় কাশীদাসী মহাভারতে, ‘ভগীরথ হৈতে সমুদ্রেতে হৈল জল’।
১৮৩৭ সালের ‘হরকরা’ পত্রিকায় লেখা হয় ‘ঐ স্থানে (গঙ্গাসাগরে) এক মন্দির আছে তাহা লোকে কহে যে ১৪০০ বৎসর হইল গ্রথিত হইয়াছে’। তবে কি না বারবার প্লাবন ও ঝড়ে আদি মন্দির কোথায় ছিল এবং কবে সেটি ধ্বংস হয়ে যায় তার হদিশ মেলে না। ১৯৬১ সালে বর্তমান মন্দিরটি গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়।
যেকোনও সংক্রান্তি দিবসেই পুণ্যতীর্থে স্নান হিন্দুদের পালনীয়, তবে মকর সংক্রান্তিতে স্নান বিশেষ তাৎপর্য হল ওইদিন থেকে সূর্যের উত্তরায়ণ শুরু হয়। এই উত্তরায়ণে মনে করা হয়, দেবতাদের দিনের শুরু আর দক্ষিণায়ণে দেবতাদের রাত্রির সূত্রপাত। দেবতাদের জাগরণের পুণ্যপ্রভাতে শুচিস্নাত হয়ে দেবতাদের অর্চনা করার নির্দেশ শাস্ত্রীয় বিধান।
মেগাস্থিনিসের ভারত ভ্রমণ বিবরণেও গঙ্গাসাগরের উল্লেখ পাওয়া যায়। পরে পর্তুগিজ জলদস্যুরা বাংলায় এসে এই অঞ্চলে ব্যাপক লুঠতরাজ করায় যাত্রীদের আনাগোনা দীর্ঘকাল বন্ধ প্রায় ছিল। ইংরেজ আমলে পুনরায় সেসব উপদ্রব বন্ধ হলে মকর সংক্রান্তি দিবসে পুণ্যস্নান ও বিরাট এক মেলা চালু হয়। বস্তুত, ১৮১৯ সালে ওয়ারেন হেস্টিংসের ব্যবস্থাপনায় ধীরে ধীরে সাগরদ্বীপে জনবসতি গড়ে উঠতে থাকে। ক্রমে রাস্তাঘাট ও টেলিগ্রাফ অফিস তৈরি হয়। তবে বাঘের উৎপাত যে ছিল, সেকথা তো বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসে বলেছেন। তাছাড়া ১৮৫৩ সালে ‘সম্বাদ প্রভাকর’-এর তথ্য অনুযায়ী, সেনা নিয়োগ করে তোপের সাহায্যে বাঘ তাড়াতে হয়, তাও তিনজন নাবিক বনে কাঠ কাটতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারায়। তবুও নিরাপত্তার আশ্বাস পেয়ে লোকে ভারতের নানা প্রান্ত থেকে সাগরে পুণ্যস্নানে আসতে শুরু করেন। হরিদ্বার ও নাসিকের কুম্ভমেলায় এই মেলার জনসমাগমের সঙ্গে একমাত্র তুলনীয়। ১৮৩৭ সালেই ‘সমাচার দর্পণ’ জানিয়েছে, ‘ভারতবর্ষের অতিদূর দেশ অর্থাৎ লাহোর, দিল্লী, বোম্বাই হইতে যে বহুতর যাত্রী সমাগত হইয়াছিল তৎসংখ্যা পাঁচ লক্ষের ন্যূন নহে’।
কাকদ্বীপ থেকে নদী পার হয়ে সাগরদ্বীপের উত্তরে চক্রবেড়িয়া থেকে অথবা কচুবেড়িয়া থেকে সারা বছরই লোকে এই তীর্থে গিয়ে থাকেন। তবে মকর-স্নানের মেলায় শুধু যে সাধুসন্ত আর তীর্থযাত্রীদের ভিড় থাকে এমন নয়, সঙ্গে থাকেন বহু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, আর নানা প্রদেশের ব্যবসায়ীরা। মন্দিরের পরিচালনার দায়িত্বে আছেন আযোধ্যার রামানন্দী-আখড়া। কোন এক সময়ে এই অঞ্চলের জমিদার ছিলেন মেদিনীপুরের মানুষ যদুরাম, তিনিই নাকি রামচন্দ্রের পূর্বপুরুষের স্মৃতিবিজড়িত পুণ্য তীর্থের মন্দিরের দায়িত্ব তাঁদের হাতে তুলে দিয়ে যান। তবে মেলার আয়োজন ও সার্বিক ব্যবস্থা পরিচালিত হয় পশ্চিমবঙ্গের সরকারে নিয়ন্ত্রণে।
…পড়ুন তীর্থের ঝাঁক-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৪। কোন উপায়ে লুপ্ত বৃন্দাবনকে ভরিয়ে তুললেন রূপ-সনাতন?
পর্ব ৩। পুত্র রাম-লক্ষ্মণ বিদ্যমান থাকতেও পুত্রবধূ সীতা দশরথের পিণ্ডদান করেছিলেন গয়ায়
পর্ব ২। এককালে শবররা ছিল ওড়িশার রাজা, তাদের নিয়ন্ত্রণেই পুজো পেতেন জগন্নাথদেব
পর্ব ১। ছোটবেলায় ছবি দেখেই কাশীধামে যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন ম্যাক্সমুলার সাহেব