পুকুর ঘিরে নানা ভয়ের সংস্কার জড়িয়ে। কেউ জলে ডুবে মারা গেলে সে হয় পানভূত। হাঁড়ির মতো চুপটি মেরে ভেসে থাকে। সময় আর সুযোগ পেলে সেই পানভূত জলে ডুবিয়ে দেয়। জোছনা-ঝরা রাতে পুকুরের পাড় দিয়ে গেলে শোনা যায় কাঁচা ছেলের কান্না। অদ্ভুত শব্দ। পেত্তার হঠাৎ জ্বলে ওঠা। কারণ দু’ বছরের ছেলেকে কবরস্থ করা হয়েছে পুকুরের ঈশানকোণের পাড়ে। ঠাকুরপুকুর থেকে মাঝে মাঝে অলৌকিক ধূপধুনোর গন্ধ ভাসে বাতাসে।
৪.
‘পুকুর’ শব্দটি এসেছে ‘পুষ্করিণী’ থেকে। মূলে আছে ‘পুষ্কর’ নামে যক্ষ। আবার মেঘও। পুষ্কর যক্ষ ভয়ানক বদরাগী। ইনি পুকুর-দেবতা। পুকুর কাটার সময় দেবতার পুজো করতে হত জাঁক করে। তবে নাগেরা হল পুকুরের পাহারাদার।
নাগেরা পুকুর-দিঘি-খাল-বিলের রক্ষক হিসাবে প্রাচীনকাল থেকে বিশেষ মান্যতা পেয়েছিল। খ্রিস্টাব্দের সূচনায় মথুরা অঞ্চল ছিল নাগ উপাসনার অন্যতম প্রাচীন ঘাঁটি। কণিষ্কের অষ্টম রাজ্যাঙ্কে একটি পুকুর ‘ভূমি’ নামক নাগদেবতার নামে উৎসর্গীকৃত হয়েছিল।
কণিষ্কের ২৬-তম রাজ্যাঙ্কে মন্দিরের প্রস্তরফলকে উৎকীর্ণ লিপি থেকে জানা যায় দধিকর্ণ নাগের কথা। দধিকর্ণনাগ ছিলেন নাগেদের রাজা তথা নাগদেবতা। কুষাণ সম্রাট হুবিষ্কের সময়ে দুই বন্ধু সেনহস্তি এবং ভুনুক তাঁদের কাটানো পুকুরে নাগদেবতার মূর্তি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
বাংলাতে নাগদেবতার কোন মূর্তি পাওয়া না গেলেও পুকুরে নাগকাষ্ঠ পোঁতার অনেক পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। আগে পুকুর কাটার সময় মাঝামাঝি স্থানে আরেকটি কুয়ো তৈরি করে উল্লম্ব কাষ্ঠখণ্ড পোঁতা হত। মাথাটি সর্পাকৃতি বিশিষ্ট। ইনি পুকুরের রক্ষক নাগদেবতার প্রতীক। একেই বলে নাগকাষ্ঠ। লোকবাংলায় বলে, ‘লাগকাঠ’।
যারা পুকুর কাটায় দক্ষ তাদের লোকায়ত নাম ছিল মাট-কাটা মুনিষ। একাজে মুসলমানরাই নাকি ভারি দড়। ধাপে ধাপে পুকুর কাটা হত। ঠিক যেন একখান পেল্লাই কড়াইয়ের মতো সাইজ। পুকুরের মাঝখানটিতে আলাদা চৌবাচ্চা করা হত। গেঁয়ো ভাষায় বলে ‘চুয়ো’।
চুয়োতে পুঁতে দেওয়া হত টকড়িশুদ্ধ ঘট। একখানা বেলগাছের লাগকাঠ। পুষ্কর যক্ষের পুজো করা হত। কামনা করা হত সোমবছর যেন জল থাকে। মাছ হয় ভালো। কেউ যেন না ডুবে যায়। অনেক পুকুর গ্রীষ্মকালে শুকিয়ে এক্কেবারে খটখটি। পুকুর থেকে পাঁক তুলে নেওয়ার পর চুয়ো দেখা যেত। অনেক পুকুরে আবার বেশ খানিকটা গাড় করলে কী সুন্দর রঙিন মাটি পাওয়া যেত। তুলে রাখা হত, দুগ্গাপুজোর আগে মাটির বাড়িতে নিকোনো-চুকোনোর কাজে লাগবে বলে।
পুকুর নিয়ে দু’টি মেয়েলি ব্রত আজও পালিত হয় গ্রামাঞ্চলে। ‘পুণ্যিপুকুর’ আর ‘যমপুকুর’ ব্রত। বৈশাখমাসের কুমারী মেয়েদের ব্রত পুণ্যিপুকুর। উঠোনের মাঝখানে চৌকো করে কাটানো মডেল-পুকুর। ছোলা মটর তেওরা প্রভৃতি দানাশস্যের অঙ্কুর। মানে পুকুর পাড়ে দো’-জমিতে রবিশষ্য। তারপর উঠোন জুড়ে আলপনা– পদ্মলতা, ধানের শিষ, পাখি, সূর্যের উদয় আরও কত কী! তারপর সেই সুরেলা ছড়া।
পুণ্যিপুকুর পুষ্পমালা কে পুজে রে দুপুর বেলা।
আমি সতী লীলাবতী সাত ভায়ের বোন ভাগ্যবতী।।
যমপুকুর ব্রতে ওই একইরকম পুকুর কেটে কচুগাছ, কলমিলতা, ধানগাছ ওই ছোট্টপুকুরে পুঁতে দিতে হবে। মানে খাঁটি গড়ে বা ডোবা। ধানগাছে সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে ফুলের মালা পরানো হয়। আশ্বিন মাসের সংক্রান্তির দিন থেকে কার্তিক সংক্রান্তি পর্যন্ত প্রতিদিন কাক ডাকার আগে ভোরে যমপুজো সেরে নিতে হয় পুকুরপাড়ে বসে।
সংক্রান্তি শেষ হলে লতাপাতার বিসর্জন। অনেক সময় পুকুরে কেউ ডুবে গেলে জলকুমরির পুজো দিতে হয় কড়ি, গোটা ফল, বাতাসা আর প্রদীপ জ্বেলে। কেউবা খোয়াজ খিজিরের উদ্দেশে পুকুরে ভাসায় বেহেস্তের নৌকা বা বেড়া।
পুকুর ঘিরে নানা ভয়ের সংস্কার জড়িয়ে। কেউ জলে ডুবে মারা গেলে সে হয় পানভূত। হাঁড়ির মতো চুপটি মেরে ভেসে থাকে। সময় আর সুযোগ পেলে সেই পানভূত জলে ডুবিয়ে দেয়। জোছনা-ঝরা রাতে পুকুরের পাড় দিয়ে গেলে শোনা যায় কাঁচা ছেলের কান্না। অদ্ভুত শব্দ। পেত্তার হঠাৎ জ্বলে ওঠা। কারণ দু’-বছরের ছেলেকে কবরস্থ করা হয়েছে পুকুরের ঈশানকোণের পাড়ে। ঠাকুরপুকুর থেকে মাঝে মাঝে অলৌকিক ধূপধুনোর গন্ধ ভাসে বাতাসে।
প্রত্নক্ষেত্র থেকে নানা ধরনের মানত বা ছলন অর্থাৎ ভোটিভ পাওয়া গিয়েছে। যেমন পোড়া ও কাঁচা মাটির তৈরি হাতি ঘোড়া বলদ বা ষাঁড়, বিভিন্ন ধরনের মাতৃকামূর্তি, লেখযুক্ত বস্তু, এমনকী, পোড়ামাটির তৈরি পুকুরও এই তালিকায় আছে।
‘ভোটিভ’ বলতে সাধারণত বুঝি, ঈশ্বর বা দেবতার কাছে কোনও প্রতিজ্ঞাপূরণ সূত্রে অথবা ব্রত পালনের পর সংশ্লিষ্ট দেবতাকে উৎসর্গ করা বস্তু বা প্রতিমা।
ভোটিভ পুকুর আসলে নারীদের পালিত ব্রত বিশেষের পর উৎসর্গ করা বস্তু। এটি ধর্মীয় বিশ্বাসের অঙ্গ বিশেষ। বাংলার কোনও প্রত্নক্ষেত্র থেকে ভোটিভ পুকুরের প্রত্ননিদর্শন আবিষ্কৃত না হলেও, মথুরা অহিচ্ছত্র তক্ষশীলার সিরকাপ উৎখননে একাধিক এই ধরনের বৈচিত্রময় বস্তু মিলেছে। আনুমানিক সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতক থেকে খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতক।
ভারতে এই ধরনের ভোটিভ পুকুরের অস্তিত্বের কথা জানা যায় কুষাণযুগে। তবে এর থেকেও প্রাচীন নিদর্শন মিলেছে তক্ষশীলার শিরকাপ উৎখননে। অনেক ঐতিহাসিক ভোটিভ পুকুরের রীতির মধ্যে বিদেশি পার্থিয়ানদের সংস্কৃতি লক্ষ করেছেন, কিন্তু স্যর জন মার্শাল ও অনেক গবেষক ঐতিহ্যটিকে ‘ভারতীয়’ বলে দাবি করেছেন।
ভোটিভ পুকুরগুলি আয়তাকার প্রায়। এগুলি মূলত হাতে তৈরি। কোনওটা আবার উজ্জ্বল লাল রঙের। চারপাশে খানিকটা দেওয়ালযুক্ত অর্থাৎ এগুলো পুকুরের চার পাড়কে নির্দেশ করা হয়েছে। চার কোণে চারটি গোলাকৃতি পাত্র। অনুমান করা যায় এগুলি দীপাধার। পুকুরের ধারে বসা পাখিকেও দেখা যায়। পুকুরে নামার যেমন ঘাট থাকে, ঠিক তেমনই গোলাকৃতি কয়েকটি চাকতি পরপর সাজিয়ে কানা থেকে নিচে পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে।
কোনও কোনও পুকুরের ভিতরে জলজ প্রাণী, যেমন– সাপ, কুমীরকে দেখানো হয়েছে। কানায় পাখি বসে আছে। পুকুরের ভিতরে একদিকে ঠেস দিয়ে বসে আছেন মাতৃকামূর্তি, জলজ প্রাণী এবং বাদ্যকার। বাদ্যকারের সংখ্যা এক থেকে তিন। অনেক বাদ্যকারদের পোশাক-আশাকে পার্থিয়ান সংস্কৃতির ছাপ লক্ষ করা যায়। আবার বাদ্যকর হিসাবে তিনটি বানরের বসে থাকা ভোটিভ পুকুরও পাওয়া গেছে অহিচ্ছত্র থেকে।
ভোটিভ পুকুরের সঙ্গে অনেকটা মিল দেখা যায় বাংলায় পালিত যমপুকুর ব্রতর সঙ্গে।
………………..পড়ুন ঠাকুরদার ঝুলির অন্যান্য পর্ব………………..
পর্ব ৩: পুকুরের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে লোককথা আর লোকবিশ্বাস
পর্ব ২: পৌরাণিক হিন্দু ও বৌদ্ধ সাহিত্যে দেবতা অথবা মানুষের বন্ধু হিসেবেই স্থান পেয়েছে কুকুর
পর্ব ১: সেকালের ডাকাতির গপ্প
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved