সফোক্লিস এবং পাবলো নেরুদা। দুই কিংবদন্তি একমেরুতে। এক অবস্থানে। নতুন সৃষ্টির অভিলাষে তাঁরা নিজেদের লেখার টেবিলের কাছে সমর্পিত। রাজা ইডিপাসের প্রতি দায়বদ্ধতা সফোক্লিসকে ফিরিয়ে এনেছে তাঁর জন্মস্থান– কলোনাসে। ঘরের জানলার কাছে রাখা চেয়ার-টেবিল, সেখানেই সফোক্লিস লিখবেন তাঁর জীবনের শেষ নাটক। উদ্ধার করবেন রাজা ইডিপাসকে অনুতাপের নির্বাসন থেকে। অন্যদিকে, পাবলো নেরুদা। একশো বছর আগে বছর উনিশের নেরুদা তাকিয়ে রয়েছেন এক আকাশ নীল তারার দিকে। আলোকবর্ষ দূরের অলীক আলোয় নেরুদা লিখছেন মৃত্যুহীন প্রেমগাথা, আকাশ-টেবিলকে আশ্রয় করে।
৩.
স্থান: গ্রিস। সময়: যিশু খ্রিস্টের জন্মের ছ’শো বছর আগে। অ্যাথেন্স শহর তখন গ্রিক সভ্যতা, সংস্কৃতি, সাহিত্যের বর্ণময় কেন্দ্র। অ্যাথেন্সের পাশেই কলোনাস। বিখ্যাত গ্রিক নাট্যকার সফোক্লিসের জন্মস্থান। তাঁর শেষ এবং একশোতম নাটকটি লিখতে সফোক্লিস কলোনাসে। সফোক্লিসের বয়স প্রায় নব্বই। একশোতম নাটকটি তাঁকে লিখতেই হবে। না লিখলে মরেও শান্তি পাবেন না তিনি!
রাজা ইডিপাস-এর গল্প আমরা প্রত্যেকেই জানি, অন্তত কিছুটা। ইডিপাসের মেয়ে আন্তিগোনে, তার কাহিনিও আমাদের অজানা নয়। ইডিপাস নিজের অজান্তে বিয়ে করল, অনিরুদ্ধ নিয়তির পাকেচক্রে, তার মা জোকাস্থা-কে। এবং পুত্র ইডিপাস-এর ঔরসে মাতৃগর্ভে দুই ছেলে দুই মেয়ের জন্মও হল। ইডিপাস আর জোকাস্থার দুই ছেলের নাম, ইটিয়োক্লেস আর পলিনিসেস। আর দুই মেয়ের নাম আন্তিগোনে আর ইসমেনে। এদের মর্মান্তিক, অকল্পনীয় ট্র্যাজেডি এবং জীবনযন্ত্রণার কথা ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন সফোক্লিস তাঁর দু’টি নাটকে– ‘ইডিপাস দ্য কিং’ এবং ‘আন্তিগোনে’। কিন্তু একেবারে শেষ জীবনে এসে সফোক্লিস উপলব্ধি করলেন, মাকে বিয়ে করে তার গর্ভে চার সন্তানের জন্ম দিয়ে সত্যিই তো কোনও সচেতন অন্যায় ও পাপ করেনি ইডিপাস। সে যা কিছু করেছে, সে তো সবই দেবতা ও নিয়তির প্যাঁচে পড়ে! এবং যখন ইডিপাস ক্রমশ এসে দাঁড়াল এই অসহনীয় নির্মম সত্যের সামনে যে, সে তার বাবাকে হত্যা করে না জেনে। মাকে বিয়ে করে তার সঙ্গে বছরের পর বছর সহবাসে মাতৃগর্ভে চারটি সন্তানের জন্ম দিয়েছে, তখন তার অসহনীয় পাপবোধ, তার উদ্ভ্রান্ত পরিতাপ তাকে পৌঁছে দিল আত্মপীড়নের চূড়ান্তবিন্দুতে। সে নিজের ‘মা-বউয়ের’ পোশাক থেকে ছাড়িয়ে-নেওয়া একটি আঁকশি দিয়ে উপড়ে ফেলল নিজের দু’টি চোখ! কিন্তু সফোক্লিসের অনুতপ্ত অনুভবে ক্রমশ জেগে উঠল এই সংবেদনা যে, ইডিপাসকে চিরায়ত নরকে এইভাবে ছেড়ে চলে যাওয়া যায় না। কিন্তু কী করে, কীভাবে উদ্ধার করব ইডিপাসকে? এই পৃথিবীতে কোথায় ঠাঁই দেব তাকে? কোথায় মিলবে তার আশ্রয়?
সফোক্লিস এক অদৃশ্য টানে চলে এলেন তাঁর জন্মস্থান কলোনাসে। ফিরে এলেন নিজের ঠিকানায়, নিজের বাড়িতে। যে-বাড়িতে শৈশব কেটেছে তাঁর, সেই বাড়িতেই জীবনের শেষ নাটকটি লেখার জন্য তাঁর ঘরের জানলার পাশে রাখলেন লেখার চেয়ার-টেবিল। এবং ডাকলেন তাঁর যুবক নাতিটিকে। বললেন শোন্, আমি কলোনাসে আমার জন্মভিটায় ফিরে এসেছি আমার শেষ নাটকটি লেখার জন্য। ফিরে এসেছি, রাজা ইডিপাসের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে। তাকে আমি অন্তহীন অন্ধত্বে এবং অনুতাপে নির্বাসন দিতে পারি না। সে তো জেনে কোনও পাপ করেনি, অন্যায় করেনি। সে নিয়তি এবং দেবতাদের শিকার। তাকে আমি উদ্ধার করবই। এবং উদ্ধার করব আমার নিজের জন্মভিটের জানলার ধারে এই লেখার ডেস্কে বসে।
নাতিকে এই কথাগুলি বলে, লেখার জন্য পাতলা পার্চমেন্টটি টেবিলের ওপর বিছিয়ে দেন সফোক্লিস। তারপর নাতির দিকে অভিমানে তাকিয়ে বলেন, ইজিপ্ট থেকে যেসব প্যাপিরাস আসে, তার দাম ক্রমশই বাড়ছে। আর দাম দিলেও বাজারে পাওয়া যায় না। আর এদেশে প্যাপিরাসের তেমন চাষ হলই বা কোথায়! তাই প্যাপিরাসের ছালে না লিখে জন্তু-জানোয়ারের ছালেই আজকাল লিখছি। আমার নাতি হয়েও তুই তো মল্লবীর হয়েছিস। লেখাপড়ার বালাই নেই! তাই প্যাপিরাসে লিখবি না জানোয়ারের ছাল থেকে তৈরি পার্চমেন্টে লিখবি– এসব ভাবনা তোকে ভাবতেই হয় না। তবে তোকে আমার কাছে একটি কাজে প্রতিশ্রুত হতেই হবে।
–কী কাজ দাদু? অবাক নাতির ভীত প্রশ্ন।
–এই নাটকটি শেষ করার পরে আমি আর বেশিদিন বাঁচব না। অ্যাথেন্সে পরের নাট্যোৎসবের দিন আসতে এখনও বছর চারেক। সেই নাট্যোৎসবে আমার এই নাটকটা মঞ্চস্থ করার আয়োজন তোকে করতেই হবে। আমার ধারণা, আমার ‘ইডিপাস দ্য কিং’-এর মতো এই নাটকটাও প্রথম পুরস্কার পাবে। আর সেই পুরস্কার তুই মঞ্চে উঠে আমার হয়ে গ্রহণ করবি।
সফোক্লিসের মল্লবীর নাতি অবাক হয়ে তাকায় তার পরম ভালবাসা ও শ্রদ্ধার দাদুর দিকে। তারপর ছুটে গিয়ে নিয়ে আসে টেবিলের ওপর দাদুর রুপোর ওয়াইন ডিক্যান্টার। দাদুর শ্বেত পাথরের ওয়াইন-পাত্র। তারপর দাদুর কপালে একটা আলতো চুমু খায়। দাদুকে জিজ্ঞেস করে, নাটকটার কী নাম দিয়েছ? সফোক্লিস ওয়াইনে চুমুক দিয়ে গলা ভিজিয়ে জানলা দিয়ে অনেকক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। আকাশের গায়ে পাহাড়ের রেখা। সফোক্লিস শুধু সেই দিকে তাকিয়ে নীরব।
–কী গো দাদু, নাম দাওনি এখনও নাটকটার?
–দিয়েছি।
–তাহলে বলো কী নাম।
–ইডিপাস অ্যাট কলোনাস।
–আমাদের এই কলোনাসে ইডিপাস?
–ঠিক তাই। আমার জন্মস্থানও ইডিপাসের মতোই অমর হয়ে গেল। মানবসভ্যতা কোনও দিন ভুলবে না আমার ‘ইডিপাস দ্য কিং’-কে। যেমন ভুলবে না আমার জন্মস্থান কলোনাস-কে।
–কিন্তু ইডিপাস-এর সঙ্গে কলোনাস-এর সম্পর্ক?
–ওই দূরে আকাশের গায়ে সারি সারি পাহাড়গুলোকে দ্যাখ্। ওই পাহাড়গুলোর মাঝখান দিয়ে চলে গেছে স্বর্গের পথ। ওখানে এসে দাঁড়াবে দেবতারা। মেয়ে আন্তিগোনের হাত ছেড়ে গভীর খাদের পাশ দিয়ে একলা হাঁটতে থাকবে ইডিপাস। দেবতারা নিজে এসে ইডিপাসকে নিয়ে যাবে চিরকালের স্বর্গে। আর তাকে পৃথিবীতে ফিরে আসতে হবে না।
–কিন্তু এসব কথা এমন করে তুমি ভাব কী করে? কে তোমাকে জুগিয়ে চলে এমন সব অসম্ভব ভাবনা? প্রশ্ন করে নাতি।
–আমার লেখার মায়াবী টেবিল!
–তোমার লেখার টেবিল তোমাকে ভাবনার জোগান দেয়? তোমাকে স্বপ্ন দেখায়?
–আমার লেখাও লিখে দেয়, বলেন সফোক্লিস।
–কী বলছ দাদু? তুমি কি ওয়াইন খেয়ে মাতাল হয়ে গেলে না কি?
–মাতাল না হলে কেউ এমন ভাবনা ভাবতে পারে? লিখতে পারে এমন সব বাক্য?
–শোনাও শোনাও কী লিখেছ।
–শোন্ তাহলে–
পৃথিবীতে এমন কেউ রইল না যে বলতে পারে, চোখের সামনে ইডিপাস কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল… হিজ ডিপারচার ওয়াজ্ আ মারভেল্! এই শেষ লাইনটা আমি লিখিনি রে। লিখেছে আমার লেখার এই মায়াবী টেবিল।
নাতির মুখে কোনও কথা নেই। ডিক্যান্টার থেকে আরও খানিকটা ওয়াইন গলায় ঢেলে দেন সফোক্লিস। তারপর চিৎকার করে নাতিকে বলেন,
Consider my story madness if you will
I don’t want your belief!
*****
১৯২৪। ঠিক একশো বছর আগে। একটি উনিশ বছরের ছেলে। সে হারিয়েছে তার প্রাণের তরুণীকে। এই লুপ্তির কোনও ফিরে পাওয়া নেই। উনিশ বছরের ছেলেটি তাকায় এক আকাশ নীল তারার দিকে। তারারা কাঁপছে আলোকবর্ষ দূরত্বের অলীক আলোয়। উনিশ বছরের পাবলো নেরুদা অলীক আলোর তারার অক্ষরে আকাশ-টেবিল জুড়ে লেখে শুধু একটি লাইন: ‘টুনাইট আই ক্যান রাইট দ্য স্যাডেস্ট লাইনস্’। উনিশ বছরের পাবলো জানেও না সে লিখে ফেলল আকাশ– টেবিলের গায়ে খোদাই-করা বেদনার এক মরণহীন প্রেমের কবিতা।
স্প্যানিশ ভাষায় এমন অশ্লীল, এমন সুন্দর, এমন শরীরময়, এমন আত্মাস্নাত প্রেমের কবিতা আর কেউ লেখেনি কখনও। ১৯২৪-এ চিলিতে প্রকাশিত হল স্প্যানিশ ভাষায় এই তনুময় তন্ময় প্রেমগাথা। ১৯৬৯-এ আঠাশ বছরের আমার হাতে এল ডব্লু.এস. মারউইন-এর ইংরেজি অনুবাদে পাবলো নেরুদার ‘বিশটি প্রেমের কবিতা’। বিস্ময়ে কেঁপে উঠল আমার আত্মা: কী অদম্য অশ্লীল, কী অপূর্ব সুন্দর! ১৯৭১: পাবলো নেরুদা পেলেন নোবেল প্রাইজ। সেই বছরেই আমি দ্বিতীয়বার প্রেমে পড়লুম। সে আমার ছাত্রী। আমি তার মেধা ও তনুশ্রীতে আটকে গেছি। জানালাম তাকে, পাবলো নেরুদার বিশটি প্রেমের কবিতা উপহার দিয়ে।
আজ রাতে আমি লিখতে পারি বিধুরতম লাইনগুলি।
তারায় ভরা রাত। এবং তারারা নীল। এবং তারারা কাঁপছে বিপুল দূরত্বে।
রাতের বাতাস পাক খাচ্ছে আকাশে। এবং গাইছে গান।
আজ রাতে আমি লিখতে পারি বিধুরতম লাইনগুলি।
আমি ভালোবেসে ছিলাম তাকে। কখনও কখনও সেও ভালোবেসে ছিল আমাকে।
এইরকম কত রাতে আমি তাকে জড়িয়ে রেখেছিলাম হাতে।
শেষহীন আকাশের তলায় বারবার কতবার তাকে চুমু খেয়েছি।
সে ভালোবেসেছিল আমাকে। কখনও কখনও আমিও তাকে ভালোবেসেছি।
তার অপলক দু’টি অপূর্ব চোখ, না ভালোবেসে থাকা যায়!
আজ রাতে আমি লিখতে পারি বিধুরতম লাইনগুলি।
শুধু যদি ভাবি, সে আর আমার নয়! যদি অনুভব করি, আমি তাকে হারিয়েছি।
যদি শুনতে পাই এই বিশাল রাতটিকে, বুঝতে পারি, তাকে ছাড়া আরও বিপুল এই রাত! এবং যেমন করে শিশির ঝরে তৃণভূমিতে, তেমনই আত্মায় ঝরুক কবিতা।
কী এসে যায় এত ভালোবেসেও তাকে রাখতে পারলাম না।
রাত তারায় ভরা। এবং সে নেই আমার সঙ্গে।
এই হল সার কথা। দূরে কেউ গান গাইছে। অনেক দূরে। আমার আত্মা তাকে হারিয়ে কোনও ভাবেই পাচ্ছে না শান্তি।
আমার চোখ তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আরও কাছে আনতে চায় তাকে।
আমার হৃদয় খুঁজছে তাকে। এবং সে আমার সঙ্গে নেই।
সেই একই রাত সাদা রং করছে একই গাছের গায়ে।
আমরা কিন্তু একই সময়ে আর এক নই।
আমি আর তাকে ভালোবাসি না, এটা নিশ্চিত। কিন্তু কেমন করে তাকে ভালোবেসে ছিলাম।
আমার কণ্ঠস্বর চাইল সেই বাতাস, যে তাকে পৌঁছে দেবে তার কানে।
অন্য কারওর। সে এখন অন্য কারওর। যেমন সে ছিল অন্য কারওর, আমার চুমুর আগে।
তার কণ্ঠস্বর। তার উজ্জ্বল শরীর। তার অনন্ত আঁখি।
আমি আর তাকে ভালোবাসি না। এটা নিশ্চিত। কিন্তু হতেই পারে, আমি তাকে ভালোবাসি।
ভালোবাসা বড্ড কম সময়ের। ভুলতে লাগে কতদিন।
কেননা এই রকম কত রাতে তাকে জড়িয়ে রাখতাম আমার হাতে।
আমার আত্মার এতটুকু শান্তি নেই তাকে হারিয়ে।
যদিও এটাই হোক আমার শেষ কষ্ট, তার দেওয়া শেষ দহন।
এবং এই কবিতাগুচ্ছই তাকে লেখা আমার শেষ কবিতা।
…………………….. পড়ুন কাঠখোদাই-এর অন্যান্য পর্ব ……………………
পর্ব ২: লেখার টেবিল ভয় দেখিয়েছিল টি এস এলিয়টকে
পর্ব ১: একটি দুর্গ ও অনেক দিনের পুরনো নির্জন এক টেবিল