২০২৩-এর আগস্টে খঞ্জ আমি হুইলচেয়ারে প্যারিস ঘুরি। প্যারিসের একটি পানশালায় কুন্দেরা একসময়ে নিয়মিত আসতেন। কামুও আসতেন ওই পানশালায়। ওঁরা যে-টেবিলে বসতেন, সেখানে জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে টেবিল ল্যাম্প। আমি হুইলচেয়ার গড়িয়ে নিয়ে পৌঁছলাম কুন্দেরার টেবিলটির সামনে। আমার প্যারিসে যাওয়ার দিন পনেরো আগে ৯৪ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন কুন্দেরা।
৬.
ভেরা আমার কে? আমার স্ত্রী? আমার সঙ্গিনী? আমার জীবনবন্ধুনি? ভেরা যেই হোক আমার, সে-ও আমার সঙ্গে চেকোস্লোভাকিয়া ছেড়ে চলে এসেছে ১৯৭৫-এর প্যারিসে। শুধু যে দেশ ছেড়েছি আমরা দু’জনে, তা নয়। ছেড়েছি ভাষাও। আর উপন্যাস লিখব না চেক ভাষায়। এখন থেকে আমার সব ভাবনা, সব লেখালিখি হবে ফরাসি ভাষায়। আমাকে ওরা ঠিক পাঁচ মিনিট সময় দিয়েছিল। ওরা মানে সোভিয়েত কমিউনিস্টরা। ওরা বলল আমাকে, তোমার লেখা আমরা পড়েছি। ওই রকম লেখা, ওই রকম ভাবনা, ওই রকম সমাজবিরোধী, ব্যক্তিস্বাধীনতা নিয়ে লেখা আর চলবে না। তোমাকে ঠিক পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি আমরা। তোমার বর্তমান জীবন ও ভাবনার শেষ পাঁচ মিনিট। খুব সহজ একটা কাজ তোমাকে করতে হবে। কাজটা হল, তোমার সমস্ত অতীতটাকে আমাদের কাছে বিক্রি করে দিতে হবে। ভেবে নিতে হবে, তোমার আর কোনও অতীত নেই। তোমার আর তোমার সঙ্গিনী ভেরা, দু’জনের কাছ থেকেই তোমাদের অতীত আমরা কেড়ে নিলাম। এই মুহূর্ত থেকে তোমরা দু’জন অতীতহীন মানব-মানবী। তোমাদের অতীতের বদলে তোমাদের আমরা, কমিউনিস্টরা, উপহার দিচ্ছি একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ। তোমরা কাজ করবে। কিন্তু ভাববে না। শুধু কাজ আর ভাবনাহীন নিশ্চিন্ত জীবন, ব্যস্। ভাবনা বিপজ্জনক। ভেবো না।
সমাজ সংসার কাজ চায়। আর চায় ভাবনাহীন বেঁচে থাকা। ‘কিন্তু তোমরা আমাদের প্রেমপত্রগুলোও কেড়ে নিলে কেন?’ আমি প্রশ্ন না করে পারিনি। ভেরা নীরব, নিথর, কান্নাময়। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। একজন মেশিন-কণ্ঠে বলল, ‘তোমরা প্রেমপত্রে স্বপ্ন দেখছ অন্য রকম পৃথিবীর, যে-পৃথিবী মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর, যে-পৃথিবী আমরা চাই না।’
তাহলে কী চায় এই রাশিয়ান কমিউনিস্টরা, যারা আমাদের দেশটাকে অধিকার করেছে? এই কথাটা পৃথিবীকে জানাতেই হবে, সত্যি কী চাইছে কমিউনিস্টরা? কিন্তু সেটা চেকোস্লোভাকিয়ায় থেকে বললে, দাঁড়াতে হবে বন্দুকের সামনে। মিলান কুন্দেরা আর ভেরা চলে এলেন স্বাধীন ভাবনা, মুক্ত প্রকাশের শহর প্যারিসে। পেলেন ফরাসি নাগরিকত্ব। ভেরা কুন্দেরাকে উপহার দিলেন একটি লম্বা ছাদ। সেই ছাদই হয়ে উঠল ভেরার হাতে সাজানো তাঁদের নতুন নীড়। আর ভেরা কুন্দেরাকে কিনে দিলেন এক নতুন লেখার টেবিল।
কালো পালিশ করা কাঠের টেবিল যার মধ্যে হয়তো খোদাই করা আছে মিলান কুন্দেরা আর ভেরার অদৃষ্ট ভবিষ্যৎ। এই টেবিলে কুন্দেরা লিখতে শুরু করলেন ফরাসি ভাষায় তাঁর প্রথম লেখা। ভেরার দেওয়া নতুন টেবিলটার বুকে কেঁপে উঠল কুন্দেরার পৃথিবী কাঁপানো নতুন ভাবনা:
‘They were letting him know he still had five minutes, the last five minutes, to proclaim loudly he renounces everything he said and did. They were ready to sell people a future in exchange for their past.’
ক্রমশ নতুন টেবিলটার কাছে কৃতজ্ঞবোধ করছেন কুন্দেরা। টেবিলটার বুকেই থরে থরে সাজানো আছে কুন্দেরার মনন, বাক্য, প্রকাশ ও সাহস। তিনি লিখলেন:
‘They wanted to force him to appear on television and explain in a choked voice that he had been in error when he spoke against Russia. They wanted to compel him to cast his life away and become a shadow, a man without a past, an actor without a role.’
আরও একটি লাইন উঠে এল টেবিলের বুক থেকে। কিন্তু লাইনটা লিখবেন কি কুন্দেরা– ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক সেই উক্তি? লেখো, লেখো, ওটাই তো আসল কথা। তুমি প্যারিসে। মুক্ত ভাবনার শহরে। প্রকাশ করো মনের কথা, যেন বলল তাঁর টেবিল। কুণ্ঠাহীন ভাষায়। লিখলেন কুন্দেরা। তারপর অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন তাঁর হস্তাক্ষরে এই অব্যর্থ বাক্যটির দিকে:
‘Having turned him into a shadow,
they would let him live!’
এবার কী লিখবেন মিলান? জানতে চান মেধাবিনী সুন্দরী ভেরা।
‘কী লিখি বলতো!’ ভাবেন কুন্দেরা। আর যেন টেবিলটা থেকে উঠে আসে কুন্দেরার মনের ইচ্ছে, তাঁর বাক্যরাশি।
‘I want to write a book, a book about love, about you and me, about the two of us, our most intimate diary, the diary of our own bodies’– আমি লিখতে চাই একটা পুরো বই, যে-বইয়ের বিষয় ভালবাসা– যে বইয়ের বিষয়, তুমি আর আমি, শুধু আমরা দু’জন, আমাদের নিবিড়তম অন্তরঙ্গ দিনলিপি– আমাদের দুজনের শরীরের দিনলিপি। সমস্ত মানসিক বাধাকে আমি ঝেঁটিয়ে দূর করে সব কথা বলতে চাই। নিজের বিষয়ে সব কথা, আমি কী, আমি কে, আমি কী ভাবছি, ‘And it will be a political book too, a political book about love and a book of love about politics’, পৃথিবীটাকে নতুন করে ভাবতে হবে, গড়তে হবে, করে তুলতে হবে আমাদের মন ও শরীরের মাপের পক্ষে সহনীয়, তোমার শরীর, আমার শরীর দু’জনের পক্ষেই সমান সহনীয়। ‘So that someday there will be a new way of kissing and a new way of loving’– কোনও একদিন আমরা পাব নতুনভাবে চুমু খাবার, নতুনভাবে ভালবাসার পথ। বুঝতে হবে এই হল মিলান কুন্দেরার আধুনিক শ্লেষের অপূর্ব রোম্যান্টিকতা! সমস্ত প্রাচীন, আদিম আখর লুপ্ত করার কী নিটোল নিদর্শন কত সহজে দিতে পেরেছেন কুন্দেরা!
কুন্দেরার এই তথাকথিত বুক অফ লাভ-এ তীব্রতম শ্লেষের জায়গাটি এখানে তুলে না ধরে পারছি না। প্যারিসে তাঁর নির্জন নিভৃত ছাদবাড়িতে ওই একই টেবিলে বসে কুন্দেরা একদিন লিখলেন:
‘১৯৪৮-এর ফেব্রুয়ারি। প্রাগের প্রাসাদের সামনে ক্রমে জমছে সাধারণ নাগরিকদের ভিড়। কারণ কমিউনিস্ট নেতা ক্লেমেন্ট গট্ওয়াল্ড প্রাসাদের বারান্দায়। সেখানে থেকেই শুরু হবে সাধারণ নাগরিকদের প্রতি তাঁর গলাবাজি। ১৯৪৮ মানে বোহিমিয়ার ইতিহাসে এক বিশাল তোলপাড় ও পরিবর্তনের সময়। কমরেডরা গট্ওয়াল্ড-কে ঘিরে দাঁড়িয়ে এই ক্রান্তিকালে। গটওয়াল্ডের পাশেই দাঁড়িয়ে কমরেড ক্লেমেনটিস। শুরু হল তুষারপাত। গট্ওয়াল্ডের মাথায় টুপি নেই। ক্লেমেনটিস নিজের মাথার ফারের টুপিটি পরিয়ে দিলেন গটওয়েল্ডের মাথায়। চারবছর পরের ঘটনা, লিখছেন কুন্দেরা। ক্লেমেনটিসের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ! ফাঁসি হয়ে গেল তাঁর। ইতিহাস থেকে মুছে দেওয়া হল তাঁর নাম। সমস্ত সরকারি ছবিতে লুপ্ত হলেন কমরেড ক্লেমেনটিস। লিখছেন কুন্দেরা, গট্ওয়াল্ডের পাশে ১৯৪৮-এর বারান্দায় যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন ক্লেমেনটিস, সেখানে ফাঁকা দেওয়াল। গট্ওয়াল্ডের মাথায় ক্লেমেনটিসের টুপিটা কিন্তু থেকেই গেছে।’
কুন্দেরার এই হাড়কাঁপানো, হৃদ্পিণ্ড উপড়ে-ফেলা লেখা কী অবিশ্বাস্য সাবলীলতায় উথলে উঠেছে তাঁর পালিশ করা কাঠের টেবিলটার বুক থেকে:
“Ever Since Gottwald has been alone on the balcony. Where Clementis stood, there is only the bare palace-wall. Nothing remains of Clementis but the far hat on Gottwald’s head. The struggle of man against power, is the struggle of memory against forgetting.”
যে সময়ের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি, কী তাৎপর্যময় মিলান কুন্দেরার এই অমোঘ বাক্যটি! ‘ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই আসলে ভুলে যাওয়ার বিরুদ্ধে স্মৃতির লড়াই।’ যেন ভুলে না যাই বেদনা পাই জীবনে মরণে।
২০২৩-এর আগস্টে খঞ্জ আমি হুইলচেয়ারে প্যারিস ঘুরি। প্যারিসের একটি পানশালায় কুন্দেরা একসময়ে নিয়মিত আসতেন। কামুও আসতেন ওই পানশালায়। ওঁরা যে-টেবিলে বসতেন, সেখানে জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে টেবিল ল্যাম্প। আমি হুইলচেয়ার গড়িয়ে নিয়ে পৌঁছলাম কুন্দেরার টেবিলটির সামনে। আমার প্যারিসে যাওয়ার দিন পনেরো আগে ৯৪ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন কুন্দেরা। বেশ কয়েক বছর তিনি বাড়ি থেকে বেরতেন না। কিন্তু যখন তিনি আসতেন এই পানশালায়, একাই আসতেন। পান করতেন সম্পূর্ণ একা। মগ্ন হয়ে ভাবতেন। মাঝেমধ্যে লিখতেন এই টেবিলে, যার সামনে আমি।
পানশালার ছোট্ট টেবিল। আমার মনে হল, এই টেবিল কুন্দেরার কত ভাবনাকেই না বুকে ধারণ করে আছে আজও। কুন্দেরার ভাবনা জ্বলছে টেবিলটার শরীরে, ওই টেবিলল্যাম্পের আলোয়: ‘পঁচিশ বছর ওরা একসঙ্গে থাকল, ভালবাসল পরস্পরকে। তারপর? তারপর ভালবাসা মরতে লাগল ধীরে ধীরে। তারপর একদিন সম্পর্কটা শূন্য হয়ে গেল। এবং নারীটি পুরুষকে বলল ভয়ঙ্কর সত্যকথা, পঁচিশ বছর সহবাসের পর: ‘She told him she had not been satisfied with their lovemaking’. তৃপ্ত না হওয়ার কারণ? জানতে চায় সেই পুরুষ। নারীটি বলে: ‘He had made love to her like an intellectual!’ লিখছেন কুন্দেরা নালিশের অবিকল্প ব্যাখ্যায়: ‘In the political Jargon of those days, the word intellectual was an insult. It indicated someone who did not understand, life and was cut off from people.’ সেই নারী তার যৌনজীবনের একটি হিসেব লিখে রেখেছে তার ডায়েরিতে। কুন্দেরার উপন্যাসে সেই দুর্বার দিনলিপি:
“It’s only arithmetic, very exact arithmetic! My sex-life started at fifteen, I am now sixty five. So I have had a sex-life of fifty years. I assume – and it’s very modest estimate, – that I made love an average of twice a week. That makes a hundred times a year or five thousand in my life. If an orgasm lasts five seconds, I have had twenty five thousand seconds of orgasm. That makes a total of six hours and fifty-six minutes of orgasm. Not bad.”
আমি এই হিসেবের সত্যতা ও নির্ভুলতা যাচাই করিনি। করার প্রয়োজনও বোধ করিনি। একটিই প্রশ্ন জাগল আমার মনে, আমার সামনে পানশালার এই ছোট্ট টেবিলটায় বসেই হয়তো মিলান কুন্দেরা ভাবতে পেরেছিলেন, নাগাল পেয়েছিলেন নারী-পুরুষের যৌন সম্পর্কের এই করুণ সত্যের যে, নারী-পুরুষের সেক্সচুয়াল সঙ্গতি সত্যি হয়তো সম্ভব নয়! অসামঞ্জস্য প্রসূত অতৃপ্ত বাসনা যৌন-সম্পর্কে থেকেই যাবে চিরকাল। মানব-মানবীর যৌন সম্পর্ক হয়তো চিরকালের মৃগতৃষ্ণিকা! নানাভাবে এই চরম এবং পরম সত্যটি থেকে বিন্দু বিন্দু রক্ত পড়ছে মিলান কুন্দেরার একের পর এক উপন্যাসে! সেই রক্তের দাগ হয়তো পাওয়া যাবে তাঁর লেখার টেবিলের গায়ে।
…………………….. পড়ুন কাঠখোদাই-এর অন্যান্য পর্ব ……………………
পর্ব ৫: বিয়ের ও আত্মহত্যার চিঠি– রবীন্দ্রনাথকে যা দান করেছিল লেখার টেবিল
পর্ব ৪: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের টেবিল আর তারাপদ রায়ের খাট, দুই-ই ছিল থইথই বইভরা
পর্ব ৩: টেবিলের গায়ে খোদাই-করা এক মৃত্যুহীন প্রেমের কবিতা
পর্ব ২: লেখার টেবিল ভয় দেখিয়েছিল টি এস এলিয়টকে
পর্ব ১: একটি দুর্গ ও অনেক দিনের পুরনো নির্জন এক টেবিল