আমার নাম কিয়ের্কেগার্দ– সোরেন কিয়ের্কেগার্দ। ১৮১৩ থেকে ১৮৫৫ সাল, এই ক’ বছর পৃথিবীতে ছিলাম আমি। আমার প্রায় সব বই বেরিয়েছে পেঙ্গুইন থেকে। এবং আমার বিশ্বাস আমার সবকটি বই-ই আমার পুরনো টেবিলটার দান। নতুন টেবিল কেনা হল না কোনও দিনই। সময় পেলাম কই? মাত্র তো ৪২ বছরের জীবন– সিডিউস করতে করতেই কেটে গেল।
৯.
লেখার টেবিলটায় আর যেটুকু জায়গা অবশিষ্ট আছে, তাতে একটি সাধারণ মাপের খাতার গতরটুকু কোনওরকমে ধরে যেতে পারে। বাকি টেবিল গিলে ফেলেছে বই। বইগুলোকে সরিয়ে দিলেই হয়। কোথায় সরাব? যে ফ্ল্যাটটায় থাকি, সেখানে সম্ভবত আর একটি বই রাখারও জায়গা নেই। কিন্তু তবু বই কিনছি। কিনেই চলেছি। এবং কীভাবে কোনখানে যে পুরনো বইগুলো তলিয়ে গিয়ে নতুন নতুন বইকে দিব্য জায়গা করে দিচ্ছে, বুঝতে পারি না!
যাকগে মরুকগে! আসল সমস্যায় আসি। আমার একটা লেখার টেবিল চাই। এমন টেবিল যে আমার সমস্যা বুঝে একটা যুৎসই পথ দেখাবে। সমস্যাটা সিম্পল। আরও একটা নতুন মেয়েকে আমার ফুসলানো উচিত হবে কি না? এটা আমার দোষ না গুণ, আমি বলতে পারব না। আপনারা যেভাবে দেখবেন ব্যাপারটা, তার ওপর নির্ভর করবে– এটা দোষ না গুণ।
‘এটা’ মানে ওই ফুসলানো, মেয়েদের সিডিউস করার ব্যাপারটা। আমি মেয়েদের সিডিউস না করে থাকতে পারি না। আর আমার খপ্পরে পড়লে তারাও সিডিউসড্ না হয়ে থাকতে পারে না। আমি যেন অগ্নিশিখা। আর তারা পতঙ্গ।
একটা কথা আমি জানাই আপনাদের। ইদানীং আমি সিডিউস করতে-করতে, ফুসলাতে-ফুসলাতে সম্ভবত কিঞ্চিৎ ক্লান্ত। ক্লান্তির মেন কারণ অবশ্য সিডাকশন-এর শেষে একটা সময় তো আসবেই যখন থলি থেকে বিড়াল বেরিয়ে পড়বে– সেই সময়টার কথা ভাবলে নিজেকে অসহায় লাগে। অপমানিতও মনে হয়। কিন্তু কী করা যায়, ফুসলানোর উত্তেজনা ও আনন্দ থেকে সরে তো যেতে পারছি না। বরং বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সিডিউস করায় আরও বেশি পোক্ত হয়ে উঠছি। দ্য আর্ট অফ সিডাকশন্ আমার হাতের মুঠোয়।
তিন-চারটে মেয়েকে আমি একসঙ্গে সিডিউস করতে পারি। আমার কথাই আমার সবথেকে মারাত্মক, অব্যর্থ অস্ত্র। তিনটি মেয়ে বসে আছে টেবিলের একদিকে। বা আমার বসার ঘরে, কেউ মেঝেতে, কেউ চেয়ারে, কেউ বা আমার পাশেই সোফায়। আমি কথা বলছি। ধরুন, তিন মেয়ের নাম যথাক্রমে ‘অ’, ‘আ’, ‘ই’। ‘অ’ ভালোবাসে ‘দর্শন’। ‘আ’ ভালোবাসে ‘সংগীত’। আর ‘ই’ ভালোবাসে ‘সাজতে’। আমি ‘অ’-এর সঙ্গে কথা বলছি অস্তিত্ববাদ নিয়ে। ‘আ’-এর সঙ্গে মোৎসার্ট। আর ‘ই’-এর সঙ্গে দিনের ঠিক কোন সময় কোন রঙের পোশাক পরা উচিত, বা কোন ঋতুতে কেমন পোশাক– এইভাবে তিনটি মেয়েকে একই সময়ের মধ্যে, একইসঙ্গে ‘সিডিউস’ করে নিজেকে দেখিয়ে দিয়েছি, কাজটা করা যায়! ইনফ্যাক্ট, তিনটি মেয়েই আমাকে আলাদা আলাদা ভাবে বলেছে, আমি ঝরনার মতো কথা বলি। আমার আশ্চর্য সঠিক শব্দ প্রয়োগ সাবলীল এবং অনর্গল। এবং যে-কোনও বিষয়ে আমার জ্ঞান এবং প্রসারিত পড়াশোনা সত্যি মুগ্ধ করে। এবং ‘ই’, যে মেয়ে সাজতে ভালোবাসে, সে আমাকে আভাস দিয়েছে, এবার থেকে আমার পছন্দের অন্তর্বাসে সে আমার কাছে আসবে।
এবার সমস্যার কথাটা বলি। সমস্যাটা হল, আমি একটি নতুন লেখায় হাত দিয়েছি। লেখাটার নাম দিয়েছি, ‘দ্য ডায়েরি অফ আ সিডিউসার’। নামটা কেমন হয়েছে বলুন। ভালো না? আমার তো মনে হচ্ছে, বেস্ট সেলার হবেই হবে। কিন্তু এবার আমার সমস্যার কথাটা শুনলে আপনাদের মায়া হবে কিংবা আমাকে শয়তান ভেবে ভয় পাবেন।
ওই যে তিনটি মেয়েকে আমি একসঙ্গে সিডিউস করলাম, যারা একই সময়ের পরিসরে একই জায়গায়, অর্থাৎ আমার বসার ঘরের মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছিল, তারা পৃথক-পৃথকভাবে আমাকে চিঠি লিখে জানিয়েছে, তারা কেন আমার জন্যে ক্রমশ পাগল হয়ে যাচ্ছে, কীভাবে আমার কথা ও শব্দপ্রয়োগ, ভাষা ও ভাবনা ওদের টানছে। এবং ওরা তিনজনেই আমার বিছানায় আসতে প্রবল ইচ্ছুক! ‘অ’ লিখেছে, আমার কথা শুনতে-শুনতে ‘She felt herself annihilated as a woman.’
এই কথাটা কেমন যেন বেয়াড়া মনে হচ্ছে আমার। ‘অ’ নারী হিসেবে তার অস্তিত্বই হারাল, এমন আমার সিডাকশন-এর পাওয়ার! আমার বেশ অস্বস্তি হচ্ছে এ-কথা পড়ে। ‘আ’ লিখেছে, আমার ভাষা ও ভাবের মধ্যে এমন মারাত্মক প্যাশন, তার কাঁপন ধরছিল। ‘ই’ লিখেছে, সে জানতে ইচ্ছুক সকাল, বিকেল, রাতে মেয়েদের অন্তর্বাসের কোন কোন রং পছন্দ করি।
…………………………………………………
আমার মনন, বুদ্ধিমত্তা, মুখের ও লেখার ভাষা এমনই চমকপ্রদ, এমনই টান তার, মেয়েরা পতঙ্গের মতো আসে। আমার ধনদৌলত তেমন নেই। মেয়েটানার মতো গাড়িবাড়ি বা শরীরের আকর্ষণও নেই। কিন্তু কথা বললেই বাজিমাত! মেয়েরা কী তাড়াতাড়ি আমার বাক্যের মোহে, কথার জালে, বুদ্ধিমত্তার আকর্ষণে আটকে যায়! আর পালানোর পথ পায় না। আর তখুনি শুরু হয় আমার সমস্যা। নিজেকে অপরাধী বলেও মনে হয়। কিংবা একলা অন্ধকার ঘরে বসে কাঁদি।
…………………………………………………
আমার এখন সকল খটকা আমার লেখার টেবিলটাকে নিয়ে। আমার লেখার টেবিলটা বেশ বুড়ো হয়েছে। এবং আমার একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আমাকে ঠিক পথে চালাতে সে অক্ষম বলেই মনে হচ্ছে আমার।
আচ্ছা, আপনারা বলুন তো, একটি নারীকে সিডিউস করা কি ভ্রষ্টাচার? যদি বলেন, অবশ্যই ভ্রষ্টাচার, তাহলে প্রশ্ন করব, আপনারাও যদি শুধু কথা বলে মেয়েদের সিডিউস করতে পারতেন, তাহলে সেই চেষ্টা কি আপনারাও করতেন না? আমি জানি, সিডিউস করা ভ্রষ্টাচার। কিন্তু আমি ভালোবাসি এই ভ্রষ্টাচার। এবং এই ভ্রষ্টাচারের লোভ আমি সামলাতে পারি না। কিছুতেই পারি না। আমার বুড়ো টেবিলটা আমাকে বলছে, এই যে আমি এই বুড়ো টেবিলটার ওপর খাতা রেখে আমি লিখতে বসেছি, আমার ‘ফুসলানোর দিনলিপি’, এখানেই আমার সাহস এবং আধুনিকতা। হয়তো নতুন কোনও টেবিল কিনলে সে আমাকে বারণ করত এই লেখাটা লিখতে। কিন্তু পুরনো টেবিল বলল, পরোয়া কোরো না। সবুজ সংকেত দিচ্ছি। লিখে ফেল লেখাটা।
এত ধানাইপানাইয়ের পর, এবার আসি আসল কথাটায়। ইয়েস, আই অ্যাম আ গ্রেট সিডিউসার। মেয়ে ফুসলাতে দারুণ লাগে। কোনও ক্ষতি তো করছি না। শুধু কথা খরচ করে, অব্যর্থ শব্দবাণে আমি নারীর মন জয় করছি। এটাকে ভ্রষ্টাচারও ঠিক বলা যায় কি? আমার মনন, বুদ্ধিমত্তা, মুখের ও লেখার ভাষা এমনই চমকপ্রদ, এমনই টান তার, মেয়েরা পতঙ্গের মতো আসে। আমার ধনদৌলত তেমন নেই। মেয়েটানার মতো গাড়িবাড়ি বা শরীরের আকর্ষণও নেই। কিন্তু কথা বললেই বাজিমাত! মেয়েরা কী তাড়াতাড়ি আমার বাক্যের মোহে, কথার জালে, বুদ্ধিমত্তার আকর্ষণে আটকে যায়! আর পালানোর পথ পায় না। আর তখুনি শুরু হয় আমার সমস্যা। নিজেকে অপরাধী বলেও মনে হয়। কিংবা একলা অন্ধকার ঘরে বসে কাঁদি।
প্রথমেই একটা কথা, আমার চরিত্রের একটি বড় দুর্বলতা স্বীকার করছি। ইতিহাস থেকে দর্শন, সাহিত্য থেকে সংগীত, ধর্মতত্ত্ব থেকে সমাজতত্ত্ব, রাজনীতি থেকে প্রণয়নীতি– সর্ব বিষয়ে আমার লেখাপড়া চমকপ্রদ। এমনকী, বিজ্ঞান এবং গণিতেও আমি মৌলিক মননের ভান চালিয়ে যেতে পারি। আমার সমস্ত লেখাপড়াটাই মেয়েদের সিডিউস করার জন্য। নারী আমার প্রেমে পড়ে আমার সংলাপ এবং মার্জিত ব্যবহারের টানে। আমি তাদের চোখে চমকপ্রদ ইন্টেলেকচুয়াল। এবং এই যে নারী ফুসলানোর জন্য ঝকমকে লেখাপড়া, তার পিছনে আছে আমার এই পুরনো টেবিলটার সিডিউসিভ্ মতলব, কোনও সন্দেহ নেই আমার তাতে। টেবিলটা আমার সঙ্গে কথা বলে। টেবিলটাই আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে মেয়েদের সঙ্গে ব্যবহার করতে হয়, কীভাবে কথা বলে মেয়েদের মন জয় করা যায়। কীভাবে কোন মেয়ের জন্য দিতে হয় ওয়াইনের অর্ডার, আর কোনও মেয়েকে নিয়ে যেতে হয় তার পছন্দের রেস্তোঁরায়। কত আগ্রহ নিয়ে মেয়েদের কথা শোনার চেষ্টা করতে হয়। আর কীভাবে পরম লগ্নে বেছে নিতে হয় আলতো আদরের প্রথম স্পর্শ। আর খাবার টেবিলে যদি থাকে একটির বেশি নারী, টেবিলই শিখিয়েছে কীভাবে প্রতিটি নারীকেই ভাবাতে হয়, আমি শুধুই তার। এবং টেবিল এই কথাও বলেছে, প্রতিটি নারী যেন এক সময়ে পরস্পরকে প্রশ্ন করে, ‘ডু ইউ ফিল সিডিউজড্?’
কিন্তু এত সব শেখানোর পর টেবিল আমাকে শুধু একটি ব্যর্থতার কোনও উত্তর শেখায়নি। কী উত্তর দেব আমি আমার শেষ ব্যর্থতার? আমার ফুসলানোর ভাষায় যত বর্ণময়তা, সব মরে যায় যখন প্রয়োজন হয় শরীরের জাগরণ ও ভাষা। আজীবন আমি এই অসুখে ভুগছি। আমার শিশ্ন জাগে না। আমার পুংলিঙ্গ সম্পূর্ণ অক্ষম। আমার যৌন-ইচ্ছা যত তীব্র, যৌন-ক্ষমতা ততই দুর্বল। এক কথায় সঙ্গমে সক্ষম নই আমি। এবং সেই কথা আমি জানিয়ে গেলাম আমার ‘দ্য ডায়েরি অফ আ সিডিউসার’ গ্রন্থে। হয়তো অনেকেই পড়েছেন। এখন আলাদাভাবে বেরিয়েছে। তা না হলে আমার ‘আইদার/অর’ বইটির মধ্যেও খুঁজে পাবেন এই সাহসী স্বীকারোক্তি।
………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………………
ঠিক ধরেছেন, আমার নাম কিয়ের্কেগার্দ– সোরেন কিয়ের্কেগার্দ। ১৮১৩ থেকে ১৮৫৫ সাল, এই ক’ বছর পৃথিবীতে ছিলাম আমি। আমার প্রায় সব বই বেরিয়েছে পেঙ্গুইন থেকে। এবং আমার বিশ্বাস আমার সবকটি বই-ই আমার পুরনো টেবিলটার দান। নতুন টেবিল কেনা হল না কোনও দিনই। সময় পেলাম কই? মাত্র তো ৪২ বছরের জীবন– সিডিউস করতে করতেই কেটে গেল।
…………………….. পড়ুন কাঠখোদাই-এর অন্যান্য পর্ব ……………………
পর্ব ৮: অন্ধকারই হয়ে উঠলো মিল্টনের লেখার টেবিল
পর্ব ৭: কুন্দেরার টেবিলে বসে কুন্দেরাকে চিঠি
পর্ব ৬: মানব-মানবীর যৌন সম্পর্কের দাগ লেগে রয়েছে কুন্দেরার লেখার টেবিলে
পর্ব ৫: বিয়ের ও আত্মহত্যার চিঠি– রবীন্দ্রনাথকে যা দান করেছিল লেখার টেবিল
পর্ব ৪: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের টেবিল আর তারাপদ রায়ের খাট, দুই-ই ছিল থইথই বইভরা
পর্ব ৩: টেবিলের গায়ে খোদাই-করা এক মৃত্যুহীন প্রেমের কবিতা
পর্ব ২: লেখার টেবিল ভয় দেখিয়েছিল টি এস এলিয়টকে
পর্ব ১: একটি দুর্গ ও অনেক দিনের পুরনো নির্জন এক টেবিল