Robbar

ধুম জ্বর, প্রখর মে মাসে শাল গায়ে আন্তিগোনের রেকর্ডিং করতে এসেছিলেন তৃপ্তিদি

Published by: Robbar Digital
  • Posted:October 25, 2025 6:08 pm
  • Updated:October 25, 2025 8:10 pm  
A Memoir of Tripti Mitra on Her Birth Centenary by Soumitra Mitra

আজ তৃপ্তি মিত্রর জন্মশতবর্ষ। তৃপ্তি মিত্র অত্যন্ত স্নেহ করতেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তকে। রুদ্রদারও অগাধ ভক্তি ছিল তৃপ্তি মিত্র সম্পর্কে। জন্মশতবর্ষের আগের সন্ধেয়, রুদ্রদার কাছ থেকে যদি কিছু স্মৃতি খুঁজে পাওয়া যায়, সেই আশায় আমি হাজির হয়েছিলাম। রুদ্রদার স্মৃতি যদিও খানিক ফিকে হয়েছে। কিন্তু মন ও হৃদয় সচকিত আছে।

সৌমিত্র মিত্র

সৌমিত্র মিত্র: রুদ্রদা, আগামিকাল তৃপ্তি মিত্র জন্মশতবর্ষ। কী মনে পড়ছে এখন, ঠিক এই মুহূর্তে?

রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত: তৃপ্তিদির সঙ্গে যে নাট্যজীবনে দেখাসাক্ষাৎ হয়েছিল, এ এক বড় পাওয়া। যখন আমরা ‘বাংলা নাটমঞ্চ প্রতিষ্ঠা সমিতি’ গড়ে তুলি, তখন তৃপ্তিদিকে নিয়ে নাটক করার কথা করছিলাম। সেই নাটক হয়েছিল প্রথমে অ্যাকাডেমিতে। পরে আরও কিছু জায়গায়। এমনকী, তৃপ্তি মিত্রর নির্দেশনাতেও হয়েছিল এক নাটক। ‘মুদ্রারাক্ষস’ দেখতে দু’বার এসেছিলেন অ্যাকাদেমিতে। অনেকটা আগেই আসতেন, শম্ভুদার সঙ্গে কথা বলতেন আর ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে দিতেন শম্ভুদাকে। ওই সময় ওঁরা একান্তে থাকতেন। এই নাটক আর ‘খড়ির গণ্ডি’ নাটক দু’টি দেখে স্বাতীলেখার খুব প্রশংসা করেছিলেন। স্বাতী একলাই বেশ কয়েকবার গিয়েছে তৃপ্তিদির বাড়ি।

‘বহুরূপী’র চার অধ্যায় নাটকে তৃপ্তি মিত্র ও শম্ভু মিত্র। ছবি: নিমাই ঘোষ

সৌ: আপনিও তো যেতেন… 

তৃপ্তিদি জীবনের উপান্তে যখন একা থাকতেন, তখন আমি মাঝেমধ্যে যেতাম ওঁর কাছে। খুব কিছু বলতেন না, কিন্তু কীরকম মনে হত, তিনি নিজে সরে গিয়ে চারপাশের প্রতি যতটা অন্যায় করেছেন, নিজের প্রতি অন্যায় করেছেন আরও বেশি। ম্যাগসাইসাই পুরস্কারের অর্থ শম্ভুদা গোপনে অনেককে দিয়েছেন। সেই টাকা তৃপ্তিদি ভোগ করেননি। দারিদ্র ছিল, প্রকাশ ছিল না। এসবের মধ্যে দৈনন্দিন প্রাণধারণের উপাদান কোথা থেকে করতেন জানি না।

তৃপ্তি মিত্র

সৌ: কী অদ্ভুত ব্যাপার! আচ্ছা, এই যে বললেন– তেমন কথা বলতেন না, কিছুই কি বলতেন না?

রু: মাঝে মাঝে গল্প বলতেন। শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্রর একসঙ্গে যে যাত্রাপথ, সেকথাও থাকত। বহুরূপীর ‘বহুরূপী’ হয়ে ওঠা, শম্ভু মিত্রর ‘শম্ভু মিত্র’ হয়ে ওঠা। সেই গল্পেই বুঝতে পারতাম এই সবের নেপথ্যে তৃপ্তিদির অবদান ছিল কতটা। কতটা উজাড় করে দিয়েছিলেন তিনি! সেজন্য আজ আরও বেশি করে মনে হয়, যে নামডাক শম্ভুদা পেয়েছেন; তৃপ্তি মিত্র পাননি। কোনও দ্বিধা নেই, শম্ভু মিত্র অসামান্য একজন অভিনেতা, অসামান্য পরিচালকও– ভারতীয় থিয়েটারের ‘ফার্স্ট পার্সন’। কিন্তু যে-নামডাক শম্ভু মিত্র, কুমার রায়-সহ অনেকেই পেয়েছেন, সে তুলনায় তৃপ্তিদি অনেকটা বঞ্চিত রয়ে গেলেন অত্যন্ত কৃতি হওয়া সত্ত্বেও। এখন তো আর কিছু করার নেই। শুধুই স্মরণ। তৃপ্তিদিকে মনে রেখে যদি কোনও স্কলারশিপ বা অর্থসাহায্য বা স্মারক কিছু একটা করা যায়, মন্দ হয় না।

সৌ: কেয়াদি যখন চলে গেলেন তখন ‘আন্তিগোনে’ নাটকটা রেডিওয় হওয়ার কথা, সেসময় আমি-আপনি আর অজিতদা, তিনজনে নাসিরুদ্দিন রোডে তৃপ্তিদির বাড়ি গিয়েছিলাম, মনে পড়ে? সেখানে তাঁকে সম্মত করা হল। তারপর ‘নান্দীকার’-এর ঘরে তিনি মহড়া দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘কেয়া আমার আত্মার বন্ধনে জড়িয়ে আছে। আমি অভিনয়টা করব।’ যেদিন রেকর্ডিং ছিল, তারিখটা ছিল ৩১ মে। প্রচণ্ড গরম। আগের দিন জানা গেল তৃপ্তি মিত্র খুব অসুস্থ ও জ্বরে ভুগছেন। আপনারা ভাবছিলেন, তবে কি রেকর্ডিংটা পিছিয়ে দেওয়া হবে! তখন তৃপ্তি মিত্রর বাড়িতে মেরি বলে যে মেয়েটি থাকতেন, তিনি ফোনে জানিয়েছিলেন, ‘না। মা বারণ করেছেন। মা যাবেন।’ কেউ যেন এসে তাঁকে ঠিক সময় নিয়ে যায়। আমার উপর দায়িত্ব বর্তেছিল, নাসিরুদ্দিন রোড থেকে আকাশবাণী ভবনের সামনে তাঁকে নিয়ে যাওয়ার। মনে পড়ে, মে মাসের ওই গরমের মধ্যেও একটি শাল গায়ে দিয়েছিলেন তৃপ্তিদি। বলে রেখেছিলেন, ‘যখন বাড়ি থেকে বেরবে একটা ফোন করবে।’ কলকাতায় তখন এত গাড়ি, এত যানজট ছিল না। আপনি এবং অজিতদা– দু’জনেই আকাশবাণী ভবনের বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি ওই জ্বর অবস্থায় ভিতরে এসে বসলেন। এবং রেকর্ডিংটাও হল। এই স্মৃতিটা মনে পড়ে?

রু: মনে পড়ে তো! খুবই স্পর্শ করে যায় এই ভালোবাসা। তৃপ্তিদির মতো সমসাময়িক অনেকেই বোধহয় চারপাশটাকে দেখতেন বুদ্ধি দিয়ে, মাথা দিয়ে। কিন্তু তৃপ্তিদি বুঝতেন হৃদয় দিয়ে। আসলে আমার একটা দৃঢ় ধারণা, এখনও, যে, মানুষ বাঁচে হৃদয় গিয়ে। মস্তিষ্ক আছে ঠিকই, কিন্তু ওগুলো সব গাড়ির চাকা, বনেট, সিট, স্টিয়ারিং পর্যন্ত– কিন্তু গাড়ির ইঞ্জিন হল হৃদয়।

থিয়েটারকে তৃপ্তি মিত্র বুঝতেন হৃদয় দিয়ে

সৌ: এই যে ‘বহুরূপী’ হল। উনি ছেড়ে চলে গেলেন। তারপরও থিয়েটারের প্রতি ভালোবাসা ও নতুন শিল্পী তৈরির প্রতি যে উদগ্র বাসনা, তা তাঁর যায়নি। যে কারণে ‘আরব্ধ নাট্যবিদ্যালয়’ গড়লেন– সেটা কি মনে পড়ে আপনার?

রু: মনে পড়ে, কিন্তু সেই সবে আমি খুব কৌতূহলী বা উৎসাহী হতে পারিনি। এই কারণে যে, সময়ের স্রোত থেকে অতীতকে তুলে এনে আবার বর্তমানে গ্রথিত করা যায় না। কাজেই যে তৃপ্তিদিকে আমরা দেখেছিলাম, পেয়েছিলাম– সেই তৃপ্তিদিকে আর ফিরে পাব না জানতাম।

সৌ: কিন্তু এখানেও তো তিনি অনেক শিল্পী তৈরি করেছেন। বিধায়ক ভট্টাচার্যর ‘সরীসৃপ’ নাটকটা করেছিলেন। সে নাটকে তৃপ্তিদির অভিনয়ের যে দ্যুতি ও ছটা– এখনও ছিন্ন ছিন্ন ভাবে যখন দেখি তখন বোঝা যায় তৃপ্তিদি কতটা মহিয়সী অভিনেত্রী! শব্দকে ব্যবহার করা, শব্দকে অভিনয় দিয়ে রেঁধে দর্শকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য যে তীব্র তীক্ষ্ণতা ও মনন প্রয়োজন– সে তো তাঁর অসাধারণ!

রু: সে নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। শম্ভুদা বলেছিলেন, তিন অক্টেভেই তৃপ্তি মিত্রর স্বর যেভাবে যাতায়াত করে, তা অস্বাভাবিক! গুণাবলির দিক থেকে ব্যাপারটা অতুলনীয়, বিস্ময়কর।

যুগলবন্দি: তৃপ্তি মিত্র-শম্ভু মিত্র

সৌ: ওঁর সম্পর্কে আপনার কি এখন কিছু মনে পড়ে এখনও, যা আপনাকে এখনও একটা খোঁজের পথ দেখায়?

রু: এখন আমার মানসিক-শারীরিক যা অবস্থা, কোনও কিছু সম্পর্কেই আর আগ্রহ বা কৌতূহল নেই। তবে, সারাজীবন যে সমস্ত মানুষের সঙ্গে মিশেছি, তাঁদের মধ্যে তৃপ্তিদি একজন অনন্য মানুষ। অসম্ভব প্রতিভার সঙ্গে হৃদয় ঠিকঠাক মিশে গেলে, কী হয়, তা তৃপ্তিদির সঙ্গে অল্প মিশলেই বোঝা যেত। যতটা হৃদয়বতী হওয়া সম্ভব, তিনি তাই-ই ছিলেন। ওঁর জীবন যখন প্রান্তে এসে ঠেকল, ক’দিন পর চলে যাবেন, তখন শম্ভু মিত্র তাঁর নির্বাসন থেকে ফিরে গিয়েছিলেন তাঁর কাছে, যেখানে থাকতেন তৃপ্তি মিত্র। মনে হত, যাক, ‘বেটার লেট দ্যান নেভার’।