সুজন মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ‘চেতনা’-র নাটক ‘মহাত্মা বনাম গান্ধী’ মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সঙ্গে তাঁর বড় ছেলে হরিলালের মিতালি-সংঘাতের ইতিবৃত্ত। দক্ষিণ আফ্রিকা, আহমেদাবাদ, মুম্বই, কলকাতা– বিস্তৃত পটভূমিতে কয়েক দশকের বিস্তার। সুজন মুখোপাধ্যায়ের নিপুণ পরিচালনায় এই পরিসরের ঘূর্ণায়মান প্রেক্ষিতে দ্বন্দ্বের স্বরূপটি কেন্দ্রে আসে। গান্ধীহত্যা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, অসহযোগ আন্দোলন– এইসব সদরের কথার সমান্তরালে আলো পড়ে অন্দরে।
আজ ২ অক্টোবর ২০২৩, সকাল সোয়া দশটায় অ্যাকাডেমি মঞ্চে পরিবেশিত হল ‘চেতনা’-র নাটক ‘মহাত্মা বনাম গান্ধী’। অজিত দালভি-র মূল নাটক তরজমা করেছিলেন অরুণ মুখোপাধ্যায়। তার সম্পাদনা করে মঞ্চে নিয়ে এলেন সুজন মুখোপাধ্যায়, এ নাটকের নির্দেশক। ‘চেতনা’ নাট্যদল ধারাবাহিকভাবে দীর্ঘসময় ধরে এমন সব নাটক দর্শকের সামনে নিয়ে আসে, যেখানে শুধু কাহিনি গ্রন্থনা বা আখ্যানের দৃশ্যরূপ মঞ্চায়িত হয় না, নানা আকার-প্রকারের কিছু প্রশ্নকেও স্পর্শ করতে চায়। শুধু মনোরঞ্জনের নন্দন নয়, কেন্দ্রে থাকে ভাবনার সূচিমুখ।
এই নাটকও ব্যতিক্রম নয়। আড়াই ঘণ্টার এই নাটক দর্শককে প্রণোদিত করে, প্ররোচিত করে কয়েকটি বুনিয়াদি প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়াতে। মঞ্চে উপস্থাপিত চরিত্র, ঘটনাবলি, সংলাপ, দৃশ্যরূপ থেকে উত্থাপিত হয় নাট্যভাষ। সেই ভাষ্য কোনও সমাধানের সহজ উপসংহার খোঁজে না, বরং জটিল বহুকৌণিক অবস্থান এবং স্থানাঙ্ক নির্ণয়ের দিকে দর্শককে ঠেলে দেয়।
মোটা দাগে বললে, এ নাটক মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সঙ্গে তাঁর বড় ছেলে হরিলালের মিতালি-সংঘাতের ইতিবৃত্ত। দক্ষিণ আফ্রিকা, আহমেদাবাদ, মুম্বই, কলকাতা– বিস্তৃত পটভূমিতে কয়েক দশকের বিস্তার। সুজন মুখোপাধ্যায়ের নিপুণ পরিচালনায় এই পরিসরের ঘূর্ণায়মান প্রেক্ষিতে দ্বন্দ্বের স্বরূপটি কেন্দ্রে আসে। গান্ধীহত্যা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, অসহযোগ আন্দোলন– এইসব সদরের কথার সমান্তরালে আলো পড়ে অন্দরে। কস্তুরবা, গুলাব, মণিলাল, রামদাস, দেবদাস সেই প্রশ্নে নানা মাত্রা সংযোজিত করে। ‘চেতনা’র এই মঞ্চায়ন বহুলাংশে যেন পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীতের মতো মহাত্মা এবং হরিলালের পয়েন্ট, কাউন্টার পয়েন্টে সুনির্দিষ্ট অবয়বে আকার নিতে থাকে। অনবদ্য অভিনয় করেছেন ‘কস্তুরবা’ চরিত্রে নিবেদিতা মুখোপাধ্যায়। অনির্বাণ চক্রবর্তী-র নিচুতারের অভিনয় আর সুজন মুখোপাধ্যায়ের হরিলাল তথা আবদুল্লা তথা হীরালাল চরিত্রে তুলনায় চড়া অভিনয়ের ভারসাম্য গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত প্রশংসনীয় মুনশিয়ানায় রক্ষা করে যান নিবেদিতা। তাঁকে কখনও কখনও যোগ্য সঙ্গত করেন ‘গুলাব’ চরিত্রে মেরি আচার্য। কয়েকটি স্মরণযোগ্য মুহূর্তে সুজন, নিবেদিতা এবং অনির্বাণ স্ব-স্ব ধরনের প্রকাশে তথা অভিনয় শিখর স্পর্শ করেন। এত মানবিক অথচ অসমন্বিত প্রশ্ন তুলে দেন তাঁরা যে, অভিঘাতে আপ্লুত হয়ে যেতে হয়। সম্ভবত, মূল প্রশ্নটা প্রথম দৃশ্যেই উচ্চারিত হয় হরিলালের মুখে– জীবনের সত্যসন্ধানে পরিণতি নাকি অভিযাত্রা– কোনটা গুরুত্বপূর্ণ। পথ নাকি গন্তব্য? প্রত্যেকে কি নিজস্ব ধরনে জারি রাখবে এই সন্ধান, নাকি কোনও ‘বাদ’ বা ‘মতাদর্শ’ কেন্দ্রিক বাঁধাবুলি আর পূর্ব-নির্ধারিত খুপরিতে বদ্ধ রাখবে নিজেকে? এ প্রশ্ন বর্তমান দুনিয়ায় খুব প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হিসাবে আলোচিত হচ্ছে।
চেতনার এই নাটক, সুজনের হাত ধরে বর্তমান ভারতের ধর্মান্ধ বাস্তবতায় খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। গান্ধী তাঁর জীবন দিয়ে সেইসব প্রশ্ন তুলেছেন। হরিলালের ‘আবদুল্লা’ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতেও সেইসব প্রশ্নের আঁচ এ নাটক ছড়িয়ে দেয়। গান্ধী একরকম পথে আত্মকে খোঁজেন, হরিলাল আরেক পথে। সবথেকে বড় কথা, এ নাটক হয়ে যেতে পারত হরিলালের ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি। তার মালমশলাও মজুত ছিল। কিন্তু তরজমা, সম্পাদনা এবং উপস্থাপনে জোর পড়ল গান্ধীর পথ, কস্তুরবার সমালোচনা-মূলক সহযোগ এবং হরিলালের প্রতিপ্রশ্নে। সেটাই প্রাপ্তি। এ নাটক বিশেষত নতুন প্রজন্মকে, অনেক ভাবনার খোরাক জোগাবে বলে আমার বিশ্বাস।
অনেক অনেক কথা বলা বাকি রয়ে গেল। তবু উল্লেখ করতেই হবে এমন একটি তীব্র আবেগের তীব্র টানাপোড়েনের মঞ্চায়নে ব্রেখটীয় রীতির ছোট-ছোট প্রয়োগ নির্দেশক মিশিয়েছেন ভাল। পিছনের অতিকায় চরকা এবং তার স্থির থাকা, চলনের গতিমুখ, তার নীচে তিন বাঁদরের ছবি– প্রতীক হিসাবে চমৎকার! সুজন কি একবার ভাববেন, ভারতের তৎকালীন বহমান রাজনীতি, উত্তাল রাজপথ-জনপথ, স্বরাজের স্বপ্ন কোনওভাবে কোথাও ইশারা-ইঙ্গিতেও আভাসিত করা যায় কি না? গান্ধীর এই জনপরিসর-ব্যক্তি পরিসরের সংঘর্ষ, যার চিহ্ন শেষদৃশ্য়ে– ভক্তদের হাতে হরিলালের বহিষ্কারের, সেই সংকট আরও স্পর্শগ্রাহ্য হয়ে উঠতে পারে কি দর্শকের কাছে? এসব প্রশ্ন অবশ্য অবান্তর খানিকটা! গান্ধীর সত্যসন্ধানী কঠোর পদচারণার ছবি আর কস্তুরবার মাতৃত্বের হাহাকার– হরিলালের তর্কশীল মৃতদেহ– আমাদের ভাবতে শেখায়। অন্তত ভাবনার তরঙ্গশীর্ষকে দৃশ্যমান করে। সেটা বড় পাওয়া। ধন্যবাদ, ‘চেতনা’কে।
পুনশ্চ: প্রসঙ্গত মনে পড়ল ‘নিম্নবর্গের ইতিহাস’ গ্রন্থের (আনন্দ পাবলিশার্স। ১৯৯৮) একটি প্রবন্ধের কথা। ঐতিহাসিক শাহিদ আমিনের সেই প্রবন্ধের নাম ‘গান্ধী যখন মহাত্মা’। মহাত্মা গান্ধীর অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার গালগল্প কীভাবে তাঁর ব্যক্তিত্বের মহাকায় আকার তৈরি করছিল জনমানসে আর তার প্রভাব কীভাবে পড়ছিল আন্দোলনে, সেই নিয়ে আলোচনা। শুধু নামের সাদৃশ্যই নয়, অন্তর্গত প্রশ্নের অভিমুখগুলোকে সংযোগের সূত্রে দেখাই কাম্য মনে হয়।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved