সাঁকরাইল থেকে সমুদ্র পর্যন্ত হুগলি নদী বর্তমানে যে-পথে প্রবাহিত হচ্ছে, তা আদতে সরস্বতী নদীর নিম্নপ্রবাহ। এভাবেই, হুগলি নদীর সৌজন্যে সজীব সরস্বতীর নিম্নাংশ। বর্তমানে সরস্বতী নদীর পরিচিতি ত্রিবেণী থেকে সাঁকরাইল পর্যন্তই। হারিয়েছে অতীতগৌরব। ঠিক যেভাবে আদিগঙ্গাও জৌলুস হারিয়ে মৃতপ্রায়। বাংলার নদী-ভূগোলের বিবর্তনের আড়ালে লুকিয়ে-থাকা ইতিহাস আরও আলোচিত হওয়া উচিত। বৃহত্তর প্রেক্ষিতে জনপদ, বাণিজ্য এমনকী রাজনৈতিক উত্থান-পতনেরও বিশ্লেষণ করা যায় এর সূত্র ধরে।
দক্ষিণবঙ্গের একটি নদী, নাম সরস্বতী। এমন নামকরণ কেন, তা অনুমান করা শক্ত নয়। এলাহাবাদে গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী নদীর মিলনস্থল যেমন ‘ত্রিবেণী’ নামে পুরাণবিদিত, বাংলাতেও রয়েছে তেমন এক স্থান– হুগলি জেলার ত্রিবেণী। ভাগীরথী ওরফে হুগলি নদী সেখানে তিনদিকে বিভক্ত– পশ্চিমবাহিনী সরস্বতী, দক্ষিণবাহিনী হুগলি ও পূর্ববাহিনী যমুনা। সরস্বতী ও যমুনা নামকরণ স্পষ্টতই এলাহাবাদ-প্রভাবিত। পার্থক্য একটাই– সেখানে গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী মিলিত হয়, আর হুগলির ত্রিবেণীতে বিশ্লিষ্ট– যে কারণে এটি ‘মুক্তবেণী’ নামেও পরিচিত।
ত্রিবেণী থেকে সামান্য দূরত্বে, এই সরস্বতী-তীরেই বিগত সহস্রাব্দে গড়ে উঠেছিল বাংলার অন্যতম আন্তর্জাতিক বন্দর– সপ্তগ্রাম। তবে ইউরোপীয় বাণিজ্যতরী আসার আগে থেকেই সপ্তগ্রামের সমৃদ্ধি ছিল ঈর্ষণীয়। বিপ্রদাস পিপিলাই-এর মনসামঙ্গল কাব্যে (১৪৯৫), চাঁদ সদাগর ত্রিবেণীতে ডিঙা থামিয়ে সপ্তগ্রাম-ভ্রমণে ইচ্ছুক– ‘দেখিব কেমন সপ্তগ্রাম’। সে-নগর দেখে সদাগর মোহিত। দিন-দুয়েক কাটিয়ে দিলেন সেখানেই।১ এর বছর কুড়ি পরে, নিত্যানন্দও ধর্মপ্রচার করতে হাজির সপ্তগ্রামে।২ উল্লেখ্য, এই দু’টি উদাহরণই ইউরোপীয়দের সপ্তগ্রামে আগমনের পূর্বেকার। ১৫৩৭ সালে পর্তুগিজরা বাণিজ্য করতে আসে সেখানে– সমুদ্র থেকে সরাসরি সরস্বতী নদী বেয়ে সপ্তগ্রামে পা রাখেন তারা। প্রসঙ্গত, সপ্তগ্রাম ছিল তাদের কাছে ‘পোর্ট পেকুইনো’ (ছোট বন্দর; ‘পোর্ট গ্র্যান্ডে’ চট্টগ্রাম)। সপ্তগ্রামকে কেন্দ্র করেই বাণিজ্য বিস্তারলাভ করতে থাকে; সরস্বতী পরিচিত হয় ‘সাতগাঁ রিভার’ নামে।
তবে ষোড়শ শতক সরস্বতী নদীর পক্ষে খুব একটা সুখের সময় নয়। এককালে ভাগীরথীর মূলধারা প্রবাহিত হত সরস্বতী-পথে; হুগলি নদী ছিল গৌণ।৩ ষোড়শ শতক থেকে সরস্বতী নদীতে বালি জমতে থাকায়, নাব্যতা কমে আসে ক্রমশ। একইসঙ্গে, ভাগীরথীর মূল ধারা ঘুরে যায় হুগলি নদীর দিকে। এই গতিপথ পরিবর্তনের পিছনে ভূমিকম্প, বন্যা ইত্যাদি অনেক কারণ অনুমান করা হয়। তারপরও, সে-শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সরস্বতী নদী ছিল যথেষ্ট স্রোতস্বিনী। ১৫৫০ সালে অঙ্কিত জ্যাও ডি ব্যারোজের মানচিত্রে হুগলি নদীর সমান চওড়া দেখতে পাই সরস্বতীকে। অথচ পট এত দ্রুত পরিবর্তিত হয় যে, সেই শতকেই পর্তুগিজরা বাধ্য হয়ে তাদের বাণিজ্যকেন্দ্র ও বন্দর স্থানান্তরিত করে হুগলিতে (১৫৭৯)।
১৫৭৮ সালে সিজার ফ্রেডরিক লিখছেন, সরস্বতীর নাব্যতা এতই কমে এসেছে যে, সমুদ্র থেকে সে-নদীতে প্রবেশ করে বড় জাহাজগুলি বাধ্য হয় বেতড়ে নোঙর করতে। তারপর, বেতড় থেকে সপ্তগ্রাম পর্যন্ত বাকি পথ যেতে হয় ছোট জাহাজে।৪ অন্যদিকে, ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে র্যালফ ফিচ বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে সপ্তগ্রামের প্রশংসায় মুখর।৫ বোঝাই যাচ্ছে, নদীর নাব্যতা কমে এলেও, সপ্তগ্রামের দীর্ঘ গৌরবে তখনও ভাঙন ধরেনি। এই গৌরব ও আন্তর্জাতিক খ্যাতির প্রতিফলন দেখা যায় মানচিত্রেও। ব্যারোজের (১৫৫০) মানচিত্রে সপ্তগ্রামের পাশাপাশি অন্যান্য অঞ্চলের উল্লেখ থাকলেও, ইতালিয়ান মানচিত্রকার গিয়াকামো গাসটল্ডি একমাত্র সপ্তগ্রাম বন্দরকেই চিহ্নিত করেছেন (১৫৬৩)। মানচিত্রে সপ্তগ্রামকে চিহ্নিত করার প্রবণতা বজায় ছিল সপ্তদশ শতকেও। সে-শতকের শেষদিকে, বাঙালি কবি কৃষ্ণরাম দাসের কাব্যেও সপ্তগ্রামের সুখ্যাতি দেখা যায়,৬ যা বিস্ময় জাগাতে বাধ্য। অষ্টাদশ শতক থেকে কাব্য ও মানচিত্র উভয়তই অনুল্লেখ্য হয়ে পড়ে সপ্তগ্রাম।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ষোড়শ শতক থেকে সরস্বতী নদীতে বালি জমতে থাকায়, নাব্যতা কমে আসে ক্রমশ। একইসঙ্গে, ভাগীরথীর মূল ধারা ঘুরে যায় হুগলি নদীর দিকে। এই গতিপথ পরিবর্তনের পিছনে ভূমিকম্প, বন্যা ইত্যাদি অনেক কারণ অনুমান করা হয়। তারপরও, সে-শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সরস্বতী নদী ছিল যথেষ্ট স্রোতস্বিনী। ১৫৫০ সালে অঙ্কিত জ্যাও ডি ব্যারোজের মানচিত্রে হুগলি নদীর সমান চওড়া দেখতে পাই সরস্বতীকে। অথচ পট এত দ্রুত পরিবর্তিত হয় যে, সেই শতকেই পর্তুগিজরা বাধ্য হয়ে তাদের বাণিজ্যকেন্দ্র ও বন্দর স্থানান্তরিত করে হুগলিতে (১৫৭৯)।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এবার একটি কূটতর্কে প্রবেশ করা যাক। মৃতপ্রায় সরস্বতী নদীকে বর্তমানে চিহ্নিত করা যায় ত্রিবেণী থেকে সাঁকরাইল পর্যন্ত, যা মূলত সরস্বতীর ‘ঊর্ধ্বপ্রবাহ’। সাঁকরাইলে এসে, হুগলি নদীতে মিশেছে সরস্বতী। তবে, ষোড়শ শতকেও সমুদ্র থেকে ত্রিবেণী পর্যন্ত দু’টি ভিন্ন জলপথ বর্তমান ছিল– একটি সরস্বতী নদী ধরে, অন্যটি আদিগঙ্গা-হুগলি নদীর পথে।৭ অর্থাৎ, উৎস থেকে সমুদ্র পর্যন্ত সরস্বতী ছিল স্বনির্ভর। কথিত আছে, আনুমানিক ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দে নবাব আলিবর্দি খাঁ-র আমলে ওলন্দাজরা কাটাগঙ্গার মাধ্যমে হুগলি নদী ও সরস্বতী নদী যুক্ত করে দেয়। এর পরবর্তীতে, হুগলি নদী প্রবাহিত হতে থাকে সরস্বতীর নিম্নপ্রবাহ ধরেই। নীহাররঞ্জন রায়, রাধাকমল মুখোপাধ্যায়, কপিল ভট্টাচার্য প্রমুখ এই প্রচলিত ধারণাটির ওপরেই আস্থা রেখেছেন।৮ ৯ ১০ হুগলি নদীর গতি-পরিবর্তন ও আদিগঙ্গার মজে-আসার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এই ঘটনাকেই।
এখানে ‘আদিগঙ্গা’ ও ‘কাটাগঙ্গা’– শব্দদু’টি অভিনিবেশের দাবি রাখে। প্রচলিত মত অনুযায়ী, আদিগঙ্গাই ভাগীরথী তথা হুগলি নদীর প্রাচীনতম প্রবাহপথ। যুক্তি হিসেবে দেখানো হয়, মুকন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল-সহ অন্যান্য মঙ্গলকাব্যগুলিকে, যেখানে বণিকদের বাণিজ্যতরী বেতড় থেকে আদিগঙ্গার পথেই সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। এখানেই প্রশ্ন ওঠে, কাব্য রচনার সময়কালের সঙ্গে নদীর প্রকৃত গতিপথের সময়কাল নির্ধারণ করা কতটা যুক্তিযুক্ত? অর্থাৎ, ১৭৫০-এর আগে পর্যন্ত আদিগঙ্গাই কি ছিল হুগলি নদীর একমাত্র প্রবাহপথ? আদিগঙ্গা কতদিন পর্যন্ত ‘আদি’?
যখন সরস্বতী ও হুগলি নদীর দু’টি ভিন্ন প্রবাহপথ বর্তমান ছিল, বাঙালি বণিকরা কেন সপ্তগ্রাম ছুঁয়ে সরস্বতী-পথেই সমুদ্রে গেলেন না? হুগলি নদীপথ বেছে নিতে হল কেন? আদিতম উদাহরণ হিসেবে বিপ্রদাসকে তুলে ধরা যায়, কেননা মুকুন্দরাম-সহ অন্য কবিরা মঙ্গলকাব্যে প্রচলিত পথের অনুরণন ঘটিয়েছেন– সে-সম্ভাবনাই প্রবল। বিপ্রদাসের সময়ে সরস্বতী কিন্তু চলাচলের উপযুক্ত; ৪০ বছর পরে পর্তুগিজরাও ব্যবহার করেছে সেই পথ। তাহলে একজন বাঙালি বণিকও সরস্বতী-পথে ডিঙা বাইলেন না? একটি সম্ভাব্য যুক্তি হতে পারে, ভাগীরথী বেয়ে ত্রিবেণীতে এসে, শাখানদী সরস্বতীতে প্রবেশ না-করে সোজা হুগলি নদী ধরেই এগোনোকেই শ্রেয় ধরে নিয়েছেন তাঁরা। যেহেতু হুগলি নদীও গঙ্গা নামেই পরিচিত ছিল এবং সরস্বতী পৃথকনামা, সে-জন্য গঙ্গাপথ ছাড়তে চাননি। যাত্রাপথে একাধিক তীর্থক্ষেত্র (কালীঘাট-সহ) দর্শনের ইচ্ছাও কাজ করে থাকতে পারে। সে-কারণেই, সরস্বতী-পথ সচল থাকা সত্ত্বেও, বণিকরা পছন্দ করতেন হুগলি নদী ও আদিগঙ্গার পথই।
কাব্যে বর্ণিত ভূগোল কবিদের সমসাময়িক হলেও, যাত্রা সমকালীন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। সপ্তগ্রাম ছিল সে-আমলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর এবং সরস্বতী-পথেই ভাগীরথীর মূলস্রোত প্রবাহিত হত। ফলে, সরস্বতী নদী ধরে অতিরিক্ত নৌ-চলাচল এমনকী জলদস্যুর আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বণিকদের অপেক্ষাকৃত গৌণ ও শান্ত হুগলি নদীপথ বেছে নেওয়ার এটাও একটা কারণ হতে পারে। পরবর্তীতে, হুগলি নদীই মূল হয়ে ওঠায়, কাব্যবর্ণনার অনুকূলে যায় তা।
ষোড়শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সরস্বতী যখন মজে আসতে শুরু করে, বিকল্প হয়ে ওঠে আদিগঙ্গা-হুগলি নদীর পথই। ইউরোপীয় জাহাজগুলিও, এই পথেই সমুদ্র থেকে হুগলি পর্যন্ত যাতায়াত করতে শুরু করে। সরস্বতী নদীর প্রাসঙ্গিকতা বজায় থাকে কেবলমাত্র গঙ্গা থেকে সাঁকরাইল পর্যন্ত। শেরউইল ও ফার্গুসনের মতে, সরস্বতী নদী সাঁকরাইলের কাছে এসে দু’টি ভাগে বিভক্ত হত। একটি ধারা হুগলি নদীতে গিয়ে আদিগঙ্গা হয়ে সমুদ্রে যেত, অন্যটি সরস্বতীর মূল ধারা– সরাসরি দক্ষিণবাহিনী হয়ে সমুদ্রে।১১ সরস্বতীর সুসময়ে এ-সম্ভাবনা থেকেই যায়।
আলিবর্দি খাঁ-এর আমলে কাটাগঙ্গা খননের তত্ত্বের পাশাপাশি এই মতও উঠে আসে যে, সেখানে একটি সংকীর্ণ খাল আগে থেকেই ছিল, যা সরস্বতী ও হুগলি নদীকে যুক্ত করত; আলিবর্দি তা চওড়া করান।১২ খিদিরপুর থেকে সাঁকরাইল পর্যন্ত হুগলি নদীর বর্তমান অংশের ‘কাটাগঙ্গা’ নামে পরিচিতি এই ইতিহাসেরই ইঙ্গিত দেয় যে, কখনও-না-কখনও খনন হয়েছিল তার। কিন্তু আলিবর্দির আমলে, না তার আগেই?
আমরা সিজার ফ্রেডরিকের লেখাতেই পেয়েছি, ষোড়শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সরস্বতীর ঊর্ধ্বপ্রবাহের নাব্যতা এমন কমে আসে যে, জাহাজগুলি সরস্বতী-পথে এসে বেতড়ে নোঙর করতে বাধ্য হত। তারপর, ছোট জাহাজ নিয়ে সপ্তগ্রামে যাত্রা। ততদিনে ধীরে ধীরে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে হুগলি বন্দরও। সেখানে যাওয়ার জন্য, ইউরোপীয় বণিকরা কি সমুদ্র থেকে শুধুমাত্র আদিগঙ্গার পথই ধরতেন? বিকল্প আরেকটি পথ খুলে যেতে পারে, যদি সরস্বতী ধরে সাঁকরাইল পর্যন্ত এসে, কাটাগঙ্গার মাধ্যমে হুগলি নদীতে পৌঁছনো যায়। নাব্যতা-কমতে-থাকা আদিগঙ্গার বিকল্প পথও হতে পারত তা।
একইসঙ্গে এ-কথাও মাথায় রাখতে হবে, সরস্বতী নদীর ঊর্ধ্বপ্রবাহ মজে গেলেও, নিম্নপ্রবাহ (সাঁকরাইল পর্যন্ত) তখনও জীবিত। সে-অঞ্চলে তখনও যদি অন্য-কোনও নদী না-ই মিশে থাকে, প্রাণবন্ত থাকল কীভাবে? অতএব হুগলি নদীর সঙ্গে সরস্বতীর যোগাযোগ কাটাগঙ্গা মারফত বরাবরই ছিল; হুগলি থেকে জল পাওয়ার কারণেই সরস্বতীর নিম্নপ্রবাহ কখনও নাব্যতা হারায়নি। সমান্তরালভাবে জীবিত ছিল আদিগঙ্গাও। হুগলি নদী খিদিরপুর পর্যন্ত এসে দু’ভাগে ভাগ হয়ে যেত– একটি সাঁকরাইলের দিকে ও অন্যটি আদিগঙ্গার দিকে এবং দু’টি ধারা একই সময়ে প্রবহমান ছিল।
তবে কাটাগঙ্গার মাধ্যমে হুগলি ও সরস্বতী নদী যুক্ত থাকলেও, প্রাথমিকভাবে তার প্রস্থ নিয়ে সন্দেহ জাগে। কোনও এক সময় কাটাগঙ্গাকে বিস্তৃত করা হয়, যার ফলে হুগলির মূল স্রোত ঘুরে যায় সেদিকেই। হুগলি নদী + বিস্তৃত কাটাগঙ্গা + সরস্বতীর নিম্নপ্রবাহ হয়ে ওঠে মূল গতিপথ। আদিগঙ্গা ইতিমধ্যেই নাব্যতা হারাচ্ছিল, এবার জলের অভাবে মরে আসতে থাকে ধীরে-ধীরে। কোনও কোনও ঐতিহাসিক কাটাগঙ্গাকে সরস্বতীর মৃত্যুর জন্যেও দায়ী করেছেন, তবে তা যুক্তিযুক্ত নয়; সরস্বতীর ঊর্ধ্বপ্রবাহের নাব্যতা হারানোর সঙ্গে কাটাগঙ্গার কোনও সম্পর্কই নেই।
অন্যদিকে, আদিগঙ্গা যে হুগলি নদীর এককালের প্রধান ধারা ছিল– এই প্রাথমিক ধারণাকেই খারিজ করে দিচ্ছেন সি.আর. উইলসন। তাঁর মতে, কাটাগঙ্গা-সরস্বতীর নিম্নপ্রবাহ বরাবরই ছিল প্রধানতম; আদিগঙ্গা গৌণ ধারা। বাংলার বণিকরা (কাব্যে) আদিগঙ্গার পথ বেছে নিতেন, কেননা সেই পথ ছিল অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। আর সরস্বতীর নিম্নপ্রবাহটি গভীর হওয়ায়, সে-পথে বড়-বড় জাহাজ ও জলদস্যুদের আনাগোনা ছিল প্রচুর। বাঙালিরা সাগরে যাওয়ার ক্ষেত্রে সে-পথ এড়িয়ে চলতেন।১৩ উইলসনের মতকে প্রাধান্য দিলে, কাটাগঙ্গা ছিল প্রাকৃতিক, খনন-করা পথ নয়। কিংবা ষোড়শ শতকের ঢের আগেই খনন করা হয় সেটি। সেক্ষেত্রে, অন্তত পঞ্চদশ শতক থেকেই হুগলি নদী খিদিরপুরের কাছে এসে দু’ভাগে বিভক্ত হত। ভূ-সাংস্থানিক মানচিত্র থেকেও স্পষ্ট, সাঁকরাইলের কাছে যেখানে সরস্বতীর ঊর্ধ্বপ্রবাহ ও হুগলি নদী এসে মিশছে, সে-স্থানটি অস্বাভাবিক স্ফীত। মৃত্যু-পূর্ববর্তী সরস্বতীর ঊর্ধ্বপ্রবাহ ও হুগলি নদী– দুই স্রোতস্বিনীর মিলনের ফলেই এমন ভূগোল জন্ম নিতে পারে।
এবার, প্রচলিত একটি ধারণাকে নস্যাৎ করা যাক। বলা হয়, আদিগঙ্গা ধীরে-ধীরে নাব্যতা হারাচ্ছিল বলে আলিবর্দি খাঁ-এর আমলে (১৭৩৯-৫৬) কাটাগঙ্গার খনন বা সংস্কার করা হয়। প্রখ্যাত ঐতিহাসিকেরাও ভরসা রেখেছেন এই মতে। ব্যারোজ (১৫৫০) বা ভ্যান ডেন ব্রুকের (১৬৬০) মানচিত্র থেকে হুগলি নদীর গতিপথ স্পষ্ট বোঝা না-গেলেও, ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে আঁকা একটি অখ্যাত ফরাসি মানচিত্রে দেখছি, হুগলি নদী ততদিনে কাটাগঙ্গা-পথেই বাঁক নিয়েছে সাঁকরাইলের দিকে এবং সেটিই মূল ধারা। এর সাক্ষ্য রয়েছে ১৭১৪ খ্রিস্টাব্দের একটি মানচিত্রেও, যেখানে খিদিরপুরের কাছে এসে হুগলি নদী ডানদিকে বাঁক নিয়েছে সাঁকরাইলের দিকে। দ্বিতীয় মানচিত্রটিতে আদিগঙ্গাও চিহ্নিত, তবে তা মৃতপ্রায়। অর্থাৎ, ১৬৯০-এর ঢের আগেই হুগলি নদী কাটাগঙ্গা-মারফত সরস্বতীর নিম্নপ্রবাহের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছিল– তা প্রমাণিত। আদিগঙ্গাও ততদিনে গুরুত্বহীন। অতএব, আলিবর্দির আমলে হুগলি নদীর গতিপথ পরিবর্তনের তত্ত্বটি সম্পূর্ণ ভুল।
কাটাগঙ্গা-পথ বরাবরই হুগলি নদীর মূল ধারার অন্তর্গত ছিল, নাকি খনন-সংস্কারের মাধ্যমে মূল করে তোলা হয়– এই বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনও সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়। তবে সাঁকরাইল থেকে সমুদ্র পর্যন্ত হুগলি নদী বর্তমানে যে-পথে প্রবাহিত হচ্ছে, তা আদতে সরস্বতীর নিম্নপ্রবাহও। এভাবেই, হুগলি নদীর সৌজন্যে সজীব রইল সরস্বতীর নিম্নাংশ। বর্তমানে সরস্বতী নদীর পরিচিতি ত্রিবেণী থেকে সাঁকরাইল পর্যন্তই। হারিয়েছে অতীতগৌরব। ঠিক যেভাবে আদিগঙ্গাও জৌলুস হারিয়ে মৃতপ্রায়। বাংলার নদী-ভূগোলের বিবর্তনের আড়ালে লুকিয়ে-থাকা ইতিহাস আরও আলোচিত হওয়া উচিত। বৃহত্তর প্রেক্ষিতে জনপদ, বাণিজ্য এমনকী রাজনৈতিক উত্থান-পতনেরও বিশ্লেষণ করা যায় এর সূত্র ধরে। বঙ্গদেশের ইতিহাস থেকে বর্তমানে অপ্রাসঙ্গিক এইসব নদীর ইতিহাসকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না কোনওভাবেই।
তথ্যসূত্র:
১. সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, মডার্ন বুক এজেন্সী, ১৯৪০, পৃ. ১১৩-১৪
২. রাধানাথ কাবাসী সম্পাদিত, বৃন্দাবন দাস, শ্রীশ্রীচৈতন্যভাগবত, ধান্যকুড়িয়া মদনমোহন মন্দির, ১৩৪৪ বঙ্গাব্দ, পৃ. ৫৭৩
৩. Radhakamal Mukherjee, The Changing Face of Bengal, University of Calcutta, 1938, p. 113
৪. S. S. O’Malley and Monmohan Chakravarti, Bengal District Gazeteers: Howrah, Bengal Secretariat Book Depot, 1909, p. 19-20
৫. J. Horton Ryley, Ralph Fitch: England’s Pioneer to India and Burma, T. Fisher Unwin, London, 1899, p. 100-01
৬. সত্যনারায়ণ ভট্টাচার্য সম্পাদিত, কবি কৃষ্ণরাম দাসের গ্রন্থাবলী, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৫৮, পৃ. ১৫১
৭. Kumud Ranjan Biswas, Rivers of Bengal, Volume II Part II, West Bengal District Gazeteers, 2001, p. 31
৮. নীহাররঞ্জন রায়, বাংলার নদনদী, বিশ্বভারতী পত্রিকা, তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, ১৩৫১, পৃ. ১৭৭
৯. Radhakamal Mukherjee, The Changing Face of Bengal, University of Calcutta, 1938, p. 113
১০. কপিল ভট্টাচার্য, বাংলা দেশের নদনদী ও পরিকল্পনা, এপিডিআর, ২০০০, পৃ. ১৬
১১. Kumud Ranjan Biswas, Rivers of Bengal, Volume II Part II, West Bengal District Gazeteers, 2001, p. 30
১২. Radhakamal Mukherjee, The Changing Face of Bengal, University of Calcutta, 1938, p. 113
১৩. Journal of the Asiatic Society of Bengal, Vol. LXI., Part I, 1893, p. 111
…পড়ুন সরস্বতী পুজোর আরও ফিচার…
সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়: আদিতে চার হাত, তবে সরস্বতী দু’-হাতেও বিদ্যেবতী
অরিঞ্জয় বোস: প্রেমে ফেল করলে পাশ করায় পাশবালিশ
চিরন্তন দাসগুপ্ত: শুধু স্লেট-পেনসিলে নয়, পকেটমারিতেও হয় হাতেখড়ি