দু’তারিখ হসপিটালে ডাক্তারের কাছ থেকে সফদরের মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর, জন নাট্য মঞ্চের প্রধান অভিনেত্রী, সংগঠক, সফদরের স্ত্রী, মলয়শ্রী হাসমি, জনমের অন্য সদস্যদের হাসপাতালে দাঁড়িয়েই নির্দেশ দেন, তিন তারিখ শেষযাত্রার পর, চার তারিখেই শাহিবাবাদ, যেখানে নাটক অসম্পূর্ণ রেখে চলে আসতে হয়েছিল তাঁদের, ঠিক যেখানে সফদরকে লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে খুন করেছিল কংগ্রেসের গুন্ডারা, ঠিক সেখানেই ‘হাল্লা বোল’ নাটকের অভিনয় হবে। দ্য শো মাস্ট গো অন।
১৯২৩ সালে জন্মেছিলেন হাবিব তানভির। সদ্য পেরিয়ে আসা বছর ছিল ওঁর জন্মশতবর্ষ। ভারতীয় আধুনিক থিয়েটারের সবচেয়ে পরিচিত আন্তর্জাতিক মুখের জন্মশতবর্ষ খুব শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়নি। ভারতীয় আধুনিক চিত্রকলার সবচেয়ে পরিচিত আন্তর্জাতিক মুখ মকবুল ফিদা হুসেইন, জীবনের শেষ দিনগুলো, তাঁর নিজের দেশে কাটাতে পারেননি। ভারতের পথনাটকের, রাজনৈতিক পথনাটকের সবচেয়ে কমিটেড কর্মী, কমিউনিস্ট সফদর হাসমি খুন হয়েছিলেন কংগ্রেসি গুন্ডাদের হাতে। এঁরা তিনজনই জন্মসূত্রে মুসলমান, তা কোনও কাকতালীয় নয়। ভারতে সংখ্যালঘু মানুষদের ওপর রাষ্ট্রীয় মদতে আক্রমণ একটা ফেনোমেনন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য– এম. এফ. হুসেইনের আঁকা ‘ট্রিবিউট টু হাসমি’ ছবিটিই ভারতের প্রথম পেইন্টিং, যা এক মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়।
সফদর মারা যাওয়ার কয়েক দিন পরই দিল্লিতে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের মঞ্চে প্রতিবাদ পত্র পাঠ করেন শাবানা আজমি। পাশে যে বাঙালি অভিনেতা নিশ্চুপ দাঁড়িয়েছিলেন, তিনিই প্রথম বাঙালি নায়ক, যিনি পরবর্তীতে বিজেপির হয়ে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। বছরের শেষদিনে মোহন ভাগবত তাঁর সঙ্গে দেখা করে গেলেন। সঠিক সময়ে নিশ্চুপ থাকার কারণে শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতা জানালেন সম্ভবত। সফদর নিজে ছিলেন সোচ্চার। নিশ্চুপ থাকা ওঁর ধাতে ছিল না। রাজনৈতিক মতামত ছিল স্পষ্ট। কোনও রাখঢাক করে ইনিয়েবিনিয়ে কথা বলতেন না সফদর। অতটা সপাট, আপোসহীন না হলে ৩৪ বছর বয়সে থিয়েটার করতে গিয়ে খুন হয়ে যেতেন না মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের সদাহাস্যজ্জ্বোল সদস্যটি।
দিল্লিতে WBIB ওয়েস্ট বেঙ্গল ইনফরমেশন ব্যুরোর ইনফরমেশন অফিসার হিসেবে চাকরি করেছেন সফদর ১৯৮০ থেকে ১৯৮৩ সালে। ওঁর দপ্তরটি দিল্লির প্রগতিশীল শিল্পী সাহিত্যিকদের প্রধান আড্ডাখানা হয়ে উঠেছিল ওই সময়ে। বাংলা থেকে যাওয়া শিল্পীরা অবাক হতেন দপ্তরে রাখা একটা বড় ছবি দেখে। সাধারণত অফিসারদের ঘরে, যে রাজ্যের চাকরি করছেন, সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ছবি ঝুলিয়ে রাখাই দস্তুর। কিন্তু সফদরের ঘরে দেওয়ালে টাঙানো ঋত্বিক ঘটকের ছবি। ছবিতে ক্যাপশন– ‘দি আনপ্যারালালড ফিল্ম জিনিয়াস’। এমনটাই মনে করতেন সফদর। আর যা মনে করতেন, তা জোর গলায় বলতে ডরাতেন না। ঋত্বিককুমার ঘটক, কমিউনিস্ট পার্টি থেকে আচরণগত সমস্যার কারণে বহিষ্কৃত, সেই মানুষের ফোটোগ্রাফ, কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত সরকারের দপ্তরে পূর্ণ মর্যাদায় শোভা পাচ্ছে, আর এক কালচারাল ফ্রন্টের কমিউনিস্ট সদস্যের উদ্যোগ আর ভালোবাসায়, এ নজির বিশ্বের কমিউনিস্ট ইতিহাসেই বিরল। বস্তুত জানিয়ে রাখা ভালো, তখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন জ্যোতি বসু। মজার বিষয়– ঋত্বিকের পার্টি থেকে বহিষ্কার সংক্রান্ত যে তিন সদস্যের অভ্যন্তরীণ কমিশন, তার অন্যতম ছিলেন জ্যোতি বসু। কমিশনে তিনজনের মতৈক্য হয়নি, দুইজন বহিষ্কারের পক্ষে ছিলেন, একজন চেয়েছিলেন ঋত্বিক পার্টিতে থাকুন। সেই সংখ্যালঘু সদস্যের নামও জ্যোতি বসু। তিনি নোট রেখেছিলেন– সমস্ত সদস্যকে একই প্যারামিটারে বিচার করা উচিত নয়, ঋত্বিকের মতো সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বর ক্ষেত্রে পার্টির উচিত আরও একটু ফ্লেক্সিবল এবং সংবেদনশীল হয়ে বিবেচনা করার।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
দিল্লিতে ‘কমিটি ফর কমিউনাল হার্মনি’র সবচেয়ে কমবয়সি নেতা ছিলেন সফদর। কিছু বছর পরে, সফদরের সম্প্রীতির পক্ষে অবদানের স্বীকৃতিতে একটি সংগঠন ওঁকে পুরস্কৃত করতে চায়। পুরস্কার মূল্যও কিছু কম নয়, দশ হাজার টাকা! ১৯৮৮/’৮৯ সালে দশ হাজার টাকা অনেকখানি টাকা। কিন্তু সফদর তাঁর নিজস্ব মেজাজেই শর্ত দেন, এই কাজ ওঁর একার নয়, ‘জন নাট্য মঞ্চ’ দলের এই কাজ।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সংস্কৃতির বিষয়ে নিজেকে নিদারুণ অজ্ঞ ঘোষণা করা রাজনৈতিক মানুষটির কমন সেন্স সম্ভবত সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিবেচক অবস্থানকে সূচিত করেছিল। ফলে সেই সময়ের দিল্লির অপ্রশস্ত দপ্তরটি সফদরের উদ্যোগে প্রধান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পর্যবসিত হয়। শুধুমাত্র পার্টির ইয়েস ম্যানরা সেই দপ্তর ঘিরে থাকত না। কলকাতা থেকে দিল্লির লেডি শ্রীরাম কলেজে পড়তে যাওয়া বাঙালি মেয়ে সোহিনী ঘোষের স্মৃতিতে আছে সফদরের স্বতঃস্ফূর্ত ব্যবহার। আজ সোহিনী ঘোষ কর্নেল ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করা, দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার অধ্যাপক এবং স্বীকৃত ডকুমেন্টারি ফিল্ম মেকার, কিন্তু সেদিন সোহিনী ছিলেন কলকাতার সাংস্কৃতিক পরিসর থেকে হঠাৎই বিচ্ছিন্ন হয়ে দিল্লিতে চলে আসা এক আন্ডার গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট। সোহিনীর সে সময় একমাত্র প্রাণের আরাম ছিল কলেজের ফিল্ম সোসাইটি, কিন্তু সেটা আজকের মতো ওয়েব, পেন ড্রাইভ, ডিভিডি, হার্ড ডিস্কের সময় নয়। ফিল্ম স্ক্রিনিং মানে ফিল্ম ক্যান জোগাড় করা, আর তা জোগাড় করার একমাত্র উপায় পুনের আর্কাইভে চিঠি লিখে অপেক্ষা করা, যদি কর্তৃপক্ষ দয়া করে নেহাতই অর্বাচীন কলেজ ফিল্ম ক্লাবকে ফিল্ম ক্যান পাঠায়! এই সময় হঠাৎই সোহিনী WBIB অফিসের খোঁজ পেয়ে চলে আসেন বাবা খড়ক সিং মার্গের দপ্তরে। সেখানের প্রধান দপ্তরী ওঁর সঙ্গে বাংলায় আলাপচারিতা চালান এবং তুলে দেন রাজেন তরফদারের ‘পালঙ্ক’ ছবির প্রিন্ট। একজন কলেজ ছাত্রীকে এই ফিল্ম ক্যান তুলে দেওয়ার জন্য সফদরকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ভর্ৎসনা শুনতে হয়েছিল, কিন্তু সফদর এসব পাত্তা দিতেন না। ভাগ্যিস দিতেন না।
১৯৮৯ সালের জানুয়ারি মাসের দু’ তারিখ একটা প্রেস কনফারেন্স ডেকেছিলেন সফদর। সেই প্রেস কনফারেন্সটি হয়, কিন্তু সফদর ছিলেন অনুপস্থিত। কারণ ১৯৮৯ সালের জানুয়ারি মাসের দু’ তারিখ সফদর শাহদত বরণ করেন। কিন্তু সফদর যে জন্য প্রেস কনফারেন্স ডেকেছিলেন, তা জানলেই সফদরকে অনেকখানি চিনতে পারা যায়, সফদরকে কেন হত্যা করতে হল, তাও অনেকখানি বুঝতে পারা যায়। সফদর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বারবার কলম ধরেছেন, গান বেঁধেছেন, থিয়েটার করেছেন। ’৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর হত্যা পরবর্তী দিল্লি দাঙ্গায়, সফদর ছিলেন সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার, আক্রান্ত মানুষের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করার, দাঙ্গা বিরোধী মিছিল সংগঠিত করার এক প্রধান নেতা। দিল্লিতে ‘কমিটি ফর কমিউনাল হার্মনি’র সবচেয়ে কমবয়সি নেতা ছিলেন সফদর। কিছু বছর পরে, সফদরের সম্প্রীতির পক্ষে অবদানের স্বীকৃতিতে একটি সংগঠন ওঁকে পুরস্কৃত করতে চায়। পুরস্কার মূল্যও কিছু কম নয়, দশ হাজার টাকা! ১৯৮৮/’৮৯ সালে দশ হাজার টাকা অনেকখানি টাকা। কিন্তু সফদর তাঁর নিজস্ব মেজাজেই শর্ত দেন, এই কাজ ওঁর একার নয়, ‘জন নাট্য মঞ্চ’ দলের এই কাজ। ব্যক্তি সফদর নয়, দলকে এই সম্মান প্রদর্শন করা হলে, তবেই সফদর এই সম্মান নেবেন। অর্গানাইজাররা সফদরের এই প্রস্তাবে সম্মত হন। কিন্তু আর এক মুশকিল ঘটে! দেখা যায় পুরস্কার তুলে দেবেন তৎকালীন তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রী, কংগ্রেস সাংসদ, হরি কৃষ্ণ লাল ভগত। হরি কৃষ্ণ লাল ভগত, ’৮৪ সালের শিখ নিধনে অন্যতম অভিযুক্ত, আর তিনিই জন নাট্য মঞ্চকে পুরস্কার তুলে দেবেন তাদের দাঙ্গা বিরোধী অবস্থানের জন্য! সফদর পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন, এবং প্রত্যাখ্যানের কারণ জানাতে ১৯৮৯ সালের জানুয়ারি মাসের দু’ তারিখ প্রেস কনফারেন্স ডাকেন, যে প্রেস কনফারেন্সে সফদর নিজে উপস্থিত হতে পারেননি। সফদরের ডাকা প্রেস কনফারেন্স থেকেই সফদরের মৃত্যুর সংবাদ জানান ভারতীয় থিয়েটারের তিন দিকপাল– হাবিব তানভির, গোবিন্দ দেশপাণ্ডে, এম. কে. রায়না। এই কনফারেন্স থেকে সফদর জানাতে চেয়েছিলেন– যে কংগ্রেসিরা খুন করেছে, জাতি দাঙ্গায় ইন্ধন দিয়েছে, তাদের হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করবেন না। আর এক কংগ্রেসি গুন্ডা মুকেশ শর্মা, সফদরকেই খুন করে, সফদরের আনকম্প্রোমাইজিং রাজনৈতিক অবস্থানকে এক প্রকার পুরস্কৃতই করেন।
থিয়েটারের একটা অলিখিত কথা আছে– দ্য শো মাস্ট গো অন। ’৭৪ সালে কলকাতার কার্জন পার্কে বাদল সরকারের নাটক চলাকালীন কংগ্রেস সরকারের পুলিশ আক্রমণ চালায়। পুলিশ পিটিয়ে পিটিয়ে খুন করে নাটক দেখতে আসা যুবক প্রবীর দত্তকে। এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সমস্ত সাংস্কৃতিক কর্মী, ইন্টালেকচুয়ালস, সাধারণ মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তোলেন বাংলায়। এবং প্রতিরোধের পদ্ধতি ছিল অসাধারণ। কার্জন পার্কেই পরের শনিবার আবার নাটক অভিনয় আয়োজন করা হয় উৎপল দত্ত-র সভাপতিত্বে। হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী, অধ্যাপক, মজদুর, গ্রামের থেকে আসা কৃষক কার্জন পার্ক ভরিয়ে দেন নাটক দেখতে। পুলিশের সাহস হয়নি সেদিন আর কোনও বেয়াদবি করতে।
দু’তারিখ হসপিটালে ডাক্তারের কাছ থেকে সফদরের মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর, জন নাট্য মঞ্চের প্রধান অভিনেত্রী, সংগঠক, সফদরের স্ত্রী, মলয়শ্রী হাসমি, জনমের অন্য সদস্যদের হাসপাতালে দাঁড়িয়েই নির্দেশ দেন, তিন তারিখ শেষযাত্রার পর, চার তারিখেই শাহিবাবাদ, যেখানে নাটক অসম্পূর্ণ রেখে চলে আসতে হয়েছিল তাঁদের, ঠিক যেখানে সফদরকে লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে খুন করেছিল কংগ্রেসের গুন্ডারা, ঠিক সেখানেই ‘হাল্লা বোল’ নাটকের অভিনয় হবে। দ্য শো মাস্ট গো অন।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
পড়ুন শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা: সামান্যকে অসামান্য করতে হাবিব তনভীরের একমাত্র আশ্রয় ছিল নাটক
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
দু’দিন আগে শাহিবাবাদে দর্শক হয়েছিল দেড়শো জন। দু’দিন পর দর্শক হয় পঁচিশ হাজার। নাটক শুরুর আগে একটা মিছিল হয় এলাকায়। সেদিনের হামলায়, সফদর ছাড়াও, গুন্ডাদের গুলিতে মারা গিয়েছিলেন সিআইটিইউ কর্মী রাম বাহাদুর। রাম বাহাদুরের বাড়ি গিয়ে ওঁর স্ত্রী প্রবিত্রাকে, মলয়শ্রী হাসমি বলে আসেন– ‘ডরো মাত। হাম হ্যায়।’
সেদিনের ঐতিহাসিক শোয়ের যেসব ফোটো পাওয়া যায়, তার মধ্যে একটায় দেখা যাবে, একজন দর্শক একটা হাতে লেখা পোস্টার তুলে ধরেছেন, তাতে লেখা– ‘সফদর মারা গেছে, কিন্তু ধমনীতে সে বেঁচে’।
স্পেশাল ইভেন্টগুলো খুব উপভোগ করতাম, যেমন, নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে সেকেন্ড চ্যানেলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, দিনটি ছিল ১৯ নভেম্বর, ইন্দিরা গান্ধীর জন্মদিন। সেবারের অনুষ্ঠানে কলকাতার বহু নামী শিল্পী যেমন ছিলেন, তেমন ছিলেন বম্বের অনেক নামজাদা সঙ্গীতশিল্পী।