জীবনের শেষ চার বছরে বাংলা ভাষায় বিবেকানন্দের লেখা গদ্য ও তাঁর বিপুল পত্রসম্ভার যদি নিবিষ্টমনে পড়া যায়, লক্ষ্য করা যায়, কলকাতার কথা ও আভাস। কখনও কলকাতার ভদ্রলোক শ্রেণি, বা ‘মার্সেন্টাইল ক্লাস’ নিয়ে ঈষৎ ব্যঙ্গ ও কৌতুক স্থান পাচ্ছে তাঁর ‘পরিব্রাজক’-এ।
কলকাতা মহানগরীর রাজপথ দিয়ে এতোল-বেতোল ছুটছে একটা ঘোড়ার গাড়ি। ঘোড়াটা খেপে গেছে। কোচোয়ান লাগাম টেনেও কিছু করতে পারছেন না; গাড়ির ভিতরের মহিলারা চিৎকার করছেন প্রাণভয়ে, ‘বাঁচাও!’ আর বাঁচাও! কে বাঁচাবে তখন? পথ থেকে পালাচ্ছে মানুষজন ছত্রভঙ্গ হয়ে। কিন্তু– ও কী! কোত্থেকে একটা ছেলে ছুটে এসে, ওই পাগলা ঘোড়ার মুখের বল্গা ধরে ঝুলে পড়েছে! চতুর্দিকে রে-রে রব; সবকিছু উপেক্ষা করে ছুটছে ঘোড়াটা, আর ছেলেটাও চলেছে ঝুলতে ঝুলতে। অবশেষে তার দৌলতেই ঘোড়াটা আরও কিছুটা ছুটে শান্ত হয়ে থামল, আর গাড়ির যাত্রীরাও প্রাণ হাতে করে নামতে পারলেন। ধন্য-ধন্য বলে ছুটে এল সবাই– অতটুকু ছেলের কী সাহস! কিন্তু আশ্চর্য, যেন এসব কোনও ব্যাপারই না– এমন একটা মেজাজ নিয়ে ছেলেটা চলে গেল ভিড় কাটিয়ে নিজের পথে আবার, আপনমনে।
খোঁজখবর নিলে জানা যায়, ও কলকাতার গণ্যমান্য অ্যাটর্নি বিশ্বনাথ দত্তের ছেলে– নরেন্দ্রনাথ।
পরিত্রাতারূপে ধূমকেতুর মতো যেখানে-সেখানে এসে পড়া, এবং কাজ সেরে আবার ভিড় থেকে নিজেকে নিরঙ্কুশ সরিয়ে নেওয়ার ম্যাজিক জানা নরেন্দ্রনাথ দত্ত অকুতোভয়, আড্ডাবাজ, দামাল। তাঁর জন্মের শহরটি তৎকালীন ভারতবর্ষের ‘এথেন্স’ যেন। শিক্ষা-দীক্ষা, নবজাগরণের ‘গ্রাউন্ড জিরো’। ‘নবজাগরণ’ কথাটির মধ্য দিয়েই, সে যেন নিজেকে ভারতের আর পাঁচটা অজ্ঞান, ঘুমন্ত শহরের চেয়ে কিছুটা উচ্চাসনে বসিয়ে নিয়েছে। সেইখানে, পশ্চিমি ধ্যানধারণায় নিজেকে গড়ে তুলছেন নরেন্দ্রনাথ। মেট্রোপলিটান স্কুল, প্রেসিডেন্সি কলেজ, জেনারেল এসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন (আজকের স্কটিশ চার্চ কলেজ)– সব জায়গায় পাঠ নিচ্ছেন তিনি; সাঁতার-ক্রিকেট-ফুটবল-কুস্তি-লাঠিখেলায় মেতে থাকছেন পাশাপাশি।
স্কুলের অনুষ্ঠানে জনপ্রিয় দেশনেতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনে কথা বলতে হবে– এই ভয়ে যখন লুকিয়ে পড়ছে মুখচোরা অন্যান্য বন্ধুরা, ডাকাবুকো নরেনের গলা কাঁপছে না বক্তৃতা করতে। কলেজ-জীবনে পড়ছেন, ডেভিড হিউম বা জন স্টুয়ার্ট মিলের দর্শন; বাদ যাচ্ছেন না কান্ট-হেগেলও। কুসংস্কারাচ্ছন্ন হিন্দুধর্মকে ‘সাফ-সুতরো’ করা ব্রাহ্মসমাজে যাচ্ছেন নরেন্দ্র, কট্টর যুক্তিবাদী হয়ে প্রশ্ন করছেন মূর্তিপূজাকে।
তাঁর উত্থানের রোম্যান্টিক পটভূমি হিসেবে কলকাতাকে ব্যবহার করেননি নরেন্দ্রনাথ; কেবলমাত্র ‘স্ট্রিট-স্মার্ট’ হওয়ার অলংকার হিসেবেও এই শহরকে গায়ে জড়াননি। তিনি কলকাতার প্রাণরসটুকু আত্মস্থ করেছিলেন। নরেন্দ্রনাথের বাল্যবন্ধু, প্রিয়নাথ সিংহের স্মৃতিতে সেই তরুণ ‘পলিম্যাথ’-এর জীবনে, এক একটি দিন যেন শহরযাপনের আদর্শ এক দিনপঞ্জি হয়ে ওঠে। বেলা এগারোটা নাগাদ নরেনের পড়াশুনার খেই ভেঙে বন্ধুরা বাড়ি এসে আবদার করছে, ‘আবার রাত্তিরে পড়িস! দুটো গান গা দেখি এখন।’ আড্ডায় বন্ধুদের অনুরোধ ফেলা কি সাজে? বেলা গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায়, গান-গল্প-কথায় মাতোয়ারা হয়ে থাকে বন্ধুদের দল। টপ্পা, খেয়াল, ধ্রুপদ; বাংলা, হিন্দি, সংস্কৃত। মাঝেমাঝে হুঁকোয় দু’-চার টান। সন্ধের অন্ধকার গাঢ় হয়, ঘরে প্রদীপ জ্বলে ওঠে। শেষে রাত দশটায় আসর ভাঙে বন্ধুদের– তড়িঘড়ি বাড়ির পথ ধরে সবাই।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
স্কুলের অনুষ্ঠানে জনপ্রিয় দেশনেতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনে কথা বলতে হবে– এই ভয়ে যখন লুকিয়ে পড়ছে মুখচোরা অন্যান্য বন্ধুরা, ডাকাবুকো নরেনের গলা কাঁপছে না বক্তৃতা করতে। কলেজ-জীবনে পড়ছেন, ডেভিড হিউম বা জন স্টুয়ার্ট মিলের দর্শন; বাদ যাচ্ছেন না কান্ট-হেগেলও। কুসংস্কারাচ্ছন্ন হিন্দুধর্মকে ‘সাফ-সুতরো’ করা ব্রাহ্মসমাজে যাচ্ছেন নরেন্দ্র, কট্টর যুক্তিবাদী হয়ে প্রশ্ন করছেন মূর্তিপূজাকে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সম্পদ ও বিপদ– কলকাতা দুই-ই দিয়েছিল নরেন্দ্রনাথকে, প্রাণভরে। তাঁর ব্যক্তিজীবনের বিবর্তনে কলকাতার সবচেয়ে বড় দান ছিল, এক ‘বহিরাগত’– গদাধর চট্টোপাধ্যায়, ওরফে শ্রীরামকৃষ্ণ। কলকাতার আত্মম্ভরিতাকে সপাটে প্রত্যাখ্যান করা ওই গ্রাম্য, মেঠো মানুষটির সামনে নগরকেন্দ্রিক যুক্তিবাদের কুঠার হাতে দাঁড়িয়েছিলেন নরেন্দ্রনাথ। চার বছরব্যাপী দীর্ঘ ‘যুদ্ধে’র পর অবশেষে নরেন্দ্রনাথ নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন তাঁর পায়ে, বৈদান্তিক যুক্তি, ভক্তি ও অতীন্দ্রিয়বোধে বলীয়ান হয়ে। কিন্তু ততদিনে বদলে গেছে চারপাশের ছবিও। তাঁর পিতৃবিয়োগ ঘটেছে, দত্ত-পরিবারে নেমে এসেছে নিদারুণ অভাব অনটন। যে শহরে একদিন দাপিয়ে বেড়িয়েছেন নরেন, আজ সেই শহরেই তিনি সঙ্গীহীন, কর্মহীন, নিদ্রাহীন; রামতনু বসুর গলিতে, তাঁদের মাটিতে বসে যাওয়া এঁদো একতলার ঘরে একবেলা ভাত ফোটে কি ফোটে না! এদিকে, গুরুভাইদের নিয়ে তিনিও তখন বাসা বেঁধেছেন বরাহনগরের পোড়ো ‘ভূতের বাড়ি’তে; কঠোর সাধনা চলছে দিবারাত্র। নাগরিক মায়ায় মোড়া পথেঘাটে, যে নরেন এককালে শানাতেন তাঁর পশ্চিমি ঢাল-তরোয়াল, আজ তিনিই সেইসব পথে খালি পায়ে, একবস্ত্রে হাঁটেন, কোনও একভাবে তন্ময় হয়ে। বাগবাজার পুলে তাঁর দেখা হয় গিরিশ ঘোষের ভাই অতুল ঘোষের সঙ্গে। ঘোরের মধ্যে নরেন্দ্র বলে ওঠেন, ‘আমার মায়া মরে গেছে।’ এর কিছুদিন পর, কয়েক বছরের জন্য, কলকাতার স্মৃতি থেকে হারিয়ে যান নরেন্দ্রনাথ দত্ত।
পরবর্তী জীবনে, স্বামী বিবেকানন্দ ফিরে এসেছেন যখন, তখন তিনি আর কেবল কলকাতা-র নন। অক্লান্ত সেবাধর্ম পালন করে গেছেন ধনী-দরিদ্র, স্বদেশ-বিদেশ, মানুষ ও মনুষ্যেতর জীব নির্বিশেষে। আদর্শগতভাবে সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর আত্ম-পর ভেদাভেদ থাকে না; বিবেকানন্দও ফারাক করেননি কলকাতার মানুষ আর অন্য মানুষে। চরিত্রানুগভাবেই, কোনও মায়াবিজড়িত, স্মৃতিমেদুর আখ্যানও লেখেননি কলকাতাকে নিয়ে।
তবু, এই শহর থেকে গিয়েছে তাঁর মনের গোপন কোনও কুঠুরিতে। জীবনের শেষ চার বছরে বাংলা ভাষায় বিবেকানন্দের লেখা গদ্য ও তাঁর বিপুল পত্রসম্ভার যদি নিবিষ্টমনে পড়া যায়, লক্ষ করা যায়, কলকাতার কথা ও আভাস। কখনও কলকাতার ভদ্রলোক শ্রেণি, বা ‘মার্সেন্টাইল ক্লাস’ নিয়ে ঈষৎ ব্যঙ্গ ও কৌতুক স্থান পাচ্ছে তাঁর ‘পরিব্রাজক’-এ। কখনও ‘কলকেতার ভাষা’ যে বাংলা, তাকে সাহিত্যের ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে লড়ছেন; সেই ভাষাতেই আঁকছেন শহরের আশ্চর্য যাপনচিত্র, যা ফুটে উঠছে ‘কেরাঞ্চি ও ট্রামঘড়ঘড়ায়িত ধূলিধূসরিত কলকাতার বড় রাস্তার ধারে’, বা ‘পানের পিক-বিচিত্রিত দ্যালে, টিকটিকি-ইঁদুর-ছুঁচো-মুখরিত একতলা ঘরের মধ্যে দিনের বেলায় প্রদীপ জ্বেলে’, কিংবা ‘আঁব-কাঠের তক্তায় বসে, থেলো হুঁকো টানতে টানতে’।
কলকাতা বিবেকানন্দের মনে রয়ে গেছে অস্ফুট এক সম্ভাবনা হয়ে– যে সম্ভাবনায় বিবেকানন্দের মতো আশান্বিত, আর কেউ হননি; যার বাস্তবায়নে তাঁর চেয়ে বেশি সুখী, ও যার স্খলনে তাঁর চেয়ে বেশি বেদনাদীর্ণও আর কেউ হননি। মার্কিন মুলুক থেকে গুরুভাই বা শিষ্যকে চিঠিতে লিখছেন– রামকৃষ্ণ আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্রটি তাঁর কলকাতাতেই স্থাপন করার ইচ্ছা, উদ্দীপ্ত হচ্ছেন কলকাতায় রামকৃষ্ণ ভাবধারার প্রসারে, চাইছেন কলকাতার কেন্দ্র থেকেই একটি বাংলা ভাষার পত্রিকা শুরু করতে (আজ যা ‘উদ্বোধন’ নামে খ্যাত)। এরই অন্য পিঠে, সেবা ও আন্দোলনের দারিদ্রের দিনে, কলকাতায় অর্থসাহায্য নিয়ে আসা বাঙালির সংখ্যা ছিল গুটিকয় মাত্র; হতাশায় বিবেকানন্দ বলতে দ্বিধাবোধ করেননি, মাদ্রাজে তাঁর সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা কলকাতার চেয়ে বেশি। আবার প্লেগ মহামারীর কবলে পড়ছে যখন তাঁর প্রিয় শহর, বিবেকানন্দের কলম উতলা হয়ে উঠছে। কোনও চিঠিতে দুর্ভাবনার প্রকাশ– এক সপ্তাহে কলকাতায় ৫০০ লোক মরেছে প্লেগে; কোনও চিঠিতে হা-হুতাশ– এত বড় মহামারী নিয়েও উপরমহল কী নিশ্চুপ, নির্বিকার! এই অসহায়তা থেকেই ক্রমান্বয়ে জন্ম নিচ্ছে অঙ্গীকার– ১৮৯৮ সালের ২৯ এপ্রিলের একটি চিঠিতে লিখছেন, ‘আমি যে-শহরে জন্মেছি, সেখানে যদি প্লেগ এসে পড়ে, তবে আমি তার প্রতিকারকল্পে আত্মোৎসর্গ করব বলেই স্থির করেছি’। কে বলে, সন্ন্যাসীর ‘একান্ত আপন’ বলে কিছু হয় না?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: বেকেনবাওয়ার– থমথমে জার্মানির ভেতর জন্ম নেওয়া একফালি মুক্তাঞ্চল
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
এসবের কী প্রতিদান পেয়েছেন? কলকাতাকে যত আপন করেছেন তিনি, কলকাতার মানুষ তারও চেয়ে অনেক বেশি আঘাত ফিরিয়ে দিয়েছে বিবেকানন্দকে। তাই, শেষ অবধি শহর ও তার সন্তানের মধ্যে সম্পর্কটি সেই তিক্তমধুর হয়েই থেকে গিয়েছে। যখন আমেরিকা বা ইউরোপে নিরলসভাবে বক্তৃতা দিয়ে চলেছেন বিবেকানন্দ নিজের দেশ ও সভ্যতাকে নিয়ে, কলকাতার ‘রক্ষণশীল সমাজ’ তখন মাথা ঘামিয়েছে– বিদেশের কনকনে ঠান্ডার শরীর গরম রাখতে যুবক সন্ন্যাসী মদ-মাংস খাচ্ছেন না কি? দেশনায়করূপে ১৮৯৭ সালে যখন ফিরলেন, এই কলকাতার বিদ্বজ্জনেরাই বলেছেন– ‘কায়স্থের ছেলে কালাপানি পেরিয়েছে, সে আবার সন্ন্যাসী কিসের? ওর তো জাত ধর্ম সবই গেছে!’ এই একই কারণে, টাউন হলে বিবেকানন্দকে অভ্যর্থনা জানাতে সম্মত হলেও উত্তরপাড়ার মহারাজ প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায় শর্ত জারি করেছিলেন– সংবর্ধনায় কোথাও ‘স্বামী’ শব্দটি ব্যবহার করা যাবে না, বলতে হবে ‘ব্রাদার বিবেকানন্দ’।
বিবেকানন্দ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মুখ বুজে সহ্য করেছেন এইসব। আবার, এক এক সময় আর থাকতে না পেরে গর্জে উঠেছেন, এই সংকীর্ণ মনোভাবের বিরুদ্ধে; আলাসিঙ্গা পেরুমলকে চিঠিতে লিখেছেন– ‘কলকাতায় বন্ধুদের এদিকে একবিন্দু ক্ষমতা নেই, অথচ হামবড়াইটা খুব আছে’। চোখের সামনে বিবেকানন্দ দেখেছেন, কলকাতার আত্মম্ভরিতার জাহাজডুবি, দেখেছেন, কীভাবে তাঁর প্রিয় শহর সমস্ত স্বাতন্ত্র্য জলাঞ্জলি দিয়ে ক্রমশ ক্লীবে পরিণত হচ্ছে। তবু, ঘরের মানুষ বলেই বিবেকানন্দ হয়তো ভেবেছিলেন, তাঁর প্রতি কলকাতার এই উদ্ভট প্রেমে ‘আঘাত আছে, নাইকো অবহেলা’; তাই শহরের সঙ্গে ‘খেলা’টি মধুর না হলেও, ময়দান ছেড়ে তিনি চলে যাননি।
‘পরানুবাদ’, ‘পরানুকরণ, ‘পরমুখাপেক্ষা’, ‘দাসসুলভ দুর্ব্বলতা’, ‘লজ্জাকর কাপুরুষতা’– স্বাধীন হওয়ার পথে অন্তরায় হয়ে উঠতে পারে, মনে করে যে বিশেষ অভিধাগুলিতে বিবেকানন্দ তৎকালীন ভারতবর্ষকে বিঁধেছিলেন, কতিপয় উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ব্যতীত, তা আজও তাঁর দেশ ও এই প্রিয় শহরের ক্ষেত্রে একইরকম প্রযোজ্য। আজও এই শহরের প্রতিটি না-পারায়, অসৎ নীরবতায়, ঔদাসীন্যে অশ্রুত আবহের মতো বেজে চলে বিবেকানন্দের যন্ত্রণাক্লিষ্ট, অগ্নিমুখর কথাগুলি। হয়তো আমরা এখনও হীন, অযোগ্য– সেইসব কথার ধারক ও বাহক হতে, তাই আমাদের কানে কিছুই এসে পৌঁছয় না।
তবু, নানা অপারগতার মাঝে, এখনও তার মধ্যে যেটুকু প্রাণ অবশিষ্ট আছে, তা দিয়ে কলকাতা সাধ্যমতো ভালোবাসে বিবেকানন্দকে। হয়তো সে ভালোবাসা অনুসরণে নেই; আছে মুগ্ধতায়। যেমন নষ্ট-দুষ্ট, ‘আত্মঘাতী’ অভিভাবক কখনও কখনও তাঁদের সকল ভুল ও হেরে-যাওয়ার বিরুদ্ধে উত্তর খুঁজে পান সন্তানের নিষ্কলুষ কৃতিত্বে, সেই সাফল্যের বিভায় যেমন তাঁরাও গরীয়ান হন, এই ভালোবাসা তেমনই। আমরাও হতভাগ্যের মতো, তাঁকে জড়িয়ে ধরে বলে ফেলি, তিনি ‘আমাদের’– সেই বহুবচনে সাম্য নেই, প্রতিজ্ঞা নেই, প্রতিশ্রুতি নেই। আছে অপ্রতিভ, নিষ্ফলা এক অধিকারবোধ। তবে এই অধিকারটুকু থেকেও বঞ্চিত করেননি বিবেকানন্দ আমাদের। বিশ্বনাগরিকের সাজটি, সচেতনভাবেই সরিয়ে রেখে কলকাতা অধিবেশনে বলেছিলেন, ‘কলিকাতাবাসী এক বালকরূপেই এসেছি এখানে। ইচ্ছা হয়, আবার এই নগরীর রাজপথে ধূলার উপর বসে, সরল প্রাণে আপনাদের সঙ্গে দুটো কথা বলি।’
সেই বালকটিকেই বুকে ধরে রাখতে চায় কলকাতা– বিষাদে ও বন্ধুত্বে। কলকাতার মানুষও অপেক্ষা করে বন্ধুদের দেশে ফেরার, যেমন অপেক্ষা করতেন প্রিয়নাথ সিংহ, তাঁর বাল্যবন্ধু নরেনের। নির্জনে বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্য, ছেলেবেলার মতো দুটো কথা বলার জন্য, মন বড় ব্যাকুল হয়ে ওঠে তাঁর। তারপর একদিন সেই খ্যাতিমান বন্ধু, সত্যিই দেশে ফিরলে প্রিয়নাথ তাঁকে পাকড়াও করে নিয়ে যান নিভৃতে, গঙ্গাপারের বাগানবাড়িতে। বন্ধুটি বড় ব্যস্ত এমনিতে; নানা লোকে ক্ষণে ক্ষণে দেখা করতে আসে তাঁর সঙ্গে। কিন্তু অতিথি-অভ্যাগতরা এখন অপেক্ষা করুন একটু, তামাক-টামাক খান। সমস্ত উপাধি-আবর্জনা থেকে কিছুক্ষণের জন্য রেহাই নিয়ে প্রিয়নাথের সামনে তখন– না, স্বামী বিবেকানন্দ নয়– হাত-পা ছড়িয়ে বসেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত। উত্তর কলকাতার আড্ডাবাজ দুই বন্ধুতে ছেলেবেলার মতো গল্প হতে থাকে আবার। স্মৃতিগুলি আবার জীবন্ত হয়ে রঙ্গ করতে থাকে চোখের সামনে। তাঁদের হাসির দমক পুরনো শহরের ঘাট বেয়ে নেমে যায় নদীতে; গঙ্গার বাতাস তাকে বয়ে নিয়ে যায় দক্ষিণে, বিপুল জীবনসমুদ্রের দিকে।