সকাল সাতটা, উজ্জ্বল নীলার মতো পাহাড়ি আকাশের নিচে বের করে আনা হল তাঁর কফিনবন্দি দেহ, রওনা হল স্টেশনের উদ্দেশে। অনেকদিন আগে, এই ‘স্টেপ অ্যাসাইড’ বাড়ি থেকেই দার্জিলিং শ্মশানের পথে রওনা হয়েছিল আর-এক বিতর্কিত বাঙালির ততোধিক বিতর্কিত মরদেহ, তিনি ভাওয়ালের সন্ন্যাসী রাজা। তিনি অবশ্য ফিরে এসেছিলেন নিশ্চিত মৃত্যুর অবিশ্বাস্য হাতছানি এড়িয়ে, রহস্যগল্পের নায়কের মতো। কিন্তু চিত্তরঞ্জন ফেরেননি।
ঠিক ১০০ বছর আগের দার্জিলিং ম্যাল। অবিশ্রান্ত রডোডেনড্রন ফোটানোর পালা শেষ করে তখন সদ্য কর্মখালির বিজ্ঞাপনের দিকে এগচ্ছে সবুজ পাতার ঝাঁক। আর ঠিক সেই সময় মে মাসের মূর্ছিত শহর কলকাতা ছেড়ে তিনিও এলেন– এই তখনও অবধি নিরালা শৈলশহরে, ওই লালিগুরাস গাছের মতোই, ক্ষণিকের বিরাম-বাসনায়। চিত্তরঞ্জন দাশ, তাঁকে চেনে না এমন মানুষ তখন ভূ-ভারতে বিরল। ব্যারিস্টার জীবনের লব্ধপ্রতিষ্ঠা তিনি ততদিনে ঝেড়ে ফেলেছেন সব, অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজস্ব স্থাবর-অস্থাবর। মাত্র বছর দুয়েক আগেই কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রথম নির্বাচিত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। তার সঙ্গে জাতীয় স্তরের রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ তো আছেই!
বিপুল কর্মোদ্যোগজনিত এই অস্বাভাবিক শক্তিক্ষয়ের শোধও শরীর নিল। ১৯২৫ সালের মে মাসেই ফরিদপুরে গিয়েছিলেন বাংলার প্রাদেশিক কংগ্রেসের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করতে, ভাঙা শরীরে কলকাতায় ফিরে জ্বরে একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন তিনি। পাহাড়ের হাওয়াবদলি শুশ্রূষা আর একটু নিরিবিলি বিরামের আশা এবার এল একেবারে ডাক্তারি নির্দেশিকা হয়ে। ঠিক হল, দার্জিলিঙে এসে তাঁরা থাকবেন নৃপেন্দ্রনাথ সরকারের বাড়িতে। ১১ মে, নৃপেন্দ্রনাথ সরকার চিঠি লিখলেন তাঁর ব্যবস্থাপক অনুপলাল গোস্বামীকে। সেই চিঠিতে স্পষ্টই জানালেন তাঁর আশঙ্কার কথা, ‘শরীরটা এবারে তাঁর খুবই খারাপ, মনে হয় না আর খুব বেশিদিন বাঁচবেন। দার্জিলিঙে গিয়ে ওঁর যদি কোনও অসুবিধে হয়, তা কিন্তু তোমার-আমার ব্যক্তিগত দায়। আশা করি, বাড়িটা ঠিকঠাক আছে, বালিশটালিশও যথেষ্টই রয়েছে। ওঁর স্ত্রী এবং মেয়েও যাবেন ওঁর সঙ্গে, একটু দেখো।’
চিত্তরঞ্জন দার্জিলিঙে এসে পৌঁছলেন ১৬ মে, ম্যালের ঠিক নিচেই নৃপেন্দ্রনাথ সরকারের ছিমছাম পাহাড়ি লতাঘেরা দোতলা বাড়িটিতে, বাড়ির নাম ‘স্টেপ অ্যাসাইড’। তখনও বোঝা যায়নি তাঁর মেয়াদ আর ঠিক এক মাস। এসে থেকেই রোজ ওই পাহাড়ি পাকদণ্ডি পথের চড়াই-উতরাই পেরিয়ে লম্বা পথে পায়ে হেঁটে পাড়ি জমাতেন। শরীর ক্রমশ বেশ ভালো বোধ হতে লাগল। গাঢ় সবুজ পাহাড়ের আর্দ্রশীতল চরাচর এবারে যেন তাঁকে বড় বেশি টানছে। এর আগেও, ঠিক ১৪ বছর আগে, আরও একবার তিনি দার্জিলিঙে এসেছিলেন। সেবারে নিজের নয়, তবে অন্য আর একজনের শুশ্রূষার কামনায় মন ছিল ভরা। যদিও, সে আশা পূর্ণ হয়নি। ওই ১৯১১ সালের দার্জিলিঙে, লেবং কার্ট রোডের পাশে রয় ভিলার বাড়িতে সেবার মৃত্যুশয্যা পেতেছিলেন সিস্টার নিবেদিতা। তাঁর সঙ্গে ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু আর তাঁর স্ত্রী, ডাক্তার অবলা বসুও। চিত্তরঞ্জন দেখতেও গিয়েছিলেন তাঁকে, কিন্তু এক শারদ প্রত্যুষের আলো চোখে রেখে সেই যে নিবেদিতা কাঁপা-কাঁপা গলায় বললেন, ‘The boat is sinking… but I shall see the sunrise…’, আর ফিরলেন না তিনি।
কিন্তু এসব মৃত্যুকথা উদ্যমী দেশবন্ধুর মনকে খুব একটা দমিয়ে ফেলতে পারেনি। যদিও প্রতি সপ্তাহের জ্বর ঠিক ঘণ্টি বাজিয়ে এসে পড়ছে নাছোড় সময়ানুবর্তী পাহারাদারের মতো, তবু সকাল-সন্ধে মাইলের পর মাইল হাঁটায় বিরাম ছিল না তাঁর। দার্জিলিঙের জল-হাওয়ায় ক্রমশ বেশ ভালো বোধ করছিলেন চিত্তরঞ্জন। চেনা উদ্দীপনার ঢেউ যেন ধীরে ধীরে ফিরে আসছিল শিরায় শিরায়। দার্জিলিং এত ভালো লেগে গেল যে ঠিক করলেন, রাজনৈতিক ডামাডোলের ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে একটু দূরে, এখানেই একটা ছোট্ট বাসার বন্দোবস্ত পাকাপাকি করে ফেলতে পারলে ভালোই হয়! পৃথ্বীশচন্দ্র রায়কে সেকথা জানিয়েওছিলেন তিনি– ব্যাঙ্কে যেটুকু সঞ্চয় পড়ে আছে, তার দুই-তৃতীয়াংশ অন্তত খরচ করে যদি দার্জিলিঙে একটা পছন্দসই বাড়ি কিনতে পারা যায়, তাহলে বাকি টাকা দিয়ে জীবনটুকু কোনওরকমে কাটিয়ে দিতে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না হয়তো!
ভাবা যায় না, সেই মুহূর্তে দেশের শ্রেষ্ঠ ব্যারিস্টারদের মধ্যে অন্যতম– কলকাতার মেয়র চিত্তরঞ্জন দাশ, যাঁর আয় এবং সামর্থ অর্থনৈতিক প্রতিপত্তির নিরিখে অমন বিপুল। শুধু দেশের স্বার্থে নিজের সর্বস্ব তিনি বিলিয়ে দিয়েছেন এমনভাবে যে, স্বাস্থ্যরক্ষার তাগিদটুকু সামলানোর জন্যও তাঁকে এই হিসেব করতে হচ্ছিল ওই পাহাড়ি জনপদের নিরালায় বসে। শহর দার্জিলিং থেকে মাইল তিনেক দূরে, জলপাইগুড়ি স্পারের ওপরে আর অকল্যান্ড রোডের ঠিক নিচে, শুভ্র তুষারের অপরূপ সৌন্দর্যে ঘেরা একটা বাড়ি পছন্দও হল তাঁর, নাম তার ‘ক্যাথলিন কট’।
বাড়ি কেনা সংক্রান্ত প্রাথমিক কথাবার্তা এগোচ্ছিল ভালোই, চিত্তরঞ্জন নিজে তো পায়ে হেঁটেই বেশ কয়েকবার দেখে এলেন বাড়িটিকে। তাঁর কাজকর্মও থেমে ছিল না। ইতিমধ্যে অ্যানি বেসান্ট একবার এলেন ‘স্টেপ অ্যাসাইড’-এ, তাঁর তৈরি ‘কমওয়েলথ অফ ইন্ডিয়া বিল’-এর বিষয়ে জরুরি আলোচনা করতে। ৪ জুন এলেন গান্ধিজিও, এসে থাকলেন ওই ‘স্টেপ অ্যাসাইড’ বাড়িরই দোতলার একেবারে শেষ ঘরটিতে। সেবারে দিন পাঁচেক জুড়ে কংগ্রেস এবং স্বরাজ দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা চলল তাঁদের মধ্যে। কার্ট রোড ধরে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতেও বেরোলেন দেশবন্ধু। তাঁর পরনে ভারী জোব্বা, ট্রাউজার্স, পায়ে বুট, মাথায় টুপি। আর গান্ধিজির সেই চিরন্তন খাটো ধুতি, গায়ে চাদর, হাতে লাঠি আর খালি পা! তবে গান্ধিজিও খেয়াল করলেন, ক্রমশ বেশ সুস্থ হয়ে উঠছেন চিত্তরঞ্জন। ঠিক করা হল, কলকাতায় একবার ফিরে বেশ কিছু জরুরি কাজও সেরে ফেলা হবে।
কিন্তু গান্ধিজি ফিরে যাওয়ার সপ্তাহখানেকের মাথায়, ১৪ জুন থেকে আবার জ্বরে পড়লেন চিত্তরঞ্জন। এবারে অবস্থা বেশ ঘোরালো, তীব্র জ্বর ক্রমশ বিকারের চেহারা নিল। অসহ্য যন্ত্রণায় মাথা তুলতে পারছেন না তিনি, ওষুধে কোনও কাজ হচ্ছে না আর। ১৬ জুন, মঙ্গলবারের সকাল থেকে জ্বর একটু ছাড়ল। কিন্তু তাপমান কমার সঙ্গে সঙ্গে নাড়ির স্পন্দনও একেবারে পড়তির দিকে। দুপুর একটা নাগাদ অসম্ভব বুক ধড়ফড় করতে লাগল তাঁর, আচ্ছন্ন ভাবটা আচমকা কেটে গেল, আর তার পরেই জ্ঞান হারালেন তিনি। প্রায় ঘণ্টা চারেক সংজ্ঞাহীন পড়ে ছিলেন জীবন আর মৃত্যুর ঠিক মাঝদুয়ারে, তারপর বিকেল সোয়া পাঁচটা নাগাদ চিরতরে চলে গেলেন চিত্তরঞ্জন দাশ।
খবরটা চাউর হতে বেশি সময় লাগল না, জলস্রোতের মতো দর্শনার্থীর ভিড়ে তখন ‘স্টেপ অ্যাসাইড’-এ তিল ঠাঁই মেলা ভার। মধ্যরাত অবধি চলল অগুনতি চেনা-অচেনা মানুষের ঢল। কেউ বুক চাপড়ে কাঁদছেন, কেউ নির্বাক নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে আছেন বাড়ির ঘোরানো সিঁড়িতে, আত্মীয়-অনাত্মীয়ের ভেদ মুছে যাচ্ছে চোখের জলে। পরদিন সকাল সাতটা, উজ্জ্বল নীলার মতো পাহাড়ি আকাশের নিচে বের করে আনা হল তাঁর কফিনবন্দি দেহ, রওনা হল স্টেশনের উদ্দেশে। অনেকদিন আগে, এই ‘স্টেপ অ্যাসাইড’ বাড়ি থেকেই দার্জিলিং শ্মশানের পথে রওনা হয়েছিল আর-এক বিতর্কিত বাঙালির ততোধিক বিতর্কিত মরদেহ, তিনি ভাওয়ালের সন্ন্যাসী রাজা। তিনি অবশ্য ফিরে এসেছিলেন নিশ্চিত মৃত্যুর অবিশ্বাস্য হাতছানি এড়িয়ে, রহস্যগল্পের নায়কের মতো। কিন্তু চিত্তরঞ্জন ফেরেননি। সকালের দার্জিলিং মেলে পার্সেল ভ্যানে উঠল তাঁর ফুলে ফুলে সাজানো দেহটি, কলকাতার পথ পর্যন্ত প্রতিটি স্টেশনে সেদিন জনতার ঢেউ, প্রিয় দেশবন্ধুকে একটিবার বিদায় জানানোর আশায়।
ঠিক ১০০ বছর কেটে গেছে। মাঝে বহুদিন অযত্নে, অনাদরে বন্ধ পড়ে ছিল বাড়িটি। গত বছরের শেষ দিকে আবার সারিয়ে, দর্শনার্থীদের জন্য যত্ন করে খুলে দেওয়া হয়েছে স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি। বাড়ির পিছন দিকে দেশবন্ধুর নামেই শিশু এবং মাতৃসেবা সদন খোলা হয়েছে। সেখানে চিকিৎসা, টীকাকরণ সবই চলে নিয়মিত। বাড়ির সামনেই দেখলাম তাদের অ্যাম্বুল্যান্স দাঁড়িয়ে, তাও দেশবন্ধুর নামাঙ্কিত। ঢোকার মুখেই দেখা হল রীতা শেরপা-র সঙ্গে, মঙ্গোলয়েড মুখের আদলে অজস্র ভাঁজ ফেলে গেছে বয়স, হাঁটতে হয় ক্রাচে ভর করে। তিনিই বাড়িটি দেখাশোনা করেন, দর্শনার্থীদের এগিয়ে দেন টিকিট, হাসিমুখে বলে যান পুরনো দিনের আশ্চর্য সব গল্প। গৌরবময় ইতিহাসের জলে মুগ্ধ বিস্ময়ে ঝাঁপ দিতে যাওয়ার ঠিক আগে তালটা কাটল, যখন শুনলাম– সংগ্রহশালা নতুন করে খোলা হয়েছে, ফান্ডও বরাদ্দ হয়েছে প্রচুর, কিন্তু তাঁর মাইনে পড়ে আছে সেই আদ্যিকালের হিসেবেই। আজও মাসপ্রতি মাত্র ১২৮০ টাকা! দেশের কাজে সর্বস্ব বিকিয়ে দেওয়া মানুষটির বাড়িখানা এই বিভুঁইয়ে পরম যত্নে আগলে রাখার এই প্রতিদানের হিসেব শোনার লজ্জা ছেয়ে ফেলেছিল মনটাকে। তবু তাঁকে অবোধের প্রবোধটুকু দিয়ে নিঃসম্বল মনে ঢুকে পড়েছিলাম বাড়ির ভেতরে।
ঝকঝকে ‘স্টেপ অ্যাসাইড’-এ এখন সেজে উঠেছে দেশবন্ধুর স্মারক-সমন্বিত স্থিরচিত্র প্রদর্শনী। বাড়ির উপর-নীচ জুড়ে অসংখ্য ফোটোগ্রাফ, দোতলায় রয়েছে তাঁর শোবার ঘর, লেখার টেবিল। তাকালে মনে হয়, এই তো এই বালিশেই সেদিন রাখা ছিল তাঁর জ্বরতপ্ত মাথা, ঘরের চার দেওয়ালে যেন এখনও ঘুরে মরছে স্বজন হারানোর কান্না। যে ঘরে এসে থেকেছিলেন গান্ধিজি, সে ঘরেও দেরাজ, আলমারি, বিছানা দাঁড়িয়ে আছে টানটান। পুরনো লেপ-তোশকের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে সদ্য সংস্কার হওয়া সাদা বাড়ির রঙের গন্ধ। স্মৃতিভারে ছেয়ে যাওয়া আসবাব আর ছবির মধ্যে এসে দাঁড়ালে প্রাণপ্রাচুর্যময় দার্জিলিঙের উজ্জ্বলতা যেন ক্রমশ ফিকে হয়ে আসে। উদাস মনে ছায়া ফেলে যায় শান্ত সাদা বাড়িটির স্তিমিত অনুভূতি। ফায়ারপ্লেসের দিকে তাকালে মনে হয়, ১০০ বছরের ছাই কি এতই প্রাচীন, যে খুঁজলে সেদিনের সন্ধ্যার দু-একটি কাষ্ঠভস্মে দেশবন্ধুর স্মৃতি খুঁজে পাওয়া যাবে না?
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved