কেবল বলপূর্বক নয়, ছল-চাতুরি ও কৌশলের দ্বারা অন্যের জমির অধিকার হরণের উদাহরণও বড় কম নয়। এ-বিষয়ে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী দক্ষিণ আফ্রিকান নেতা ডেসমণ্ড টুটু ভালোই বলেছেন। তাঁর কথায়, ইউরোপিয়ানরা (পাদরিরা) যখন আমাদের দেশে এসেছিল, তখন তাদের হাতে ছিল বাইবেল, আর আমাদের হাতে ছিল দেশের তাবৎ জমি। তারা আমাদের চোখ বন্ধ করে ঈশ্বরের ধ্যান করতে বলল। আমরা তাই করলাম। চোখ খুলে দেখি, আমাদের হাতে বাইবেল, আর দেশের তাবৎ জমি চলে গেছে তাদের দখলে।
আমাদের পূর্বপুরুষরা যেদিন গাছ থেকে জমিতে পা রেখেছিলেন, সম্ভবত সেদিন থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল তাঁদের ভূমি-দখলের লড়াই। ভূমির প্রতি তাঁদের অধিকারবোধের উন্মেষও ঘটেছিল তখনই। তবে, মানুষ যতদিন ভ্রাম্যমান ছিল, ততদিন কোনও বিশেষ ভূমি বা ভূখণ্ডের ওপর তাদের অধিকার কায়েম করবার ইচ্ছেটা বোধহয় সেভাবে দানা বাঁধেনি। কিন্তু যেদিন মানুষ কৃষিকাজ শিখল, থিতু হতে চাইল, সেদিন থেকেই শুরু হল ভূমির ওপর মানুষের ব্যক্তিগত কিংবা যূথবদ্ধ অধিকার কায়েম করবার প্রয়াস। তারপর থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে, যুগে যুগে, অবিশ্রাম চলে আসছে ভূমির ওপর ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের অধিকার স্থাপনের ব্যক্তিগত বা যূথবদ্ধ লড়াই। সেই লড়াই, চলেছে তো চলেছেই। তার যেন আর বিরাম নেই।
প্রাচীনকালে সেই লড়াইয়ের চরম বিস্ফোট ঘটেছিল কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে। সেই যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে একদিকে ছিল কুরু-বংশীয়দের অনৈতিক উপায়ে ভূমি দখলের প্রয়াস; পাশাপাশি ছিল পাণ্ডব-বংশীয়দের তাদের প্রাপ্য জমির অধিকার অর্জন। মানুষের স্মৃতিকালের মধ্যে, জমির অধিকার রক্ষায়, সেটাই সম্ভবত ছিল সর্বপ্রথম এবং সবচেয়ে বড় মাপের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম।
একদিকে বলপূর্বক ভূমি দখল; এবং অন্যদিকে নিজের বা নিজেদের অর্জিত ভূমির অধিকার রক্ষা করবার প্রয়াস, ও তার জন্য নিরবচ্ছিন্ন সংঘর্ষ, বিপুল প্রাণহানি ও রক্তপাত– মানুষের সমগ্র ইতিহাসে এ যেন এক চিরাচরিত ঘটনা। সেই ট্র্যাডিশন আজও সমানে চলেছে।
জোরপূর্বক ভূমি দখল– এই সেদিন অবধি ছিল বিশ্বব্যাপী রাজা-রাজড়াদের বীরত্বের পরিচায়ক। পাশাপাশি, নিজ রাজ্যের ‘সূচ্যগ্র মেদিনী’টুকুর ওপর অধিকার কায়েম রাখবার জন্যও রক্তাক্ত সংগ্রাম চলেছে যুগে যুগে। আজও চলছে।
কেবল বলপূর্বক নয়, ছল-চাতুরি ও কৌশলের দ্বারা অন্যের জমির অধিকার হরণের উদাহরণও তো কম নয়। এ-বিষয়ে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী দক্ষিণ আফ্রিকান নেতা ডেসমণ্ড টুটু ভালোই বলেছেন। তাঁর কথায়, ইউরোপিয়ানরা (পাদরিরা) যখন আমাদের দেশে এসেছিল, তখন তাদের হাতে ছিল বাইবেল, আর আমাদের হাতে ছিল দেশের তাবৎ জমি। তারা আমাদের চোখ বন্ধ করে ঈশ্বরের ধ্যান করতে বলল। আমরা তাই করলাম। চোখ খুলে দেখি, আমাদের হাতে বাইবেল, আর দেশের তাবৎ জমি চলে গেছে তাদের দখলে।
নির্দিষ্ট ভূমির ওপর নিজ অধিকার কায়েম করা– এই প্রক্রিয়ার স্বরূপটিও ভারী বিচিত্র। একটা সময় ছিল, যখন ইহুদিদের কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ড ছিল না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তারা পরবাসী হয়ে থেকেছে দীর্ঘকাল। পাশাপাশি, নিজস্ব একটি ভূখণ্ডের স্বপ্নও দেখে গিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাদের জীবনে এল এক সৌভাগ্যের মুহূর্ত। মিত্রশক্তির বদান্যতায় তারা পেল একটি নিজস্ব ভূখণ্ড। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইহুদিরা ধাবিত হল তাদের নিজস্ব বাসভূমির উদ্দেশে। গঠন করল ইজরায়েল রাষ্ট্র। এবং তৎক্ষণাৎ শুরু করে দিল পার্শ্ববর্তী ফিলিস্তানীয় ভূমির ওপর জবরদখল, যার পরিণতি আজকের ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন যুদ্ধ। ওই যুদ্ধ তো অন্য কিছু নয়, স্রেফ ভূমির অধিকার হরণ এবং অধিকার রক্ষার রক্তক্ষয়ী লড়াই। আবার, স্বাধীনতার প্রাক্কালে পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিম পাকিস্থানের লক্ষ লক্ষ মানুষের থেকে বলপূর্বক কেড়ে নেওয়া হয়েছে তাঁদের পুরুষানুক্রমে অর্জিত ভূমির অধিকার। রাতারাতি পিতৃপুরুষের জমির থেকে তাবৎ অধিকার হারিয়ে তাঁদের উদ্বাস্তু হতে হয়েছিল। কিন্তু এটা তো আজ স্বীকৃত সত্য যে, দেশভাগের প্রাক্কালে পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিম পাঞ্জাবে যেসব ভয়ানক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটেছিল, তার পেছনে যত-না ছিল ধর্মীয় বিদ্বেষ, তার চেয়ে ঢের বেশি ছিল ওই দুই ভূখণ্ডের হিন্দু ও শিখ ধর্মাবলম্বী মানুষের ফেলে আসা জমিগুলির দখল পাওয়ার লালসা। স্পেনীয় ও পর্তুগীজ হানাদাররা কীভাবে গোটা ল্যাটিন আমেরিকার ভূমিপুত্রদের জমির অধিকার হরণ করেছে, ইতিহাস তার জ্বলন্ত সাক্ষী। বিশ্বব্যাপী মানুষের জমির অধিকার হরণের এমন অজস্র উদাহরণ পাওয়া যাবে।
আমাদের দেশে বিভিন্ন অরণ্যচারী আদিবাসী গোষ্ঠী চিরটাকাল অরণ্যের ওপর প্রবলভাবে নির্ভরশীল ছিল। বহু প্রজন্ম ধরে এই নির্ভরতা বহাল ছিল। ফলত, অরণ্যের ওপর তাদের অলিখিত অধিকার ছিল। সেই অধিকার তারা ভোগ করে এসেছে প্রজন্ম ধরে। কিন্তু ইংরেজ প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত তাদের সেই অধিকারকে নড়বড়ে করে দিয়েছিল। তার পরিণতিতে ইংরেজদের সঙ্গে আদিবাসীদের তুমুল লড়াই বেঁধেছিল। তা ছিল অরণ্য ও অরণ্য-সংলগ্ন জমির অধিকার রক্ষার লড়াই। তাদের মধ্যে কেবল চুয়াড়-বিদ্রোহের কথা আমাদের বেশি মনে আছে। কিন্তু বস্তুতপক্ষে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, বিভিন্ন সময়ে চলেছে আদিবাসী ও নিম্নবর্গের মানুষের ‘অরণ্যের অধিকার’ রক্ষার লড়াই।
বিগত শতাব্দীর তিন-চারের দশকে ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি আওয়াজ তুলেছিল, ‘লাঙল যার, জমি তার’। এতদ্বারা তারা জমির প্রকৃত অধিকার কার হওয়া উচিত, সে-সম্পর্কে নিজ দলের ভাবনার একটি প্রতিফলন ঘটিয়েছিল। দেশে তখনও ছিল ইংরেজ জমানা। জমিদার-জোতদারদের ছিল প্রশ্নহীন দাপট। কিন্তু তাও কেবল আওয়াজ তুলেই তারা থেমে থাকেনি। শুরু করেছিল দেশব্যাপী বর্গাচাষীদের তেভাগার লড়াই। সেও তো এক অর্থে জমির ফসলের ওপর নিজ অধিকার কায়েমের লড়াই।
১৯৫৩ সালে এ-রাজ্যে জমিদারি উচ্ছেদ আইন পাশ হল। ফলে, শুরু হল জমির অধিকার রক্ষার জন্য আর এক কিসিমের লড়াই। সেই লড়াইতে শামিল হলেন রাজ্যের তাবৎ জমিদারকুল। দিকে দিকে বেনামে জমি রেখে দেবার হিড়িক পড়ে গেল। আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে কৌলিক দেবদেবী, বাড়ির চাকর-বাকর, আশ্রিত-অনুগতজন, মায় বাড়ির কুকুর-বেড়ালের নামেও জমি রেখে দেবার সার্বিক প্রয়াস চলেছিল বেশ কিছুদিন। তার জবাবে এই রাজ্যে প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমল থেকেই শুরু হয়েছিল বেনাম জমি উদ্ধার ও সেইসব জমি ভূমিহীনদের মধ্যে বিতরণ করবার কর্মযজ্ঞ। এতদ্বারা একশ্রেণির মানুষের থেকে জমির অধিকার হরণ করা হয়েছিল, অপরপক্ষে, শত শত ভূমিহীন গরিব মানুষ নতুন করে পেয়েছিল জমির অধিকার।
স্বাধীন ভারতের সংবিধানে ‘রাইট টু প্রপার্টি’ নাগরিকদের একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাষ্ট্রের দ্বারাই ব্যক্তি এবং সমষ্টির জমির অধিকার তো অস্বীকৃত হয়েছে পদে পদে। আজও তা সমানে চলছে। ছত্রিশগড়, মধ্যপ্রদেশ-সহ এদেশের খনিজ সম্পদে পূর্ণ অনেক রাজ্যেই দেশি ও বিদেশি পুঁজিপতির দল তাদের বন্ধু-সরকারের সহায়তায় বিশাল-সব ভূখণ্ডের দখল নিয়েছে। ফলত শত শত আদিবাসী-গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। সেইসব গ্রামের লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহারা, ভূমিহারা হয়ে কোথায় যে গেলেন, কীভাবে যে বেঁচে রয়েছেন, কতজন যে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছেন– রাষ্ট্র তার কতটুকু খোঁজ রেখেছে? অনুরূপভাবে, উন্নয়নের নামে, নদীতে ড্যাম তৈরি ও বিশাল বিশাল জলাধার বানানোর কারণে গোটা দেশের কত প্রান্তে কত গ্রাম যে তলিয়ে গিয়েছে জলের তলায়, কত মানুষ যে নিজ-নিজ জমির অধিকার হারিয়ে ভূমিহারা, গৃহহারা হয়েছেন– তার অনুপুঙ্খ হিসেবও তো আমরা রাখি না।
…………………………………..
আরও পড়ুন অনিতা অগ্নিহোত্রী-র লেখা: অরণ্য, পরিবেশ, ধনতন্ত্র, মানুষ– সংঘাতের চতুষ্কোণ
…………………………………..
পরিশেষে, জমির ওপর অধিকার তো কেবল মানবজাতির একচেটিয়া নয়। উদ্ভিদ-সহ তাবৎ প্রাণীকুলেরও তো এই বিশ্বের তাবৎ ভূমির ওপর সমান অধিকার রয়েছে। কিন্তু সেই আদিমকাল থেকেই উদ্ভিদ ও প্রাণীদের সেই অধিকারকে পদে পদে অস্বীকার করা হয়েছে। এবং মানুষই এখানে হানাদার। বসতি স্থাপনের নামে, উন্নয়নের নামে, সভ্যতার অজুহাতে মানুষ চিরকালই বিস্তীর্ণ বনভূমি ধ্বংস করে কোটি কোটি উদ্ভিদকে নির্মূল ও কোটি কোটি প্রাণীকে নিরাশ্রয় করেছে। নির্মমভাবে কেড়ে নিয়েছে জমির ওপর তাদের ন্যায্য অধিকার। তাই, ভূমির অধিকার নিয়ে যে-কোনও আলোচনার সময় তাদের অধিকারের কথাটিও সমান প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
…………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………….