হিমু হলুদ কেন? হলুদ কি হিমু-র প্রিয় রং? হিমুভক্তরা বলতে পারবেন হিমু-কে নিয়ে লেখা অসংখ্য উপন্যাসের কোথাও এই প্রশ্নের উত্তর আছে কি না। এক বান্ধবীর দেওয়া হলুদ পাঞ্জাবি পরে সে ঘুরে বেড়ায়, এর বেশি আমার কিছু জানা নেই। তবে এই উপন্যাসের নামে এমন একটা ইঙ্গিত আছে মনে হয় যে হলুদ শুধু হিমুর পাঞ্জাবির রং নয়। এ তার মনেরও রং। অপরিচিত ভুবনে পা রাখার যে-সাহস মানুষকে ঘরছাড়া করেছে যুগে-যুগে, অথবা শিল্পী, অভিযাত্রী, বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, বিপ্লবী এই সব বানিয়েছে, হয়তো সেই সাহসেরই রং হলুদ। সেই সাহসকে যারা ভয় পায়, তাদের রং কালো।
‘আমি একপর্যায়ে হা করে জিভ বের করে দিলাম। ছোট্ট একটা পরীক্ষা– মশারা জিভ থেকে রক্ত খায় কিনা দেখা। মানুষের জিহ্বা তাদের জন্য অপরিচিত ভুবন। মশারা কি অপরিচিত ভুবনে পা রাখবে? নাকি মানুষই শুধু অপরিচিত ভুবনে পা রাখার সাহস দেখায়।’
রাতে ঢাকা-র রাস্তা থেকে সন্দেহভাজন জঙ্গী হিসেবে হিমু-কে তুলে নিয়ে এসেছে র্যাব, রেখেছে কুখ্যাত অপরাধী মুরগি ছাদেকের সঙ্গে একই লক-আপে। মশাদের সঙ্গে সেখানে এই অভূতপূর্ব পরীক্ষাটি চালাচ্ছে হিমু। তাকে ওই অবস্থায় দেখে এমনকি মুরগি ছাদেকও– যে ভয় পাচ্ছে হয়তো সকাল হওয়ার আগেই তাকে এনকাউন্টারে মেরে ফেলবে র্যাব–আশ্চর্য হচ্ছে। অতঃপর হিমু-র দার্শনিক সিদ্ধান্ত, ‘মানুষ বড়ই অদ্ভুত প্রাণী। মৃত্যুর মুখোমুখি বসেও তার চেতনায় বিস্ময় এবং কৌতূহল থাকে। পুরোপুরি কৌতূহলশূন্য সে বোধহয় কখনোই হয় না।’ এই সবই ঘটছে হলুদ হিমু কালো র্যাব নামের উপন্যাসে। হিমু হলুদ কেন? হলুদ কি হিমু-র প্রিয় রং? হিমুভক্তরা বলতে পারবেন হিমু-কে নিয়ে লেখা অসংখ্য উপন্যাসের কোথাও এই প্রশ্নের উত্তর আছে কি না। এক বান্ধবীর দেওয়া হলুদ পাঞ্জাবি পরে সে ঘুরে বেড়ায়, এর বেশি আমার কিছু জানা নেই। তবে এই উপন্যাসের নামে এমন একটা ইঙ্গিত আছে মনে হয় যে হলুদ শুধু হিমুর পাঞ্জাবির রং নয়, এ তার মনেরও রং। অপরিচিত ভুবনে পা রাখার যে-সাহস মানুষকে ঘরছাড়া করেছে যুগে-যুগে, অথবা শিল্পী, অভিযাত্রী, বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, বিপ্লবী এই সব বানিয়েছে, হয়তো সেই সাহসেরই রং হলুদ। সেই সাহসকে যারা ভয় পায়, তাদের রং কালো।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নীলু-র সঙ্গে কিছু মিল আছে হিমু-র। দু’জনেই বাউণ্ডুলে টাইপ, কাজকর্ম নেই। সংসার তাদের হাতে-পায়ে বেড়ি আর চোখে ঠুলি পরাতে পারেনি। তাই সংসারী মানুষরা তাদের দায়িত্বজ্ঞানহীন, উৎকেন্দ্রিক– এই সব বলে গাল দেয়। কিন্তু এই পাগলাটে, ভবঘুরে, সংসার-পালানো লোকগুলোর মধ্যে কিছু একটা আছে, যার আকর্ষণ তারা এড়াতেও পারে না। আর অল্পবয়সিদের চোখে তারা তো প্রায় হিরো। মেয়েরা মাঝে মাঝেই তাদের প্রেমে পড়ে, কিন্তু তার পরেও তারা প্রেমিকই থেকে যায়, সংসারী হয় না। দুই চরিত্রের মধ্যে অমিলের জায়গাও অনেক। তার মধ্যে না গিয়ে আমি শুধু এটুকুই লক্ষ করতে চাই এখন যে সংসার আর তার সংকীর্ণ হিসেব-নিকেশে বাঁধা নয় বলেই এরা পৃথিবীটাকে একটু অন্যভাবে দেখেতে পারে, এদের মূল্যবোধগুলোও তাই আলাদা। হয়তো সংসারী মানুষের থেকে আরও গভীরভাবে, বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে এরা সংসারটাকে দেখতে পায়, কারণ কোনও কিছুকে ভালো করে দেখার জন্যও তো একটা দূরত্ব লাগে। সংসারের থেকে সেই প্রয়োজনীয় দূরত্বটুকু এদের আছে। আবার সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীও এরা নয়, জগতের সঙ্গে মায়ার বন্ধন এদের গভীর (ছেলেকে মায়া-প্রুফ করার একটা ভয়াবহ চেষ্টা হিমু-র বাবা করেছিলেন যদিও)। বরং সংসারের ছোট ছোট খোপে ভরে ফেলতে হয়নি বলে এদের ভালোবাসা ছড়িয়ে পড়তে পারে সর্বত্র, জড়িয়ে ধরতে পারে সব কিছুকেই, ছেড়েও দিতে পারে সহজে।
এই দু’টি চরিত্রের বিপুল পাঠকপ্রিয়তা একই দিকে নির্দেশ করে: সংসারী কর্তব্যপরায়ণ মানুষের মধ্যেও একটা ভবঘুরে বাউণ্ডুলের সম্ভাবনা ছিল, ছিল এক স্বপ্নদর্শী বালক। এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা যাক যে বাংলা সাহিত্যের সব স্বপ্নদর্শী বাউণ্ডুলে চরিত্রের আদিবালক সম্ভবত অপু। বিভূতিভূষণ একটি আদিবালিকাও সৃষ্টি করেছিলেন, তার নাম লীলা। কাশীতে থাকাকালীন সর্বজয়া যে পরিবারে পরিচারিকার কাজ করতেন, তাদেরই মেয়ে। সামাজিক অবস্থানের দূরত্ব সত্ত্বেও তার সঙ্গে যে অপুর এরকম সখ্য হল, তার কারণ তারা ছিল যাকে বলে কিন্ড্রেড স্পিরিট। অপুর মতোই তার চোখে ছিল অগাধ বিস্ময় আর মনে অপার কৌতূহল। সে-ও গোগ্রাসে বই পড়ত আর স্বপ্ন দেখত বড় হয়ে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ানোর। কিন্তু অপুর যদিও বা জায়গা ছিল তখনকার সমাজে, লীল-র ছিল না। বিভূতিভূষণ, কারা যেন অভিযোগ করে তিনি যথেষ্ট সমাজমনস্ক ছিলেন না, একজন বড় শিল্পীর মতোই অনায়াসে এটা বুঝিয়ে দিলেন যে অপুর মতো মন নিয়ে জন্মানো স্বাধীনচেতা একটি মেয়েকে তার সমাজ বেঁচে থাকতে দেবে না। আত্মহত্যা করেছিল লীলা। অপরাজিত লেখার পর অনেক সময় কেটে গেছে, কিন্তু এখনও যে বাংলা ভাষায় হিমু বা নীলুর মতো কোনও জনপ্রিয় মহিলা চরিত্র তৈরি হল না, তার থেকে বোঝা যায় আমাদের সমাজ এখনও লীলা-র জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত নয়। যাই হোক, কথা হচ্ছিল হিমু বা নীলু-র মতো চরিত্রের জনপ্রিয়তা নিয়ে। মিশেল ফুকো পাগলামির ইতিহাস নিয়ে লিখেতে গিয়ে এক জায়গায় এরকম একটা মন্তব্য করেছেন যে ইউরোপের ইতিহাসে একটা সময়ের পরে যুক্তির সঙ্গে পাগলামির আদানপ্রাদানের সব পথ বন্ধ হয়ে গেল। আমাদের সংস্কৃতিতে কিন্তু, সাদা চোখে মনে হয়, এই কথোপকথন সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়নি। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুকুমার রায় এরা সবাই পাগলের জন্য একটা বিশেষ সম্মানের আসন তৈরি করে দিয়ে গেছেন বাংলা সাহিত্যে। মধ্যবিত্ত বাঙালির মনে ভবঘুরে, ছন্নছাড়া, সংসার-উদাসীন গুণী পুরুষের জন্য একটা অনিচ্ছুক শ্রদ্ধা আছে। ভ্যান গঘ-এর প্রতি আমাদের টানের একটা কারণ বোধহয় এটাও।
ভ্যান গঘ আবার আমাদের একটা হলুদ ক্যানভাসের মাঝাখানে নিয়ে এলেন। তবে এতক্ষণ তো হলুদের কথাই হচ্ছিল, আড়ালে। সংসারের নিয়ম-কানুন নিয়ে খেলাধুলো করার সাহস আর বাউণ্ডুলেপনার রং তো হলুদ-ই। ভ্যান গঘ কিন্তু সংসার পাততে চেয়েছিলেন সন্তানসম্ভবা সিয়েন-এর সঙ্গে। ‘If one wakes early and is not alone, one sees a fellow human being beside one, it makes the whole world so much more a livable place’, লিখেছিলেন চিঠিতে।
…………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………
দারিদ্র সেই ঘর ভেঙে দেয়। ভিনসেন্টের নিরুপায়, প্রতিহত ভালোবাসার রং কি হলুদ? কুণাল বিশ্বাস-এর একটি কবিতার বইয়ের নাম ভ্যান গঘের প্রিয় রঙ। বইয়ের ২১ নম্বর কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘প্রাণের একক এই হলুদ– রাখালের দর্শন।’ ভ্যান গঘ হলুদ নয়, নিজের প্রাণ ব্রাশের ডগায় তুলে এনেছেন ক্যানভাসে। হলুদ হিমু কালো র্যাব উপন্যাসে মুরগি ছাদেক হিমু-র জিহ্বা এক্সপেরিমেন্ট দেখে বলছে, ‘আপনি আজিব লোক’। কিন্তু তারপর জুড়ে দিচ্ছে, ‘আজিবের উপর আজিব হইল ক্ষিধা। এমন ক্ষিধা লাগছে! কিছুক্ষণ পরে যাব মইরা, লাগছে ক্ষিধা। চিন্তা করেন অবস্থা!’ কেমন ছিল ভিনসেন্টের খিদের রং?
… পড়ুন বে নী আ স হ ক লা-র অন্যান্য লেখা …
লাল নিয়ে লিখছেন হিরণ মিত্র: সাদা-কালো ক্যানভাসে একদিন লালের ফোঁটা পড়ল, আমার ছবি বদলে গেল তারপর
কমলা নিয়ে লিখছেন সুশোভন অধিকারী: সময় যখন সন্ধ্যা, তখন এক লহমায় চিনে নিতে পারি অনুচ্চারিত রংটি কী?
সবুজ নিয়ে লিখছেন মাধবেন্দু হেঁস: সবুজ মানে গাছপালা, বনজঙ্গল শুধু নয়, বরং তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা জীবন, জীবিকা, স্মৃতি, প্রেম
বেগুনি নিয়ে লিখছেন হিয়া মুখোপাধ্যায়: বেগুনি রংটা বাস্তবে কোনও অস্তিত্ব নেই, গোটাটাই একটা কাল্পনিক নির্মাণ
আকাশি নিয়ে লিখছেন দেবশঙ্কর হালদার: প্রসেনিয়ামে আকাশকে টেনে আনা, আকাশি রঙে মিশে যাওয়াই আমাদের চ্যালেঞ্জ
আমরা যারা প্রায়ই সিনেমাকে ঘিরে বাঁচতে বাঁচতে দূরে সরে যাই সিনেমার থেকে, সিনেমা আমাদের কাছে অনেক সময়ই ‘হিট’, ‘ফ্লপ’, ‘লাইন’ আর ‘ইন্ডাস্ট্রি’র দাঁড়িপাল্লায় ওঠানামা করে, সিনেমা যখন আমাদের কাছে অনেকটা অভিমান আর লড়াইও, তখন বসন্তের উদাসী সন্ধ্যায়, দীর্ঘদেহী, আশির দোরগোড়ায় দাঁড়ানো মায়েস্ত্র বলে ওঠেন ‘সিনেমা পবিত্র’।