উনিশ শতকে ইংরেজি শিক্ষার ফলভোগী যে মেধাজীবী সম্প্রদায়, তাঁদের রুচি দিয়েই সেই সময় গোটা বাঙালি সমাজের সাংস্কৃতিক যাপন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। ফলে বাংলা গোয়েন্দা-সাহিত্যে দেবেন্দ্রবিজয় থেকে শুরু করে হুকাকাশি, জয়ন্ত থেকে পরাশর বর্মা, ব্যোমকেশ থেকে কিরীটী, প্রতুল লাহিড়ি থেকে ফেলুদা, কৃষ্ণা থেকে দময়ন্তী; স্থান-কাল-লেখক নির্বিশেষে কেন্দ্রীয় চরিত্র সত্যান্বেষীরা সকলেই ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলা।
“কী? ‘মেয়ে গোয়েন্দা’ শুনেই একটু অবজ্ঞার হাসি হাসা হল মনে হচ্ছে! তা হাসিটা হতেই পারে। গোয়েন্দা গল্পের লেখকরা তো মেয়েদের কখনো তাঁদের আসরে আসতে দেন না বড় একটা। যেন গোয়েন্দা হওয়াটা পুরুষদের একচেটে অধিকার।”
যেন একচিলতে বিদ্রুপ হাসিতে মিশিয়েই এ কথা বলছেন আশাপূর্ণা দেবী। ১৪০৪ বঙ্গাব্দে লেখা ‘মেয়ে গোয়েন্দার বাহাদুরি’ গল্পের গোড়াতেই। শুনেই মনে হচ্ছে, ফের সেই একঘেয়ে ‘নারীবাদী’ দোষারোপ! মেয়েরা যা কিছু করে উঠতে পারে না, তারই দায় যেন পুরুষের! সত্যিই তো, বাংলা গোয়েন্দা-কাহিনিতে মেয়ে-গোয়েন্দার দেখা যদি নাই মেলে, তার জন্য পুরুষরা কী করবেন? বরং মেয়েরাই তো সে ভার নিলে পারেন, তাই না?
আজ্ঞে, তাই নিয়েছিলেন তো। আশাপূর্ণা দেবী যখন লিখছেন, তারও শ-খানেক বছর আগে। সেই ১২৯৫ বঙ্গাব্দে, বাংলা সাহিত্যে প্রথম অপরাধের কাহিনি লিখেছিলেন সৌদামিনী দেবী, যেখানে প্রেমিকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে স্বামীকে খুন করেছিল এক স্ত্রী। দ্বিচারিণী নারীটিকে সতীত্বের শিক্ষা দেওয়ার সুযোগও আদৌ ছাড়েননি লেখিকা। কিন্তু হলে কী হবে, নারীর কলমে কি না এমন ‘পাপের চিত্র’! সে নিয়ে পত্রপত্রিকায় বয়ে গেল নিন্দার ঝড়। মেয়েরা কী লিখবেন, কেন লিখবেন, ঠিক করে দিতে যে সমাজ এত উদগ্রীব, সেখানে গোয়েন্দা-কাহিনির খুন-জখম-হিংসার পাপের পাঁকে মেয়েদের টেনে আনার সাহস আর কে দেখাবেন, বলুন তো! অবশ্য বলতে পারেন, আশাপূর্ণা যখন লিখছেন, তখন তিনি আর অতখানি একা নেই। তখন কলমে শান দিচ্ছেন আরও অনেক মেয়ে। তাঁদের কলমে আরও বেশি করে মেয়েদের কথাও উঠে আসছে বইকি, যেমনটা আসছিল আশাপূর্ণার কলমেও। কিন্তু তাতেও যে আরেকরকম লক্ষ্মণরেখা টানা হতে থাকে! তিনি মেয়েলি লেখিকা। তিনি মেয়েদের কথা লেখেন। লেখেন মেয়েদের জন্যই। অন্দরমহলের চারটে দেওয়ালের খুপরিতেই তাই তাঁকে থামিয়ে দিতে হয়। এহেন ডিসকোর্সেই তো আশাপূর্ণা দেবীকে দেখতে অভ্যস্ত আমরা, বাংলা সাহিত্যের ‘সিরিয়াস’ পাঠকেরা। কিন্তু যে কোনও কৌশলী ম্যাজিশিয়ানের মতোই, আশাপূর্ণা দেবী তাঁর হাতের তাসগুলো লুকিয়ে রাখতে জানতেন। যে তাসের হদিশ অনেকটা অজানাই থেকে গেছে আমাদের কাছে। কারণ, মূলস্রোতের জোয়ারে ‘other’ কিংবা ‘অপর’-এর কথা চাপা পড়ে যাওয়াটাই দস্তুর। আর নিজে সেই অপরত্বের স্বাদ পেয়েছিলেন বলেই কি না কে জানে, সেই ‘অপর’ সম্প্রদায়ের কথাই বারে বারে লিখে গিয়েছেন আশাপূর্ণা দেবী। যেমন মেয়েলি গল্পে, তেমনই শিশু-কিশোর সাহিত্যে, তেমনই ছোটদের জন্য লেখা গোয়েন্দা-কাহিনির দুনিয়ায়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
না, আশাপূর্ণা দেবী ক্লাসিকাল গোয়েন্দা গল্প লিখতেই চাননি মোটে। বরং ছোটদের জন্য লেখা গোয়েন্দা-কাহিনিতে তিনি বুনে দিতে চেয়েছিলেন সহজ জীবনবোধ, আর স্বচ্ছ হাসির মোড়কে ভালো-খারাপের সহজপাঠ। কেবল তাঁর দু’টি কাহিনিতেই গোয়েন্দারা ভদ্র পরিবারের সন্তান। ‘লংকা মরিচ রহস্য’-এ চোরাচালানের দলকে পাকড়াও করা দুই যমজ ভাই। আর ‘ভূতুড়ে কুকুর’ উপন্যাসে বালক গোয়েন্দা রিংকু। সে অবশ্য নিজের নামকরণ করে ‘বংকাদা’, সহকারী হিসেবে থাকে বাড়ির কাজের লোক, মাকড়দাবাসী ফটিক ওরফে মাকড়সা।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
না, আশাপূর্ণা দেবী ক্লাসিকাল গোয়েন্দা গল্প লিখতেই চাননি মোটে। বরং ছোটদের জন্য লেখা গোয়েন্দা-কাহিনিতে তিনি বুনে দিতে চেয়েছিলেন সহজ জীবনবোধ, আর স্বচ্ছ হাসির মোড়কে ভালো-খারাপের সহজপাঠ। কেবল তাঁর দু’টি কাহিনিতেই গোয়েন্দারা ভদ্র পরিবারের সন্তান। ‘লংকা মরিচ রহস্য’-এ চোরাচালানের দলকে পাকড়াও করা দুই যমজ ভাই। আর ‘ভূতুড়ে কুকুর’ উপন্যাসে বালক গোয়েন্দা রিংকু। সে অবশ্য নিজের নামকরণ করে ‘বংকাদা’, সহকারী হিসেবে থাকে বাড়ির কাজের লোক, মাকড়দাবাসী ফটিক ওরফে মাকড়সা। এই কিশোরেরা বাড়ির আদরের ছেলে বটে, কিন্তু সেই আদরের শর্ত যে কথাবার্তা-চালচলনে বড়দের বেঁধে দেওয়া ছকটিই অনুসরণ করা, পদে পদে তার ইঙ্গিত ছেড়ে যান আশাপূর্ণা। আসলে কোনও না কোনওভাবে ‘অপর’ তো সে-ই, যার নিজস্ব স্বরের কোনও গুরুত্ব থাকে না ক্ষমতাবানের সামনে। পরিবারতন্ত্রের মধ্যে তাই কখনও নারী, কখনও শিশুরা অপর হয়ে উঠতে থাকে। আর সেইসব ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দারেরা যদি যাবতীয় চাপানো শর্ত ভাঙতে চায়, তবে নিজেদের জ্ঞানবুদ্ধির উপর নির্ভর করা ছাড়া আর উপায় কই! সে কথা জানা বলেই কি না, সেই পথে সবসময় কাঁটার বেড়া তুলে রাখতে চায় ক্ষমতা-কাঠামো। গোয়েন্দা-কাহিনির দুনিয়ায় তাকালেও দেখা যাবে, বুদ্ধির অধিকার সেখানে এক বিশেষ শ্রেণিরই অধিগত মাত্র। সে শ্রেণি অবশ্যই শিক্ষিত ভদ্রলোক পুরুষের।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: ইরফানের মতো খুব কম মানুষ দেখেছি যাঁকে বলা যায়– ওয়ার্ক ইন প্রোগ্রেস
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আসলে বাংলায় সঠিক অর্থে গোয়েন্দা-কাহিনির উদ্ভব যখন হয়েছে, বাংলাদেশে ভদ্রলোক শ্রেণির উত্থানের সময়টাও তার প্রায় সমানুপাতী। উনিশ শতকে ইংরেজি শিক্ষার ফলভোগী যে মেধাজীবী সম্প্রদায়, তাঁদের রুচি দিয়েই সেই সময় গোটা বাঙালি সমাজের সাংস্কৃতিক যাপন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। ফলে বাংলা গোয়েন্দাসাহিত্যে দেবেন্দ্রবিজয় থেকে শুরু করে হুকাকাশি, জয়ন্ত থেকে পরাশর বর্মা, ব্যোমকেশ থেকে কিরীটী, প্রতুল লাহিড়ি থেকে ফেলুদা, কৃষ্ণা থেকে দময়ন্তী; স্থান-কাল-লেখক নির্বিশেষে কেন্দ্রীয় চরিত্র সত্যান্বেষীরা সকলেই ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলা। কিন্তু আশ্চর্যের কথা হল, এই পরম্পরাকে ভাঙার সাহস দেখাতে পেরেছিল আশাপূর্ণার ‘মেয়েলি’ কলমই। তাঁর মেয়ে গোয়েন্দাটির পেট চলে পরিচারিকার কাজ করে, আর গোয়েন্দা জুটির দুই মূর্তি আদতে চোর!
১৯৭৭ সালের এক শারদীয়ায় আশাপূর্ণার ‘গজ উকিলের হত্যা রহস্য’ উপন্যাসে আবির্ভূত হয়েছিল দুই পকেটমার বন্ধু– ট্যাঁপা আর মদনা। এদের সেই অর্থে পরিবার নেই। মদনা, ঠাকুমার কাছে মানুষ, আর কেষ্টগোপালের ছেলে ট্যাঁপাগোপাল, সৎমার দুচ্ছাই শুনে বড় হয়েছে। এদের মুখের ভাষাও ভদ্রজনোচিত নয় আদৌ। গোয়েন্দা মানেই ভদ্রলোক, বাংলা গোয়েন্দা-সাহিত্যে এতদিনের এই অতি জোরালো বয়ানের পালটা বয়ান হিসেবেই দাঁড়িয়ে পড়ে ট্যাঁপা-মদনা। আর সেই প্রতিবয়ান আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে, যখন দেখা যায়, পকেটমারি ছেড়ে সৎ পথে চলার সিদ্ধান্ত নিয়ে পেশাদার গোয়েন্দা হয়ে উঠছে মানিকজোড়। অর্থাৎ এখানেই লেখিকা স্পষ্ট করে দিচ্ছেন, বুদ্ধি এবং জ্ঞান কোনওটাই আদতে শ্রেণিনির্ধারিত নয়। আর উপরের খোলসের সামান্য অদলবদলেই শ্রেণির বিভেদ ঘুচে যায়। যেমনটা ঘুচিয়ে ফেলেছিল ‘মেয়ে গোয়েন্দার বাহাদুরি’ গল্পের কাজল। সর্বতোভাবে ‘অপর’ কাজল কেবল মেয়েই নয়, ‘কাজের মেয়ে’। রাজপুরের মহামায়া বালিকা বিদ্যালয়ে ক্লাস এইট অবধি পড়াশোনা করা কাজল মণ্ডলের গতি হয়েছিল ডাক্তার লাহিড়ির বৃদ্ধা মা নীহারিকা দেবীর আয়াগিরিতে। নীহারিকা দেবীর সংগ্রহের গাদা গাদা গোয়েন্দা গল্পের বই পড়ে, আর তার সহজাত তীক্ষ্ণ বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে, সে একটা আস্ত খুনের সমাধান করে কীভাবে, তাই নিয়েই এ গল্প। গল্পের শুরুতেই লেখিকা বলছেন, “গল্প শুনতে শুনতে আর পড়তে পড়তেই গড়ে ওঠে মানুষ… কাজেই এন্তার গোয়েন্দা গল্প পড়তে পড়তে যদি একটি ‘কাজের মেয়ে’, ‘মেয়ে গোয়েন্দা’ হয়ে ওঠে, সে আর আশ্চর্য কী?” অর্থাৎ যে জ্ঞানের পুঁজি তথাকথিত ভদ্রলোক শ্রেণির একচেটিয়া, তার সেই বানিয়ে তোলা গণ্ডিকে অস্বীকার করছেন লেখিকা। আর মেয়েদের সঙ্গে চিরদিন জুড়ে থাকা যে বুদ্ধিহীনতার অভিযোগ গোয়েন্দা-কাহিনির দুনিয়াতেও তার পিছু ছাড়েনি, তাকেও একহাত নিতে ছাড়ছেন না তিনি। মেয়ে-গোয়েন্দার গল্প লিখতে না-চাওয়া পুরুষেরা যে মেয়ে-গোয়েন্দার গল্পলিখিয়ে এক লেখিকার ভাঁড়ারে উঁকিঝুঁকি দিতে দ্বিধা করেন না, আগাথা ক্রিস্টির নাম না করেই সে কথাও ফাঁস করে দিয়েছেন আশাপূর্ণা।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: আঙ্গুরবালার জীবদ্দশায় মানুষ তাঁর নাম লেখা শাড়ি পরত
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আশাপূর্ণার আগেই বাংলা সাহিত্যে প্রথম মেয়ে-গোয়েন্দাকে নিয়ে এসেছিলেন তাঁরই মতো আর-এক ‘মেয়েদের লেখিকা’, প্রভাবতী দেবী সরস্বতী। কিন্তু তাঁর দুই গোয়েন্দানী– কৃষ্ণা ও শিখা, কেবল সম্ভ্রান্ত ও উচ্চশিক্ষিতই নয়, আর পাঁচজন বাঙালি মেয়ের সাপেক্ষে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হিসেবেই তাদের নির্মাণ। কিন্তু মেয়েদের অন্দরমহল যে এমন সব-পেয়েছির দেশ হয় না, সে কথা জানতেন আশাপূর্ণা। তাঁর নিজের অভিজ্ঞতায় রয়েছে দাদাদের সামনে বসে উলটো লেখা দেখে দেখে অক্ষর পরিচয়ের গল্প। সেখানে মেয়েদের পড়াশোনা শেখার ক্ষেত্রে উঁচিয়ে রয়েছে ঠাকুমার নিষেধের তর্জনী। এই না-পাওয়ার জগৎ থেকে এসে তাই আকাশছোঁয়া প্রাপ্তির রূপকথা বুনতে চাননি আশাপূর্ণা দেবী। বরং সাধারণের দিন-আনি-দিন-খাই জীবনের গায়েই একটুকরো ‘এমন কেন সত্যি হয় না’-র ‘আহা’টুকু তিনি বুলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।
মেয়েলি লেখিকার মতোই।