জগদ্দলই বিমলের কাছে বাঘের বাচ্চা, নিরপরাধ বালক, যাকে আকাশের পাখিও হিংসে করে, তার তেষ্টা পেলে বিমল ছটফট করে তাকে ‘বাবা জগদ্দল, খুব তেষ্টা পেয়েছে নারে?’ বলে ছুটে গিয়ে জেরিকান ভরে জল নিয়ে আসে। আবার কিছুক্ষণ পরেই জগদ্দল খুনখুনে বুড়ো, যে জোয়ান মদ্দের মতো ডন বৈঠক মারে আর কুস্তি করে বলে সবাই তাকে দেখে জ্বলে-পুড়ে মরে। জগদ্দল স্ত্রী, প্রেমিকা, সন্তান, সখা, প্রতিপালক। সংজ্ঞার বিভ্রান্তি তার মনিবকেও ছাড়ে না। জগদ্দল মানুষ হয়, বিমল হয়ে যায় যন্তর, যার পোড়া পেট্রোলের গন্ধে নেশা লাগে।
গ্রাফিক্স: অর্ঘ্য চৌধুরী
‘চল বাবা জগদ্দল; একবার পক্ষীরাজের মতো ছাড় তো পাখা!’
যার থেকে পক্ষীরাজের প্রত্যাশা বিমল ড্রাইভারের, তার নাম সে রেখেছে ‘জগদ্দল’। তার মনিবের কল্যাণে এমন বহু বিভ্রান্তিকর বিপরীতের আধার হতেই থাকে এই শেভ্রলে গাড়িটি। টোপর সহ বর-রূপী যাত্রী দেখলে, বিমল গাড়ি পুঁছে ঝকঝকে করে, সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে গাড়ির সঙ্গে লাজুক মুখে ছবি তোলার তোড়জোড় করে।
গাড়ি পোঁছার সময় অন্য ড্রাইভার কৌতুক করলে, সে বলে ‘অন্যের প্রাইভেট ব্যাপারে তোমাদের এত মাথাব্যথা কীসের?’ পিয়ারা সিং তার উত্তরে হেসে বলে, ‘এটা গাড়ি না ঘর কা ঔরত?’
পিয়ারা সিং তার গাড়িকে বলে, ‘বুডঢা ঘোড়া’, ‘খোঁড়া হাঁস’, ‘কানা ভইস’।
বলে, ‘বুড়িকে এবার পেনশন দিয়ে দাও।’ বিমল উল্টে বলে, ‘দিয়ে তোর মতো হাল মডেলের বেবুশ্যে রাখি?’
আবার এই জগদ্দলই বিমলের কাছে বাঘের বাচ্চা, নিরপরাধ বালক, যাকে আকাশের পাখিও হিংসে করে, তার তেষ্টা পেলে বিমল ছটফট করে তাকে ‘বাবা জগদ্দল, খুব তেষ্টা পেয়েছে না রে?’ বলে ছুটে গিয়ে জেরিকান ভরে জল নিয়ে আসে। আবার কিছুক্ষণ পরেই জগদ্দল খুনখুনে বুড়ো, যে জোয়ান মদ্দের মতো ডন বৈঠক মারে আর কুস্তি করে বলে সবাই তাকে দেখে জ্বলে-পুড়ে মরে।
জগদ্দল স্ত্রী, প্রেমিকা, সন্তান, সখা, প্রতিপালক।
সংজ্ঞার বিভ্রান্তি তার মনিবকেও ছাড়ে না। জগদ্দল মানুষ হয়, বিমল হয়ে যায় যন্তর, যার পোড়া পেট্রোলের গন্ধে নেশা লাগে।
ভালোইবাসে বিমল। অনেকগুলি লোককে। সেই অনেকগুলি লোক কোথাও নেই। তাদের হয়ে প্রক্সি দেয় জগদ্দল।
নরসিংহ মন্দিরে ঢুকতে গিয়েও ঢুকতে পারে না বিমল। যখন ফুল হাতে দিয়ে তাকে পুরোহিত বলে যে, এই মন্দির জাগ্রত, তার সন্তান ও পরিবারের মঙ্গল হবে, সংকোচে কুঁচকে যায় সে।
পর মুহূর্তে বেরিয়ে এসে বাচ্চাদের কাদা ছোড়া থেকে দু’-হাত দিয়ে নিজের সন্তানের মতো আগলে রাখে জগদ্দলকে। সম্ভবত, এই সংজ্ঞার অস্থিরতা, শুধুই ছবির দুই মূল পাত্রের লক্ষণ নয়।
একটা ভাঙাচোরা লড়ঝড়ে গাড়ি’র মনুষ্যত্ব– নেহাতই উন্মাদ না হলে এই ছবির উদ্ভট প্লট কেউ বিশ্বাস করবে না, ‘অযান্ত্রিক’ প্রসঙ্গে বলেছিলেন ঋত্বিক। এই যে বিশ্বাস করাতে না চাওয়া– এর মধ্যে একটা স্পষ্ট অভিপ্রায় লুকিয়ে থাকে, যা তার মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক দর্শকের অভ্যাসের সঙ্গে নির্মম রসিকতা করে। বারবার বলে দেওয়া সত্ত্বেও, তারা প্লটই খুঁজে মরে। না পেয়ে, ঠকে গেছি মনে করে। এরাই জ্বর হলে, দেওয়ালের ভেজা দাগকে ডাইনোসর ভেবে মজা পায়, ঢাউস কালো টেলিফোন বাজলে, ‘আরে বাবা যাচ্ছি!’ বলে রান্নাঘর থেকে ছুটে আসে, ভাড়া বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সময় সিঁড়ির রেলিং ছুঁয়ে কাঁদে।
কিন্তু তাদের দৈনন্দিন আছে, তাতে অনেক বাসন-কোসন, জিনিসপত্রের আওয়াজ হয়, ফলে এইগুলো তাদের ভেতরে ‘প্রাইভেট’ হয়েই থেকে যায়।
বিমলের দৈনন্দিনে জগদ্দলের নানারকম শব্দ ব্যতিরেকে আর কোনও আওয়াজ নেই। তার প্যাসেঞ্জার আসে কালেভদ্রে, এলে বেশিরভাগ সময় ক্যাঙারুর পেটের ভেতরে একসঙ্গে ১০ জন সেঁধায়। শুনশান রাস্তার উপর বসে সে হেঁড়ে গলায় ভুল লিরিকে শ্যামাসংগীত গায়।
তার গাড়ি যে প্রান্তরের ওপর দিয়ে ছুটে যায়, সেই নিসর্গ এখনও গাড়ির সঙ্গে ঠিক মানিয়ে উঠতে পারেনি। শয়ে শয়ে গরুর পাল সেখানে রাস্তা আটকে কাঠের ঘণ্টির সিম্ফনি শোনায়, নির্লিপ্তভাবে দুই ওঁরাও বৃদ্ধা মেলার প্রাঙ্গণ ছেড়ে রাস্তার উপরে ঠ্যাটার মতো বসে থাকে। উদাসীন কয়লার বালতি আকাশে ঝুলতে ঝুলতে কনভেয়ার বেল্ট দিয়ে আসা-যাওয়া করে। আর মাঝে মাঝেই মন্দার, নাগারা, লোহাটির আওয়াজ শোনা যায়। সেই আওয়াজ ঘিরে থাকে ওঁরাও নারী-পুরুষ। তাদের নিশান ওড়ে, তারা নেশা করে, নাচে, প্রেমের মান-অভিমান করে। আর খুনসুটি করতে করতে বিমলের গাড়ি ঠেলে দেয়।
‘এই নাচের আবহে দাঁড়ালে তোমার মনে হবে তুমি এমন কিছু প্রত্যক্ষ করছ যার বয়স এই দেশের মানুষের ইতিহাসের সমান। তার সুর, ধ্বনি ও দৃশ্যকল্প তোমায় চেনাবে মানুষের জীবনের প্রাথমিক আনন্দ ও উদ্যমের শক্তি’, বলেছেন ঋত্বিক। ‘অযান্ত্রিক’ করার আগের বছর ওঁরাওদের নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি শুট করেছিলেন তিনি। অন্য এক জায়গায় অযান্ত্রিক সম্বন্ধে বলছেন, এই ছবি ওঁরাওদের নিয়েই। তাদের অংশগ্রহণ ছাড়া এই ছবি কল্পনা করা অসম্ভব ছিল!
এই যৌথতা ও আবহমানতাকে যে আস্থায় ও অসহায়তায় ঋত্বিক ১৯৫৮-এ আঁকড়ে ধরেন, তা তার অজান্তেই বিমলের ভালোবাসারই প্রতিবিম্বিত দোসর। তার পরিণতি ২০২৪-এ এসে আমাদের কাছে জগদ্দলের স্ক্র্যাপ হয়ে যাওয়ার মতোই নিদারুণ লাগে।
একটি পর্ব থেকে আরেকটি পর্বের উদ্দেশ্যহীন যাত্রার মধ্যে দশ বছরের সুলতান বিমলকে বেফাঁস জিজ্ঞাসা করে ফেলে, তোমার বাড়ি কোথায় মাস্টার? তোমার কি কেউ নেই?
বিমল উত্তর না দিয়ে বলে, বেশ কাটছে না, দিনগুলো? তার কিছু আগেই গাড়ির ভেতর পলায়নরতা এক সালংকারা নারী জগদ্দলের রেক্সিনের ছাদের ফুটো নিয়ে রসিকতা করেছে, খিলখিল করে হেসেছে, ভালোবেসেছে তার সঙ্গীকে, তারপর রাস্তার ধারে কাঠের কাঁকুই দেখে উত্তেজনায় গাড়ি থামাতে গিয়ে অতর্কিতে বিমলের পিঠ ছুঁয়ে দিয়েছে। তখনও বিমল জানে, তার ঘর নেই, তার কেউ নেই। কিছুদিন পর সে পুলিশের জিজ্ঞাসার উত্তরে সুলতানকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটিকে চেনে না বলে নির্লিপ্তমুখে মিথ্যে কথা বলে। আর জগদ্দলও বিসদৃশ আওয়াজ করতে শুরু করে দেয়।
এপিক-এর নিয়মে আমরা জানি, তার কিছুদিন পরেই বিমলের সঙ্গে মেয়েটির দেখা হবে। ততক্ষণে রসিকরা দেখেছে ঋত্বিকের ফ্রেম সরে গিয়ে বিমলকে অদ্ভুত এক অস্বস্তিকর কোনায় ফেলে রেখেছে। সেই ফ্রেমেরই আরেক অস্বস্তিকর কোণে পাথরের উপর মেয়েটি নিরাভরণ বসে থাকে। তারপর স্টেশনে ক্ষণিকের বিভ্রান্তিতে তার জন্য কেনা রেলের টিকিট বিমল ফেরত দিতে গিয়ে বুঝতে পারে, সে কী করছে! ভুল ভেঙে সে ছোটে জানলার পাশ ধরে মেয়েটির হাতে টিকিট তুলে দেওয়ার চেষ্টায়। শব্দবিজ্ঞানের সমস্ত পার্সপেক্টিভ ভেঙে ক্যামেরার কোণ থেকে মেয়েটির আওয়াজ শ্রাব্য হয় না, অথচ ট্রেনের সঙ্গে প্ল্যাটফর্মে পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে বিমল চেঁচিয়ে চলে, ‘কী বললেন? কী বললেন? কী বললেন?’
যা সে কোনও দিন শোনেনি, তা শোনার লোভ সে সামলাতে পারে না। আমরা জানি, জগদ্দল এই প্রতারণা সইবে না। প্রতিদানে সে-ও প্রত্যাঘাত করবে। কোনও এক শুশ্রূষার আশায় আদিবাসী পরবের মধ্যে গিয়ে বসে নেশা করে বিমল। সে নিজেও বোঝে সে বিচ্ছিন্ন। এই প্রবাহ থেকে সে চিরকালের জন্য নির্বাসিত।
মৃত্যুপথযাত্রী সঙ্গীকে সাধ্যের অতীত শ্রম ও খরচ করে বাঁচাতে পারে না বিমল। সব জেনেও নিষ্ফলা জেদে আঁকড়ে ধরে থাকে। যা সে তথ্য আকারে জানত, সেটা তার কাছে প্রত্যয়ের জায়গা নিয়েছে। তার কেউ নেই। এবং যে এতদিন ছিল, সে তাকে প্রতারণা করে। জগদ্দলের ইঞ্জিনের ভেতর যে অপার্থিব ধাতব আওয়াজ কাঁটার মতো বিঁধে থাকে তার গলায়, ঋত্বিকের যাত্রাপথে তার একদিকে ইতিহাস অন্যদিকে নিয়তি। যে রাগে তর্জনী তুলে অভিযুক্ত করেছেন তিনি ‘মেঘে ঢাকা তারা’য়, সেই একই আক্রোশে পাথরের পর পাথর তার ব্যর্থ সম্পর্কের ওপরে চাপিয়ে বিমল বলে ‘একেই বলে লোড’।
এটা কখনওই কাকতালীয় থাকে না যখন দেখি স্টেশনের পাশে বুলাকি পাগলা তার পুরনো তুবড়ে যাওয়া গামলার প্রতি অন্ধপ্রেম বিসর্জন দিয়ে পরম মমতায় নতুন চকচকে গামলা জড়িয়ে ধরে। সে উন্মাদ, ইতিহাস বিবর্জিত। তার পরিত্রাণ সম্ভব।
জগদ্দল ও তার মনিবের সম্পর্কে এক বিপথগামী রূপক-বিলাসের সম্ভাবনা নিজেই রোপণ করে রেখেছেন ঋত্বিক। যাতে অনিবার্যভাবে যন্ত্রসভ্যতা, ক্যাপিটালিজম, এলিয়েনেশন, নির্বিকার অনাদি প্রকৃতি ইত্যাদি শব্দ এসে ভিড় করতে থাকে। কিন্তু সে পথে কিছুক্ষণ হাঁটলেই বোঝা যায়, মনিবের চোখে জগদ্দলের নানা চরিত্রভেদের মতোই, এই ছবিতে অর্থের প্রতিসরণ বহুমুখী ও পরিবর্তনশীল। তাতে নুড়ি-পাথরের মতো বহুবিধ থিম সংকলিত হয়েছে, যার মধ্যে, এমনকী, একাধিক খ্রিস্টান প্যাশন প্লের অনুষঙ্গও বাদ যায়নি। এই ছবির শব্দ কল্পনা ও সংগীত আয়োজনে সেই চিত্রনাট্যই আক্ষরিক পুনর্লিখিত হয়েছে। শর্ট ওয়েভ রেডিওর নব ঘোরানোর মতো তা সরে সরে যেতে থাকে এক পর্দা থেকে আরেক পর্দায়, এক ঘরানা থেকে অন্য ঘরানায়। আলী আকবরের সরোদের ফাঁক দিয়ে তারস্বরে চিল্লিয়ে ওঠে জগদ্দলের হর্ন। একটা কমিক ইন্টারলিউডের মধ্যে থেকে উঠে আসে আদিবাসী গানের আখর। আর তারপরে একেবারে শব্দের ফোরগ্রাউন্ডে কিছু ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে আসে তৈরি করা একটি যতি।
……………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………………
অভিনয়ের পর্দাও একই নিয়মে আলাদা আলাদা। যে সপ্তকে গোবিন্দ মেকানিক (জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়) অভিনয় করেন, প্রথম দৃশ্যের গঙ্গাপদ বসু ও সতীন্দ্র ভট্টাচার্য সেই স্কেল থেকে অনেক দূরে। এই অনভ্যাসের প্রাথমিক দেওয়াল যদি আমরা কাটিয়ে উঠতে পারি, তাহলে ছবির পুরো শরীর জুড়ে এই আলাদা নুড়িপাথরগুলো আমাদের ভেতরে আমাদের নিজস্ব নিয়মে সাজানোর একটা সুযোগ তৈরি হয়।
কিন্তু সেই সাজানোর মধ্যেও স্থিরতার সম্ভাবনা কম। তার গড়ন সরে সরে যায়, আর তার মূল সুর বৈপরীত্যের। একেবারে নিজস্ব নিয়মে যেভাবে ছবির শেষে সেই শিশুর আর্কিটাইপে গিয়ে পৌঁছন ঋত্বিক। সে মুহূর্তের কোনও বাংলা প্রতিশব্দ আমি খুঁজে পাইনি। দ্বন্দ্বের ব্যাকরণ মেনেই যা হোপলেসলি অপটিমিস্টিক।
ঋ-ফলার অন্যান্য লেখা
……………………………………………………………
দেবজ্যোতি মিশ্রর লেখা: তিতাস শুকোয়, কান্না শুকোয় না, সুরও না
সোহিনী দাশগুপ্তর লেখা: গীতা আর নীতার তফাত আদর্শচ্যুত মানুষ আর আদর্শে বেঁচে থাকা মানুষের তফাত
সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়-এর লেখা: শালবনে মাতাল নীলকণ্ঠের যে গমনাগমন– তা আসলে শ্মশানের পরপারে বসে থাকা মানুষের