‘ঈশ্বর, পৃথিবী, ভালবাসা’ পড়লে জানা যায়, শিব্রাম সত্যিকারের বাড়ি পালানো ছেলে। তিনি হাওয়ায় গল্প লেখেননি। তাঁর সত্যিকারের ফুটপাথবাস ঘটেছে, বিয়েবাড়িতে লুকিয়ে খাওয়া নির্দ্বিধায় সত্যি। কালোয়াতি গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়া, এ-ও শিব্রামের অভিজ্ঞতার রোজগার। কিন্তু শিব্রামের ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’-র শিশুসাহিত্যের বাইরে আর কিছু হওয়ার দায় নেই। যা হয়তো ঋত্বিক ঘটকের ‘বাড়ী থেকে পালিয়ে’-এর ছিল।
গ্রাফিক্স: অর্ঘ্য চৌধুরী
শুরুর কথাটা শুরুতে সেরে ফেলা ভালো। ‘বাড়ী থেকে পালিয়ে’ এই শহরের দুই মহারথী ভবঘুরের মহামিলন।
শিব্রাম ও ঋত্বিক।
তাই বইয়ের পাতার কাঞ্চন যখন সেলুলয়েডের কাঞ্চন হয়ে ওঠে, তখন তা আর শিব্রামের কাঞ্চন থাকে না, তা হয়ে যায় ঋত্বিকের কাঞ্চন। সেই কাঞ্চন দ্যাখে এক কাঞ্চন দেশের স্বপ্ন, যার নাম ‘এল ডোরাডো’। কাঞ্চন ভাবে, শহর কলকাতা বুঝি-বা সেই সোনার শহর। এখানে একটা মজার বিষয় দেখুন– ঋত্বিক ও মৃণাল দু’জনেই কলকাতাকে এল ডোরাডো বলেছেন। কিন্তু দু’জনের এল ডোরাডো সম্বন্ধে ধারণা বা মতামত হয়তো আলাদা ছিল। যাক গে, গল্পে ফিরি, কাঞ্চনের জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে শিক্ষক বাবার নিয়মের বেড়াজাল, চাণক্যের নীতি, বেতের আঘাতের ত্র্যহস্পর্শে। কাঞ্চন বাড়ি থেকে পালায়। মা থেকে যান পিছুটান হয়ে।
কলকাতা শহরকে যখন কাঞ্চন দেখতে পায়, আমরাও দেখি, যেন এক সুবিশাল লোহার খাঁচার সামনে একটা ছোট্ট, একলা শিশু দাঁড়িয়ে। এরপর শুরু হয় কাঞ্চনের এই বিশাল শহর ও তার মানুষ দেখা, চেনার গল্প। এই শহরে ঘটনার কোনও খামতি নেই, তা অচিরেই কাঞ্চন বুঝতে পারে। নানা চরিত্রের আকাশ ওর জানলায় ধরা দিতে থাকে। যার মধ্যে সবথেকে বেশি প্রভাব ফেলে তার ওপর হরিদা আর মাসি। হরিদা হচ্ছে হরিদাসের বুলবুল ভাজার ফেরিওয়ালা, কলকাতায় কাঞ্চনের প্রথম আশ্রয়দাতা, ফ্রেন্ড, ফিলোজফার অ্যান্ড গাইড। আর মাসি হচ্ছেন মিনির মা, এই কর্কশ শহরে যার কোলে দু’দণ্ড ছায়া পেয়েছিল কাঞ্চন।
হরিদার দেশভাগ হয়েছে, তাই সে-ও বাড়ি থেকে পালিয়েছে। কাঞ্চন দ্যাখে সুসজ্জিত বিয়েবাড়ির অঢেল খাওয়াদাওয়া, দেখে তার বাইরেই আবর্জনা থেকে খুটে খাওয়া মানুষদের। দেখে ইংরেজি জানা না জানার ভিত্তিতে মানুষের শিক্ষাকে নির্ধারণ করার কলকেতাবাজি। সে স্বপ্নে দ্যাখে মা-র কাছে নিয়ে গেছে মিনি-কে। তার শৈশব প্রেমকে স্পষ্ট ছুঁতে পারে না, স্বপ্নে বিলি কেটে দিতে চায়। কিন্তু দুঃস্বপ্নের নাম বাবা, সে নিয়মের বেত উঁচিয়ে কাঞ্চন ও মিনিকে তাড়া করে। স্বপ্নের মধ্যে দুঃস্বপ্ন মিশে গিয়ে বাড়ি ফেরা পিছিয়ে যায় কাঞ্চনের। সে মাকে দিতে চায় সেসব, যা তার বাবা মনে করে অবান্তর, বিলাসিতা। কিন্তু তার জন্য কাঞ্চনকে করতে হবে রোজগার, তাই সে পথে নামে আবার। পথেই সে পায় তার মিনিকে আবার, একলা, এবার আর সেই বিয়েবাড়ির তালেবর মাসতুতো ভাইরা পাশে নেই।
……………………………………….
কলকাতা শহরকে যখন কাঞ্চন দেখতে পায়, আমরাও দেখি যেন এক সুবিশাল লোহার খাঁচার সামনে একটা ছোট্ট, একলা শিশু দাঁড়িয়ে। এরপর শুরু হয় কাঞ্চনের এই বিশাল শহর ও তার মানুষ দেখা, চেনার গল্প। এই শহরে ঘটনার কোনও খামতি নেই, তা অচিরেই কাঞ্চন বুঝতে পারে। নানা চরিত্রের আকাশ ওর জানলায় ধরা দিতে থাকে। যার মধ্যে সবথেকে বেশি প্রভাব ফেলে তার ওপর হরিদা আর মাসি। হরিদা হচ্ছে হরিদাসের বুলবুল ভাজার ফেরিওয়ালা, কলকাতায় কাঞ্চনের প্রথম আশ্রয়দাতা, ফ্রেন্ড, ফিলোজফার অ্যান্ড গাইড। আর মাসি হচ্ছেন মিনির মা, এই কর্কশ শহরে যার কোলে দু’দণ্ড ছায়া পেয়েছিল কাঞ্চন।
……………………………………….
মিনির সঙ্গে সে আসে মিনির বাড়িতে, যেখানে মিনি আলাপ করিয়ে দেয় তার মায়ের সঙ্গে। সেখানে তৈরি হয় এক আশ্চর্য দৃশ্য যখন কাঞ্চন আর মিনির মা একসঙ্গে ছাদে বসে থাকে। কাঞ্চন তখন ছাদ থেকে দেখতে পাওয়া শহরে মুগ্ধ। সে বড় হতে চায়, এই বিশাল শহরে রোজগার করে মাকে পাঠাতে সাবান, পাউডার, পমেটম, আর উল্টোদিকে বসে মাসি– যে ফিরতে চায় কাঞ্চনের বয়সে। ফিরতে চায় তার শৈশবের গ্রামে। যদি সেখানকার জল-হাওয়ায় সারে তার এই দুরারোগ্য নাগরিক ব্যাধি। কাঞ্চন অবাক হয় মিনির বাবাকে দেখে, কারণ তিনি কাউকে বকেন না, চাণক্যের নীতি শোনান না ঘাড় ধরে। কাঞ্চনের মনে হয়, মিনির বাবাও বুঝি বাবার আড়ালে লুকিয়ে থাকা একজন মা! কিন্তু রোজগার যার ফিকির, তার এক জায়গায় তিষ্ঠোনোর জো কী। তাই কাঞ্চনের অভিযান চলতে থাকে শহরের গলির শিরা-উপশিরা জুড়ে।
সেই অভিযান আর এখানে না লিখে শুধু শেষ পর্বের একটা ঘটনায় আসি। মাসি (মিনির মা) মারা গেছেন, হরিদা কাঞ্চনকে বলেন বাড়ি ফিরে যেতে। কলকাতার উপার্জন হিসেবে কাঞ্চনের হাতে তুলে দেন নিজের সম্বল।পরচুল আর থলি, বলেন– এবার কাঞ্চনের খেলা দেখানোর পালা। তিনি এবার বসে বসে এ শহরের পরিযায়ীদের আসা-যাওয়া দেখবেন। হঠাৎ মনে হয়, ঋত্বিক এইবার কাঞ্চন থেকে হরিদার মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছেন। এইবার মনে হয়, আমার সৎ হওয়া প্রয়োজন। যা কিছু আমি বলছি, তা বড় হয়ে বোঝা। ছোটবেলায় দু’বার ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ দেখার সুযোগ হয়েছিল। একবার দূরদর্শন-এ ঋত্বিক ঘটক রেট্রোস্পেক্টিভ-এ, পরেরবার ‘ছুটি ছুটি’-তে।
মনে রাখবেন, আমার বাবা বিজন ভট্টাচার্যের ছাত্র ছিলেন। তর্কাতীতভাবে ঋত্বিকের অন্যতম কাছের বন্ধু এবং সহকর্মী। বস্তুতপক্ষে, ওই যে আবর্জনা খুটে খাওয়ার দৃশ্য তা-ও বিজনের নবান্নর রেফারেন্স। কাজেই আমাদের বাড়িতে ঋত্বিক ঘটক নিয়ে আলাদা কাজল চোখে লাগানোই ছিল, তা সত্ত্বেও আমার শিশুমনকে ‘বাড়ী থেকে পালিয়ে’ আন্দোলিত করতে পারেনি। একজন শিশুর কলকাতা শহরে পকেটমারের গ্যাং-এর পাল্লায় পড়া বা রেল ইয়ার্ডের কয়লা বিক্রি করতে গিয়ে কাঞ্চনের মার খাওয়ার যে রুক্ষ বাস্তবতা, তা আমার শিশুমন গ্রহণ করতে চায়নি। উল্টোদিকে, যদি আমি শিব্রামের ‘বাড়ী থেকে পালিয়ে’ দেখি, তা আমার কাছে অনেক বেশি অনাবিল।
‘ঈশ্বর, পৃথিবী, ভালবাসা’ পড়লে জানা যায়, শিব্রাম সত্যিকারের ‘বাড়ি পালানো’ ছেলে। তিনি হাওয়ায় গল্প লেখেননি। তাঁর সত্যিকারের ফুটপাথবাস ঘটেছে, বিয়েবাড়িতে লুকিয়ে খাওয়া নির্দ্বিধায় সত্যি। কালোয়াতি গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়া, এ-ও শিব্রামের অভিজ্ঞতার রোজগার। কিন্তু শিব্রামের ‘বাড়ী থেকে পালিয়ে’-র শিশুসাহিত্যের বাইরে আর কিছু হওয়ার দায় নেই। যা হয়তো ঋত্বিক ঘটকের ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’-এর ছিল।তাই হয়তো, আমার বা আমার বন্ধুদের মনে এই ছবিটির উজ্জ্বল উপস্থিতি শৈশবে অন্তত নেই। কিন্তু তারপর যখন দেখি, ঋত্বিক ঘটকের নামাঙ্কিত মেট্রো স্টেশনের পাশে জ্বলজ্বল করছে মার্সিডিজ-এর শো রুম, তার ঠিক পাশেই মাথা উঁচিয়ে কলকাতার অন্যতম বিলাসবহুল অ্যাট্মোস্ফিয়ার। মাথায় গুনগুন করে ওঠে ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’-র গান:
‘অনেক ঘুরিয়া শ্যাষে আইলাম রে কইলকাতা
তার রকম সকম দেইখ্যা আমার ঘুইরা গ্যাসে মাথা।’
যা করেছেন, বেশ করেছেন!
ঋ-ফলার অন্যান্য লেখা
……………………………………………………………
দেবজ্যোতি মিশ্রর লেখা: তিতাস শুকোয়, কান্না শুকোয় না, সুরও না
সোহিনী দাশগুপ্তর লেখা: গীতা আর নীতার তফাত আদর্শচ্যুত মানুষ আর আদর্শে বেঁচে থাকা মানুষের তফাত
সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়-এর লেখা: শালবনে মাতাল নীলকণ্ঠের যে গমনাগমন– তা আসলে শ্মশানের পরপারে বসে থাকা মানুষের
ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী-র লেখা: জগদ্দল মানুষ হয়, বিমল হয়ে যায় যন্তর, যার পোড়া পেট্রোলের গন্ধে নেশা লাগে
মৈনাক বিশ্বাস-এর লেখা: চরিত্রের মধ্যে বিলীন না হয়ে কিছুটা বিজন ভট্টাচার্য হয়ে থেকে যান ‘সুবর্ণরেখা’-র হরপ্রসাদ
প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য-র লেখা: ‘কোমল গান্ধার’ এক প্রেমের ছবিই, যা ভবিষ্যৎ অর্থনীতির দলিল হয়ে উঠেছিল