উঠোন-বারান্দায় বাবার জন্য অপেক্ষা করত যে কৃষ্ণাঙ্গ বালকটি, সে পরবর্তীকালে সারা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ড্র্যাগ-রানিদের একজন হয়ে ওঠে। ড্র্যাগে যেমন দস্তুর নতুন নামগ্রহণ, এই ছেলেটি তা করে না। সে তাঁর নিজের ‘রুপল’ নামটিই রেখে দেয়। যে-নাম তাঁকে একজন জোতিষী দিয়েছিল ছোটবেলায় এবং ভবিষ্যৎবাণী করেছিল যে, এ ছেলে বড় হয়ে অনেক নাম করবে। কিন্তু ‘নাম করে ফেলা’ কি এতই সহজ? মাত্র ১১ বছর বয়সে রুপল মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে, ছোটখাট পানশালায় ড্র্যাগাভিনয় করতে করতে নিজেকে আরও অন্ধকারে ডুবিয়ে ফেলে। আমেরিকার সমাজে একই সঙ্গে কৃষ্ণাঙ্গ আর ড্র্যাগ হয়ে বাঁচা সে-সময় ছিল মরে যাওয়ারই নামান্তর।
ষোড়শ শতকের শেষদিকে গ্রিক ও ল্যাটিনের হাত ঘুরে ইংরেজি ভাষায় একটি শব্দ যুক্ত হয়: ‘ফেনোমেনান’ (phenomenon)। কোনও দর্শনীয় বস্তু বা কখনও ব্যক্তি এর অর্থ। কিন্তু বাংলা ভাষায় এর আরেকটি মানে আছে, যা ‘প্রপঞ্চ’ কথাটির খুব কাছাকাছি। অর্থাৎ ঘটনা বা ব্যক্তি যেখানে খানিক জাদু বা রহস্যযুক্ত, যার পাঠ অসহজ তাকেও ‘ফেনোমেনান’ বলা যেতে পারে।
১৯৬৭-’৬৮ সাল নাগাদ আমেরিকার সান দিয়েগো শহরের ভেতর দিকে একটি কৃষ্ণাঙ্গ শিশু আর তার তিন বড় দিদি তাদের উঠোন-বারান্দা থেকে মোড়ের গাড়িগুলির দিকে তাকিয়ে থাকত। একেকটা গাড়ি যেত আর তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করত, ‘পরের গাড়িটা ড্যাডির হবে!’ কিন্তু দুঃখের বিষয়– তাদের ড্যাডি অর্থাৎ বাবার গাড়ি তারা কখনও দেখতে পায়নি। কারণ, তাদের বাবা সেই যে ছেড়ে গিয়েছিল, সে আর কোনও দিন কাছে ফেরেনি। সবাই ধীরে ধীরে মেনে নিলেও বাড়ির সব থেকে ছোট সদস্যটি, মুখচোরা বালকটি তা মানিয়ে নিতে পারেনি আগামী দিনগুলোয়। সে যখন আরও বড় হল, চারিদিকে নাম করল; কেরিয়ারের প্রথম ১০-১৫ বছর সে শুধু তার বাবার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে বলে বিভিন্ন মঞ্চে অভিনয় প্রদর্শন করত। যদি বাবা কখনও দেখতে আসে! কিন্তু হায়! বাবা কখনও কোনও মঞ্চেই তাকে দেখতে আসেনি। আর বাবা যদি আদৌ কোনও দিন সেই অভিনয় দেখতেও আসত, সে কি চিনতে পারত সেই সাত বছরের ছেড়ে আসা পুত্র সন্তানটিকে? না। কেন? কারণ, ছেলেটি যে কেবল বড় হয়ে গেছে তা নয়, ছেলেটির মঞ্চাভিনয়ও যে তখন সম্পূর্ণ মেয়ে সেজে! সে যে ততদিনে ‘ড্র্যাগ’ রানি! মানে? ড্র্যাগ আবার কী? ড্র্যাগ আসলে ছদ্মবেশ, বিশেষত পুরুষরা নারীর পোশাক-পরিচ্ছদ, প্রকরণ, হাবভাব– সব নকল করে এক আলাদা মঞ্চ ব্যক্তিত্ব তৈরি করে নেওয়ার নামই ড্র্যাগ। ইউরোপ-আমেরিকার সমস্ত ইতিহাস জুড়ে যার বা যাদের উপস্থিতি। এবং এই উপমহাদেশেও যে ড্র্যাগের নানা সংস্করণ এখনও মজুত। অথবা ড্র্যাগ আসলে পোশাকের স্বাধীনতা। যে রাজনীতি পোশাককে পরাধীন বানিয়ে রাখতে আর কে, কী পরবে তা ঠিক করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করে ড্র্যাগ সেই রাজনীতির বিরুদ্ধে এক অপরিসীম জেহাদ!
আরও পড়ুন: ৫০টির বেশি বাল্য বিবাহ ঠেকিয়ে রোশনি আজ রাষ্ট্রপুঞ্জের সামিটে
সেই উঠোন-বারান্দায় বাবার জন্য অপেক্ষা করত যে কৃষ্ণাঙ্গ বালকটি, সে পরবর্তীকালে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ড্র্যাগ-রানিদের একজন হয়ে ওঠে। ড্র্যাগে যেমন দস্তুর নতুন নামগ্রহণ, এই ছেলেটি তা করে না। সে তাঁর নিজের ‘রুপল’ নামটিই রেখে দেয়। যে-নাম তাঁকে একজন জোতিষী দিয়েছিল ছোটবেলায় এবং ভবিষ্যৎবাণী করেছিল যে, এ ছেলে বড় হয়ে অনেক নাম করবে। কিন্তু ‘নাম করে ফেলা’ কি এতই সহজ? মাত্র ১১ বছর বয়সে রুপল মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে, ছোটখাট পানশালায় ড্র্যাগাভিনয় করতে করতে নিজেকে আরও অন্ধকারে ডুবিয়ে ফেলে। আমেরিকার সমাজে একই সঙ্গে কৃষ্ণাঙ্গ আর ড্র্যাগ হয়ে বাঁচা সে-সময় ছিল মরে যাওয়ারই নামান্তর। কিন্তু রুপলের তো মরে গেলে চলত না। তাকে তো আরও বড় হতে হত। সে তাই ধ্বংসের শেষতলানি থেকে ঘাই মারতে শুরু করে আর আমেরিকা প্রথম ১৯৯২ সালে ‘সুপারমডেল’ মিউজিক-ভিডিওতে ক্ষীণতনু অথচ ছ’ফুটের ওপর দীর্ঘাঙ্গী, মাথায় সোনালি বুঁফোর একটি মেয়েকে ভিডিও জুড়ে দেখতে থাকে যে, তখনকার দিনের নামী মডেল সিন্ডি ক্রফর্ড আর নেওমি ক্যাম্বেলের এক অদ্ভুত মিশেল। আমেরিকা স্তম্ভিত হয়ে যায়! কী এই তীক্ষ্ণ সৌন্দর্য? কে এই নারী? কিন্তু ও তো নারী নয়। ও নারীর বেশভূষা এবং তার সমস্ত রকম রং, জৌলুস ও রাজনীতিকে ধরে রাখা, বয়ে নিয়ে চলা এক কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ। আমরা প্রত্য়েকেই তো তাই। পোশাক-পরিচ্ছদ, বেশভূষাকে লিঙ্গরাজনীতি থেকে বের করতে পারলে আমরা প্রত্যেকেই যে একেকটা ছদ্মবেশ। ড্র্যাগ। রুপল নিজেই বলেছিলেন, ‘উইক অল আর বর্ণ নেকেড অ্যান্ড রেস্ট ইস ড্র্যাগ!’ (আমরা প্রত্যেকেই জন্ম-উলঙ্গ আর বাকিটা ড্র্যাগ!)
এরপর অনেক পথ ঘুরে ২০০৯ সালে রুপল চালু করেন বিশ্ববন্দিত ‘‘রুপল’স ড্র্যাগ-রেস’’; যে গেম-শোতে ড্র্যাগ সেজে বহু প্রতিযোগী একে অপরের সঙ্গে ব্যক্তিত্ব ও সাজগোজের লড়াইতে নামে। অনেকের ধারণা আছে এবং সেটা আমেরিকার সমাজেও ছিল যে সমকামী-রূপান্তরকামী চিন্তাপ্রসূত কোনও অনুষ্ঠানই বোধ করি আম দর্শক দূরে সরিয়ে রাখে। কিন্তু ‘‘রুপল’স ড্র্যাগ-রেস’’ সেই মান্ধাতা আমলের ধারণাগুলোকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়। রুপল এককভাবে এবং ওই গেম-শো-র জন্য সব মিলিয়ে ১২ বার প্রসিদ্ধ ‘প্রাইমটাইম এমি’ পুরস্কার পর পর বছরে জিতে নেয়। এই সাফল্য এখনও কেউ ছুঁতে পারেনি। তবে এর আগে রুপলের আরেকটি প্রখ্যাত সাফল্য আছে– তিনি ১৯৯৪ সালে বিশ্বের প্রথম ড্র্যাগ-রানি হিসেবে বিখ্যাত ম্যাক প্রসাধনী সংস্থার ‘মুখ’ হিসেবে বিবেচিত হন। নারী প্রসাধনীর মুখ একজন পুরুষ যিনি নারী সেজে থাকেন! এ এক অনন্যসাধারণ বিপ্লব!
আরও পড়ুন: ‘হিজড়ে’ বলেই আক্রমণ দক্ষিণপন্থী দলের, যাদবপুরে আমার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা
তবে রুপল নিজে এই লিঙ্গ-যৌনতা ও তাঁর রাজনীতির ক্ষেত্রে খানিক বিতর্কেও জড়িয়েছেন। রূপান্তরকামী মানুষদের প্রতি এক সময় তিনি নির্দয় ছিলেন। ‘‘রুপল’স ড্র্যাগ-রেস’ অনুষ্ঠানে প্রথম দিকে রূপান্তরকামী মানুষদের অংশগ্রহণের অধিকার ছিল না। রুপলের ধারণা ছিল ড্র্যাগ এবং রূপান্তরকামিতা বোধ করি যোজন দূরত্বের দুই ভিন্ন যাপন। কিন্তু যে পোশাক-পরিচ্ছদের স্বাধীনতা যে-কোনও ড্র্যাগের মূল তা যে লিঙ্গ-যৌনতা নির্বিশেষে একই হওয়া উচিত সকলের জন্য, এই ধারণা থেকে রুপল বিচ্যুত হয়েছিলেন এক সময়। তবে পরে, নিজের ভুলের জায়গাটা উপলব্ধি করে নিজেই সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন। ‘‘রুপল’স ড্র্যাগ-রেস’-এ অংশগ্রহণে লিঙ্গ-যৌনতা কোনও অন্তরায় হয় না তারপর থেকে। বহু বহু ড্র্যাগশিল্পী অন্তরাল থেকে বেরিয়ে আসেন এই গেম-শো’র জন্য। ড্র্যাগ যা ছিল অন্ধকার পানশালাগুলির নিষিদ্ধ সুখ তাকে রুপল ও তাঁর ‘‘রুপল’স ড্র্যাগ-রেস’ বিশ্বের অন্যতম গ্ল্যামারাস শিল্পে উন্নীত করেন। এসবই তাঁর আত্মস্মৃতি ‘দা হাউস অফ হিডেন মিনিঙ্স’ (‘লুকানো অর্থের অনিকেত’) বইয়ের মধ্যে আছে। এই বইও এক সময়ের ‘বেস্ট সেলার’ ছিল!
আজ, ১৭ নভেম্বর) রুপল-এর জন্মদিন। ১৯৬০ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার সান দিয়েগোতে জন্ম নেওয়া কৃষ্ণাঙ্গ রুপল পৃথিবীর জনপ্রিয়তম ব্যক্তিত্বদের একজন। তিনি প্রকৃতই ড্র্যাগ-রানি। যে-কোনও সাক্ষাৎকারে তাঁর উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব, রসবোধ ও দার্শনিক চিন্তাপ্রবাহ আলো হয়ে থাকে। পৃথিবীর কোণে কোণে দূর-বহুদূরের যে ছেলেটি লিপস্টিক পরেছিল বলে মার খেয়েছিল বা যে মেয়েটি বেশি সেজে ফেলেছিল বলে টিপ্পনীর শিকার হয়েছিল; রুপল তাদের সকলের কখনও হেরে না যাওয়ার, ভেঙে না পড়ার স্থির আদর্শ। সেই ‘সুপারমডেল’ গানে তো তিনিই লিখেছিলেন–
‘ইট ডোন্ট ম্যাটার ওয়াট ইউ ওয়্যার (ইট ডাসেন্ট ম্যাটার ওয়াট ইউ ওয়্যার)
দেয়ার চেকিং ইয়োর স্যাভো ফেয়ার (উহ, উহ, উহ-ইয়্যা)
অ্যান্ড ইট ডোন্ট ম্যাটার ওয়াট ইউ ডু
কস এভরিথিং লুক্স গুড অন ইউ’…
পোশাক-পরিচ্ছদ দিয়ে তুমি-আমি আর ওরা-আমরা চেনার পৃথিবীতে রুপল আসলে প্রতিক্ষণ আমাদের শেখাচ্ছেন মানবজীবন এ সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে এবং অমূল্য। পোশাক-পরিচ্ছদে আমরা কেউ ভিন্ন নই। কেউ ছোট কেউ বড় নই। কেউ নারী কেউ পুরুষও নই। এটা মনে রাখতে হবে। রাখতেই হবে। তাহলেই আমরা প্রত্যেকে একেকটি ফেনোমেনন্ হয়ে উঠতে পারব একদিন।
প্রচ্ছদের ছবি: অর্ঘ্য চৌধুরী
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এতে অবশ্যই ‘সম্পদ’ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু ভয় হয় যে তা নিতান্তই বিনামূল্যের ঘরোয়া শ্রম হয়ে থেকে যাবে না তো? উৎপাদিত সম্পদের মূল্যভাগ, পাবেন তো মেয়েরা? তা না-হলে দেশীয় সম্পদ হয়তো সৃষ্টি হবে, কিন্তু নারীউন্নয়নের পথটি অধরাই থেকে যাবে।