Robbar

ভারতে তৈরি বিজ্ঞাপনকে ‘ভারতীয়’ করে তুলেছিলেন পীযূষ পাণ্ডে

Published by: Robbar Digital
  • Posted:October 24, 2025 4:01 pm
  • Updated:October 24, 2025 4:21 pm  

প্রায় সাতের দশক পর্যন্ত ইংরেজিই ছিল সর্বভারতীয় বিজ্ঞাপনের প্রধান ভাষা। এমনকী, বাংলা ভাষার কাগজেও ‘অনুবাদ এজেন্সি’র করা বিকট বিজ্ঞাপন বহুদিন চালু ছিল। আটের দশকে আস্তে আস্তে ভারতীয় ভাষায় কথা বলে– এরকম একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি হল। এই ‘ক্রেতা ভারত’ নিজেদের ভাষা, ছবি দেখতে চাইল। ফলে, দেশজ ভাষায় বিজ্ঞাপনের চাহিদা তৈরি হল। মনে রাখা দরকার, ‘ভাষা’ মানে এখানে কেবল শব্দের ভাষা নয়, ছবির ভাষা, কল্পনার ভাষা। এই বাজারে নিজের শক্তি নিয়ে উঠে এলেন পীযূষ পাণ্ডে।

রংগন চক্রবর্তী

চলে গেলেন পীযূষ পাণ্ডে।

পীযূষ পাণ্ডে

বয়স তেমন বেশি হয়নি, ৭০। এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ার কথা ছিল না। শুনছি, বছর দুয়েক আগে থেকে তিনি দায়িত্ব মোটামুটি ছেড়ে দিয়েছিলেন, হয়তো শরীর খারাপ ছিল। একজন মানুষ মারা গেলে তাঁর অসুস্থতা নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগে না। আর বিশেষ করে, পীযূষ পাণ্ডের মতো মানুষের ক্ষেত্রে তো একেবারেই না। কারণ প্রাণশক্তিই তাঁর নিজের কাজের পরিচয় ছিল। বিজ্ঞাপনের কাজ করা বা ভারতীয় বিজ্ঞাপনের খোঁজ রাখা বাকি সব মানুষের মতো আমিও তাঁর নাম জানতাম, কিছু কিছু সময় ওই প্রাণশক্তির ছাপের জন্য তাঁর কাজ চিনতেও ভুল হত না। অন্য আর পাঁচটা ক্রিয়েটিভ কাজের সঙ্গে বিজ্ঞাপনের তফাত হল– এতে নির্মাতাদের নাম থাকে না। ছাপা বিজ্ঞাপনে, আগে এজেন্সিদের ‘কি নম্বর’ থাকত, এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাও থাকে না! তাই বিজ্ঞাপনের বহু শক্তিশালী মানুষের পরিচয় অজানাই থেকে যায়। তুলনামূলকভাবে পীযূষের নাম মানুষ বেশি জানত, তাও বোধহয় কয়েক বছর ধরে কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে তাঁর সান্নিধ্যের জন্য। তিনি ৪০ বছর ধরে ‘ওগিলভি’ বিজ্ঞাপন সংস্থার সঙ্গে ছিলেন, তাঁর সর্বময় কর্তাও হয়ে উঠেছিলেন। কেবল ভারত নয়, দুনিয়া জুড়েই তাঁর কর্তৃত্ব স্বীকৃত ও সম্মানিত ছিল। তাঁর তৈরি বহু বিজ্ঞাপন আপনারা জানেন, যেমন ‘সেই ক্যাডবেরি গার্ল’, ‘এশিয়ান পেন্টস’-এর ‘হর ঘর কুছ কহতা হ্যায়’, ‘ভোডাফোন’-এর সেই পাগ কুকুরটা, আর ‘জুজুর’ দল– আমরা ভুলিনি কিছুই। গুগল করলে আরও পাবেন, তাই লিস্ট বাড়ালাম না।

ভোডাফোনের বিজ্ঞাপনে পাগ

ভারতের বিজ্ঞাপনের ইতিহাস পীযূষকে কেন মনে রাখবে? মনে রাখবে কারণ, তিনি ভারতে তৈরি বিজ্ঞাপনকে ‘ভারতীয়’ করে তুলেছিলেন। এই কথাটা গভীরভাবে সামাজিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক একটা কথা, তাই এর একটু বিশ্লেষণ দরকার। গত ৫০ বছরের পড়াশোনা আমাদের সব কথাকেই প্রশ্ন করতে, ভেঙে দেখতে শিখিয়েছে, আমরা পীযূষের এই অতিমানবিক ভূমিকাকেও তাই খতিয়ে দেখে তাঁর যোগ্য প্রাপ্য দিতে চাই। এই আলোচনার মধ্যে এবং বাইরেও ভাবা দরকার ‘ভারতীয়’ মানে কী? এখানে তো অত জায়গা নেই!

কুন্তলীন-এর পুরাতন বিজ্ঞাপন

ইংরেজ শাসনের হাত ধরে আধুনিক যুগে বিজ্ঞাপন ভারতবর্ষে এসেছিল মুদ্রণ শিল্প এবং ইংরেজি ভাষার মধ্য দিয়ে। বাংলায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন জোরদার হওয়ায় বেশ কিছু স্বদেশি দ্রব্য আর বাংলা বিজ্ঞাপন তৈরি হয়েছিল, যেমন ‘কুন্তলীন’, ‘দেলখোস’ ইত্যাদি। অন্য প্রদেশের স্থানীয় ভাষায় বিজ্ঞাপন বিষয়ে অজ্ঞতা স্বীকার করেও বলা যায় যে, প্রায় সাতের দশক পর্যন্ত ইংরেজিই ছিল সর্বভারতীয় বিজ্ঞাপনের প্রধান ভাষা। এমনকী, বাংলা ভাষার কাগজেও ‘অনুবাদ এজেন্সি’র করা বিকট বিজ্ঞাপন বহুদিন চালু ছিল। আটের দশকে আস্তে আস্তে ভারতীয় ভাষায় কথা বলে– এরকম একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি হল। এই ‘ক্রেতা ভারত’ নিজেদের ভাষা, ছবি দেখতে চাইল। ফলে, দেশজ ভাষায় বিজ্ঞাপনের চাহিদা তৈরি হল। মনে রাখা দরকার, ‘ভাষা’ মানে এখানে কেবল শব্দের ভাষা নয়, ছবির ভাষা, কল্পনার ভাষা। এই বাজারে নিজের শক্তি নিয়ে উঠে এলেন পীযূষ পাণ্ডে। তিনি জয়পুরে জন্মেছিলেন, ন’ ভাইবোনের একজন। গায়িকা ইলা অরুণ তাঁর বোন, পীযূষের অনেক বিজ্ঞাপন ছবির নির্মাতা প্রসূন পাণ্ডে, তাঁর ভাই। মাঠ-ঘাটের ভারতকে খুব ভালো চিনতেন, রণজি খেলেছেন, দেশের ভাষা, জীবন, জীবনের ছবি বুঝতেন। তাঁর মন্ত্র-শিষ্যদের মধ্যে একজন হলেন এখন শাসকদের ঘনিষ্ঠ– প্রসূন যোশী। তিনি নিজেও খুবই শক্তিধর। বিজ্ঞাপন, বলিউড– সবেতেই তিনি ছেয়ে আছেন, অনেকটাই নিজের যোগ্যতায়।

ক্যাডবেরি গার্ল

পীযূষের বিজ্ঞাপনে অসম্ভব সুন্দর, প্রায় গুলজারের মতো একটা বোধের আমরা দেখা পাই, যেমন এশিয়ান পেন্টস-এর: ‘হর ঘর কুছ কহতা হ্যায়’। এটা কেবল ‘বিজ্ঞাপনী স্লোগান’ নয়, একটা গভীর বোধ। এই বোধটা আবার কেবল ভাষার নয়, তার চেয়েও গভীরতর জীবন চেনার বোধ। এই বোধই মানুষকে তাঁর বিজ্ঞাপনের কাছে টেনেছিল, তাঁর বিপণন সফল হয়েছিল। ‘ক্যাডবেরি গার্ল’ ছবিতে যেমন সোচ্চারে কিছু না বলেও তিনি এক নারীবাদী ঘোষণা করতে পেরেছিলেন।

…………………….

পীযূষের এই ‘গাং হো’, ‘সেলিব্রেট ইন্ডিয়া’ মনোভাব তাঁর বিজ্ঞাপনকে সব সময় এত পজিটিভ করে তুলেছিল। যা তাঁর উত্থানের নেপথ্যে কাজ করেছিল। আমরা যারা বেশিরভাগ সময়টাই কলকাতায় বা দিল্লিতে বিজ্ঞাপনে কাজ করেছি, দেখেছি ক্লায়েন্টরা কারণে অকারণে কীভাবে আমাদের কাজ রিজেক্ট করে দেয়। পীষূষ আমায় বলেছিলেন, ওঁর গোটা কর্মজীবনে এ ঘটনা প্রায় ঘটেইনি।
…………………….

পীযূষ পাণ্ডের প্রাণশক্তিই ছিল ‘সেলিব্রেট ইন্ডিয়া’

বছর কয়েক আগে একবার আমি মুম্বইতে তাঁর বাড়িতে তাঁর সঙ্গে বিজ্ঞাপন ও সমাজভাবনা নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলাম। দেখেছিলাম, এই নিয়ে তিনি প্রায় কিছু বলতে পারছেন না। মানে লুকোতে চান তা নয়, আমরা; কলকাতার লোকেরা ‘সমাজভাবনা’ বলতে যা বুঝি, উনি ওইভাবে ভাবেননি কোনও দিন। ওঁর যে প্রাণশক্তি ওঁর বিজ্ঞাপনে প্রকাশ পায়, তার মূল মন্ত্রই হল ‘সেলিব্রেট ইন্ডিয়া’। আর এই দর্শন কখনও কোনও ক্ষমতাকে বা অসাম্যকে তেমন ভাবে প্রশ্ন করে না। যেমন ধরুন, ওঁর একটা বিজ্ঞাপন আছে, রাজস্থানের গ্রামের রাস্তা দিয়ে ভিড় ঠাসাঠাসি বাস চলেছে, তার ছাদেও তিল ধারণের জায়গা নেই, বহু স্থানীয় মানুষ গাদাগাদি করে বসে আছে। কিন্তু সবাই যেন কী এক ‘আঠায়’ আটকে আছে, ঝাঁকুনি খাচ্ছে, কিন্তু কেউ পড়ে যাচ্ছে না। এই আঠাই যেন ‘ভারতীয়ত্ব’, জীবনে আটকে থাকা! কিন্তু বিজ্ঞাপন তো, শেষে তাই ‘ফেভিকল’-এর অনুষঙ্গ এল। আমি বহু দিন বিজ্ঞাপনে কাজ করেছি, পেলে এখনও করি। এই কল্পনার ক্ষমতার কথা বাদ দিন, বাংলায় বড় হওয়া ভুয়ো ও ভিতু বামপন্থী হিসেবে আমার মনে হয়, আমার মতো অনেকেই এই বিজ্ঞাপনটা ভাবতাম না। তার কারণ আমরা গরিব মানুষের এই কষ্টটাকে জীবনের স্বাভাবিক, এমনকী, মজার অঙ্গ হিসেবে দেখে সেলিব্রেট করতে পারতাম না। আমরা যে ‘পালকি চলে’ আর ‘রানার’ মাথায় রেখে বড় হয়েছি! তাতে কি ফেভিকল খুব ‘স্বাভাবিক’ জীবনের ব্রত উদযাপন হিসেবে ঢুকত?

পীযূষের এই ‘গাং হো’, ‘সেলিব্রেট ইন্ডিয়া’ মনোভাব তাঁর বিজ্ঞাপনকে সব সময় এত পজিটিভ করে তুলেছিল। যা তাঁর উত্থানের নেপথ্যে কাজ করেছিল। আমরা যারা বেশিরভাগ সময়টাই কলকাতায় বা দিল্লিতে বিজ্ঞাপনে কাজ করেছি, দেখেছি ক্লায়েন্টরা কারণে-অকারণে কীভাবে আমাদের কাজ রিজেক্ট করে দেয়। পীষূষ আমায় বলেছিলেন, ওঁর গোটা কর্মজীবনে এ ঘটনা প্রায় ঘটেইনি। আমি বুঝতে পারি, উনি ‘পীযূষ পাণ্ডে’ হয়ে ওঠার পর এটা হতে পারে। এইচটিএ-তে কাজ করার সময় দেখতাম সুভাষ ঘোষাল ক্যাম্পেন প্রেজেন্ট করলে রিজেক্ট হত না। ক্লায়েন্টরা উঠে দাঁড়াত। কিন্তু কেরিয়ারের একেবারে গোড়া থেকে? তার মানে কত বড় ক্ষমতা হতে হয়!

……………………………………..
পড়ুন বিজ্ঞাপন নিয়ে আরও লেখা: পুঁটুরাণীর জন্য পাত্র চাই: পুরাতন কলিকাতার পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপন 
……………………………………..

পীযূষের বিজ্ঞাপনের ভিত ছিল এই সমস্যাহীন ভারত। খোলা মাঠে বসে থাকা পরিবার, চটি ছিঁড়ে যাওয়া মানুষ, এমনকী, ভারত পাকিস্তানের ওয়াঘা সীমান্ত– সবই ছিল তাঁর এই ‘ফেভিকল পেয়েছির দেশ’। বিজ্ঞাপন ছিল জগতে আনন্দযজ্ঞে সবার নিমন্ত্রণের চিঠি। এর একটা ভালো দিক ছিল। শ্রেণি বা শোষণের বোধ ছিল না বলে সব কিছুকেই মজার দেখান যেত। যেমন এ. আর. রহমানের ‘বন্দে মাতরম্‌’ গানে আধুনিক গায়কের সঙ্গে থাকে ইতিহাসে আটকে যাওয়া প্রায় আদিবাসী বাকি সব নাগরিক। শেষ বিচারে পীযূষ ছিলেন সফল বিজ্ঞাপন নির্মাতা।

আজকের এই সব গুলিয়ে যাওয়ার মুহূর্তেই আমাদের তাঁর সে ভূমিকার পরিসীমায় তাঁর অভূতপূর্ব অবদানের কথা মনে রাখা দরকার।

………………………………………

পড়ুন বিজ্ঞাপন নিয়ে আরও লেখা: বিজ্ঞাপনে দেখানো উজ্জ্বলতা না পেলে আপনার জীবন বৃথা?

………………………………………