জমি কেবল সম্পদ না। জমির সাথে জুড়ে আছে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, সামাজিক নিরাপত্তা, আত্মপরিচয়, এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা। জমির মালিকানা নির্ধারণ করে কে সিদ্ধান্ত নেবে, কে নিয়ন্ত্রণ করবে এবং কে সুবিধা ভোগ করবে। ভারতবর্ষের মতো বিভাজিত সমাজে জমি হয়ে ওঠে ক্ষমতার কাঠামোর ভিত্তি। স্বাধীন ভারতে জমির ওপর দখল নিয়ে বহু সংঘর্ষ জন্ম নিয়েছে। দলিত-উচ্চবর্ণ, আদিবাসী-রাষ্ট্র, কৃষক-কর্পোরেট ইত্যাদি দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে রয়েছে জমি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই জল-জমির লড়াইয়ের মুখ হয়ে ওঠেন ফুলনের মতো মহিলারা।
১৯৬৩ সালের ১০ আগস্ট উত্তরপ্রদেশের জালাউন জেলার ছোট্ট গ্রাম গোরহা কা পুরওয়াতে ফুলন দেবীর জন্ম এক দরিদ্র দলিত মাল্লা পরিবারে। ফুলনের বৈষম্যবিরোধী দুঃসাহসী বিদ্রোহের গল্প ঘরে ঘরে প্রচলিত। নিজের ধর্ষণ এবং অমর্যাদার প্রতিশোধে বেহমাই গ্রামে ২২ জন উচ্চবর্ণের ঠাকুর পুরুষকে গুলি করার কথা আমরা শুনেছি। শেখর কাপুরের ১৯৯৪ এর ‘ব্যান্ডিট কুইন’ সিনেমা ধরে রেখেছে এই অসম্ভব বিপ্লবের কাহিনি, যার সূত্রপাত এক জমির অধিকারকে নিয়ে।
ফুলনের জেঠুর ছেলে মায়াদিন জমির দলিল জাল করে তাঁদের জমি কেড়ে নেয়। ১০ বছরের ফুলন কথাটা জানতে পেরে সেই জমিতে ধর্না দেন। নিজের অধিকারের জমি ছেড়ে যেতে না চাওয়ায় মায়াদিনের ইটের বাড়ি খেয়ে অজ্ঞান হন। এই ঘটনার পর ফুলন ‘বাঘি’ (বিপ্লবী) বলে গ্রামে চিহ্নিত হন। তড়িঘড়ি এক বছরের মাথায় তাঁদের ১১ বছরের মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেন ফুলনের বাবা মা। ১০০ টাকা, একটা গরু এবং একটা সাইকেলের বিনিময়ে ফুলনকে বিয়ে করে নিয়ে যায় তাঁর চেয়ে বয়সে তিনগুণ বড় এক লোক। শ্বশুরবাড়িতে নিয়মিত শারীরিক এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হন ফুলন। ফিরে আসেন গোরহা কা পুরওয়া। গ্রামে এসেও শান্তি নেই। উচ্চবর্ণের পুরুষ ও জেঠুদের পরিবারের হেনস্থা চলতে থাকে। জমির অধিকারের লড়াই কিন্তু তাও ছাড়েননি।
ইতিমধ্যে, তাঁর অটল প্রতিবাদে জমির মামলা এলাহাবাদ হাইকোর্ট অবধি পৌঁছে যায়। ক্ষিপ্ত মায়াদিন ফুলনের প্রতিরোধের প্রতিশোধ নেন প্রথমে তাঁকে মেরে জেলে পাঠিয়ে এবং জেল থেকে ছাড়া পেলে তাঁকে অপহরণ করিয়ে। উচ্চবর্ণের ঠাকুরদের এক দল তাঁকে ধরে নিয়ে যায় উত্তরপ্রদেশের খ্যাতনামা গিরিখাত চম্বলে। এখানেই ডাকাতদলের নেতা বাবু গুজ্জার ও তার সঙ্গীদের হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার হন ফুলন। এই হেনস্থার প্রতিবাদে বাবুর সেনাপতি ভিক্রম মাল্লা গুলি করে হত্যা করেন নেতাকে। এরপরই মাল্লার হাতে শুরু হয় ফুলনের ডাকাত-নেতা হয়ে ওঠার প্রশিক্ষণ।
পরবর্তী এক বছর মাল্লা আর ফুলন চম্বল অঞ্চলে তাঁদের আধিপত্য স্থাপন করেন। উচ্চবর্ণের বাড়ি হানা, ট্রেন লুট, টাকার জন্য অপহরণ– এই সবের মাধ্যমে আস্তে আস্তে নাম ও প্রতাপ বাড়তে থাকে ডাকাত নেতার। নিম্নবর্ণের মানুষদের কাছে ফুলন হয়ে ওঠেন ‘দস্যু সুন্দরী’।
তবে দীর্ঘস্থায়ী হয় না এই আধিপত্য। দলিত হয়েও উচ্চবর্ণের লোক খুন করার অপরাধে বাবুর দলের দু’জন প্রাক্তন সদস্য শ্রীরাম সিংহ ও তার ভাই লালা রাম সিংহ, ভিক্রমকে গুলি করে হত্যা করে ও ফুলনকে ধরে নিয়ে যায় বেহমাই গ্রামে। প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে ফুলনকে বন্দি করে নিয়মিত ধর্ষণ করে দুই ভাই এবং বেহমাইয়ের ঠাকুর গোষ্ঠীর বিভিন্ন সদস্য। একবার নগ্ন অবস্থায় তাঁকে গ্রামের সবার সামনে হেঁটে কুয়ো থেকে জল তুলে আনতেও বাধ্য করে শ্রীরাম সিংহ।
কোনওক্রমে নিজেকে মুক্ত করে পালিয়ে গিয়ে ফুলন আবার দল গঠন করেন এবং ঠাকুরদের হাতে অমর্যাদার প্রতিশোধ নেন। ১৯৮১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি নিজের দল নিয়ে বেহমাই হামলা করেন। মেগাফোনে ঘোষণা করেন শ্রীরাম এবং তার ভাইকে ডাকাত দলের হাতে তুলে দিতে। দু’জনের খোঁজ না পেয়ে যমুনা নদীর তীরে ২২ জন ঠাকুর পুরুষকে দাঁড় করিয়ে পেছন থেকে গুলি করেন দস্যুরানি। মৃত্যু হয় ২০ জনের। গোটা দেশকে নাড়িয়ে দেয় এই গণহত্যা। উচ্চবর্ণের মুখে তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয় এই ঘটনার। কিন্তু প্রান্তিকদের কাছে হয়ে ওঠেন বিপ্লবী।
ফুলন দেবীর গল্প আমরা ছোটবেলা থেকে শুনে আসি অ্যান্টি-কাস্ট প্রতিবাদের এক রূপ হিসেবে। নারীবাদী মহলেও চম্বলের দস্যুরানি প্রায় এক পৌরাণিক স্থান অর্জন করেছেন। ২০০১ সালে গুপ্তহত্যার পরেও তাঁর প্রভাব কমেনি। কিন্তু এই প্রতিবাদ, হিংস্রতা ও ক্ষমতার উপস্থাপনার পেছনে রয়েছে খুবই জটিল এক সমীকরণ– জমি।
জমি কেবল সম্পদ না। জমির সাথে জুড়ে আছে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, সামাজিক নিরাপত্তা, আত্মপরিচয়, এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা। জমির মালিকানা নির্ধারণ করে কে সিদ্ধান্ত নেবে, কে নিয়ন্ত্রণ করবে এবং কে সুবিধা ভোগ করবে। ভারতবর্ষের মতো বিভাজিত সমাজে জমি হয়ে ওঠে ক্ষমতার কাঠামোর ভিত্তি। স্বাধীন ভারতে জমির ওপর দখল নিয়ে বহু সংঘর্ষ জন্ম নিয়েছে। দলিত-উচ্চবর্ণ, আদিবাসী-রাষ্ট্র, কৃষক-কর্পোরেট ইত্যাদি দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে রয়েছে জমি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই জল-জমির লড়াইয়ের মুখ হয়ে ওঠেন মহিলারা।
দলিত মহিলারা চাষের জমিতে সারাদিন কাজ করেও চাষের ফলন উপভোগ করতে পারেন না। আজীবন এই অত্যচার এবং বঞ্চনা দেখে, ২০১৬ সালে তামিলনাডুর শাকিলা কালাইসেলভান Pallur Dalit Women Collective তৈরি করেন। শাকিলার নেতৃত্বে পল্লুর গ্রামে প্রায় ৪০ জন দলিত নারী সাত একরের বেশি অবৈধভাবে দখল করা সর্বজনীন জমিতে নিজেদের দাবি জানান। কর্তৃপক্ষ তাঁদের দাবিকে গুরুত্ব না দিলে, এই মহিলারা জোটবদ্ধ হয়ে নিজেরাই জমি পরিষ্কার করে চাষ শুরু করেন। প্রথমে সরকার উচ্চবর্ণের জমিদারদের সমর্থন করলেও, আদিবাসী দলিত মহিলাদের বিপুল প্রতিবাদের মুখে পড়ে বাধ্য হন তাঁদের কথা মেনে নিতে। হার মেনে নিতে না পেরে এক জমিদার শাকিলাকে খুন করার চেষ্টাও করে। তবে মহিলাদের জোরদার বিরোধ এবং বলিষ্ঠ অধিকার আদায়ের আন্দোলনের সামনে সব প্রতিরোধ ম্লান হয়ে যায়।
২০০১ সালে কেরালা সরকার, ৩০ জন আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের মৃত্যু এবং তার প্রতিবাদের পর প্রতিশ্রুতি দেন যে তাঁরা আদিবাসী সম্প্রদায়কে চাষের জমি দেবেন। ২০০৩-এও সেই জমি না পাওয়ার পর আদিবাসী মহিলা সি. কে. জানুর নেতৃত্বে শয়ে শয়ে মানুষ Muthunga Wildlife Sanctuary দখল করেন। মুথুঙ্গার জঙ্গলের সঙ্গে এখানকার আদিবাসী গোষ্ঠীর ঐতিহাসিক সম্পর্ক আছে। এই জঙ্গলই ছিল তাঁদের জীবিকা। সেই জঙ্গল থেকে উৎখাত করে দেওয়া হয়েছিল। আবার মুথুঙ্গা দখল করে তাঁরা জমি চাষ এবং বসবাস শুরু করেন। কিন্তু ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সরকার তাঁদের উচ্ছেদ করার আদেশ জারি করেন। জঙ্গল না ছাড়তে চাওয়ায় ১৮ রাউন্ড গুলি চালায় পুলিস। একজন প্রতিবাদী আদিবাসী এবং এক পুলিসের মৃত্যু হয়। সি. কে. জানু গ্রেফতার হন। তবে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যায় দেশে। সরকার বাধ্য হন জমির বাটোয়ারা করতে।
পাঞ্জাবের সিংরুরেও একই কাহিনি। দলিত মহিলারা জমি চাষ করেন কিন্তু কোনও অধিকার নেই ফসলের ওপর। উচ্চবর্ণের অধীনে জমি। পাঞ্জাবের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বছরে দু’বার জমির নিলাম করেন। কিছু জমি উচ্চবর্ণের জাঠদের জন্য আর কিছু সংরক্ষিত থাকে শিডিউল কাস্টের জন্য। কিন্তু ক্ষমতাশালী জাঠ জমিদাররা কিছু প্রক্সি দলিত প্রার্থীদের নামে জমি কিনে নেয় নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য। এই অনাচারের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালে দলিত মহিলারা সংগঠিত হন এবং পঞ্চায়েতি জমিতে অংশীদারিত্বের দাবি তোলেন। তাঁদের ওপর শুরু হয় অত্যাচার, মারধর, বাড়ির সদস্যদের জেলবন্দি। তাও হাল ছাড়েননি মহিলারা। নিলাম বয়কট করে, টাকা জোগাড় করে সর্বজনীন জমি কিনে সমবায় কৃষি শুরু করেন। ২০২০-তে আসে আরেক বাধা। সরকার ঘোষণা করে পুঁজিপতিরা সর্বজনীন জমি কিনতে পারবে। আবার অস্তিত্বের সংকট। তবে প্রশাসনের বাধা, পুলিশি হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও জমি অধিকারের দাবিতে তাঁরা এখনও সংগঠিতভাবে লড়ে চলেছেন।
নারীরা রাস্তা, প্রতিবাদ, ও সংগঠনের মাধ্যমে জমির অধিকার ছিনিয়ে নিচ্ছেন। জমি হয়ে উঠেছে লিঙ্গ, শ্রেণি ও জাত বৈষম্যের বিরুদ্ধে অস্ত্র। শহরমুখী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কারণে বহু পুরুষ, বিশেষত নিম্নবর্ণের এবং নিম্নশ্রেণির, উপার্জনের জন্য পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলে যান। গ্রামে থাকে পরিবারের মহিলারা। তাঁরা জমির কাজ করেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জমির মালিক কিন্তু উচ্চবর্ণ সম্প্রদায়ের পুরুষ। দলিত আদিবাসী বা দরিদ্র মহিলার শ্রমের ফল তারা উপভোগ করে।
অন্য ক্ষেত্রে যেই পরিবারে জমি থাকে, মালিকানা সাধারণত পুরুষদের নামে হয়। মেয়েরা পরিবারে কাজ করলেও তাঁদের হাতে জমির কাগজ থাকে না। ফলে তাঁরা আর্থিকভাবে নির্ভরশীল থাকেন স্বামী, বাবা বা ছেলের উপর। স্বামীর মৃত্যুর পর বঞ্চিত হন সম্পত্তি থেকে। বাড়ির মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলে ভাইয়েরা হকের সম্পত্তি বোনকে দিতে চায় না। অনেক সম্প্রদায়ের আইন, যেমন– হিন্দু উত্তরাধিকার আইন সংশোধন ২০০৫, নারীকে সমান উত্তরাধিকার দিলেও পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা নারীদের বঞ্চিত করে। আর মুসলিম মহিলারা এখনও পৈতৃক সম্পত্তিতে সমানাধিকার পান না। মুসলিম মেয়েদের দ্বিগুণ সম্পত্তি পায় মুসলিম ছেলেরা।
নারীদের এবং প্রান্তিকদের জন্য জমির মালিকানা এবং জমির ফসলের ওপর অধিকার পারিবারিক স্বীকৃতি, সামাজিক স্বীকৃতি ও মানুষ হিসেবে পূর্ণ মর্যাদার একটা রূপ। জমির ওপর অধিকার শুধু আর্থিক নিরাপত্তা নয়, পুরুষতান্ত্রিক ও জাতভিত্তিক ক্ষমতার কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করার এক বাস্তব হাতিয়ার। জমি অধিকারের প্রতীক আর ফুলনের মতো মহিলারা যখন জমির দাবিতে এগিয়ে আসেন, তখন সেটা শুধু ব্যক্তিগত দাবি নয়, সামাজিক প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে ওঠে।