রাগ এমন একটা বস্তু, যেটা মানুষকে শান্তি কিংবা স্বস্তি দেয় না। মেয়েদেরও না। যখন মেয়েরা রেগে যায়, কারও ওপর রেগে ফেটে পড়ি, তখন কিংবা নিজেদের মনের মধ্যেও পীড়ন সৃষ্টি হয়। যন্ত্রণা হয়। যতক্ষণ না সেই অবস্থা থেকে মুক্তি হচ্ছে, রাগ কমছে, মেয়েরা কিন্তু স্বাভাবিক হতে পারবে না। কোনও রাগী মানুষ, মেয়ে হোক কিংবা ছেলে, সে যদি রেগে থাকে, তা প্রকাশ না করে, তার মানসিকতায়, অবদমিত চেতনার তার ব্যাপক প্রভাব পড়ে।
রাগ এমন একটা জিনিস, যা সকলেরই হয়। এখানে কোনও লিঙ্গভেদ নেই। কিন্তু রাগ জিনিসটাই সামাজিকভাবে কাম্য নয়। রাগ যখন প্রকাশ পায়, তখন তাকে নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন। কারণ রাগের যে পরিণতি ঘটে, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধ্বংসাত্মক। তাতে শুধু সামগ্রিক পরিস্থিতির অবনতি হয়, তাই নয়, সেইসঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্কও শেষ হয়ে যায়। রাগের ফলে যে একটা নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হয়, তাকে অস্বীকার করার উপায় নেই।
কিন্তু রাগকে শুধু এই একমুখী দৃষ্টিকোণে বিচার করা ভুল হবে। ভিন্ন পরিসরে রাগের ভিন্ন প্রকাশ। ইংরেজিতে একটা কথা আছে– ‘লাভ অ্যান্ড অ্যাগ্রেশন’। রাগ আগ্রাসনের একটা ভিন্নধর্মী রূপভেদ। ক্রীড়াজগতের ব্যক্তিত্বরা, সে নারী হোক কিংবা পুরুষ, তাদের মধ্যে এই আগ্রাসনটা বিশেষ করে কাজ করে। ক্রিকেট হোক কিংবা ফুটবল, কিংবা হকি বা যে কোনও স্পোর্টস– আগ্রাসনটাই একজন ক্রীড়াবিদের মধ্যে জেতার খিদে তৈরি করে। এই আগ্রাসনকে উসকে দেয় মনের ভিতরে জমে থাকা বঞ্চনা-ক্ষোভ, অবদমিত রাগ।
মেয়েদের ক্ষেত্রে যেটা সমস্যা হল, যে কোনও আবেগকে সচেতনভাবে লুকিয়ে রাখতে হবে, আড়াল করতে হবে, এই সামাজিক শিক্ষা তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বরাবর। যেখানে মেয়েরা বৈষম্যের শিকার, সেখানে তাদের সেই আপোসটা আরও বেশি করে করতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু কোথাও গিয়ে তাদের রাগের গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তাকে অনুভব করতে হবে। রাগ করা এবং তাকে প্রকাশ করার অধিকার মেয়েদের রয়েছে। যে কোনও আপত্তিজনক পরিস্থিতিতে, যেখানে অপমানিত হতে হচ্ছে, অসম্মান জুটছে, সেখানে মেয়েদের রাগে ফেটে পড়াটাই স্বাভাবিক। ছেলেদের রাগ থাকতে পারলে মেয়েদেরও থাকবে। কারণ সামাজিক অধিকার, সম্মানবোধের প্রশ্নে তারা পুরুষদের সঙ্গে সমানধিকারের দাবিদার। অথচ ইতিহাস সাক্ষী, সমাজের চোখে মেয়েদের রাগটা সবসময় উপেক্ষিত থেকে গেছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মেয়েদের রাগকে গুরুত্ব দেয় না, তাকে ধর্তব্যের মধ্যে গ্রাহ্য করে না। এটাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়। তাই মেয়েদের সবার আগে বুঝতে হবে রাগের গুরুত্ব, সেটাকে যে চেপে রাখলে চলবে না, প্রকাশ করতে হবে, সেই বোধটাই সবার আগে তৈরি হওয়া দরকার একটা মেয়ের মধ্যে।
শুধু তাই নয়, রাগের প্রকাশটা হওয়া দরকার গঠনমূলক। খেলাধুলো কিংবা চাকরির ক্ষেত্রে যখন মেয়েরা পা রাখছে, পেশাদারি বৃত্তে তাদের মধ্যে কিন্তু এই গঠনমূলক আগ্রাসনটা কাজ করে। তাদের ভাবনায় উন্নতির চিন্তা বিকশিত হয়। হয় বলেই সেই আগ্রাসনটা কখনও ধ্বংসাত্মক হয় না, গঠনমূলক হয়। সমস্যা হচ্ছে, ছোটবেলা থেকে পারিবারিক কিংবা সামাজিক শিক্ষা, মেয়েদের বরাবর আপোস করতে শেখায়। রাগের অধিকার যে তাদেরও রয়েছে, তাকে যে অবদমন করে রাখতে নেই। এটা তাদের কেউ বলে না। উল্টে অন্যান্য আবেগ, অনুভূতি দিয়ে কীভাবে রাগকে প্রশমিত করা যায়, ধামাচাপা দেওয়া যায়, সেই শিক্ষার তালিম তাদের দেওয়া হয়। এই মানসিকতা মেয়েদের জীবনে চলার পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠার জ্বালানিটাই সে পায় না।
রাগের ক্ষেত্রে নেতিবাচক মানসিকতা বর্জনের কথা বললাম। কিন্তু এ প্রসঙ্গে আরও একটা ব্যাপার পরিষ্কার বলতে চাই। মেয়েদের রণচণ্ডী হয়ে ওঠারও দরকার আছে। কেন একথা বলছি? বলছি, তার যথেষ্ট কারণ আছে। আমাদের সমাজে মেয়েদের শারীরিক ও মানসিকভাবে কম নির্যাতন সহ্য করতে হয় না। পুরুষদের লালসার শিকারও তারা। খবরের দুনিয়ায় চোখ রাখলেই দেখা যায়, প্রতি মিনিটে মিনিটে মেয়েদের শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটছে। সেসব থামার ইঙ্গিত নেই। এসব ক্ষেত্রে মেয়েদের ধৈর্যের পরীক্ষা দিলে চলবে না। সমাজের রক্তচক্ষুর সামনে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকলেও হবে না। গর্জে উঠতে হবে। প্রবল রাগের মধ্যে দিয়ে তার বহিঃপ্রকাশ হওয়া দরকার। এসব পরিস্থিতিতে রাগ মেয়েদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।
খেলাধুলোর ক্ষেত্রে যে পরিসর কিংবা সুযোগ ছেলেরা পায়, তা মেয়েদের জোটে না। যে খেলাধুলোগুলোতে শারীরিক সক্ষমতার প্রয়োজন। সেগুলোর ক্ষেত্রে আমরা সাধারণত মেয়েদের উৎসাহিত করি না। মেয়েদেরকেই এই ব্যাপারগুলোয় সচেতন হতে হবে। এইভাবে দূরে সরিয়ে রাখতে রাখতে মেয়েদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়। সেই রাগের মূল কারণ কী, সেটা মেয়েদের বুঝতে হবে। কোন পরিস্থিতিতে, কাদের ব্যবহারে মেয়েদের রাগ হচ্ছে, সেটা বুঝতে হবে। সেই রাগের অধিকার রয়েছে মেয়েদের।
এই সমাজে মেয়েদের ভূমিকার বদল ঘটে। যখন সে কারও মেয়ে, যখন কারও মা, যখন যে চাকুরিজীবী হিসেবে পেশাদার বৃত্তে পা রাখছে– ভিন্ন ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে মেয়েরা লাঞ্ছনার শিকার হয়। তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার হাতিয়ার কিন্তু রাগ। রাগের প্রকাশ ছাড়া এর থেকে মুক্তি নেই। অনেকক্ষেত্রে, মেয়েরা অবসাদে চলে যায়। সমাজের বিরুদ্ধে যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ সেটাকে সে উগড়ে দিতে না পেরে নিজের ওপর বার করে। তখন মেয়েরা জীবনবিমুখ হয়ে পড়ে। নিজেকে গুটিয়ে নেয়। এই অবস্থা থেকে তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার অন্যতম থেরাপিক উপায় হল রাগ। এই রাগের বহিঃপ্রকাশ মেয়েদের মধ্যে বিপুল এনার্জির সঞ্চার ঘটায়। যার বিরুদ্ধে ক্ষোভ, কিংবা যে সমাজের বিরুদ্ধে মেয়েদের রাগ তা যদি উগড়ে দিতে পারে, তাহলে ফের ফিরে আসতে পারবে স্বাভাবিক জীবনে। থেরাপিস্টরা অ্যাগ্রেসিভ ড্রাইভ থেকে তাদের লাইভ ড্রাইভে ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হয়, পজিটিভভাবে।
রাগ এমন একটা বস্তু, যেটা মানুষকে শান্তি কিংবা স্বস্তি দেয় না। মেয়েদেরও না। যখন মেয়েরা রেগে যায়, কারও ওপর রেগে ফেটে পড়ি, তখন কিংবা নিজেদের মনের মধ্যেও পীড়ন সৃষ্টি হয়। যন্ত্রণা হয়। যতক্ষণ না সেই অবস্থা থেকে মুক্তি হচ্ছে, রাগ কমছে, মেয়েরা কিন্তু স্বাভাবিক হতে পারবে না। কোনও রাগী মানুষ, মেয়ে হোক কিংবা ছেলে, সে যদি রেগে থাকে, তা প্রকাশ না করে, তার মানসিকতায়, অবদমিত চেতনার তার ব্যাপক প্রভাব পড়ে। মানসিক সমস্যাও তৈরি হয়। তাই রাগের বহিঃপ্রকাশ হওয়া অবশ্যই দরকার। কিন্তু সেটা ধ্বংসাত্মক নয়, ইতিবাচক এবং গঠনমূলক দৃষ্টিকোণে। তার আগে মেয়েদের বুঝতে হবে, রাগের অধিকার তাদের আছে। এরজন্য ছোটবেলা থেকে মেয়েদের মধ্যে সেই বোধের সঞ্চার ঘটানো দরকার। তা করতে গেলে স্বাধীনভাবে তাদের লালনপালন করা দরকার, কোনওরকম বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি রাখলে চলবে না।