Robbar

দারিদ্র কি ক্রমশ ইউটিউবের পপুলার কনটেন্টে পরিণত হবে?

Published by: Robbar Digital
  • Posted:October 16, 2024 7:03 pm
  • Updated:October 16, 2024 7:43 pm  

ইউটিউবের পপুলার কন্টেন্ট দারিদ্র। একটি ছেলে বেছে নিয়েছে ব্যারাকপুর স্টেশান। প্ল্যাটফর্মই যাদের ঘরবাড়িসুখ, ছেলেটি প্রত্যেককে বিরিয়ানি বিলোচ্ছে প্যাকেট প্যাকেট। পেছনে ভিডিওগ্রাফার। সিনেম্যাটিক শট। হেবি এডিট। দারিদ্রের জন্য স্পেশাল এস্থেটিক এফেক্ট। দুরন্ত দুঃখী আবহসংগীত । কুড়ি মিনিটের ভিডিও। কুড়ি লাখ ভিউ। শেষে, এইরকম আরও ভিডিও দেখতে চাইলে, চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করে আমার পাশে থাকুন। বিশ্ব খাদ্য দিবসে পভার্টি পর্ন নিয়ে বিশেষ লেখা।

গ্রাফিক্স: অর্ঘ্য চৌধুরী

রোদ্দুর মিত্র

দিল্লি শহরতলি। শুনশান একটা ফুটপাথে উনুন জ্বলছিল। পাশে ত্রিপলে তৈরি ঘর। অথবা আড়াল। ভেতরে তিনটি প্রাণী। মানুষের মতো। মাছি উড়ছে ইতিউতি। একজন ভাত রাঁধছে। একজন আঁচ পোহাচ্ছে। একজন নাক খুঁটছে। দূর থেকে একটা কালো এসইউভি এসে দাঁড়াল। বাক্সভর্তি খাবার ফেলে দিয়ে গেল উনুনের পাশে। আপনার শরীরে থইথই সমবেদনা, তাই ফেসবুকে শেয়ার করে লিখলেন: মানবতাই পরম ধর্ম।

দার্শনিক অরিন্দম চক্রবর্তী ‘ভাতকাপড়ের ভাবনা ও কয়েকটি আটপৌরে দার্শনিক প্রয়াস’-এ লিখেছিলেন: অপর মানুষ বা প্রাণীকে উৎপীড়িত, যন্ত্রণার্ত, দুঃখী দেখলে যে কোনও সংবেদনশীল সাধারণ মানুষের মনে যে সমবেদনা জাগে, মহাভারত তাকেই বলেছেন অনুক্রোশ। অর্থাৎ, আপনি অনুক্রোশের বশে, একটি ভিডিও শেয়ার করলেন। অথবা কোনও চমৎকার সকালবেলায় মনে হল, যারা ফুটপাথবাসী, সকলকে একটা দিন পেটভরে খাওয়ানো প্রয়োজন। যেন একটি নাগরিক কর্তব্য! অরিন্দম চক্রবর্তী সপাটে বলছেন: এ কোনও বৈষম্য দূরীকরণের পন্থা নয়। আখেরে অলক্ষ্মীর ভাণ্ডার উথলে ওঠে। অথচ, যে মানুষটি দারিদ্রর ভিডিও বেচলেন, ঝুড়ি ঝুড়ি লাইক, শেয়ার আর সিম্প্যাথি কুড়োলেন, দিনশেষে তাঁর লক্ষ্মীলাভ হয়েছে ঢের।

শিল্পী: জয়নুল আবেদিন

দারিদ্রর প্রদর্শন। যা কুৎসিত। নীতিবোধহীন। ভায়োলেন্ট। এবং অর্গ্যাজমিক। আসলে ‘পভার্টি পর্ন’। শব্দবন্ধটি একুশ শতকের আমদানি নয়। পঞ্চাশের মন্বন্তরে পশ্চিমবঙ্গের যে মুখচ্ছবি, এই ২০২৪ সালেও ইথিওপিয়ার সঙ্গে তা হুবহু মিলে গেছে। কারণ অপুষ্টি কখনও কাঁটাতার বা সময়গ্রন্থি বোঝে না। খিদেকে যেভাবে দমিয়ে রাখতে পারেনি রাষ্ট্র। অথচ, খিদের দারুণ রিচ। ভিউয়ারশিপ দুর্দান্ত। কেন? আমরা অপরের দুঃখে দুঃখী হতে ভালোবাসি। মানবের ধর্ম। আহা গো, মানুষ বড় কাঁদছে বলামাত্রই আমাদের রক্তে যেন সমবেদনার বান ডাকে! যৌনকামনার মতো।

ছবিঋণ: ইন্টারনেট

মনে পড়ছে, মৃণাল সেনের ছবি ‘আকালের সন্ধানে’? ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায় চলচ্চিত্র-পরিচালক। দুর্ভিক্ষের ছবি বানাতে চায়। অভিনেতাদের সামনে একের পর এক দুর্ভিক্ষের ফোটোগ্রাফ হাজির করছে সে। চোখ কখনও স্ট্রেট ক্যামেরায়। কখনও বাইরে। অন্য চরিত্রের ওপর। সিগারেটের ধোঁয়া উড়ছে। হাসির রোল। আয়েশ করে দুর্ভিক্ষ উপভোগ করছিল। আর তাকাচ্ছিল আমাদের দিকে। সে-মুহূর্তেই একজন জিজ্ঞেস করে, রাতে কী খাবেন? চিকেন আর ফ্রায়েড রাইস বলি?

দুর্ভিক্ষের ছবি তৈরি করতে চেয়ে, না খেয়ে মরতে হবে– এমনটি বলছি না মশাই। বলাটাও কাম্য নয়। আমাদের সকলের পরিণতিই তবে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প-চরিত্র মৃত্যুঞ্জয়। মৃণাল সেন বলতে চাইলেন, দারিদ্রের সঙ্গে সিম্প্যাথির যোগসূত্রটা ঠিক কতখানি ঠুনকো। সাময়িক। বিস্মৃতপ্রায়। কারণ উই আর প্রিভিলেজড!

Poverty Porn | World News, Latest and Breaking News, Top International News Today - Firstpost
ছবিঋণ: ইন্টারনেট

ইউটিউবের পপুলার কন্টেন্ট দারিদ্র। একটি ছেলে বেছে নিয়েছে ব্যারাকপুর স্টেশন। প্ল্যাটফর্মই যাদের ঘরবাড়িসুখ, ছেলেটি প্রত্যেককে বিরিয়ানি বিলোচ্ছে প্যাকেট প্যাকেট। পেছনে ভিডিওগ্রাফার। সিনেম্যাটিক শট। হেবি এডিট। দারিদ্রের জন্য স্পেশাল এস্থেটিক এফেক্ট। দুরন্ত দুঃখী আবহসংগীত। ২০ মিনিটের ভিডিও। ২০ লাখ ভিউ। শেষে, এইরকম আরও ভিডিও দেখতে চাইলে, চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করে আমার পাশে থাকুন। অর্থাৎ, আমাকে দেখুন। এ-হেন দারিদ্রের উদযাপন করে ছেলেটি মাসে দু’-বার মন্দারমণি ঘুরে আসে। লাক্সারি হোটেল। সুইমিং পুল। বেড-টি। লক্ষ্মীর আপডেটেড ভার্সান কি এমনই? ভাতের দাবি, চাকরির দাবি– উৎকৃষ্ট মিম? অনুক্রোশ শব্দটির গূঢ়অর্থ কি তলিয়ে গেল কমেন্টের চাপে?

দারিদ্রের বিনাশ– সে চিন্তা মস্তিষ্কে নেই। যে-সমস্ত বিদেশি ফোটোগ্রাফার কলকাতায় এসেছিলেন দুর্ভিক্ষের ছবি তুলতে, সকলে ছবিটুকুই তুলে নিয়ে গেছেন। ডলারে বিক্রি করেছেন। যাবতীয় অনুভূতি শুধু ট্রিগার্ড হয়েছে। অথচ, ‘আকালের সন্ধানে’ ছবিতে, শ্রীলা মজুমদারের মুখ আমাদের তাড়া করেনি কোনও দিন। দুঃস্বপ্নেও না। দারিদ্র একটা সুদৃশ্য পুতুল যেন! শো-কেসে সাজিয়ে রেখেছি দশক দশক। ফিরে আসি ভাতকাপড়ের ভাবনা ও কয়েকটি আটপৌরে দার্শনিক প্রয়াসে। ফরাসি দার্শনিক জাক রঁসিয়ের শ্রম-সংক্রান্ত একটি প্রবন্ধের কথা উল্লেখ করে অরিন্দম চক্রবর্তী লিখছেন: যদি আমরা সত্যি-সত্যিই শ্রমিকদের নিজের কণ্ঠে বলা দর্শন ও কাব্য শুনতে পেতাম, শ্রমিকের জবানিতে দার্শনিক তাত্ত্বিকের কথা নয়, তবে জানা যেত বৈষম্যের দাঁত কী কুৎসিত ক্ষত তৈরি করেছে… ‘শ্রমিক’ ধারণাটি যখন হাড়-মাংসের পোশাক পরে মূর্ত হয়ে দাঁড়ায়, তখন ‘ওরা তো কথা বলে না। ওদের সময় নেই। ওরা বড্ড বেশি ক্লান্ত।’

Is poverty porn over? Towards a new era of fundraising campaigns – Eye on Global Health
ছবিঋণ: ইন্টারনেট

কথা বলে না– এই কপট ধারণা থেকেই সহজে ছবি তুলে নেওয়া যায়। কারণ, কনসেন্ট আবার কী? ওরা তো অনুগত। খেতে দিচ্ছি। ‘না’ বলার মুরোদ আছে! হে পাঠক, চ্যারিটি করে দেশ চলে না। রাজ্যও না। ক্ষুধাসূচকে আমাদের স্থান: ১০৫।

……………………………………………….

আরও পড়ুন সম্প্রীতি চক্রবর্তী-র লেখা: অরন্ধন কেবল ব্রত নয়, মহিলাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সংগঠিত করার উপায়ও

……………………………………………….

দারিদ্র থেকে মুক্তি, সে দাবি হারিয়ে গেছে। দাবি বললেই যে আনুষঙ্গিক প্রসঙ্গ ইত্যাদি এসে পড়ে, তার মধ্যে অন্যতম, পভার্টি পর্নোগ্রাফির পেছনে ঝেড়ে লাথি। কিন্তু মারবেটা কে? রফিক আজাদের একটি কবিতায় লিখেছিলেন, ‘ভাত দে হারামজাদা, তা না হলে মানচিত্র খাবো’। অত্যন্ত বৈপ্লবিক। রক্তে আগুন জ্বালতে বাধ্য। এ-ও নিশ্চয়ই কোনও প্রিভিলেজ অবস্থানে বসেই লেখা। যেমন লিখছি আমিও। কারণ এ-লেখা পৌঁছবে না দারিদ্র অবধি। যদি পৌঁছত, সেই পরিসরটুকু পেত, তবেই বিপ্লব। তবেই লক্ষ্মী। তবেই না কোজাগরী!

…………………………………………

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল

…………………………………………