‘আমি’র মুক্তি যিনি ঘটাতে পারেন তিনিই শিক্ষক, তাঁকে দেখে আমাদের ভরসা হয়; এই তো একজন আছেন… তাহলে মানুষ পারেন… আমিও পারব। মানুষই পারে সীমানাকে পেরিয়ে যেতে। হয়তো একই ধরনের নয়, ভিন্ন ভিন্ন; কিন্তু একটা গণ্ডি আমাদের সকলের থাকে… আর সেই গণ্ডিকে প্রসারণ করার জন্যই চাই ঈশ্বর পণ্ডিত, রবীন্দ্রনাথ, উদয়ন পণ্ডিতদের… যাঁরা কেবলই সে-রেখাকে পেরিয়ে গিয়ে ‘উদার পৃথিবীর’ দিকে আমাদের নিয়ে যাবেন…
একদিন ছোট্ট একটা টবে একজন চারাগাছ লাগিয়েছিলেন, সেই চারাগাছ একদিন প্রকাণ্ড গাছে পরিণত হল, মালি বলেছিলেন, ‘খুব যদি বাড়্ বেড়ে ওঠে/ দাও ছেঁটে দাও সব মাথা/ কিছুতে কোরো না সীমাছাড়া/ থেকে যাবে ঠিক ঠান্ডা চুপ–’ (রাধাচূড়া/ শঙ্খ ঘোষ) কিন্তু মালি যা বলেননি সেটা হল, ‘সেই বাড়্ নীচে চারিয়ে যায়/ শিকড়ে শিকড়ে মাথা খোঁড়ে, আর/ এখানে-ওখানে মাটি ফুঁড়ে/ হয়ে ওঠে অন্য এক গাছ’। আর তখন ইতস্ততের চোরা টানে ভেঙে যায় টব। বাগানবিলাসির বাগান শূন্য বুকে শ্রান্ত চোখে চেয়ে থাকে।
আর ওই ইতস্তত চোরা টানের নান্দীমুখ করতেই আবির্ভাব হয় উদয়ন পণ্ডিতদের। তাই উদয়ন পণ্ডিতের মৃত্যু নেই… তাঁদের সক্রিয়তায় বন্ধ হয়ে যায় রাজার যন্তর মন্তরের কাজ। তাই রাজা বলেন ‘লেখাপড়া করে যে, অনাহারে মরে সে’… ‘ওরা যত বেশি পড়ে, যত বেশি জানে, তত কম মানে’। মাস্টারমশাইকে হয়তো সাময়িকভাবে আত্মগোপন করতে হয় পাহাড়ের গুহায় কিন্তু ততদিনে আগামী প্রজন্ম তৈরি হয়ে যায়; তারা পারে শান্ত গলায় প্রত্যয়ী সজীব শরীরীভাষায় বড় একটা মুক্তির জন্য ছোট ছোট কিছু পাওয়াকে অতিক্রম করতে; তারা জানে নিজেদের সুখকে স্বচ্ছন্দকে মুলতবি রাখতে…
সকলেই যে নিজেকে বিসর্জন দিতে পারেন নয়, কেউ কেউ পারেন নিজেকে সঁপে দিতে অন্য সকলের জন্য। কিন্তু যখন কোথাও থেকে বেজে উঠে মুক্তির বাঁশি, তখন ওই বাঁশি বাজাতে না পারলেও ইচ্ছেমন্ত্রকে সঙ্গী করে সেই পথে এগিয়ে যেতে পারা যায়… হোক তা দুর্গম।
‘আমি’র মুক্তি যিনি ঘটাতে পারেন তিনিই শিক্ষক, তাঁকে দেখে আমাদের ভরসা হয়; এই তো একজন আছেন… তাহলে মানুষ পারেন… আমিও পারব। মানুষই পারে সীমানাকে পেরিয়ে যেতে। রবীন্দ্রনাথের অচলায়তন-এ দু’টি শব্দ ঘুরে ফিরে বারবার আসে: আকাশ আর পাথর। পাথরের ছবি আসে আচার্যের দ্বন্দ্বাতুর বেদনায় আর আকাশের আনন্দ উদ্ভাসিত হয় পঞ্চকের নির্ভার সহজ চলার ছন্দে। রক্তকরবী-তে রঞ্জন কাজ করতে পারে নন্দিনীর ভালোবাসার জোরে, আর নন্দিনী সকলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতে পারে রঞ্জনের ভালোবাসার জোরে। কিন্তু রাজা! তিনি নন্দিনীকে ভালোবাসতে চেয়েছিলেন নিজের জন্য: হয় আমি পেতে চাই, নয়তো ভেঙে চুরে ফেলতে চাই– এই পেতে চাওয়া, অধিকার বোধ, আত্মসাৎ করা– এইটা নিয়ে আমরা যখন ভালোবাসি তখন সেটা আর ভালোবাসা নয়, সেটা ‘আমি’-র রুদ্ধতা। রাজা যখন চাইলেন রঞ্জন নন্দিনীর কাছে আসুক, ততক্ষণে সব শেষ… তবে রাজা বুঝেছেন: আমার যন্ত্র আমাকে মানছে না। ‘আমি’র সঙ্গে ‘না-আমি’র যোগ তৈরি না হলে সম্পূর্ণ হওয়া যায় না। স্বেচ্ছাচার কেবল রাষ্ট্রীয় সমস্যা নয়, এর ভেতরকার নির্জীবতা, স্তুতিকাতরতা, ভয়, শাসন রন্ধ্রে রন্ধ্রে সাজানো আছে আমাদের এই সমাজের, আমাদের এই পরিবারের, সকল স্তরেই।
এই তন্ত্র থেকে চাই সত্যিকারের মুক্তি। আর কী আশ্চর্য! এই মুক্তি আনতে পারে কেবল সংযোগ। আমরা একই সঙ্গে দু’টি তলে থাকি; একদিকে সমাজকে ছুঁয়ে থাকি, অন্যদিকে নিভৃতে ‘আমি’ র কাছে পৌঁছোতে চাই। সমাজের সঙ্গে বি-যোগ ঘটিয়ে ‘আমি’র বোধন হয় না! তাই সমাজ-সংগঠনই মূল লক্ষ্য। আমি আমার পাশের মানুষ, পাশের দেশ, গাছপালা, নদী, পাহাড়, না-মানুষ, মাটি, আকাশ, তারাদের না-ভালোবেসে নিজেকে ভালোবাসব কেমন করে? শিক্ষক সেই ভালোবাসার সেতু। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বুঝেছিলেন সবল কাণ্ডজ্ঞান না থাকলে সমাজ প্রগতি অসম্ভব। তাঁর একাকী আন্দোলনের মূল মন্ত্র ছিল তাই শিক্ষার উদযাপন… তুচ্ছতা, ক্ষুদ্রতা, নিষ্ফল আড়ম্বর ভুলে, সূক্ষ্মতম তর্কজাল এবং স্থূলতম জড়ত্ব বিচ্ছিন্ন করে, সরল সবল অটলভাবে কাজ করে যাওয়া।
পরাধীন ভারতে ডাক্তার রাধাগোবিন্দ কর ভেবেছিলেন একটা মেডিক্যাল কলেজ করা গেলে দেশের গরিব মানুষেরা সুচিকিৎসা পাবেন। সেই স্বপ্নকে সফল করতে নিজের সর্বস্ব দিয়ে নির্মাণ করলেন হাসপাতাল।
আগামী প্রজন্মের স্বপ্নের ছোঁয়া পেলে কখনও কখনও আগের প্রজন্মের মধ্যেও সজীব প্রাণ সঞ্চার হয়। আবার স্বপ্নগুলো ভেঙে গেলে শিক্ষকের বুকে বাজ পড়ে… সেই বিদ্যুৎরেখায় খান খান হয়ে যায় মেঘ… সেই মেঘ ভাঙা বৃষ্টিতে প্লাবন আসে…
শিক্ষক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ডাক্তার রাধাগোবিন্দ কর অনুভব করলেন… তাঁদের ছাত্রসমাজ এখনও শিরদাঁড়া হারায়নি… প্রতিবাদের উদযাপনের উৎস থেকে অন্ধকার আকাশে আলোর বোধন হয়েছে… সেই আলোতে জেগে উঠেছে নতুন একটা ‘আমরা’।
হয়তো একই ধরনের নয়, ভিন্ন ভিন্ন; কিন্তু একটা গণ্ডি আমাদের সকলের থাকে… আর সেই গণ্ডিকে প্রসারণ করার জন্যই চাই ঈশ্বর পণ্ডিত, রবীন্দ্রনাথ, উদয়ন পণ্ডিতদের… যাঁরা কেবলই সে-রেখাকে পেরিয়ে গিয়ে ‘উদার পৃথিবীর’ দিকে আমাদের নিয়ে যাবেন… ওই আলোর পথযাত্রী হয়ে আমরাও বিরাট হৃদয়লোকের দিকে বাড়িয়ে দেব হাত… এগিয়ে যাব ব্যক্তি থেকে সমাজে, সমাজ থেকে দেশে, দেশ থেকে পৃথিবীতে, পৃথিবী থেকে বিশ্বলোকে…