Robbar

স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি পদে ব্যর্থতার অভিমানে কখনও আসক্তি জন্মায়নি বীণা দাসের

Published by: Robbar Digital
  • Posted:August 26, 2025 7:38 pm
  • Updated:August 26, 2025 7:52 pm  

প্রতি পদে ব্যর্থতার অভিমানে আসক্তি জন্মায়নি কখনও, গ্রামে গ্রামে ঘুরে দরিদ্র কৃষককে স্লেট-পেনসিল নিয়ে লেখাপড়া করিয়েছেন, উদ্যোগ নিয়েছেন প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলার। গান্ধীর সাথে পা মিলিয়ে রবীন্দ্রসংগীত গাইতে গাইতে ঘুরেছেন দাঙ্গাবিধ্বস্ত অঞ্চল। কংগ্রেসের মূল স্রোতের সাহায্য ছাড়াই ইস্পাত-কঠিন মনোভাব নিয়ে ধর্মঘট করে স্থাপন করেছেন অমৃতবাজার পত্রিকার ইউনিয়ন; শ্রমিকের দাবিকে দৃপ্তকণ্ঠে পেশ করেছেন কর্তৃপক্ষের কাছে।

বিদিশা বিশ্বাস

১.

“প্রকৃত নারীবাদী চেতনার বিকাশ কিন্তু রয়েছে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের গভীরে। সে আমেরিকায় ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনেই হোক বা ফ্রান্স ও অন্যান্য দেশে ১৯৬৮-র বিদ্রোহের পরিণামেই হোক, মেয়েরা সেখান থেকেই নিজেদের শক্তি টের পেতে শুরু করে। ধনতন্ত্র যে গোটা দুনিয়ার গরিব মানুষের ওপর আধিপত্যের দিকে যেতে বাধ্য, একথা বুঝতে পেরে বহু মেয়ে শ্রেণিসংগ্রামে অংশ নিতে শুরু করে। যদিও তারা হয়তো সেভাবে ‘শ্রেণিসংগ্রামে’র অভিধা স্বীকার করে না। তারা-ই কর্মী। তারা মিছিলে হাঁটে, সভা-সমাবেশে যোগ দেয়, প্রচার করে, গোপন দলে গিয়ে ভেড়ে, জঙ্গি বামপন্থীতে পরিণত হয়। যে কোনও পুরুষের মতো তারা শোষণহীন, বিচ্ছিন্নতারোধী এক ভবিষ্যতের জন্য লড়ে। কিন্তু কী হলো তাতে?”– ‘The Second Sex’ প্রকাশের প্রায় ২৫ বছর পর ১৯৭৬ সালে একটি সাক্ষাৎকারে সিমন দ্য বোভোয়া একথা বলছেন, সঙ্গে এ-ও বলতে দ্বিধা করছেন না মোটেই, ‘আজ আমি অনেক বদলেছি … এখন আমি সত্যি নারীবাদী’।

এর ঠিক ১০ বছর পর অর্থাৎ ১৯৮৬-র ডিসেম্বরে স্রোতস্বিনী গঙ্গার তীরে হৃষীকেশ, পথচলতি মহিলার পায়ে ঠেকে একটি পচনশীল মৃতদেহ। ঠাহর করা যায় না, যায়নি, যতক্ষণ কলকাতা থেকে দীর্ঘদিন তাঁর কোনও খোঁজ না-পাওয়া পরিজন তাঁর টুকটাক ‘সামান’ চিহ্নিত করেন। এই দীর্ঘ কালান্তর পার করে জানা যায়, ইনিই বীণা দাস, বিপ্লবী, গোটা জীবন দেশের নামে উৎসর্গ করে যাঁর কপালে জুটেছিল ওই করুণ পরিণতি। 

জন্মভূমি ছিল চট্টগ্রাম, বাবা বেণীমাধব দাস চাকরিসূত্রে কলকাতায় চলে আসেন। ছোটবেলা থেকে নিজভূমের গল্প শুনে বেড়ে উঠেছেন, যাওয়ার সুযোগ হয় অনেক পরে, বাংলা ভাঙার প্রাকমুহূর্তে, নিজেদের সাড়োয়াতলী গ্রামে, বাবা আর ভাইয়ের হাত ধরে ঘুরে দেখেছেন চন্দ্রনাথ পাহাড় থেকে সহস্রধারা, সীতাকুণ্ড, বাড়বকুণ্ড, কর্ণফুলী নদীর মোহনা বরখল অবধি। বঙ্গভঙ্গের যন্ত্রণায় প্রায় কুঁকড়ে বলছেন, ‘বাঙলা বিভাগের কথা স্থির হয়ে যাওয়ার পর মনে মনে ঠিক করে ফেললাম, চট্টগ্রামে এখন আরো বেশি করেই আসা-যাওয়া করতে হবে আমাদের– পিতৃভূমির ঋণ বেশি সুদে শোধ করার সময় এসেছে।’

মা সরলা দেবী ছিলেন দৃঢ়চেতা, মেয়েদের নিয়ে একটি সমিতি তৈরি করেন, যার মাধ্যমে দুঃস্থ মেয়েদের পড়াশোনা, সঙ্গে সেলাই শেখানো হত। এমনকী এদের জন্য বহু প্রতিকূলতা এবং অভাব পেরিয়ে একটি আশ্রমও তিনি তৈরি করেন। বাড়িতে বড় দাদা সত্যাগ্রহ আন্দোলনে জড়িয়ে পরে জেল খেটেছেন, দিদি কল্যাণী ভট্যাচার্য্য দেশের জন্য কাজ করে চলেছেন, গড়ে তুলেছেন ছাত্রী সংঘ নামের স্বেচ্ছাসেবিকার দল, পরে তাঁরাই ১৯২৮-এর কলকাতা কংগ্রেসের বিভিন্ন অফিসার পদে নিযুক্ত হন। অন্যদিকে সুভাষচন্দ্র ছিলেন বাবার ছাত্র। বাড়িতে আসা-যাওয়া লেগে থাকত তাঁর। স্বাভাবিক চালেই বীণা বড় হয়েছেন খোলামেলা সহজ পথে। দেশের মুক্তির জন্য কাজে লেগে পড়ার সিদ্ধান্ত তাঁর জন্য একেবারেই দুরূহ ছিল– একথা বলা যায় না। মেয়েবেলার বছরগুলিতেই তার প্রাণে বেজে ওঠে দেশমুক্তির সুর। যে কথা বারবার স্মরণ করতে হবে– দেশের মুক্তি শুধু যে বিদেশি শক্তির হাত থেকে, তা নয়, বীণা সর্বান্তকরণে চেয়েছেন– দেশ মুক্ত হবে দারিদ্র থেকে, অশিক্ষা থেকে, ধর্মীয়-জাতি-লিঙ্গ বিভাজন থেকে। 

২.

মাত্র ২১ বছর বয়সে বি.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বীণা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশন প্রাঙ্গণে যে মাহেন্দ্রক্ষণে হাতে পেতে পারতেন ইংরেজি অনার্স নিয়ে পাশ করার সার্টিফিকেট– সেই অনায়াস নিশ্চিন্তির জীবনকে টোকা দিয়ে উড়িয়ে সঙ্গে করে লুকিয়ে নিয়ে যান বন্ধুর থেকে জোগাড় করা রিভলভার; উদ্দেশ্য বাংলার তৎকালীন গভর্নর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে হত্যা। পাঁচটি গুলি ছোড়েন, প্রতিটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়– টানা ৯ বছর জেলের সাজা হয় বীণার। আদালতে বুক ঠুকে বলে আসেন, ‘আমি নিশ্চিত, স্ট্যানলি জ্যাকসন মানুষ হিসেবে হয়তো আমার পিতার মতোই, কোনও ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে নয়, আমি তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছি কারণ যে সমাজব্যবস্থা আমার দেশে লাখো মানুষকে দাসত্বের শেকল পরিয়ে রেখেছে, উনি সেই ব্যবস্থারই প্রতিনিধি।’ আজ প্রায় ১০০ বছর পর পৃথিবীর তাবৎ মেহনতি মানুষ যখন শোষণভারে নিষ্পেষিত, প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে গভীর থেকে গভীরতর অন্ধকারে তলিয়ে যেতে যেতেও কি একটিবার এই আহ্বান পেয়েছি অন্তর থেকে? দেওয়ালে পিঠ থেকে গেছে সেই কবে, তবু সয়ে যাওয়ার এই অপমানের আঁচ স্পর্শও করতে পারেনি আমাদের পুরু চামড়া। 

শুধু বর্তমান নয়, বীণা সময়কে চিনেছেন তার প্রবহমানতায়।

‘সেই পুরাকাল থেকে দিল্লীতে একে একে সাতটা রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, আবার কালের স্রোতে বিলীন হয়ে গেছে বুদবুদের মতো। যুধিষ্ঠিরের ইন্দ্রপ্রস্থ থেকে পঞ্চম জর্জের দিল্লী– কী বিরাট ব্যবধান মাঝখানে, কত যুগ, কত অব্দ, কত যুদ্ধ-বিগ্রহ, শান্তি স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। ছেলেবেলা থেকে মুখস্থ করা সমস্ত ইতিহাস দিল্লীর প্রান্তরে গিয়ে দাঁড়ালে একসঙ্গে কথা কয়ে ওঠে… চোখে ভেসে ওঠে দেওয়ান-ই-আমের বিরাট রাজদরবারে সম্রাজ্ঞী নূরজাহান আর সম্রাট জাহাঙ্গীর সপারিষদ বসে রয়েছেন: সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সমুদ্রপাড়ের মুষ্টিমেয় কয়েকটা শ্বেতাঙ্গ বণিক– সম্রাজ্ঞী আর সম্রাটের কাছে করজোড়ে ভিক্ষা জানাচ্ছে একটুখানি বাণিজ্যের সুবিধের জন্য– আর কিছু নয়। তারপর দ্রুত পটপরিবর্তন… সিপাহী-বিদ্রোহের রোষবহ্নি নিভে গিয়েছে, দিল্লীর পথে পথে তখনও কিন্তু রক্তের দাগ। এবারও রাজসভায় নতুন পরিবেশ, ভারতবর্ষের ভাগ্যদণ্ড হাতে নিয়ে সেখানে সদম্ভে বসে রয়েছেন কয়েকজন অভারতীয় শ্বেতাঙ্গ পুরুষপুঙ্গব। আর তাদের সামনে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে ভারতবর্ষের শেষ স্বাধীন সম্রাট বাহাদুর শা– হাত তাঁর শৃঙ্খলিত, পায়ে লৌহদণ্ড। সে তো শুধু বাহাদুর শা-র মূর্তি নয়, এই মূর্তির মধ্যে সেদিন ফুটে উঠেছিল ভারতবর্ষের কোটি মানুষের ভবিষ্যতের ছবি।’

স্ট্যানলি জ্যাকসন

১৭-১৮ বছর বয়সের বীণা একদিন সুভাষকে প্রশ্ন করেন, ‘আচ্ছা, আপনার কী মনে হয়, কীভাবে দেশ স্বাধীন হবে– হিংসার পথে নাকি অহিংসার পথে?’

সপ্রতিভ সুভাষচন্দ্র উত্তর দেন, ‘আসল কথা হচ্ছে একটা কিছু পাবার জন্য আগে পাগল হয়ে উঠতে হয়। স্বাধীনতার জন্য আমাদেরও সারা দেশটাকে তেমনই পাগল করে তুলতে হবে। তখন হিংসা-অহিংসার প্রশ্ন বড় হয়ে উঠবে না।’

এই পাগলামোর মন্ত্রেই দীক্ষিত বীণা লাগাতার লড়ে গেছেন সমাজ বদলের কাজে। ছুটে বেরিয়েছেন দেশের কোণায় কোণায়। কোনও ভাসা আবেগ থেকে নয়, সংস্কারের প্রকৃত অর্থের শিকড়ে পৌঁছে পাল্টে দিতে চেয়েছেন শাসনযন্ত্রকে। 

‘আমাদের মুক্তির ইতিহাসে মহাত্মাজীর দানকে ছোটো করে দেখার নির্বুদ্ধিতা আমার নেই, তাঁর অসহযোগ অস্ত্রের উপযোগিতা এই নিরস্ত্র দেশে দাঁড়িয়ে অস্বীকার করবে কে? তবু বলতে চাই ১৯০৮ সাল থেকে সেই ক্ষ্যাপা তরুণের দল যদি জাতির হৃদয়কে এমনি করে মৃত্যুবরণের জন্য, দুঃখবরণের জন্য, ঘুম ভাঙিয়ে প্রস্তুত না করে যেত, মহাত্মাজীর অসহযোগ অস্ত্র ধারণ করবার মতো শক্তি দেশের লোকের হত কিনা সন্দেহ… ভারতবর্ষের মুক্তির ইতিহাসে শুধু তাঁর নাম (মহাত্মা গান্ধী) ও তাঁর কাজ লেখা থাকলেই সে ইতিহাস সম্পূর্ণ হবে না। সেখানে থাকতে হবে বাঘা যতীনের কথা, চট্টগ্রাম-অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের গৌরবময় অধ্যায়, নেতাজীর ইম্ফল-অভিযানের কাহিনী। বাদ পড়বে না মেদিনীপুর, বালুরঘাট, সাতারা, বালিয়ার জাতীয় সরকার গঠনের ইতিহাস: স্বকীয় অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পুলিশের গুলির মুখে দরিদ্র মজদুর-কিষাণের অবিচল দাঁড়িয়ে থাকার কথা।’

৩. 

কেবল নিজেকে সমর্পণই নয়, বীণা দাস ইশকুল-বয়স থেকেই জড়িয়ে পড়েছেন বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে– ছাত্রী সংঘ এবং পরবর্তীতে গুপ্তসমিতি ‘যুগান্তর’ তাদের মধ্যে অন্যতম। প্রধান কাজ ছিল অর্থ, অস্ত্র সংগ্রহ এবং আরও আরও মেয়েদের দলে টানা। কখনও সফল হয়েছেন, কখনও জুটেছে প্রিয় সই-এর প্রত্যাখ্যান। কোনও কিছুই তাঁকে সংগ্রামের পথ থেকে সরাতে পারেনি। অর্থ জোগাড় করতে লেখালেখি করেছেন, লটারির টিকিট বিক্রি করেছেন, টিউশনি করেছেন, কোনওটাই ফলপ্রসূ হয়নি। তবু অটল মনের মধ্যে টিক টিক করে বেজে চলেছে সেই মন্ত্র– “‘তোমরা হচ্ছ প্রফেশনাল রেভলিউশনারি– এ কথাটা কখনও ভুল না যেন।’ ভুলিনিও আমরা। তাই কোথায় গেল আমাদের ছাত্রীজীবনে ভালো করে পাশ করার আকাঙ্ক্ষা, কোথায় ভেসে গেল ছেলেবেলার ভবিষ্যতের সোনায় আঁকা স্বপ্নগুলো। দেশের স্বাধীনতা যতদিন না আসছে, দেশের মানুষের লাঞ্ছনা আর দুর্গতি যতদিন না ঘুচছে, ততদিন দেশের তরুণ-তরুণীর সুখী হওয়ার কোনও অধিকার নেই– ব্যক্তিগত জীবনযাপনের কোনও অবকাশ নেই।” এই নৈর্ব্যক্তিক চেতনার গ্রন্থন যে কোন জাদুকাঠির ছোঁয়ায় সম্ভব, আজ ভাবতে বিস্ময়ও বোধহয় জাগে না, অবিশ্বাস্য মনে হয়।

স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সমাবর্তনে উপস্থিত বীণা দাস

ন’ বছরের জেলজীবন সাত বছরে শেষ হয় গান্ধীজির হস্তক্ষেপে। সাত বছরের কারাগারবাসকালীন যাপনের ওঠাপড়া, অবর্ণনীয় অত্যাচার, ধুঁকতে ধুঁকতেও না মরে বেঁচে ওঠা জীবন, আরও কত রাজবন্দি এমনকী নিতান্ত খুনে আসামির প্রতি নিটোল দরদ এবং একেবারে গোড়া থেকে সেই জীবনসকলের নিপাট বিশ্লেষণ আদপে চিনিয়ে দেয় মানুষের সঙ্গে তাঁর নিবিড় প্রাণের যোগ– যা আসলে তাঁর সাংগঠনিক চরিত্রের পরিচয় বয়ে নিয়ে আসে। জেলমুক্তির পর সাত বছরের তফাতে আমূল বদলে যাওয়া জীবন দেখে অবসরের পরিবর্তে নয়া উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়েন সাংগঠনিক কাজে। হাতেখড়ি হয় টলিগঞ্জ চালকল শ্রমিক কলোনিতে– ঘুরে ঘুরে তাদের একজোট করার কাজে, সেখানকার বাচ্চাদের পড়ানোর কাজে, মেয়েদের শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সাহস জোগানোর কাজে উদয়াস্ত লেগে থাকেন বীণা। এই তাড়িতের দেশে, এই ক্ষুধার্তের দেশে মানুষকে তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন করাই তাঁর প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়, ‘মানুষকে মানুষের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার চেয়ে বড় পাপ যদি না থাকে, শুধু ভারতবর্ষকে কেন্দ্র করে যে পাপের স্তূপ জমে উঠেছে, তারই ভারে সমস্ত পৃথিবীর রসাতলে যাওয়া উচিত ছিল, যায় না কেন?’ আসলে জীবনকে কালেকটিভের আধারে দেখার শিক্ষাই তাঁকে ধীরে ধীরে পৌঁছে দেয় সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসের দ্বারপ্রান্তে। শাণিত দীপ্তিতে বলেন, ‘১৯৩২ সালের রাজনীতি আর ১৯৪০ সালের রাজনীতি এক নয়। দেশের অবস্থা আগাগোড়া বদলে গেছে। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ছড়িয়ে পড়েছে জনসাধারণের মধ্যে। চারদিকে দেখা দিয়েছে কিষাণ আন্দোলন, মজদুর আন্দোলন। রাস্তায় ঘাটে প্রায়ই চোখে পড়ে লাল ঝান্ডার শোভাযাত্রা। কম্যুনিস্ট পার্টির প্রভাব তখন যুব সমাজে খুব বেশি। একটা নতুন আদর্শ, নতুন সমাজব্যবস্থার ছবি সামনে রেখে দেশের বিপ্লবী মনকে তা আকৃষ্ট করে নিচ্ছে।’ বীণার উর্বর মস্তিষ্ক বুঝে নিচ্ছে কমিউনিজমকে স্থানোপযোগী ও সময়োপযোগী করার প্রয়োজনীয়তা, “ভারতের জলমাটির সঙ্গে মিশিয়ে, এখানকার সমস্যার সঙ্গে খাপ খাইয়ে কম্যুনিজমকে এদেশের মাটিতে রোপণ করা যায় কিনা– অনেকেই এই প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে লাগলেন। মার্ক্সের নীতিকে লেনিন দেশ-কাল-পাত্রের সঙ্গে খাপ খাইয়ে রাশিয়ায় রূপদান করেছিলেন। ভারতবর্ষের নেতৃত্বের সামনেও সেই কর্তব্যই সেদিন এসে দেখা দিল– এখানে রাশিয়ার ‘মাছিমারা অনুকরণ’ করতে গেলে সমস্যার যে সমাধান হবে না– স্থানীয় অবস্থার উপযোগী করে নতুন করে যে মার্ক্সিজমের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা দরকার– একথা অনেকেরই মনে হতে লাগল। ‘মার্ক্সিজম ইস নট এ ডেড ডগমা– ইট ইস অ্যান এভার ইভলভিং প্রিন্সিপল’।” 

৪.

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর, ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যে তার প্রভাব ভিন্ন হলেও, জার্মানির রাশিয়া আক্রমণ– গোটা দেশ, বিশেষত বাংলার মানুষকে ফ্যাসিজম বিরোধী করে তোলে। চিনের তৎকালীন অধিনায়ক চিয়ানকাইশেক, আমেরিকার সাংবাদিক লুই ফিশার ভারতের স্বাধীনতার দাবিকে প্রকাশ্যে সমর্থন করলেও দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন মত তার একতার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। এই সময় বাংলার মানুষকে এক করতে দক্ষিণ কলকাতার কংগ্রেস কমিটির সম্পাদিকা বীণা দাস হাজরা পার্কে একটি সমাবেশের ডাক দেন, এবং সভা শুরুর আগেই গ্রেপ্তার হন– দ্বিতীয়বারের তিন বছরের কারাবাস। জেলের বাইরে তখন ১৩৫০-এর শোষকসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ। ভাতের অভাবে ফ্যানের জন্য হাহাকার, সেই নৃশংস যন্ত্রণার ঢেউ কারাগারেও আছড়ে পড়ে। বীণা তখন বন্ধু উমাকে চিঠি লিখে জানাচ্ছেন বাংলা হতদরিদ্র চাষিবউদের কথা, তাদের লড়াইয়ের কথা; গ্রাম থেকে মহাজনের কাছ থেকে বেশি দামে চাল কিনে কলকাতায় বিক্রি করতে এসে ধরা পড়ে জেলে এসে পড়ার একের পর এক হৃদয়ান্তক বর্ণনা। আসলে বীণা মানুষের মরম বোঝার চেষ্টায় ব্রতী ছিলেন, চরম মমতায় আপন করাই নয়, মানুষের মনের মুকুর হয়ে ওঠার আশ্চর্য বিরল ক্ষমতা ছিল তাঁর। বারবার বলেছেন জেলে ঢোকার সময় যে মানুষটি ঢোকেন, বেরনোর সময় কোনওভাবেই আর সেই পুরনো মানুষটিকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। কেউ ফুরিয়ে যান, কেউ-বা জীবনের নিগড়ে কোনওরকমে বেঁচে থাকা প্রাণশক্তিটুকু নিয়ে বেরিয়ে আসেন।

‘…জেলে শত আঘাত শত সংঘাতের মধ্যেও আমরা মাথা হেঁট করিনি, বেদনায় অভিভূত হইনি। অন্তরের গভীরতম স্থান থেকে একটা গোপন শক্তির উৎস আমাদের প্রতি মুহূর্তে শক্তি যুগিয়েছে, প্রেরণা দিয়েছে। সে উৎস আমাদের আদর্শ। নিজেদের আমরা কোনোদিনও বিচ্ছিন্ন করে, একক করে দেখতাম না। আমরা জানতাম, আমাদের জীবনের সেই অধ্যায়টুকু তার সমস্ত ভালোমন্দ, লাভ-ক্ষতি দিয়ে, জড়িয়ে রয়েছে একটা বিরাট জাতির জীবন-মরণের ইতিহাসের সঙ্গে। সেইখানেই ছিল আমাদের পরম সান্ত্বনা, আর স্বার্থকতার নিবিড় উপলব্ধি।’

তিন বছর পর আবারও বাইরের পৃথিবীতে পদার্পণ। ভারতবর্ষ বিভাজনের অন্ধকার অধ্যায়, দাঙ্গার অনল তার লকলকে শিখা নিয়ে দেশের বুক বিদীর্ণ করছে, বীণা ছুটে গেছেন নোয়াখালি, সন্দ্বীপ। ক্ষোভ উগরে লিখেছেন ‘ধর্মের লড়াই বিংশ শতাব্দীতে অচল, সে হিসেবে ভারতবর্ষের সভ্য সমাজে অপাংক্তেয় হয়ে থাকাই উচিত’। বিশ্বাস করেছেন এর ঐতিহাসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক আর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণই ধরিয়ে দিতে পারে এর আসল গলদ, আর তাতেই ক্লেদমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব, কারণ ‘টু আন্ডারস্ট্যান্ড ইস টু ফরগিভ’। প্রতি পদে ব্যর্থতার অভিমানে আসক্তি জন্মায়নি কখনও, গ্রামে গ্রামে ঘুরে দরিদ্র কৃষককে স্লেট-পেনসিল নিয়ে লেখাপড়া করিয়েছেন, উদ্যোগ নিয়েছেন প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলার। গান্ধীর সঙ্গে পা মিলিয়ে রবীন্দ্রসংগীত গাইতে গাইতে ঘুরেছেন দাঙ্গাবিধ্বস্ত অঞ্চল। কংগ্রেসের মূল স্রোতের সাহায্য ছাড়াই ইস্পাত-কঠিন মনোভাব নিয়ে ধর্মঘট করে স্থাপন করেছেন অমৃতবাজার পত্রিকার ইউনিয়ন; শ্রমিকের দাবিকে দৃপ্তকণ্ঠে পেশ করেছেন কর্তৃপক্ষের কাছে। 

৫.

দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রাক-মুহূর্তে ক্রমশ বুঝতে পেরেছেন কংগ্রেসের ব্যর্থতা– সমাজতন্ত্রের পথ থেকে তাদের ক্রমশ দূরে সরে যাওয়া, নতুন দেশ গঠনের কাজে অপটু হাতের নিদর্শন। ভেঙে পড়েছেন। কিন্তু কখনও আত্মসমালোচনায় পিছিয়ে থাকেননি– ‘অনেকখানি আমরা রক্ষা করতে পারিনি, হারিয়েছি নিজেদেরই ত্রুটি এবং অক্ষমতায়। কোথায় ত্রুটি সবসময় বুঝতেও পারতাম না, তবে এটা ঠিক বুঝতাম আরও বৈশিষ্টপূর্ণ ব্যক্তিত্ব থাকা আমার উচিত ছিল, আরও প্রখরতর বুদ্ধি।’

১৯৪৭-এ বিয়ে করেছেন বিপ্লবী যতীশচন্দ্র ভৌমিককে। তারপর প্রায় অবগুণ্ঠনে বাস। স্বাধীন সরকারের পেনশন প্রত্যাখ্যান করেছেন দু’জনায়। যতীশচন্দ্রের মৃত্যুর পর একাকী নিরিবিলি জীবন কাটাতে পাড়ি দিয়েছেন বেনারসে, সেখান থেকে হৃষীকেশ। তাঁর শেষ জীবনের ইতিহাস অজ্ঞাত। তাঁর জন্মদিবস অতিবাহিত হয়েছে সদ্য। তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর ধৃষ্টতা আমাদের অর্জিত নয়; আমরা এক অন্য সময়ের ফসল– ইতিহাস উপড়ে আকণ্ঠ বিষপানে নীল শরীর নিয়ে অপেক্ষা করে চলেছি অদূর মৃত্যুর, যাতে শেষ হবে একে একে কোটি কোটি মানুষের ব্যর্থ জীবন; পৃথিবীর রং রস গন্ধ লুটেপুটে আহরণ করেছি কেবল– ফেরত দিইনি এক বিন্দুও। এই প্রবলা ধরণীর কাছে কীটপতঙ্গের থেকেও নগণ্য এই সকল জীবন এই সুযোগে সামান্য ক্ষমাপ্রার্থী হতেও কি চাইবে না? লজ্জা, কেবল শরীরময় লজ্জাই কি আমরা আপন করব না? আবার কি কানে বেজে উঠবে না, ‘জীবনদেবতার অভয়শঙ্খ আবার আমাদের আলোর মাঝে, মুক্তির মাঝে টেনে নিয়ে এল। সামনে অন্তহীন পথ উন্মুক্ত করে বলল, এগিয়ে চলো, এগিয়ে চলো, চলা আজ তোমাদের শেষ হয়নি। পথের শেষে আজও পৌঁছওনি। তোমাদের অসমাপ্ত কাজ সম্পূর্ণ করো। যারা জীবনের ব্রত অসম্পূর্ণ রেখে মরণের পরপারে চলে গিয়েছে তাদের– তোমাদের সেই হারানো সঙ্গীদের– ধূলায় লুটানো নিশান আবার তোমরা হাতে তুলে নাও। অনওয়ার্ড! ওভার দ্য গ্রেভস অফ ইওর কমরেডেস।’ 

স্বাধীনতা এখনও বহুদূর। 

গ্রন্থ সহায়তা: ‘শৃঙ্খল ঝঙ্কার’, বীণা দাসের আত্মজীবনী