রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুপথযাত্রী সুকুমারকে দেখতে পৌঁছে গেলেন তাঁর গড়পারের বাড়িতে। গুরুদেবকে দেখে কৃতজ্ঞতা আর আনন্দে সুকুমার আত্মহারা! তিনি কবিকে অনুরোধ করলেন দু’টি গান শোনানোর জন্য। কথা বলতে পারছেন না, বই খুলে গান দু’টি দেখিয়ে দিলেন কেবল।
মৃত্যুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নিবিড় সম্পর্ক। যে মৃত্যু-মিছিল বারেবারে আঘাত হেনেছে কবির দীর্ঘ জীবনে, সেই তাঁকে দেখিয়েছে শোক থেকে উত্তরণের দিশা। গভীর মানসিক বেদনা, সংঘাত বা জাগতিক জটিলতায় যখন মন বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ত, রবীন্দ্রনাথ মুক্তির পথ খুঁজে পেতেন তাঁর গানে। গানই তাঁর তপ্ত মনে বুলিয়ে দিত শান্তির পরশ। মিউজিক থেরাপি বা সংগীত-চিকিৎসার সাহায্যে অসুখ নিরাময়ের অন্যতম উদাহরণ রবীন্দ্রনাথের গান। বহু মারণ-রোগাক্রান্ত মানুষের অন্তিম শয্যার শিয়রে দাঁড়িয়ে, গান গেয়ে, রবীন্দ্রনাথ তাঁদের যন্ত্রণাক্লিষ্ট শরীরের কষ্ট লাঘব করেছেন, তাঁদের জীবনপারের অজানা পথটিকে অসীমের সঙ্গে মিলিয়েছেন আলোকিত আনন্দে।
রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, উপেন্দ্রকিশোর রায়ের সুযোগ্য পুত্র সুকুমার রায় নিজের প্রতিভার বিচ্ছুরণে বাংলা সাহিত্যে নিজের দক্ষতা প্রমাণ করেছেন। ১৯১১ সালে রবীন্দ্রনাথের ৫১তম জন্মতিথি উপলক্ষে শান্তিনিকেতনে যে বিশেষ সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল, সেখানেই রবীন্দ্রভক্ত তরুণ সুকুমারের সঙ্গে কবির পরিচয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। শান্তিনিকেতনের বহু উৎসব-অনুষ্ঠানে সুকুমার সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। ১৯১২ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন লন্ডন যান, সুকুমার রায় তখন সেখানকার ‘রয়্যাল ফোটোগ্রাফিক সোসাইটি’র সদস্য। প্রথমদিন থেকেই তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে তাঁর নানা অনুষ্ঠানে সঙ্গ দিয়েছিলেন।
সুপ্রভা দেবীর সঙ্গে সুকুমার রায়ের বিয়ে হয়েছিল ১৯১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর। শান্তিনিকেতনের কোলাহল থেকে সাময়িক ছুটি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ তখন শিলাইদহে, বিশ্রাম নিয়েছেন প্রেয়সী পদ্মার কোলে, পদ্মাবোটে। সুকুমারের বিয়ের খবর পেয়ে নিজের বিশ্রামসুখ ভুলে, সোজা চলে এলেন কলকাতায়। সবাইকে অবাক করে সন্ধ্যায় হাজির হলেন বিয়ের অনুষ্ঠানে। সীতা দেবী লিখেছেন, ‘বিবাহ প্রায় আরম্ভ হইতে যাইতেছে এমন সময় গেটের কাছে করতালিধ্বনি শুনিয়া কিছু বিস্মিত হইয়া গেলেম। পরক্ষণেই দেখিলাম কবি আসিয়া সভাস্থলে প্রবেশ করিলেন। পরে শুনিয়াছিলাম, এই বিবাহে উপস্থিত থাকিবার জন্যই তিনি কলকাতায় আসিয়াছিলেন। সুকুমারবাবুকে তিনি অত্যন্ত স্নেহ করিতেন।’
জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবার বরাবরই ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী এবং ব্রাহ্মধর্মের অন্যতম প্রচারক। রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘদিন ব্রাহ্মসমাজের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এছাড়াও ব্রহ্মসংগীত রচনা, মাঘোৎসব পরিচালনা, প্রবন্ধ রচনা, বক্তৃতা ইত্যাদি বহু গঠনমূলক কাজে নিজেকে নিরন্তর ব্যস্ত রেখেছেন। কিন্তু একসময়ে মূল ব্রাহ্মসমাজ নানাভাবে বিভক্ত হয়ে সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতায় ডুবে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ এই সংকীর্ণতার ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাঁর ‘নৌকাডুবি’, ‘গোরা’ ইত্যাদি উপন্যাস প্রকাশের পরে রক্ষণশীলগোষ্ঠী প্রশ্ন তুলেছিল, রবীন্দ্রনাথ আদৌ কি ‘যথেষ্ট ও যথার্থ ব্রাহ্ম’? সেই সময় সুকুমার রায়, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ প্রমুখ তরুণ ব্রাহ্ম-সদস্য রবীন্দ্রনাথকে অকুণ্ঠ সমর্থন করেছিলেন।
১৯২১ সালের ২ মে পুত্র সত্যজিৎ রায়ের জন্মের কিছুদিন পরেই সুকুমার রায়ের শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। জানা যায়, তিনি দুরারোগ্য কালাজ্বরে কবলিত। মৃত্যুই ছিল একমাত্র ভবিতব্য। সুকুমারের অসুস্থতার সংবাদ রবীন্দ্রনাথকে ব্যথিত করেছিল। তিনি নিয়মিত তাঁর খোঁজখবর নিতেন, দেখা করতে আসতেন। নানাভাবে তাঁকে সাহস জোগাতেন।
১৯২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতার অ্যালফ্রেড ও ম্যাডন থিয়েটারে রবীন্দ্রনাথের শারদোৎসব অভিনয় হচ্ছিল। অভিনয় চলাকালীন রবীন্দ্রনাথ খবর পেলেন, সুকুমার তাঁর গড়পারের বাড়িতে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন এবং এটাও জানতে পারলেন, তিনি এতই অসুস্থ যে, কথা বলার মতো অবস্থাও নেই। পুত্রসম সুকুমারের জন্য কবির মন চঞ্চল হয়ে উঠল। এদিকে সেদিনই শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের জ্যাঠতুতো দাদা দ্বীপেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনাবসান (১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯২২) হয়েছিল।
সেই পারিবারিক শোকের আবহেই রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুপথযাত্রী সুকুমারকে দেখতে পৌঁছে গেলেন তাঁর গড়পারের বাড়িতে। গুরুদেবকে দেখে কৃতজ্ঞতা আর আনন্দে সুকুমার আত্মহারা! তিনি কবিকে অনুরোধ করলেন দু’টি গান শোনানোর জন্য। কথা বলতে পারছেন না, বই খুলে গানদু’টি দেখিয়ে দিলেন কেবল। রবীন্দ্রনাথ গাইলেন ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু’ আর ‘দুঃখ এ নয়, সুখ নহে গো’ গান দু’টি। গানের বাণী আর সুরের তরঙ্গ গড়পারের বদ্ধ ঘরটিকে এক স্বর্গীয় সুষমায় ভরিয়ে তুলেছিল। নিমেষে বিলীন হয়ে গিয়েছিল যাবতীয় ক্লেশ আর বেদনার ভ্রুকুটি। সুকুমারের চোখে জলের ধারা। মুখে অসীম প্রশান্তি। যন্ত্রণার লেশমাত্র নেই। রবীন্দ্রনাথের গান মিউজিক থেরাপির মতো সুকুমারকে সমস্ত শারীরিক আর মানসিক কষ্ট থেকে ক্ষণিক মুক্তি দিয়েছিল। ১৯২৩ সালে ১০ সেপ্টেম্বর, মৃত্যুর দূত এসে সুকুমারকে নিয়ে গিয়েছিল আনন্দময় চিরশান্তির দেশে। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে বাংলা সাহিত্যের এক বিরল প্রতিভা অকালে ঝরে পড়েছিল।
পরদিন শান্তিনিকেতনে মন্দিরের উপাসনায় সুকুমারকে স্মরণ করে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘আমি অনেক মৃত্যু দেখেছি কিন্তু এই অল্পবয়স্ক যুবকটির মত, অল্পকালের আয়ুটিকে নিয়ে মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে এমন নিষ্ঠার সঙ্গে অমৃতময় পুরুষকে অর্ঘ্যদান করতে প্রায় আর কাউকে দেখি নি। মৃত্যুর দ্বারের কাছে দাঁড়িয়ে অসীম জীবনের জয়গান তিনি গাইলেন। তাঁর রোগশয্যার পাশে সেই গানের সুরটিতে আমার চিত্ত পূর্ণ হয়েছে।’
জীবনের যে কোনও দুঃখবেদনায় রবীন্দ্রনাথের আশ্রয় ছিল তাঁর গান। সুকুমারের মৃত্যুশয্যায় তিনি যা গেয়েছিলেন, তা কেবলমাত্র সুকুমারের জন্যই নয়, নিজের অশান্ত মনকে শান্ত করার প্রয়াসও ছিল তাতে।