বয়স্ক মানুষের যৌনচাহিদা স্বাভাবিক, অথচ সমাজের কাছে ঘৃণ্য
Published by: Robbar Digital
Posted on: September 30, 2024 9:13 pm
Updated: October 1, 2024 8:06 pm
যৌনজীবনের প্রসঙ্গ উঠলে আমরা ধরে নিই বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের যৌনজীবন স্তিমিত হবে। বয়স্ক মানুষ হবেন একেবারে যৌনতাবিহীন কেউ। একটা বয়সের পর বিবাহিত অনেক মানুষেরই সঙ্গীর মৃত্যু হয়। কিন্তু তারপরেও যে সেই মানুষটির যৌন চাহিদা থাকতে পারে সেটা আমরা শুধু ভুলে যাই তা নয় ঘৃণার চোখেও দেখি। বয়স্ক মানুষদের প্রেম-ভালোবাসা, যৌনতা আমাদের সমাজে গর্হিত। আর সেটা হলেও কাছাকাছি বয়সের সঙ্গীই যেন একজনের ভবিতব্য। বয়স্ক কোনও নারী বা পুরুষ যে অন্য একটি যুবক বা যুবতীর শরীর কামনা করতে পারেন, এটা আমাদের কাছে অস্বাভাবিক এবং লজ্জাজনক ব্যাপার।
ভাস্কর মজুমদার
অতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু যে তাঁর সন্তানদের উচিত শিক্ষা দিয়েছিলেন, তা নয়। তিনি আরও অনেক সন্তানকে শিখিয়েছিলেন মা-বাবা’র প্রতি তাদের ব্যবহার কেমন হওয়া উচিত। এমনকী, যে লাঠিতে ভর দিয়ে তাঁকে হাঁটতে হত প্রয়োজনে লোক ঠ্যাঙাতে তিনি সেই লাঠি ব্যবহার করেছিলেন। বাঙালি সমাজ তাঁর মধ্যে একজন আদর্শ বয়োজ্যেষ্ঠকে খুঁজে পেয়েছিল। সে-কারণে প্রভাত রায় পরিচালিত ‘লাঠি’ সিনেমাটি এত জনপ্রিয় হয়েছিল। অতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চরিত্রে ভিক্টর ব্যানার্জি ভীষণই ভালো অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু কথা হল, অতীন্দ্রনাথ আসলে কাল্পনিক চরিত্র। বাস্তবে লাঠি তুলে নেওয়ার আগে অনেক বয়স্ক মানুষ অথর্ব হয়ে যান। এখানে ‘অথর্ব’ শব্দটি গুরুত্বপূর্ণ। ভারতে চাকরিজীবন থেকে অবসরের বয়স ৬০। কোনও ক্ষেত্রে ৬২ কিংবা ৬৫। আমরা ধরে নিই, চাকরিজীবন থেকে ‘অবসর’ মানে সব কিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া।
হিন্দুধর্মের প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে মানবজীবন যেহেতু চতুরাশ্রম যথা– ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাসে বিভক্ত রাখার পরামর্শ ছিল তাই আমাদের কাছে সেই সময়-সারণিটা একটা আদর্শ হয়ে মাথায় গেঁথে গিয়েছে। আমাদের নিদান চাকরি থেকে অবসর মানে একটা মানুষের সব বিদ্যেবুদ্ধি লোপ পাওয়া। তিনি সকালে উঠবেন, মর্নিং-ওয়াকে যাবেন, সম্ভব হলে নাতি-নাতনিকে স্কুলে পৌঁছে দেবেন, কম খাবেন, বাড়ির কোনও বিষয়ে তেমন মাথা ঘামাবেন না আর তাড়াতাড়ি বিছানা নেবেন। তিনি ধার্মিক হবেন। পুজোআচ্চায় থাকবে তাঁর মন। পেনশন যদি পান তবে সংসারে কিছু সম্মান থাকে, তা না হলে সবাই যেমন বলবে তেমনই তাঁকে চলতে হবে। এত কিছুর কারণ কী? কারণ তিনি ‘বুড়ো’ হয়েছেন। কারণ, তিনি বয়স্ক। তাঁর শারীরিক-মানসিক শক্তির এখন ক্ষয় চলছে। অথচ এই সময়টাতেই একটা মানুষের সব থেকে বেশি সাহচর্য দরকার হয়।
চাকরিজীবন থেকে অবসরের পর প্রতিটা মানুষেরই নিজেকে মূল্যহীন মনে হয়। মাসিক টাকা অনেক কমে যায়। কারও পেনশন থাকে কারও থাকে না। এক থোক টাকা যে অবসরান্তে মেলে তা নিজের জন্য নাকি পরিবারের জন্য ব্যবহার করবেন বোঝা মুশকিল হয়। এ-সময় একটি মানুষের রোজগার কমে কিন্তু খরচ বাড়ে। ওষুধের খরচ, হাসপাতাল-বদ্যি তাঁকে প্রায়ই করতে হয়। তিনি বার্ধক্যের নতুন জীবনটিকে মানিয়ে নিতে অনেক সময় দেরি করেন। আর এই সময়ই তাঁর জোটে শারীরিক-মানসিক নিগ্রহ।
ভারতে একটা বিরাট শতাংশের বয়স্ক মানুষ হিংসার বলি। গার্হস্থ্য হিংসা সেই তালিকার একদম ওপরের সারিতে। ভারতে বয়স্ক মানুষেরা বাড়িতে মার খান, দিনের পর দিন কটু কথা শুনতে হয় যার মধ্যে তিনি কতটা অচল, কতটা অসভ্য, কতটা খারাপ– এসবের হিসাব থাকে। কথা না শুনলে বিভিন্ন রকম শারীরিক-মানসিক অত্যাচার চলে। এসব কিছু চলে একটাই অজুহাতে যে ‘ওঁর বয়স হয়েছে তো, কিছু বোঝেন না। যত বয়স হচ্ছে বাচ্চাদের মতো হয়ে যাচ্ছেন!’ এই ‘বাচ্চাদের মতো হয়ে যাচ্ছেন’-এ ভর করে প্রথমেই ধরে নেওয়া হয় বয়স্ক মানুষটির কোনও বাস্তব বোধ বা বুদ্ধি থাকতে পারে না। সমাজমাধ্যমে এমন অনেক ভিডিও চোখে পড়ে তাতে দেখা যায় কোনও একজন বয়স্ক মানুষকে নিয়ে তথাকথিত ‘খিল্লি’ চলছে। তিনি যত বাঁধা দিচ্ছেন তত সেই মশকরার মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। বয়স্ক মানে দাদু-ঠাকুরমা আর দাদু-ঠাকুরমা মানে তাঁরা অন্তহীন পরিহাসের পাত্র। তাঁদের সম্মানবোধ তখন মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছে। মারধোরের থেকেও এই মানসিক নির্যাতন যে কী ভীষণ হিংসাশ্রয়ী, তা বলাই বাহুল্য। অন্য দিকে এই অযত্ন এবং হেনস্তা-হিংসা বেশিরভাগ সময়ই লিঙ্গভিত্তিক। এতক্ষণ যে জীবনের আভাস পাওয়া গেল তা মূলত পুরুষের। এক্ষেত্রে মহিলাদের যেসব অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়, তা আরও ভয়াবহ।
বয়স্ক মহিলাদের একটি বিরাট অংশ অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন নন। তাঁদের যে গৃহশ্রম তার হিসাব থাকে না। দেখা যায় বহু মহিলা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রক্তাল্পতা ও বাতের ব্যথায় ভোগেন। অথচ গৃহকর্ম থেকে বিরতি নেই। একটা বয়সের পর তাঁদের থেকে আসা করা হয় বয়স্ক বলেই তাঁরা সাজগোজ করবেন না। আবার ভারতে ‘বিধবা’ (স্বামীর মৃত্যুতে) হলে আবার ধর্মীয় কারণে নিরামিষ খাওয়া বা রঙিন পোশাক না পরার নিদান দেওয়া হয়! এমনিতেই মেয়েদের ওপর ‘মা’ হওয়ার একটা পরোক্ষ চাপ থাকেই। আর বয়সকালে দেখা যায় অন্যান্য গৃহশ্রমের পাশাপাশি ছেলেমেয়েদের সন্তানপ্রতিপালনের দায়িত্বও তাঁদের কাঁধে এসে পড়ে। এবং সেটা এতটাই তীব্র যে বিদেশে বসবাসরত সন্তানেরাও অনেক সময় তাদের মাকে সে-দেশে নিয়ে যেতে চায় কারণ সন্তানপ্রতিপালনের কোনও লোক সেখানে অমিল বা সুলভ নয়। আমাদের সমাজ-রাষ্ট্রে বয়স্ক মানুষদের জায়গাটি যথেষ্ট নড়বড়ে।
যৌনজীবনের প্রসঙ্গ উঠলে আমরা ধরে নিই– বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের যৌনজীবন স্তিমিত হবে। বয়স্ক মানুষ হবেন একেবারে যৌনতাবিহীন কেউ। একটা বয়সের পর বিবাহিত অনেক মানুষেরই সঙ্গীর মৃত্যু হয়। কিন্তু তারপরেও যে সেই মানুষটির যৌন চাহিদা থাকতে পারে সেটা আমরা শুধু ভুলে যাই তা নয় ঘৃণার চোখেও দেখি। বয়স্ক মানুষদের প্রেম-ভালোবাসা, যৌনতা আমাদের সমাজে গর্হিত। আর সেটা হলেও কাছাকাছি বয়সের সঙ্গীই যেন একজনের ভবিতব্য। বয়স্ক কোনও নারী বা পুরুষ যে অন্য একটি যুবক বা যুবতীর শরীর কামনা করতে পারেন, এটা আমাদের কাছে অস্বাভাবিক এবং লজ্জাজনক ব্যাপার। অনেক সময় আবার দেখা যায় বয়স্ক ও কমবয়সি দু’টি মানুষের মধ্যেকার যৌনতা আসলে প্রকটভাবে অর্থনির্ভর। যে-কারণে ‘সুগার ড্যাডি’ বা ‘সুগার মমি’র ধারণাটি প্রাণ পেয়েছে। বয়স্ক কোনও মানুষের কমবয়সি কারও সঙ্গে প্রেম বা যৌনতা আমরা বিচার করি এই ভেবে যে বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষটি টাকা সরবরাহ করছেন বলেই সম্পর্ক এগোচ্ছে। এখানে বয়স্ক মানুষটির মানবিক চাহিদাটি আসলে ঘৃণ্য বা পরিহাসযোগ্য। এই চিত্রটা কেবল বিসমকামী সমাজের। সমকামী-রূপান্তরকামী বয়স্ক মানুষদের অবস্থা আমাদের দেশে খুবই শোচনীয়। তাঁদের এখনও বিয়ের ব্যবস্থা নেই বলে তথাকথিত পারিবারিক জীবনও একটা বয়সের পর তাঁদের থাকে না বললেই চলে।
এ-কথা ঠিক যে পরিবার কেবলমাত্র রক্তের সম্পর্ক দিয়ে তৈরি হবে, তেমন কথা নেই। কিন্তু উপমহাদেশে হিজড়া পেশার মানুষেরা যেভাবে বিসমকামী মানুষদের বিপ্রতীপে নিজেদের মতো করে পরিবারের ধারণা গড়ে তুলেছেন অন্যান্য কুইয়র শ্রেণির মানুষেরা এখনও ততটা হয়তো পারেননি। তাই বহু সময় এই সম্প্রদায়ের বয়স্ক যাঁরা তাঁদের ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তার হার খুবই কম হয়। আর যৌনতার ব্যাপারে তাঁদের যৌবন বয়সেই নানা বৈষম্যের শিকার হতে হয় যেখানে বয়স হয়ে গেলে তা বাড়ে বই কমে না।
আজ ১ অক্টোবর। আজ আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ আজকের দিনটিকে চিহ্নিত করে বিশ্ব জুড়ে বয়স্ক মানুষেরা কেমন আছেন সেই হালহকিকতের দিকে নজর দিতে। বয়স্ক মানুষেরা সুষম আহার পাচ্ছেন কী না, মানসিক স্বাস্থ্য তাঁদের কতটা আশানুরূপ, যৌনজীবন তাঁদের নিয়মিত কি না, পারিবারিক জীবনে তাঁদের অংশগ্রহণ কতটা– এমন নানাবিধ বিষয়ে আমাদের খোঁজ নেওয়া প্রয়োজন। এ-ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি জরুরি। সংসারের বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষটি তাঁর বয়সের জন্য কোনও বৈষম্য কিংবা হেনস্তা-হিংসার শিকার যেন না হন সেটা প্রতিটি মানুষকে দেখতে হবে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধদের শারীরিক সক্ষমতা কমে, এটা ঠিক। কখনও পঙ্গুত্বও গ্রাস করতে পারে। তা বলে সেই মানুষটি করুণার পাত্র হয়ে উঠবেন তা হতে পারে না। রাষ্ট্রকেও ভাবতে হবে বয়স্ক নাগরিকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা কীভাবে বাড়ানো যায়। যে সমাজে বয়স্ক মানুষেরা অবহেলিত সে সমাজ নিকৃষ্ট, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কবি পৃথিবীকে শিশুর বাসযোগ্য করে তোলার আর্জি জানিয়েছিলেন কিন্তু সেই পৃথিবী যেন বয়স্কমানুষদেরও স্বস্তির জায়গা হয়। আর এ-দায়িত্ব আমাদের প্রত্যেককেই নিতে হবে। ভুললে চলবে না একদিন আমাদেরও সেই ‘বুড়ো’ হতে হবে। সে আমরা কোনও দিন ‘লাঠি’ সিনেমার অতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে উঠি আর না-ই উঠি।
সব গবেষণার তাৎক্ষণিক হাতে-গরম প্রযুক্তিগত প্রয়োগ থাকে না; কিন্তু যে কোনও প্রকৃত বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানই মানবসভ্যতাকে এক কদম দু’কদম করে এগিয়ে দেয়– আমাদের দেশের নীতিনিয়ামক ও ফান্ডিং এজেন্সিরাও সেকথা মনে রাখলে আমাদেরই কল্যাণ।
সস্তার চিনির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হারিয়ে যেতে বসেছে গুড়শিল্প। টিকে থাকার লড়াইয়ে খাঁটি গুড়ে মিশেছে ভেজাল সংস্কৃতি। এছাড়াও খেজুর রস ফোটাতে প্রচুর জ্বালানি লাগে। আগে আশপাশের জঙ্গল, ঝোপঝাড় কেটে সংগ্রহ করা হত জ্বালানি, এখন সেই জঙ্গলও নেই।
এত যে বিশাল ছবির দাম, এত যে বিক্রি, নিলাম ইত্যাদি মিলিয়ে অর্থনৈতিক খবরাখবর, শুনেছি বিশাল সংসারে আয়-ব্যয়ের হিসেবের শেষে হুসেনের ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স নাকি জিরো! ১৭ সেপ্টেম্বর এম এফ হুসেনের জন্মদিন।