আমি আর যাব না ওখানে। কেন যাব? কার কাছে যাব? আর আজ যখন তিনি সেই শান্তিনিকেতনে এলেন তাঁর দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে এল? এর কারণ কি তবে সেই রবীন্দ্রনাথ? তিনি সেই মাটিকে স্পর্শ করলেন, অনুভব করলেন রবীন্দ্রনাথকে, আর তখনই অল্পবয়সি মেয়েটির চোখ ভারী হয়ে এল। ‘এই শান্তিনিকেতনের ঘাস, গাছপালা, আকাশ, বাতাস, যেন তখন আমাকে গ্রহণ করেছে যেন আমি সেই আমি আর নেই।’ গেয়ে উঠলেন, ‘এল যখন সাড়াটি নাই, গেল চলে জানাল তাই– এমন করে আমারে হায় কে বা কাঁদায় সেজন ভিন্ন।’
‘আমি প্রতিদিন শেষরাত্রে উঠে চুপ করে বসে নিজের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করি।’
এমন অনেক সময় আসে, আমাদের মনের উপর ভিন্ন এক মানসিক স্তর পড়ে যায়। কেমন সে স্তর? যে স্তরে প্রকাশিত মন তার আকাঙ্ক্ষার শিকড় আঁকড়ে চুপ করে বসে থাকে। হয়তো কেউ তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেত গভীর এক সুন্দরের দিকে, কিন্তু সে ভয় পায়। সে নিজেকে নিয়ে ভিন্ন এক জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে চায়। কেউ হয়তো তখন তার মনের অতলে গিয়ে দেখতে পায় না। সে হয়তো এমন এক সংকটের মুহূর্তে এসে দাঁড়িয়েছে যে, তখন ভেতরের দিকে যাওয়ার পথটুকু মনে হয় বিলাসিতা। সে বিলাসিতায় ‘আমি’কে প্রতিষ্ঠা, জীবনের ‘একমাত্র’ পথ নয়। এই পথ ধরেই তার মন একদিন ভিন্নতাকে ছুঁতে চেয়েছে। ভিন্নতা, এই অর্থে ভিন্নতা যেখানে সে নিজের একটা পথ খুঁজে পেয়েছে। পথের পাশে কিছুটা সময় চেয়ে বসে থাকতে চেয়েছে নির্জনতার সঙ্গে। কেননা মুহূর্তের ‘বড় আমি’ এখানে নিজেকে যেন মনে করছে সে অন্য কেউ। তবে কি তার আর কোথাও জাগিয়ে রাখার অবকাশ নেই? ফিরে যাওয়ার কোনও টান নেই আর যেন! কেন সে মনে করছে এমন এক হারিয়ে যাওয়ার পথের মতো?
এইরকম এক পথের পাশে তিনি দাঁড়িয়ে। বাইশে শ্রাবণ। কলেজ স্ট্রিটের একটি বারান্দায় দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথের চলে যাওয়া দেখছেন। মনে মনে প্রশ্ন করেছেন, কেন? কেন তিনি চলে গেলেন এইভাবে? যখন রবীন্দ্রনাথ জানতেন যে, তিনি যাবেন তাঁর আদরের শান্তিনিকেতনে। চোখ ভারি হয়ে এসেছে অথচ কিছুই কাউকে বলতে পারছেন না। নিজের সঙ্গে যেন সারা জীবনের একটা বোঝাপড়া চলছে। এইরকম অনেক বোঝাপড়া তাঁর জীবনে আসবে আর সেইসব দিন তো তাঁর আশ্রয় হয়ে থাকবেন রবীন্দ্রনাথ। কত আদর করে তিনি নিজেকে মানিয়েছেন যে, তাঁর সঙ্গে দেখা হবে। কিন্তু তাঁর সঙ্গে যে, এইভাবে প্রথম দেখা হবে– এটা মানতেই তাঁর সমস্ত জীবনের পথে একটা ঝড় উঠেছে। এখন আপনিই বলুন এইবার আমি কী করব? আমার জীবনের সমস্ত দিনের শুরু আমি কীভাবে জাগিয়ে রাখব?
যখন এইসব চলছে তাঁর মনে তখন রবীন্দ্রনাথ চলে যাচ্ছেন সবাইকে শূন্য করে। শূন্যই তো! কেননা একমাত্র রবীন্দ্রনাথই তো সেই আমার ‘আমি’কে প্রতিষ্ঠা করেছেন! আমরা জানি, এই দৃশ্য একজন কবিকে কীভাবে অস্থির করে তুলেছিল একদিন আর সেই সমস্ত দিনের শুরু তিনি তুলে রেখেছিলেন তাঁর রচনায়। আমরা এ-ও জানি এর পর সুচিত্রা মিত্র নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর আরাধ্য রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন গান শিখবেন বলে। যদিও তিনি তাঁর যৌবনের কয়েক বছর শান্তিনিকেতনে থাকবেন আর তাঁর জীবনের সমস্ত প্রবাহকে একটি শূন্যতার মধ্যে ধরে রাখতে পারবেন।
‘তিনি নেই। তবু তাঁরই কাছে যাচ্ছি। হ্যাঁ, তাঁরই কাছে। আমি জানি, তিনি আছেন। বড় নিশ্চিতভাবে জানি। জানি বলেই, কলকাতা ছেড়ে, আমার ১৭ বছরের নানা অনুষঙ্গে ভরা আমার শৈশব কৈশোরের শহর ছেড়ে এত দূরে চলে আসা।’
এই আসা তাঁর ভিন্ন জন্মান্তর হয়ে ফিরে এল আমাদের প্রতিদিনের জীবনে। তারই ফাঁকে কেউ কেউ বলেছিলেন ‘কেন নির্বান্ধব পুরীতে? বিদেশবিভুঁই?’ আর এর উত্তরে তাঁকে বলতে হল ‘এমন স্বদেশ আমার কাছে আর কি একটাও আছে? নির্বান্ধব পুরী?’ কারণ তিনি জানতেন, একমাত্র রবীন্দ্রনাথই আছেন তাঁর পাশে, কেননা এর পরেই আমরা শুনি ‘যাঁর গান আনন্দে আমার সঙ্গে ময়ূরের মতো নাচে, যাঁর গান দুঃখে, বিষণ্ণতায় আমার হাতে তার হাত রাখে, যাঁর গান সব হতাশা তুচ্ছ করে জীবনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় আমাকে, তাঁর চেয়ে বড় বান্ধব আমার আর কে আছে?’ আর সে কারণেই হয়তো তিনি আমাদের প্রতিদিনের জীবনে ব্যক্তিগত ‘আমি’কে সরিয়ে রেখে ভিন্ন এক সাধনার পথে নিজেকে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন।
দুই.
দ্বিতীয় জন্মের ওপার থেকে
‘সম্পদকে অন্তরে গ্রহণ করব বলেই তো তাঁর কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম’– ভেতরে ভেতরে রবীন্দ্রনাথের শূন্যতাকেই পূর্ণ এক প্রবাহ মনে হয়েছিল সুচিত্রা মিত্রর। আর তাই তাঁকে বলতে হল ‘যে আমাকে কাঁদায় সে কি অমনি ছেড়ে রবে। পথ হতে যে ভুলিয়ে আনে পথ যে কোথায় সে-ই তা জানে। ঘর যে ছাড়ায় হাত যে বাড়ায়– সেই তো ঘরে লবে।’ আর এর পরেই তাঁর ভিন্ন এক জীবনের অন্বেষণ হয়ে উঠবে সমগ্র আমির অন্বেষণ। কারণ তিনি জানতেন যাঁর হাত ধরে তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছেন তিনিই তাঁকে পথের পথে নিয়ে যাবেন।
মনের আরেক স্তর প্রকাশিত হয়। মনে হয় কি তাঁর– আমার দুঃখ এই একটিই? কী সেই দুঃখ, যা তাঁকে আরও গভীর করে তুলেছে আর সব নীরবতা থেকে? তিনি মনে করেন, এই দুঃখই যেন তাঁর একমাত্র সত্য, এছাড়া আমার জীবনের আর কোনও অর্থ নেই, স্বচ্ছলতা নেই, যেন গভীর কোনও জটিলতা তাকে ঠেলে ধরছে অন্ধকারের দিকে, ধূসর থেকে আরও কোনও ধূসর আকাঙ্ক্ষার দিকে। আর আমরা তো জানি, মনের সেই ভিন্ন এক অন্ধকার– অন্ধকার নয় আর। এতক্ষণ যা দুঃখ হয়ে ফিরছিল তার মনের উপরমহলে, তখন সেই মনের অবচেতনে ভিন্ন এক চেতনা তাঁর সমস্ত কল্পনার মুহূর্তের ছায়া হয়ে জীবনের একটা অর্থকে ভেঙে নতুন একটা অর্থ পেতে চাইছে। এইখানে যে চেতনার ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকের স্পর্শ পাই, আমরা তা সে আমিরই প্রতিধ্বনি, আর সেটা আমিকেই তার কেন্দ্রে রেখে।
২০ দিন আগে রবীন্দ্রনাথ চলে গিয়েছেন। কিন্তু তিনি আমাদের জন্য তাঁর বিপুল ঐশ্বর্যভরা শান্তিনিকেতনে রেখে গিয়েছেন তাঁর চেতনার ভিন্নতাকে। সেদিন কলেজ স্ট্রিটের দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির ভিতরে যে ‘আমি’ সর্বক্ষণ রয়েছে সে কোনও ব্যক্তিগত আমি নয়, সে সমগ্র আমির আমি, যাকে স্পর্শ করা যায় না। একমাত্র উপলব্ধি ভিতর তাকে চেনা যায়। এর পরেও তাঁর মন অস্থির হয়ে উঠেছিল? কেন?
কারণ তবে কি সেই ব্যক্তিগত আমিই এসে দাঁড়াল তাঁর মনের উপরমহলে? আর সেই কারণেই কি তাঁকে বলতে হয়েছিল, ‘কেন এত প্রশান্তি তোমার মুখে? আমি কেন এত একটুও শান্ত হতে পারছি না!’
কারণ আমরা জেনেছি আর ক’দিন পরেই তাঁর শান্তিনিকেতনে যাওয়ার কথা। ‘সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে। ঠিকঠাক হয়ে থাকুক। আমি আর যাব না ওখানে। কেন যাব? কার কাছে যাব?’ আর আজ যখন তিনি সেই শান্তিনিকেতনে এলেন তাঁর দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে এল? কেন এমন হল? এর কারণ কি তবে সেই রবীন্দ্রনাথ? তিনি সেই মাটিকে স্পর্শ করলেন, অনুভব করলেন রবীন্দ্রনাথকে, আর তখনই অল্পবয়সি মেয়েটির চোখ ভারী হয়ে এল। কারণ এই পথ দিয়েই তো রবীন্দ্রনাথ হেঁটে গিয়েছেন বারবার আর সেই পদচিহ্নের সামনে দাঁড়িয়ে আমার সবটুকু যেন তিনি ফিরে পেলেন ভিন্ন এক জীবনের সামনে। ‘এই শান্তিনিকেতনের ঘাস, গাছপালা, আকাশ, বাতাস, যেন তখন আমাকে গ্রহণ করেছে যেন আমি সেই আমি আর নেই।’ গেয়ে উঠলেন, ‘এল যখন সাড়াটি নাই, গেল চলে জানাল তাই– এমন করে আমারে হায় কে বা কাঁদায় সেজন ভিন্ন।’
গাইতে গাইতে তাঁর গলায় যেন এসে গেল ২০ দিন আগে রবীন্দ্রনাথের সেই মুখ আর তখন নিজেকে আড়াল করতে পারেননি সুচিত্রা মিত্র।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved