Robbar

আগস্টকে সজোরে ‘অনভিপ্রেত’ ঘোষণা করেছিলেন সিলভিয়া প্লাথ

Published by: Robbar Digital
  • Posted:August 31, 2025 8:13 pm
  • Updated:September 2, 2025 7:45 pm  
Sylvia Plath and August in her poetry and life by Brinda Dasgupta

‘উন্মাদিনী’ কবি সিলভিয়া প্লাথের চিঠি-কবিতা-উপন্যাসে যে আগস্টকে দেখা যায় বারবার, সে আগস্ট আমাদের (না-পশ্চিমের) শেষ-বৃষ্টি আগস্টের চেয়ে অন্তরঙ্গে জটিল; চরিত্রগতভাবে আলাদা। একদিকে জীবনের যাবতীয় মোহের দীপ্তি উস্কানো, অন্যদিকে কঠিন, অস্থির অবসাদের জল ঝরানো আগস্টকে কবি বেঁধে ফেলেছিলেন নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে– বেয়াড়া রকম, নাছোড় একটা সম্পর্কে। কবির সৃজনের যে রেপার্তয়ার, সে রেপার্তয়ারে আগস্ট তাই সরলরৈখিক একটি অবস্থান মোটে রাখে না– আগস্ট বরং সৃষ্টি এবং ধ্বংসের মধ্যবর্তী স্তর হয়ে, ক্ষেত্রবিশেষে সেতুটুকু হয়ে, কবিরই শব্দের প্রতিধ্বনির মধুতে, ভয়াবহতায় জড়িয়ে নেয় ওঁর পাঠককে।

বৃন্দা দাশগুপ্ত

বার্গম্যানের ‘ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ’ (১৯৫৭)-এ গ্রীষ্মকে, কিংবা ধরে নেওয়া যাক গ্রীষ্মের আগস্টকেই, স্রেফ ঋতুচিহ্ন হিসেবে পড়লে, সে পড়ায় ফাঁক থেকে যেতে পারে। অধ্যাপক ইসাক বর্গের গ্রীষ্মকালীন যাত্রা যেমন বুনো স্ট্রবেরির মাতাল গন্ধে বিভোর, বাধ্য রোদের আলোয় ভরা, সেই গন্ধ, সেই আলোই তো তাকে না বলে-কয়ে ফিরিয়ে নিয়ে গেল প্রথম প্রেমের কাছে, পারিবারিক সম্পর্কের বিভিন্ন ওঠানামার কাছে, তরুণকালের নানা সম্ভাবনাময়তার মায়াবী স্বপ্নের কাছে; ক্রমেই পরিচয় করিয়ে দিল নিজের অকৃতকার্যতার হিসেবের সঙ্গে, অতঃপর মৃত্যুচেতনার সঙ্গেও– অদ্ভুত গভীর এক শূন্যতার দিকে ঠেলে দিল তাকে। এই সুইডিশ গ্রীষ্মকে, গ্রীষ্মের আগস্টকে, আগস্টের সুন্দর, ভয়ানক, দ্বিমাত্রিক আত্মাকে আমি কেবল বার্গম্যানের ক্যামেরাতেই দেখেছি একবার– নীল আকাশ, সবুজ মাঠ, অবিরত আলো-ছায়ার খেলা। তবে এরই সমান্তরালে, পশ্চিমের এমনই আরও একটা গ্রীষ্ম দেখেছি, গ্রীষ্মের আগস্ট দেখেছি আমি, ভেঙে ভেঙে। ভেঙে ভেঙে, অথচ সামগ্রিকভাবেই যেন– চিঠিতে, কবিতায়, উপন্যাসে। বহুভাবে, বহুবার। যাবতীয় এই চিঠি-কবিতা-উপন্যাস একজনেরই লেখা– মায়ের আদরের সিভির লেখা।

সিভি ওরফে প্ৰখ্যাত ‘উন্মাদিনী’ কবি, সিলভিয়া প্লাথের চিঠি-কবিতা-উপন্যাসে যে আগস্টকে দেখা যায় বারবার, সে আগস্ট আমাদের (না-পশ্চিমের) শেষ-বৃষ্টি আগস্টের চেয়ে অন্তরঙ্গে জটিল; চরিত্রগতভাবে আলাদা। একদিকে জীবনের যাবতীয় মোহের দীপ্তি উস্কানো, অন্যদিকে কঠিন, অস্থির অবসাদের জল ঝরানো আগস্টকে কবি বেঁধে ফেলেছিলেন নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে– বেয়াড়া রকম, নাছোড় একটা সম্পর্কে। কবির সৃজনের যে রেপার্তয়ার, সে রেপার্তয়ারে আগস্ট তাই সরলরৈখিক একটি অবস্থান মোটে রাখে না– আগস্ট বরং সৃষ্টি এবং ধ্বংসের মধ্যবর্তী স্তর হয়ে, ক্ষেত্রবিশেষে সেতুটুকু হয়ে, কবিরই শব্দের প্রতিধ্বনির মধুতে, ভয়াবহতায় জড়িয়ে নেয় ওঁর পাঠককে। যে সেতুর বুক চিড়ে জন্ম নেয় অনন্ত কোমল দৃশ্য; দৃশ্যের ইচ্ছে গায়ে এসে ফোটে তীব্র শীতের ক্ষমাহীন দাঁতনখ– সিলভিয়ার কবি-মনের স্থিরতা, অস্থিরতার গতিপথকে যত্নে আঁকতে নিলে তাই, তাঁর আগস্টকে বোঝা একরকম বাধ্যতামূলকই।

কেন ‘কবি’ আখ্যানই পেলেন সিলভিয়া প্লাথ:

মূল আলোচনায় সরাসরি ঢুকে পড়ার আগে ছোট্ট একটা বাঁক নিই। একবার মনে করিয়ে দিই নিজেকেও, সিলভিয়া প্লাথ বড় হচ্ছেন দুটো যুদ্ধের মাঝামাঝি– মহামন্দা পরবর্তী আমেরিকায়। বাবাকে হারাচ্ছেন প্রায় শৈশবেই। নিজের আঁকা একটি ছবি ঠাকুমার অনবধানতায় কিঞ্চিৎ বিগড়ে যাওয়ার দুঃখে প্রথম কলম ধরছেন। কবিতা। কবিতার নামও রাখছেন ‘কবিতা’-ই। পৃথিবীব্যাপী বোমা-বারুদের উত্তাপে, পাশাপাশি, ব্যক্তিগত জীবনে বাবার অনুপস্থিতির জেরে, প্রতিটি মুহূর্তই তাঁর নিরাপত্তাহীনতার যোগ্য দাবিদার তখন। অথচ আশ্চর্য কথা এই যে, এমন আবহে যাঁর বেড়ে ওঠা, মৃত্যুর ঠিক কয়েক হপ্তা আগে, মা-কে তিনি লিখছেন চিঠিতে–

‘I am writing the best poems of my life. They will make my name.’

শাস্ত্র দিকনির্দেশিকামাত্র, শেষ কথা নয়। সিলভিয়া প্লাথের চিঠির এই অংশ আগাগোড়া কবিতাশাস্ত্রে বাতলে দেওয়া উদাসীনতার, দৃশ্যমানতার খিদের নিয়মকে খণ্ডন করে, হকের আত্মবিশ্বাসের, আত্মশ্লাঘার জায়গা করে নিচ্ছেন, হকের আত্মবিশ্বাসের, আত্মশ্লাঘার জায়গা করে দিচ্ছেন কবি-জীবনে– কবি বলেই মুখ্য পরিচিতিলাভ করছেন তাই হয়তো। আমেরিকার পাঁচ ও ছয়ের দশকে গড়ে ওঠা কনফেশনাল কবিতা আন্দোলনের প্রতিনিধি, সিলভিয়ার কবিতায় আগস্ট, ওঁর মনেরও ঋতু, সকল স্বীকারোক্তির ডায়েরি, তাই আসছে সাবলীলভাবে। কবিতার আগস্টে আসব পরে। এখন ফিরে দেখি উপন্যাস, চিঠি-পত্রে আগস্টের একথা-সেকথা। দিনলিপি এই আলোচনায় বাদ থাকছে।

১. দ্য বেল জার– আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসে আগস্ট

নামজাদা লেখক হওয়ার স্বপ্ন এস্থারের। নিউ ইয়র্কের এক নামী পত্রিকার ইন্টার্নশিপের কাজে যোগ দিলেন কর্মজীবনের শুরুর দিকে, ঠিক যেমনটা দিয়েছিলেন সিলভিয়া প্লাথ, মাদামইসিলে। এমনই সাদৃশ্য কেন্দ্রীয় চরিত্রের সঙ্গে কবির জীবনের চলনের, যে প্রাথমিকভাবে ছদ্মনামে প্রকাশিত হয় প্লাথের আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস, একমাত্র উপন্যাস, ‘দ্য বেল জার’ (১৯৬৩)। আত্মসচেতনতা এবং অনিশ্চয়তা কালে কালে একরাশ দ্বিধার সামনে এনে দাঁড় করায় এস্থারকে। প্রতীকী দৃশ্যে সে একটি গাছে ঝুলে থাকা নিজেরই নানা ভবিষ্যতের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে, কাদের হাতছানি উপেক্ষা করবে– কাকে বেছে নেবে। নানা ‘হেরে যাওয়ার’ বোঝার ভারে জর্জরিত হতে হতে, পরবর্তীতে বিবিধ ভয় আরওই চেপে বসে– অপূর্ণ উচ্চাশা তাকে মৃত্যুরও প্রান্তে এনে ফেলে। এই উপন্যাস জুড়ে যে হতাশা, অবসাদ, তার মূলকে বুনেছে জ্বালাময়ী এক গ্রীষ্ম। গ্রীষ্মের আগস্ট। যে আগস্ট নিমেষেই সবকিছু পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। দেয়ও। খানিক আশ্চর্যজনকভাবেই, প্লাথ তবু তাঁরই হাতে গড়া এই এই বিধ্বংসী আগস্টকে ডরাননি– লেখালিখির জগতের পরিসরে বারবারই আগস্টকে মেলে ধরেছেন এক ‘সিজনাল সাবটেক্সট’ হিসেবে– ইতিহাস, স্মৃতিকথা এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওঠাপড়া যেখানে একে অন্যকে সঙ্গত করেছে, ছায়াও দিয়েছে। উপন্যাসের গোড়াতেই গ্রীষ্মের অসহ্য তাপ, মৃত্যুর মন ভার করা শীতল সংবাদ। গ্রীষ্মকে (আগস্টকে) তাই সজোরেই ‘অনভিপ্রেত’ ঘোষণা করছেন কবি।

‘It was a queer, sultry summer, the summer they electrocuted the Rosenbergs…’

এখানে ‘sultry summer’ বলতে কেবলমাত্র আবহাওয়ার পটভূমিকে নয়, বুঝতে হবে দম আটকে আসা মানসিক বিপন্নতাকেও। একাংশের মত, তাঁর আত্মহত্যার অসফল প্রথম প্রচেষ্টার জ্বালা-যন্ত্রণার দিনগুলোর হদিশ নাকি মেলে বেল জারের পাতায় পাতায়। পাঠক ধরেই নেন, আগস্টব্যাপী এস্থারের যে ভাষা হারিয়ে ফেলা, গরমে হাঁসফাঁস করা, ঘুমোতে না পারা, সেসব প্লাথের অবসাদেরই প্রচ্ছন্ন প্রকাশ। আগস্ট, বিশেষত বেল জারের ক্ষেত্রে, সংক্রামক একটি চরিত্র বহন করে, একথাটুকু সত্য যে, আমি আলবাত মানি পাঠক হিসেবে– সহজেই নিজের অসহ্য উষ্ণতা, নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণা, শূন্যতার হাহাকার, অস্তিত্বের সংকটের লড়াই পাঠকমনে ছড়িয়ে দিতে প্রবলভাবে সক্ষম। একটু এগোতেই পাঠের মধ্যে মধ্যে আগস্টকেন্দ্রিক আরও কিছু বাক্যের ব্যবহার বিশেষ নজর কাড়ে। যেমন–

‘I lay in bed in my room. It was August. The days slipped by, bright, hot days… I could feel the stillness of everything.’

এখানে স্টিলনেস, অর্থাৎ, একধরনের অসাড়তার, থেমে থাকার কথা বলা হচ্ছে যে, সেই অসাড়তার, সেই থেমে থাকারই চারিধারে, প্লাথ একটি শব্দবাহী নৈশব্দের অমোঘ প্রাচীর নির্মাণ করছেন একটু একটু করে। কখন যেন, পাঠকের অজান্তেই, অস্বাভাবিকভাবে দীর্ঘ হয়ে উঠছে সেই প্রাচীর। সঙ্গে সঙ্গে, আগস্টও। একঘেয়েমির চটচটে আঠা দুর্বিসহ করে তুলছে অস্তিত্বকে, তার থেকে নিষ্কৃতিও জুটছে না ভাগ্যে–

‘The month of August had stretched before me like a piece of chewing gum, long and stringy and sticky and endless.’

এই উপন্যাসের এই আগস্টকে কেবল ‘সিলভিয়া-সংকট’-এর অংশ হিসেবে দেখতে গেলে, সে দেখায় একটা বড়সড় ফাঁক থেকে যেতে পারে। আমরা দেখি, উচ্চাশী একটি তরুণীর ঘাড়ে সংসার ও মাতৃত্বের বাধ্যতা চাপিয়ে দেওয়া হয় যেই, এস্থারের আরও দমবন্ধ হয়ে আসে। মনে আসে, বেটি ফ্রিডানের দ্য ফেমিনিন মিস্টিকে, মার্কিন সমাজে মেয়েদের যেভাবে দেখা হয়েছে, দেখানো হয়েছে– তার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলে। মিস্টিকে ফ্রিডান বলেন, গৃহকেন্দ্রিকতা এবং মাতৃত্বকে নারীর একমাত্র পরিপূর্ণতার মাপকাঠি হিসেবে মান্যতা দেওয়ার যে ধারাটি, সেই ধারাটিই নারীমনের গভীর অস্বস্তি ও তাদের মানসিক শূন্যতার সূত্র। প্লাথের ‘বেল জার’কে তাই, বেল জারের আগস্টকে তাই, ওঁর ব্যক্তিগত জীবনের বিষাদগাথা হিসেবে না পড়ে, সমাজব্যবস্থার এহেন দৈন্যের সাহিত্যিক প্রতিরূপ হিসেবে পড়ার দায় বোধ করি। প্লাথকে ঘিরে হাজার রহস্য থাকলেও, সে তো কল্পরাজ্যের কোনও স্বপ্নে-পাওয়া চরিত্র নন। রক্তমাংসের আস্ত একজন মানুষ, যাকে এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাই জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খেয়েছে। আক্ষরিক অর্থেও। এস্থারের যে অনুভূতি, তা কেবল প্লাথের অনুভূতি নয় তাই। সমাজের চাপানো ‘আদর্শ মেয়েমানুষ’ হওয়ার সেই বোঝা, যার বিশ্লেষণের সঙ্গে আশ্চর্যভাবে মিলে যায় ফ্রিডানের তত্ত্বকথা। সমাজতাত্ত্বিক কাঠামোর ছকে ফেলে যা বলছেন ফ্রিডান, উপন্যাসে প্লাথ তার থেকে ভিন্ন কিছু বলছেন কি?

প্লাথের তিন মুখাবয়ব প্রতিকৃতি

তবু একথা বিস্মৃত হলে চলে না যে, প্লাথের আগস্ট যেমন অনভিপ্রেত, তেমনই অনিবার্য। ভিন্ন শব্দবন্ধে লেখা রিফ্রেইনের মতো যার কথা ফিরে ফিরে আসছে ওঁর লেখায়। পিছু ছাড়ছে না। জটিলতা, সংকট ক্রমাগতই বাড়াচ্ছে বটে, তা বলে একমাত্রিক নয় কিছুতেই। আগস্টকে প্লাথ ব্যক্তিগত ও সামাজিক সমস্ত সম্পর্ক বহন করে নিয়ে যাওয়ার অন্যায্য প্রত্যাশা হিসেবেও দেখছেন।

তিনি লিখছেন–

‘I could tell her I had taken a free shorthand course instead of going to the beach in July and August, the way you were supposed to if you were a scholarship girl.’

শেষ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, সামাজিক এইসব জোর-জুলুমের এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সংঘাতের বিশ্রী একটি ছবি। সত্যি তো, আমাদের বন্দি করে রাখে আমাদের সমাজ, সমাজের নিয়ম, আমাদের বন্দি করি আমরা নিজেরাই– আমাদের ঘরটুকু নয়। এমনই লিখছেন সিলভিয়া অন্যত্রও বারবার– আগস্টকে গণ্য করছেন আত্মপর্যালোচনার, ব্যক্তিগত যাবতীয় মূল্যায়নের ‘মেথড’ অথবা প্রক্রিয়া। নিজেকে মুক্ত করার নির্ভুল পাঠ, আস্ত একটা যাত্রা।

‘সূর্য যখন অস্তে পড়ে ঢুলি
মেঘে মেঘে আকাশ-কুসুম তুলি।
সাত সাগরের ফেনায় ফেনায় মিশে
আমি যাই ভেসে দূর দিশে–
পরীর দেশের বন্ধ দুয়ার দিই হানা…’

২. আগস্টের চিঠিপত্র

সিলভিয়াকে ‘উন্মাদিনী’– আমি বলিনি, বলেছে সমাজে, আজও বলে। মা অরেলিয়া শোবারের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পেরেছেন, এমন নয়। চিঠিতে সাবলীল প্লাথ তবু তো মাকেই লিখেছেন আনন্দে, দুঃখে, সংকটে, যন্ত্রণায়। গোঁড়ামিতেও। আগস্টে নানা সময় নানা কথাই লিখেছেন মা-কে। শিক্ষিকার দায়িত্ববোধ সম্পর্কে লিখেছেন, নিজের মাতৃত্বের ‘বিটারসুইট’ অভিজ্ঞতা সম্পর্কেও লিখেছেন। তাতেও আহ্লাদের, পরিতোষের, প্রসন্নতার কি উন্মাদনা ছিল না? ছিল। কিন্তু এবার তাঁর আগস্টকালীন দু’টি একেবারেই বিপরীতধর্মী চিঠি ফিরে দেখব। তাতে ওঁর উন্মাদনাকে, উন্মাদনার উৎস এবং ট্রিগারগুলিকে স্পষ্ট পড়া যায়। এবার তাঁর আগস্টকালীন যে ‘উন্মাদনা’ চিঠিতে ধরা পড়ে, ফিরে দেখব তারই অল্প কিছুটা, যা বিবাহপরবর্তী ওঁর দামাল প্রেমের আগস্ট, মা’কে লেখা ১৯৫৬ সালের চিঠিতে রাখছেন প্লাথ- আত্মহত্যার প্রচেষ্টার ঘন কালো মেঘ তখন কেটে গেছে। সদ্যই প্রেমে পড়ে বিয়ে করেছেন টেড হিউজকে। মা’কে সেসব প্রেমের কথাই জানাচ্ছেন প্লাথ। নিজেদের কবিতার কথা জানাচ্ছেন, পারস্পরিক ছন্দকে জানার, বোঝার কথা জানাচ্ছেন, জীবনের ছন্দে যে অনিবার্য ‘বাইনারি’, তার ভালোটুকুর কথা জানাচ্ছেন। কিন্তু ওঁর আগস্ট যেমন অপেক্ষার, আকাঙ্ক্ষার, তেমনই অচলাবস্থারও বটে। তার নিদর্শনস্বরূপ আলোচ্য হতে পারে ১৯৬২ সালের চিঠি।

১৯৬২-এর চিঠিও টেড হিউজকে নিয়েই।

টেড হিউজ এবং সিলভিয়া প্লাথবাহ্যত এটি ছিল মায়ের উদ্দেশে একটি ব্যক্তিগত বার্তা, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে চিঠি একটি মেয়ের, প্রতিটি মেয়ের দাম্পত্য জীবনের শ্বাসরোধী আগুন পিছনে ঠেলে, জলের কাছে গিয়ে ওঠার সঙ্কল্পের নজির। চিঠিতে প্লাথ স্পষ্টই জানান বিবাহবিচ্ছেদে প্রবল বিশ্বাসী না হলেও, স্বামী টেড হিউজের সঙ্গে থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয় আর। সে সম্পর্ক তাঁর লেখালিখি গ্রাস করেছেন, ঘুম ছুটিয়ে দিয়েছে, শারীরিকভাবেও বিপন্ন করেছে তাঁকে। এমন অসহীনয় পরিস্থিতিতে, তিনি শহিদ (‘martyr’) হয়ে থাকতে রাজি নন। তিনি কবি। তিনি সমৃদ্ধসত্তা। তিনি লিখবেন। সন্তানেরও ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবেন পাশাপাশি, এমন ভবিষ্যৎ, যা পুরুষতান্ত্রিক সংসারব্যবস্থার মধ্যে না থেকে, স্বতন্ত্রভাবে, অথচ সামগ্রিকভাবে গড়ে তোলা যায়। চিঠির শেষ অংশে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই– শেষে এসে মায়ের কাছে যাবতীয় তথ্য সংক্রান্ত গোপনীয়তা বজায় রাখার আবেদন জানাচ্ছেন তিনি, তাঁর এই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত দেশের-দশের আলোচনার বিষয় না হয়ে ওঠে যাতে। তাই তো, স্বামীর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত সমাজের বিচার-নিন্দা-করুণার বস্তুই বটে! অথচ, কবি সক্রিয়ভাবে নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রক হিসেবে নিজেকেই প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন বারেবারে।

কবিতায় আগস্ট:

‘Today is the first of August. It is hot, steamy and wet. It is raining. I am tempted to write a poem. But I remember what it said on one rejection slip: After a heavy rainfall, poems titled RAIN pour in from across the nation.’

(Sylvia Plath, The Unabridged Journals of Sylvia Plath)

এবার আসি কবিতার কথায়। প্লাথের আগস্টকে কবিতায় পড়া মানে, নারীজীবনের নানা অভিজ্ঞতার জটিল সমস্ত অধ্যায়ে, মননের চিত্র। ওঁর কবিতায় আগস্ট-চেতনা যে, সে চেতনার দেখায়, প্রেম কীভাবে আসে কিংবা যায় এই মননে, তার তাৎপর্যের বিশ্লেষণ– কখনও অপার মায়া, কখনো অলীক স্বপ্ন, কখনও বা আতঙ্কে দিনযাপন।

১৯৫৩ সালের আগস্টে ‘ম্যাড গার্লস লাভ সং’ প্রকাশিত হয় মাদামইসিল পত্রিকায়। আগেই বলেছি, যে পত্রিকায় ইন্টার্ন হয়ে কাজে যোগ দিয়েছিলেন কবি। ভিলানেল-ছন্দের এই কবিতাটি প্রেমের কবিতা। প্রেমিককে লেখা কবিতা কি না, তাই নিয়ে পাঠক হিসেবে আমার সন্দেহ আছে মনে। যদিও এই কবিতার খসড়া তৈরি হয়েছিল আগেই, তবু এই ‘উন্মাদনায়’ মাতাল কবিতার আত্মায় রয়েছে, চেনা আগস্টের বিভ্রমের তীব্রতা।

‘I shut my eyes and all the world drops dead;
I lift my lids and all is born again.
(I think I made you up inside my head.)’

স্থিতি নয়, অস্থিরতাকেই ফের বেছে নিচ্ছেন প্লাথ। বাস্তব আর কল্পনার মধ্যে যে সীমারেখা, যে বাউন্ডারি, ঘোলা হয়ে যাচ্ছে। কেউ কাউকে চিনতে পারছে না আর। বিশেষ কোনও মানুষকেও নয়। প্রেমের অনুভূতিতে ওঁর তরুণ বয়সের আগস্ট যেন ভেসে যাচ্ছে চাঁদের আলোয়, উচ্ছ্বাসে, প্রেমের ধোঁয়াটে প্রতিশ্রুতিতে, হতাশায়।

No photo description available.

কিন্তু এক দশক পরে, ১৯৬২-র দৃশ্যপট আমূল বদলে যায়। টেড হিউজের ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ পর্বের পর প্লাথ লেখেন ‘দ্য র‍্যাবিট ক্যাচার’– প্রকৃতি আর দাম্পত্যকে একইসঙ্গে ঘেঁটে দেন পাঠক-মনে, সহিংসতার ছবি ব্যবহার করে, পাশাপাশি এনে।

‘It was a place of force—
The wind gagging my mouth with my own blown hair,
Tearing off my voice,
And the sea blinding me with its lights.’

এই কবিতায় প্রেম, অথবা অন্তরঙ্গ মুহূর্তের স্মৃতি, ঘনিষ্ঠতার সংলাপ আর আরাম দিতে নয়, আঘাত দিতে তেড়ে আসে। সমুদ্র, আলো, হাওয়া, সবই যেন গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত– নারীর কণ্ঠরোধে। আগে যে আগস্ট কল্পনা আর আকাঙ্ক্ষার সময়কাল ছিল, সে আগস্ট কেবলই বাস্তবতার রূঢ় ভার এখন, এখানে।

শূন্যতা এখানে সক্রিয়, ভারী, বস্তুত আক্রমণাত্মক। বিশ্বাসঘাতকতার পর যে শূন্যতা তৈরি হয়, সে শূন্যতায়, নীরবতায় দম আটকে আসে কবির। এস্থার তো মরেই গেছিল প্রায়। মনে নেই?

‘ক্রসিং দ্য ওয়াটার’ কবিতাটি যদিও ক্যালেন্ডারমাফিক আগস্টে লেখা অথবা প্রকাশিত নয়, তবু এই কবিতার অন্তরে আগস্টের দমবন্ধ যে চেতনা, তাকে অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই পাঠকের। যেভাবে কবিতাটি শুরু হয়–

‘Black lake, black boat, two black, cut-paper people.’

কালো জল, কালো নৌকা, ছিন্ন কাগজের মতো মানুষ। সব মিলিয়ে দৃশ্যটি যেন ফের সেই চেনা ‘সাসপেন্সনের’ প্রতিচ্ছবি। জীবন-মৃত্যুর সীমানা ছাড়িয়ে, অস্তিত্ব আপনেই পরিণত হয়ে উঠছে এক ‘অ্যাবজেক্ট’ বাস্তবতায়।

অতএব, আগস্ট কবির কাছে একটি ‘মানসিক ঋতু’– বাস্তবের চেয়েও যার ঠাঁই বেশি কবিরই মনে, জীবনে, যাত্রায়। গ্রীষ্মের প্রাণবন্ত আলো হঠাৎই আগুন হয়ে, সংকেত বহন করে নারীজীবনের বিবিধ ক্ষয়ের, ছিন্নমূলতার, শূন্যতার। জলের কঠিন স্থিরতা মৃত্যুচেতনাকে ধরে রাখে, নৌকার চালও তেমনই জাগিয়ে রাখে প্রাণের ক্ষীণ অথচ অর্থপূর্ণ সঞ্চারকে। নির্দিষ্ট কোনও গন্তব্য নেই, ঠিক। তবু তো ভেসে আছে অস্তিত্ব।

এই তিনটি কবিতাকে পাশাপাশি রাখলে বোঝা যায়, প্লাথের কাছে আগস্ট-চেতনা নিজেই একটা ক্যালেন্ডার। আলাদা ক্যালেন্ডার। যে ক্যালেন্ডার পৃথিবীর আর দ্বিতীয় কোনও প্রাণের কাছে নেই। অথবা, সবার কাছেই আছে। ফ্যান্টাসি, আঘাত, আর আতঙ্কে মিলেমিশে, প্লাথের কবিতায় আগস্ট আশ্চর্য এক দ্বিধাবিভক্ত এমব্লেম– একদিকে জন্ম। অন্যদিকে মৃত্যু। মাঝে প্লাথ। পুরুষতন্ত্রের কবিতাবিলাস, কবিতাযুক্তি, যন্ত্রণার ওজনকে রীতিমতো অস্বীকার করে, নিজেই নিজের কবিতার ব্যাকরণ তৈরি করছেন যিনি। আমি, সামান্য পাঠক বলি, মেয়েদের কবিতা-ব্যাকরণ। পূর্বের ‘যুক্তিযুক্ত’ ব্যাকরণ ভেঙে যায় যেখানে। বাক্য স্বেচ্ছায় হোঁচট খায়, মাত্ৰা ভেঙে যায়, ছন্দ বদলে যায়, সিক্সাসের ‘ইক্রেচুর ফেমিনিন’ মতে, শরীরের অস্থিরতার ছন্দকে বহন করে, বহুস্বরের আকাশ খুলে দেয়।

 

উপসংহার

রোলাঁ বার্থ নিয়ে দীর্ঘ প্রবন্ধ পড়ে-লিখেও, পাঠক্রিয়ায়, পাঠ-উত্তর প্রতিক্রিয়ায়, তবু আমরা জায়গা করে দেব না মেয়ে লেখকের ‘মৃত্যু’-কে। জীবিত থাকতেও না, বিদেহী হলেও না। ক্রমাগতই লেখাপত্রের সবই দেখব ব্যক্তিগত জীবনের নিরিখে। তবুও সেসব পাঠের গা বেয়ে যে ‘উন্মাদনার’ ব্যাকরণ ঝরে পড়ে, সে ব্যাকরণ আত্মহত্যার রোমহর্ষক রি-টেলিং-কে অতিক্রম করে যাওয়া আগস্টেরও ব্যাকরণ। আমাদের সবার ব্যাকরণ। মেয়েদের ব্যাকরণ। যে ‘উন্মাদনা’ নিয়ে ওঁর মরণোত্তর পৃথিবী আজও বিভোর, সেই উন্মাদনার জানাজা চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে আজ, এখন। কবিতাতত্ত্বের একাধিপত্যের শ্বাসরোধ করে দিচ্ছে কবির আগস্ট, আগস্টের দমবন্ধ করা গরম। সবাই হাঁসফাঁস করছে।