মূলধারার ছবিতে যখন আমরা মিসোজিনি, হিংসা (অ্যানিমাল), জাতিভেদ, পুলিশি কর্মকাণ্ড (‘সিংহম’, ‘দাবাং’, ‘গঙ্গাজল’ বা ‘আর্টিকল ১৫’-ও যদি ধরা যায়) দেখি– তখন ওই ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ক্যানভাস, প্রিয় নায়কের হিরোসুলভ উপস্থিতি, জাঁকজমক– গোটা ব্যাপারটাকে বিনোদনের মোড়কে মুড়ে দিয়ে খানিক দূরের জিনিস করে তোলে! এটা যে সিনেমা, সেটা বারবার মনে করিয়ে দেয়। আমরা জানি, পপকর্ন খেতে খেতে দেখব, তারপর যে যার বাড়ি চলে যাব! কিন্তু ‘সন্তোষ’ আমাদের বাস্তবের এত কাছে এনে দেয় যে, সেখান থেকে মুখ ঘুরিয়ে চলে যাওয়া কঠিন। এই সিনেমাটির এই বছরের জানুয়ারি মাসে মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সিবিএফসি অনির্দিষ্টকালের জন্য ব্রিটিশ পরিচালক সন্ধ্যা সুরির এই হিন্দি ছবিটি ব্যান করেছে!
ক্ষমতা কীসে ভয় পায়? কাকে ভয় পায়? এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা কাকে ‘ক্ষমতাবান’ বলব? ঠিক কারা বা কীসের সাহায্যে মানুষ ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে। কারণ, এই ক্ষমতা যদি পাইয়ে দেওয়া হয়, অর্থাৎ যা নিজের অর্জন নয়, সেই বাইরের বর্ম সরে গেলে ক্ষমতাও হারিয়ে যায়। তা সে অর্থের জোর হোক বা রাজনৈতিক সাহায্য। আজকাল এই দুটো ক্ষেত্র নির্ধারণ করে দেয়, কে কখন ক্ষমতায় থাকবে। নেতা নাকি শিল্পপতি– কার জোর বেশি বলা মুশকিল হলেও এই দুইয়ের জটিল যোগবন্ধনেই চলছে গোটা দেশ, বিশ্ব! আর আমরা, যারা সাধারণ মানুষ, তারা হলাম শত শত ক্ষমতাহীন মাথা এবং আমরাও নিজেদের মধ্যে ধর্ম, শ্রেণি, জাত, কর্মক্ষেত্র, লিঙ্গ বিশেষে হায়ারার্কি এবং পক্ষপাতিত্ব তৈরি করে ক্ষমতা দখলের লড়াই করে চলেছি। রাষ্ট্র ক্রমাগত আমাদের লড়িয়ে দিচ্ছে, উসকে দিচ্ছে! আমরা নিজেদের মধ্যে লড়লে তারা ক্ষমতায় থাকবে– এ বড় প্রাচীন পন্থা। কিন্তু এই ক্ষমতাও ভয় পায়? কাকে? কীসে? উত্তর হল– সত্যকে! আর যে বা যারা যুগ যুগ ধরে এই সত্যি তুলে ধরার চেষ্টা করে– তা সে সাহিত্য, সিনেমা, শিল্প, সাংবাদিকতা, জার্নাল– যে মাধ্যমেই হোক না কেন, তার শ্বাসরোধ করা হয়!
পুঁজিবাদী রাষ্ট্র কোনও দিনই জনকল্যাণকর নয়, পুঁজিবাদ একটা রাষ্ট্রকে ক্ষমতাবান করে তোলে যুদ্ধ, দাঙ্গা, অনাহার, পরমাণু বোমার হুমকি, জঙ্গল সাফ, উচ্ছেদ, লিঙ্গ-কেন্দ্রিক নৃশংসতা, অসাম্য, জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতার মাধ্যমে। আমরা যেদিকে তাকাব, সেদিকেই দেখব মানুষের বেঁচে থাকার মূল্য কত কম। একলা মানুষকেও তাই ক্ষমতা থ্রেট হিসেবে দেখতে পারে, ক্ষমতা এখন অনেক বেশি সচেতন– ‘চুন চুনকে’ চুল-চেরা বিচার করছে মানুষের গতিবিধির। একেবারে তুচ্ছ একলা মানুষের স্বরকেও ক্ষমতা ভয় পায় বলেই সাংবাদিক হত্যার সংখ্যা বেড়েছে, বেড়েছে নানা নিষেধাজ্ঞা। মূলধারা থেকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে সেইসব সিনেমাকে, যে সিনেমা সত্যকে তুলে ধরছে, অভিনেতাকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে, তথ্যচিত্র নিষিদ্ধ হচ্ছে– বাকস্বাধীনতা যেন সোনার পাথরবাটি!
দীর্ঘদিন ধরেই ভারতে ফ্যাক্ট বা সত্যিকে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে, বদলে যাচ্ছে ইতিহাস বই, অতীতকে অস্বীকার করলে তবেই এই নয়া ক্ষমতা টিকে থাকবে। পৃথিবী জুড়ে চলছে সত্যকে গোপন করে কভার আপ-এর খেলা। তাই এই সময়টাকে যথার্থই ‘পোস্ট ট্রুথ’ বা ‘উত্তর সত্য’ যুগ বলা হচ্ছে, অর্থাৎ কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যে এটা গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ১৯৮৩ সালে তৈরি গোবিন্দ নিহালনির ছবির শিরোনাম– অর্ধ সত্য’ যেন আরও বেশি করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। তেমনই এক ছবি ‘সন্তোষ’ এই বছরের জানুয়ারি মাসে মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সিবিএফসি অনির্দিষ্টকালের জন্য ব্রিটিশ পরিচালক সন্ধ্যা সুরির এই হিন্দি ছবিটি ব্যান করেছে!
৭৮-তম বাফটা অ্যাওয়ার্ডস-এও নমিনেশন পায় ‘সন্তোষ’। কিন্তু ভারতে ছবিটি মুক্তি পায় না। এই ছবিতে আছে ক্ষমতা আর ক্ষমতাহীনের এক অদ্ভুত ট্র্যাপিজ খেলা! ‘সন্তোষ’ দেখার পর থেকেই ভাবছি, কী এমন আছে যা আগে ভারতীয় দর্শক দেখেনি বা জানে না! ধর্মান্ধতা, মিসোজিনি, জাতিভেদ, পুলিশি অত্যাচার, নারীর নিজস্ব কণ্ঠ– ভারতীয় সিনেমায় সবই দেখেছে দর্শক!
আসলে মূলধারার ছবিতে যখন আমরা মিসোজিনি, হিংসা (অ্যানিমাল), জাতিভেদ, পুলিশি কর্মকাণ্ড (‘সিংহম’, ‘দাবাং’, ‘গঙ্গাজল’ বা ‘আর্টিকল ১৫’-ও যদি ধরা যায়) দেখি– তখন ওই ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ক্যানভাস, প্রিয় নায়কের হিরোসুলভ উপস্থিতি, জাঁকজমক– গোটা ব্যাপারটাকে বিনোদনের মোড়কে মুড়ে দিয়ে খানিক দূরের জিনিস করে তোলে! এটা যে সিনেমা, সেটা বারবার মনে করিয়ে দেয়। আমরা জানি, পপকর্ন খেতে খেতে দেখব, তারপর যে যার বাড়ি চলে যাব! কিন্তু ‘সন্তোষ’ আমাদের বাস্তবের এত কাছে এনে দেয় যে, সেখান থেকে মুখ ঘুরিয়ে চলে যাওয়া কঠিন।
এই ছবি সত্যির এত কাছাকাছি যে ক্ষমতা ভয় পায়। গোটা ছবিতে কোনও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক নেই, প্রায় তথচিত্রের ঘরানায় তৈরি এই ছবি, এক বিধবা যুবতীর গল্প বলে, যার নাম সন্তোষ সাইনি (নামভূমিকায় সাহানা গোস্বামী)। কনস্টেবল স্বামী মারা গেলে সেই চাকরি সে পায়। সন্তানহীন এই যুবতী, অন্যান্য তথাকথিত গৃহবধূর মতো নয় বলেই শ্বশুরবাড়িতেও ঠাঁই পায় না। কাল্পনিক চিরাগপ্রদেশের এক অঞ্চলে পুরুষশাসিত কর্মক্ষেত্রে তার নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে সে বুঝতে পারে তাঁকে হয়ে উঠতে হবে ক্ষমতায় থাকা পুরুষের মতো। উঁচু গলায় কথা বলতে, ঘুষ নেওয়া শিখতে হবে, অন্যায় দেখে চুপ থাকতে হবে।
পুলিশের উর্দি পরে খানিক নিজেকে ক্ষমতাবান মনে করলেও পুরুষ-শাসিত কর্মক্ষেত্র তাঁকে সর্বক্ষণ মনে করায় সে নারী। সন্তোষ স্থান-কাল-পাত্র বুঝে নিজের ক্ষমতা দেখায়, আর বাকি সময় সে সব কিছু দেখে। এই ছবি দেখায়, কীভাবে পুরুষশাসিত কর্মক্ষেত্রে নারী নিজেকে চালনা করে, নিজেকে বিস্তার করে। কেউ কেউ উচ্চাশা মেটাতে এই পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোয় ঢুকে পড়ে ক্রমাগত নিজেকে পরিবর্তন করতে করতে টিকে থাকে, আবার কেউ কেউ এই কাঠামোরই সৈনিক হয়ে ওঠে অজান্তে।
সন্তোষ এর মধ্যে ঢুকে পড়ে সমস্তটা লক্ষ করে– কখনও অবাক হয়ে দেখে, কখনও কুঁকড়ে গিয়ে, কখনও বিস্ফারিত নেত্রে তাকিয়ে থাকে! ওর চোখ দিয়ে আমরাও দেখি। আমরা দেখি এক ধর্ষিত মেয়ের বাবাকে কীভাবে থানায় মজার ছলে হেনস্তা করা হয় কারণ সে ‘দলিত’। আমরা দেখি দলিত মেয়েটির মৃতদেহ থানায় এলে, তদন্তের বদলে শুদ্ধিকরণ পুজো দেওয়া হয় সিনিয়র অফিসারের নির্দেশে। ক্ষমতা, দমন করতে চাইলেও ব্যাড পাবলিসিটি চায় না, তাই ঠাকুর পদবির সেই সিনিয়র বদলি হয়ে যায়, তার জায়গায় আসে নতুন অফিসার গীতা শর্মা (অভিনয়ে দুর্দান্ত সুনীতা রাজওয়ার)। ক্ষমতা এমন এক সিস্টেম, যেটাকে চালানোর নিজস্ব কিছু দাবি আছে। পুরুষ হোক বা নারী, চালকের আসনে বসলে সে-ও সেই সিস্টেমের অংশীদার হয়ে উঠবে। গীতাও এই ক্ষমতাতন্ত্রের দুর্নীতির এক অধস্তন কর্মী। তফাত কেবল সে এই সিস্টেমের মধ্যেও নারী-পুরুষ বৈষম্য নিয়ে নিজস্ব স্টাইলে লড়াই চালায়– কখনও পুরুষের মুখোশ পরে, কখনও সেই মুখোশের বিরুদ্ধে লড়াই করে!
বিশ্ব জুড়ে যে সত্যকে চাপা দেওয়ার খেলা চলছে, সেই খেলার নিয়ম মেনেই– দলিত মেয়েটির ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগে পুলিশ তদন্তের আড়ালে স্থানীয় মুসলিম ছেলে সেলিমকে হত্যা করা হয়। আর সিস্টেমের অংশ হয়েই সন্তোষ সেই হত্যায় তাৎক্ষণিক ক্রোধের বশে অংশ নিলেও, পরে রাতে ঘুমোতে পারে না। কারণ এই সিস্টেমেটিক মেশিনারিতে অনভ্যস্ত সন্তোষের মতো সাধারণ নাগরিকের বিবেক যেহেতু আবেগ এবং মূল্যবোধ নির্ভর করেই বাঁচে। সে, দীপাকে প্রশ্ন করে, ‘উও ক্যায়া কহ রাহা থা, হামনে শুনা ভি নাহি’! আর বেশিরভাগ সময়ই শোনা হয় না। মানুষের আবেগ, সংকট যেসব কেসের সঙ্গে যুক্ত– সেখানে ন্যায়বিচার বেশিরভাগ সময় ঠিক হয় ক্ষমতায় থাকা দলের ঠিক-ভুলের সংজ্ঞা অনুযায়ী! এখানে ইনসাফের সঙ্গে সত্যের যোগ বড় ক্ষীণ! এবং সন্তোষের মতো নিম্নমধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষদের সারল্য এবং মূল্যবোধ ব্যবহার করা হয় ঘুঁটি হিসেবে। ‘সেলিমদের’ বা ‘সঞ্জয়দের’ ভবিষ্যৎ অনেক আগেই ঠিক হয়ে যায়। ‘সন্তোষরা’ জানতেও পারে না। সে বরং কাগজে ছবি বেরনোয়, মা-মাসির ফোন পেয়ে ভাবে ‘কুছ তো আচ্ছা কিয়া ম্যায়নে’! তারপর আমরা দেখি– একটা মানুষ কীভাবে অত্যাচার সহ্য করতে করতে, গোঙাতে গোঙাতে, মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়! কেন? কারণ সেই মুহূর্তে এই অপরাধের জন্য তার মতো যোগ্য প্রার্থী আর নেই। ক্রাইম, ঘটনা বা দুর্ঘটনার বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে পুলিশ এবং রাষ্ট্রের সুবিধে অনুযায়ী অপরাধী বদলে বদলে যায়– এটাই সময়ের ইনসাফ। গীতাও, সন্তোষকে বলে, ‘আমাদের দেশে দুই ধরনের অস্পৃশ্যতা কাজ করে। একদল আছে যাদের কেউ ছুঁতে চায় না, আরেকদল আছে যাদের ছোঁয়া যায় না।… ভেবে দেখো আমরা সমাজের চোখে অন্তত ন্যায় এনে দিয়েছি’। এমন ন্যায়ের উদাহরণ আমাদের চারপাশে খুঁজলে অজস্র পাব! যেখানে গোটা সিস্টেমের কর্মফল একজন ব্যক্তির ঘাড়ে চাপিয়ে ‘ন্যায়’ বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। এই সত্যিটা সামনে আসতেও পারে আর ভয় সেইখানেই!
পুলিশ কাস্টডিতে মৃত্যুর ফলে, গীতা একাই গোটা দোষ নিজের ঘাড়ে নিলে, সন্তোষ অবাক হয়। তখন গীতা তাকে বলে, ‘কেনই বা তোর আরও বদনাম করাব, এমনিতেই মেয়ে হয়ে জন্মে কি কম বেইজ্জত হতে হয়!… রাজনীতিতে যাওয়ার ইচ্ছে আছে, মেয়েদের জন্য অনেক কিছু করার আছে…’। সন্তোষের প্রতি সিনিয়র অফিসার গীতার এই আত্মত্যাগ তাদের মধ্যেকার যৌন টানাপোড়েনের, সিস্টারহুডের কারণে নাকি কেরিয়ারে নতুন মোড় আনার দূরদর্শিতায়– সেটা পরিচালক বুঝতে দেন না। কিন্তু সন্তোষ ঠিক করে ফেলে সে আর পুলিশের চাকরি করবে না, তার যুদ্ধক্ষেত্র সে বদলে নেয়। সমাজের চোখে ন্যায় মানে যে ক্ষমতাবানের ন্যায়– এই সত্যিটা সন্ধ্যা সুরির ছবি স্পষ্ট এবং শান্ত স্বরে বলে। এবং এতবার বলে যে, স্লোগানের মতো মাথায় চেপে বসে, আর সেটাকেই এত ভয় ক্ষমতাবানের! কোনও গলাজোয়ারি নেই, দেখানেপনা নেই, বিশেষ রাখঢাক নেই, ম্যাজিকাল লোকেশন নেই, জাঁকজমক নেই, লার্জার দ্যান লাইফ নেই– শুধু বাস্তব আছে, রূঢ় বাস্তব আছে। এমন ফিকশন যা ফ্যাক্টয়ের কাছাকাছি। যে ছবি দেখলে ‘সিনেমা’ বলে মনে হয় না। যে ছবি মিথ্যে আশার কথাও বলে না। বারে বারে তেমন ছবির শ্বাসরোধ করা হয় বলেই, সেই ছবিকে দর্শকের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন!
আশ্রমজীবনকে বিদেশিরা সহজেই আপন করে নিতেন। রবীন্দ্রনাথের বিশেষ নজর ছিল তাঁদের প্রতি। রানী চন্দকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘কত বিদেশি আসে এখানে নিজের ঘর ছেড়ে। দেখিস তারা যেন সেটি অনুভব না করে। আশ্রমে যেন তারা ঘর পায়।’