সাম্প্রতিক সময়ে যে-ধরনের ছবির রমরমা, ধরা যাক ‘ছাবা’ অথবা ‘সাইয়ারা’ কিংবা ‘খাদান’– প্রতিক্ষেত্রে হয় প্রবল পৌরুষত্ব আউটবার্স্ট করে, নয় ভায়োলেন্স, নইলে প্রেম। এই যে উদ্দামতা, অযথা উচ্ছ্বাস কিন্তু ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির ফসল। ডোপামিন হিট লাগবে। তবেই ছবি সুপারহিট। ‘গুড বাই মাউন্টেন’ অবস্থান করে এর সম্পূর্ণ বিপরীতে। ইন্দ্রাশিস আচার্য যে ভালোবাসার কথা বলেন, তা একটা মাটির বাড়ি। পাশে কাগজফুলের গাছ। উঠোনে, নাইলনের দড়িতে মেলে রাখা একটা শার্ট। ভালোবাসা এভাবেই আসে। আর যখন চলে যায়, আমরা দেখি, দড়িটা ফাঁকা। জীবনের অনেক অনেক দিন পরে, অবাধ্য শার্ট ধুয়েমুছে মেলে দিয়েছিল যে– সে চলে গেছে। মায়া বোধহয় এটুকুই।
পুরাণ কাহিনির মতো একটা প্যাগোডা। সামনে এসে দাঁড়িয়েছে একা একলা মানুষ। দেওয়ালময় আশ্চর্য কত স্মৃতিছাপ, যেন ভাস্কর্যের মতো গভীর দৃশ্যমান আর ভালোবাসার মতো সত্য। একলা মানুষ, এহেন দেওয়ালেই খুঁজে পেয়েছে এক ছিদ্র। প্রত্নযুগের। রোদ পড়েছিল। ছিদ্রের গায়ে ঠোঁট দুটো ঠেকিয়ে, একলা মানুষ হয়তো বলেছিল জীবনের ক্লান্তির কথা। সিগারেটের কথা। অথবা, সেই মেয়েটির কথা! একটা আলো-আঁধারি গলিতে দাঁড়িয়েছিল যে।
–আমি ভাবতে পারিনি তুমি আমায় ভালোবাসবে!
–আমিও কি ভেবেছিলাম বলো?
একলা মানুষ ঘাস আর মাটি দিয়ে ছিদ্রের মুখ বন্ধ করে দেয় তৎক্ষণাৎ। সেই গল্প যেন প্যাগোডার অচেতন শরীরে চারিয়ে যায় তারপর। কান পাতলে শোনা যায়, একটা মেলানকোলিক বেহালা। ভাবি, ঘাস আর মাটির আবরণ খসে যদি এত বছরে? ‘ইন দ্য মুড ফর লাভ’ সিনেমায়, ওং কার ওয়াই যে গল্প বন্দি করে দিয়েছিলেন বৃহৎ স্থাপত্যের কোটরে, এ-সভ্যতার শিল্পে ও চেতনায়, অধরা মাধুরী মতো সে গল্পের দুটো চরিত্রের দেখা হয়েছে অবশেষে। ২২ বছর পরে। পাহাড়চূড়োয়। কেরলের কোনও নিরালা গ্রামে। ধরে নিলাম, সেটা ইন্দ্রাশিস আচার্যর ‘গুড বাই মাউন্টেন’ ছবিতে।
একমনে জীবনানন্দ দাশ আওড়াচ্ছিল অর্জুন। বিপরীতে, আনন্দী। “সোনালি-সোনালি চিল— শিশির শিকার ক’রে নিয়ে গেছে তারে—/ কুড়ি বছরের পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে!” কী হয় তবে? নিশ্চুপে বসে থাকে দু’জনে। কথা ফুরিয়েছে অথবা এত কথা যে গলার কাছে ঘাই মারছে প্রবল। ইন্দ্রাশিস আচার্য এক সাক্ষাৎকারে বলছেন: ‘চরিত্রদের ডেস্টিনি নিয়ে আমি বিচলিত হই না কখনও। একটা চৌখুপিতে বেঁধে না রেখে, ছেড়ে দিই।’ আমরা বুঝতে পারি, মানুষের মনের অন্তর্দ্বন্দ্ব আর অবদমিত আকাঙ্ক্ষার ওপর মহাজাগতিক কোনও টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে এগিয়ে যান ইন্দ্রাশিস।
বিলু রাক্ষসে যেমন বিলু, নীহারিকায় যেমন দীপা– উভয়েরই একা হয়ে যাওয়ার যাত্রাপথে অপেক্ষা করছিল অর্জুন। সে জানে, পৃথিবীর রূপ-রস আর গন্ধে খুব বেশিদিন নেই বেঁচে থাকার। বাইশ দিনের জন্য ফিরে পেতে চায় পুরনো প্রেম। বুকের যে জায়গাটা ফাঁপা, হাওয়া লাগলে শব্দ শোনা যায়, অর্জুন সেই শূন্যস্থান ভরাট করছিল আনন্দীর স্নানে। সাবানের ফেনায়। শাড়ির গন্ধে। আনন্দী জিজ্ঞেস করে, ‘কী করে সময় কাটাতে?’ অর্জুন বলে, ‘অপেক্ষা করে।’
এ-ছবিতে, ব্যক্তি ইন্দ্রাশিস সিনেমার সঙ্গে সংলাপ জারি রেখেছেন শেষতক। প্রথমে মনে হয়েছিল, বহু এপিসোডে ভাঙছেন বুঝি। ক্রমে ক্রমে স্পষ্ট হয়, এ-আসলে পরিচালকের স্বগতোক্তি। একটা ফেরত আসার দ্বন্দ্ব তৈরি করা। দ্বন্দ্ব তৈরি করা বাস্তব ও স্বপ্নের। অথবা, ইমোশনের রাশ টেনে ধরা। কখনও চরিত্রদের। কখনও আমাদেরও। যে কারণে শুধুই গ্যাদগ্যাদে ইমোশনাল ছবি হয়ে যায় না ‘গুড বাই মাউন্টেন’। তবে এ-ছবি কীসের? শক্তি চট্টোপাধ্যায় ‘একবার তুমি’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘বুকের ভিতরে কিছু পাথর থাকা ভালো– ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়…’। যেন ওই সমস্ত প্রতিধ্বনি জুড়ে জুড়ে ‘গুড বাই মাউন্টেন’ নির্মাণ করেছেন ইন্দ্রাশিস।
এ-ছবির রাজনীতি সম্পর্কে দু’কথা বলা প্রয়োজন।
সাম্প্রতিক সময়ে যে-ধরনের ছবির রমরমা, ধরা যাক ‘ছাবা’ অথবা ‘সাইয়ারা’ কিংবা ‘খাদান’– প্রতিক্ষেত্রে হয় প্রবল পৌরুষত্ব আউটবার্স্ট করে, নয় ভায়োলেন্স, নইলে প্রেম। এই যে উদ্দামতা, অযথা উচ্ছ্বাস কিন্তু ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির ফসল। ডোপামিন হিট লাগবে। তবেই ছবি সুপারহিট। ‘গুড বাই মাউন্টেন’ অবস্থান করে এর সম্পূর্ণ বিপরীতে। ইন্দ্রাশিস আচার্য যে ভালোবাসার কথা বলেন, তা একটা মাটির বাড়ি। পাশে কাগজফুলের গাছ। উঠোনে, নাইলনের দড়িতে মেলে রাখা একটা শার্ট। ভালোবাসা এভাবেই আসে। আর যখন চলে যায়, আমরা দেখি, দড়িটা ফাঁকা। জীবনের অনেক অনেক দিন পরে, অবাধ্য শার্ট ধুয়েমুছে মেলে দিয়েছিল যে– সে চলে গেছে। মায়া বোধহয় এটুকুই।
ইন্দ্রাশিস আচার্য যে সন্দেহের কথা বলেন, যে অপ্রেমের কথা বলেন, তা চমৎকার। আনন্দীর স্বামী রথীজিৎ উপস্থিত হয়। ভেবেছিলাম, ‘থ্রি অফ আস’ অথবা ‘পাস্ট লাইভস’-এর মতো ছবির দিকেই বাঁক নেবে। ব্যকরণ বদলে দেয় রথীজিৎ। সে চরিত্রে অনির্বাণ ভট্টাচার্যের অভিনয় অনবদ্য। রথীজিৎ এমনই এক চরিত্র, যে একটা মেকি পৌরুষ নিয়ে বেঁচে আছে। তার সৌন্দর্যবোধ, দাম্পত্যজীবন এমনকী যৌনতা ততখানিই যান্ত্রিক, যতখানি তার কান্না। ভাবে, অর্জুনকে খাদের ধারে ঠেলে দেবে। কিন্তু অতটুকুই। সে চরিত্র দড় নয়, আনন্দীকে ভেবেছে দেওয়াল আলমারির শো-পিস, সে চরিত্র যখন অর্জুনের সামনে জিতে যায়, আনন্দীকে সঙ্গে করে কলকাতায় ফেরে, সে জয় আদৌ জয়সুলভ তো? ঠিক এইখানেই অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্যের জয়।
প্রতীক্ষায় এক-একটা মানুষ পাহাড় হয়ে যায়। অর্জুন যেমন। সে চরিত্রে ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত অভিনয় করলেন খুব ভালো। বয়সের, ব্যাধির এবং না-হওয়া প্রেমের যে দুঃসহ ভার, চমৎকার বইলেন ছবিজুড়ে। একটা টপ শটে আমরা দেখছি, পাহাড়ের বুকভর্তি জল। নিস্পন্দ। গভীর। ওই জল আসলে আনন্দী। ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত যে চরিত্রে স্থাণু এবং অপূর্ব। অভিনয়ে কখনও কখনও ইমোশনালি অতিরেক। তবু আনন্দী যখন অর্জুনের বুকে কান পাতে, আমরা বুঝতে পারি, জল কেঁপে উঠল। ঝরনার জল বয়ে যাবে আজীবন। সাধুবাদ জানাতে ইচ্ছে হয় চিত্রনাট্যকার ইন্দ্রাশিস আচার্যকে। যে ডাক্তারটি অর্জুনের ট্রিটমেন্ট করছে, সেই ছোট্ট একটি চরিত্রেরও কী অপরিসীম দ্বন্দ্ব! সে ভালোবেসেছে অর্জুনকে, কলকাতায় ফিরে যায়নি তারপর। অর্জুনকে সে একান্তভাবে পেয়েছে কেবল ইঞ্জেকশন দেওয়ার মুহূর্তেই! আর তারই জিম্মায় অর্জুনকে রেখে চলে গেল আনন্দী। তারই হাতে অর্জুনের আয়ু। অনন্যা সেনগুপ্ত কী আশ্চর্য অভিনয় করলেন!
দুঃসহ ভার কি অর্জুনের একার? অর্জুন একাই কি মহৎ সেজেছে এ-গল্পে? তখন আনন্দী রথীজিতের দিকে তাকায়। অনিচ্ছাকৃতভাবে টেনে নেয় রথীজিতের হাত। মনকেমন করা বেহালাটা আর বাজে না। তবে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক এবং গান– দুই মিলিয়েই রণজয় ভট্টাচার্য চমৎকার। ‘ইন দ্য মুড ফর লাভ’ ছবির সেই দুরন্ত বেহালার স্মৃতি খুঁচিয়ে দেওয়ার জন্যে ধন্যবাদ তাঁকে।
বিমল করের একটি গল্প বলে এ-লেখায় ইতি টানি।
গল্পের নাম, ‘খিল’। মাধবী এবং সুধাংশুর হঠাৎ দেখা। রেলস্টেশনে। মাধবী এসেছিল চাকরির ইন্টারভিউ দিতে। সুধাংশু অপেক্ষা করছিল অন্য কারও-র জন্যে। গল্প যত এগোয়, একটা না-হওয়া প্রেমের বাতাস এসে লাগে চোখে। মুখে। সুধাংশুর বাংলোয় ওঠে মাধবী। ভোরবেলায় উঠে পড়েছিল দু’জনেই। মাধবীর ঘুম হয়নি রাতে। এরপর সুধাংশু বলে,
–খিল তো তোমার ঘরে ছিলই!
–খিল! মাধবী স্পষ্ট কণ্ঠে বললে, ‘খিল তো খোলাই ছিল।’
–আমিও জেগেছিলুম সারারাত। আস্তে আস্তে বললে সুধাংশু, ‘এ ঘরের এপাশেও খিল ছিল না।’
ইন্দ্রাশিস আচার্য সেই ভেজিয়ে রাখা দরজাটা যেন খুলে দিলেন। আমরা দেখলাম মাধবী আর সুধাংশু কাছে এসেছে ২২ বছরের ঝড়জল শেষে। আমরা দেখলাম, অসামান্য কিছু লং শট। যেখানে প্রতিটা মানুষই একা। আমরা দেখলাম একটা ঝরনার সামনে বসে আছে একা একলা অর্জুন। সম্বল বলতে, আনন্দীর রুমাল, চুলের ক্লিপ, ঘুমের ওষুধ। আর রবীন্দ্রনাথ। মায়া বলতে এটুকুই।
………………………………
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
………………………………
ধৈর্যের একেবারে চূড়ান্ত সীমায় এসে কবির মনে হয়েছে, ‘ছবিগুলি বুবা লুকিয়ে রেখেছে এই সন্দেহ বরাবর আমার মনে আছে। সে আমার মৃত্যুর অপেক্ষা করবে’ ইত্যাদি ইত্যাদি। তারও বছর তিনেক বাদে কিশোরীমোহনের প্রবল পরিশ্রমে ১৯৪০-এর পুজোর মুখে সেই ছবির অ্যালবাম ‘চিত্রলিপি’ প্রকাশ পেয়েছে।
মনসুরের তৈরি করে দেওয়া এক ধরনের পাঞ্জাবিই রীতি মেনে বাবাকে পরতে দেখেছি। পাঞ্জাবি অবশ্যই অনেকগুলো, নানা সময়ে তৈরি করতে দেওয়া। কিন্তু প্রতিটা পাঞ্জাবিই এক্কেবারে একইরকম দেখতে। ছয়ের দশকের পাঞ্জাবির নকশা বা কাপড় যা, নয়ের দশকেও তাই।