বিদ্যালয়ে মেন্সট্রুয়াল হাইজিন ম্যানেজমেন্ট কি নেওয়া হয়েছে?– এই প্রশ্নের সদর্থক উত্তর পাওয়া কঠিন। বাস্তব অস্বস্তি ও মানসিক চাপ নিয়ে ছাত্রীরা এসময় বিদ্যালয়ে থাকতে রাজি হয় না। আর কর্তৃপক্ষও এই বিষয় নিয়ে শুধু ছাত্রীদের জন্য অন্যরকম কিছু কি ভাবা যায়, তা নিয়ে অত মাথাব্যথা করতে রাজি নয়। প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কাজের মাঝে এটা অতি গুরুত্বপূর্ণ বলে মান্যতা পায় না। আর বিষয় যখন শারীরিক এবং গোপনীয় তখন মেয়ের বাড়ির লোক দেখভাল করার জন্য দায়বদ্ধ ধরে নেওয়া হয়। পাঁচদিন পর যখন স্কুলে ফেরা তখন শরীর খারাপ বললেই বিষয় সহজ হয়ে যায়। তাই ছাত্রীর পিরিয়ডসের দিন বিদ্যালয়ের দিনের বদলে ঘরে থাকার অভ্যাসে এবং প্রতিষ্ঠানের জন্য এটি স্বাভাবিক ঘটনা বলেই চলে আসছে।
ছাত্রীর বয়স মাত্র দশ। ওর কাছে লজ্জা মানে জামায় দাগ। লাল দাগ।
অসম্মান হল দাগ নিয়ে পথ পেরিয়ে বাড়ি ফেরা। দেখে ফেলবে এই অপমানবোধে মানসিক চাপে থাকা।
এমন নানা লজ্জা-ভয়-অপমানের সংজ্ঞা বদলের জন্য পাশে কেউ নেই ওদের। যেমন সীতাতলার সঙ্গীতারও কেউ ছিল না। ১৪ বছরের কিশোরী গাওকরে নির্বাসিত ছিল দিন পাঁচেক। পিরিয়ডসের সময় এই ঘরেই থাকার নিয়ম। পিরিয়ডসের দিনে বিচ্ছিন্নবাসের জন্য তৈরি ছৌপদীকে মানবাধিকার লঙ্ঘন বললেও এই প্রথার বিরুদ্ধে ল ড়ে একেবারে বন্ধ করা যায়নি এই অব্যবস্থাটি। মর্যাদার পিরিয়ডসের দিন আদায় করে নেওয়া যায়নি দেশের কোনায় কোনায়। অগত্যা সবটাই সেই ‘কপালের দোষ’। ‘হ্যাপি টু ব্লিড’ বা ‘রেড ইজ নট শেম’, ‘পিরিয়ড প্রাইড’-এর গর্জন কোথাও কোথাও একেবারেই মূল্যহীন। সাম্প্রতিক প্রকাশিত খবর বলছে, পরীক্ষা হলে প্যাড না পেয়ে বাড়ি ফেরা একাদশের ছাত্রীটিও দাগ লুকোতে বাড়িই ফিরে গেল। বিদ্যালয়ের অনেক কাজের মাঝে ছাত্রীর পিরিয়ডস সমস্যা অত গুরুত্ব পেল না। কারণ পেটে ব্যথা হলেই বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া প্রাতিষ্ঠানিক এক অলিখিত নিয়ম প্রায় সর্বত্র। পিরিয়ডস নিয়ে ভয়, উদ্বেগ ও বিব্রত ছাত্রীর পাশে তখন একরাশ লজ্জা আর আড়াল খোঁজা। মাঝে মাঝে প্রশ্নবাণ। কী রে তুই জানতিস না? এলি কেন স্কুল তবে? উত্তরে মাথা নীচু মুখ লাল করা বাচ্চাটি অসহায়ভাবে নীরব। দায় নেই যেখানে, সেখানে লজ্জা! ভুল নেই যেখানে, সেখানেই উত্তর দেওয়ার পালা! তারপরে বিশ্বাস করতে থাকা মেয়ে হয়ে জন্ম নিলে এসব সকলকেই মেনে নিতে হয়! সাহায্যের বদলে তিরস্কার মাথায় তুলে নেওয়ার অভ্যাস এভাবেই শুরু। আত্মবিশ্বাস হারানোর ছবিটা মনে গেঁথে দেয় এই দিনগুলো।
……………………………………………
আর্লি মেনার্কি বা দ্রুত পিরিয়ডসের ফলে হঠাৎ দিনটি চলে আসা এখন গ্লোবাল ট্রেন্ড। বিষয়টি অনেকের কাছেই অজানা। সেটি বিদ্যালয়ে ঘটতে পারে এবং এটি স্বাভাবিক ঘটনা বলেই ছাত্রীদের কাছে প্রতিভাত হওয়ার কথা। সেই পরিস্থিতিতে যে সহযোগিতা পাওয়ার কথা, সেটা সবক্ষেত্রে ছাত্রীরা পাচ্ছে না। কারণ মেনুস্ট্রুয়াল হেলথ নিয়ে বেশি বলাবলিতে অনভ্যস্ত থাকাটা প্রান্তিক এলাকায় খুব বেশি অস্বাভাবিক নয়।
……………………………………………
বিদ্যালয়ে মেন্সট্রুয়াল হাইজিন ম্যানেজমেন্ট কি নেওয়া হয়েছে?– এই প্রশ্নের সদর্থক উত্তর পাওয়া কঠিন। বাস্তব অস্বস্তি ও মানসিক চাপ নিয়ে ছাত্রীরা এসময় বিদ্যালয়ে থাকতে রাজি হয় না। আর কর্তৃপক্ষও এই বিষয় নিয়ে শুধু ছাত্রীদের জন্য অন্যরকম কিছু কি ভাবা যায়, তা নিয়ে অত ভাবতে রাজি নয়। প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কাজের মাঝে এটা অতি গুরুত্বপূর্ণ বলে মান্যতা পায় না। আর বিষয় যখন শারীরিক এবং গোপনীয়, তখন মেয়ের বাড়ির লোক দেখভাল করার জন্য দায়বদ্ধ ধরে নেওয়া হয়। পাঁচদিন পর যখন স্কুলে ফেরা, তখন শরীর খারাপ বললেই বিষয় সহজ হয়ে যায়। তাই ছাত্রীর পিরিয়ডসের দিন বিদ্যালয়ের বদলে ঘরে থাকার অভ্যাস প্রতিষ্ঠানের জন্য স্বাভাবিক ঘটনা বলেই চলে আসছে। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। তবে ড্রপ আউটের ভয়াবহ পরিসংখ্যান ভাবতে বাধ্য করছে সমস্যা কি আদৌ চিহ্নিত হচ্ছে! মেয়েরা কি সত্যিই পিরিয়ডসকে লজ্জা ও অসম্মানের বেড়ি থেকে মুক্ত করে বিষয় নিয়ে স্বাভাবিক হতে পারছে! সেক্ষেত্রে কতটা সহায়ক ভূমিকা প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক বাতাবরণ দিতে পেরেছে!
আর্লি মেনার্কি বা দ্রুত পিরিয়ডসের ফলে হঠাৎ দিনটি চলে আসা এখন গ্লোবাল ট্রেন্ড। বিষয়টি অনেকের কাছেই অজানা। সেটি বিদ্যালয়ে ঘটতে পারে এবং এটি স্বাভাবিক ঘটনা বলেই ছাত্রীদের কাছে প্রতিভাত হওয়ার কথা। সেই পরিস্থিতিতে যে সহযোগিতা পাওয়ার কথা, সেটা সবক্ষেত্রে ছাত্রীরা পাচ্ছে না। কারণ মেনুস্ট্রুয়াল হেলথ নিয়ে বেশি বলাবলিতে অনভ্যস্ত থাকাটা প্রান্তিক এলাকায় খুব বেশি অস্বাভাবিক নয়। আবার শহরের অনেক বিদ্যালয়ে আর্লি মেনার্কি দেখভালের জন্য স্টাফ ও স্থায়ী কাউন্সিলিং-এর ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। সচেতনতার শিবিরে ছেলে-মেয়ে সকলের সমানভাবে অংশগ্রহণ এবং সেই নিয়ে আলোচনা এগিয়ে যাওয়ার বিষয়ও সীমিত।
আসলে পিরিয়ডসের সঙ্গে জুড়ে থাকা মিথ্যা বিশ্বাসকে ভাঙা বেশ কঠিন। মেন্সট্রুয়াল ব্লাড নিয়ে অবৈজ্ঞানিক সংস্কারগুলিকে মেনে আসা হয় প্রায় নিয়ম করে। রান্নাঘর থেকে খাওয়া এবং পুজোর ঘর থেকে দৈনন্দিন সামগ্রীতে হাত লাগানো নিয়ে যাবতীয় বিধিনিষেধ চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ঘরের মানুষরাই। নিজেদের শরীরটাকেই অভিশাপ ও অপবিত্রতার সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছে পিরিয়ডসের দিন। সঙ্গে মুড সুইং, অনিয়ন্ত্রিত আবেগের সমস্যা নিয়ে অপব্যাখ্যা ও অবাস্তব চর্চা। এটি দূর করার একমাত্র উপায় পিরিয়ডস নিয়ে স্বাস্থ্যকর অনুশীলন। নারী শরীর বিষয়ক জ্ঞান ও তথ্যের খোলামেলা আলোচনা। কেননা এই শরীরই পরিবারের আগাম ভিত নির্মাণের কাজটি করে চলে। নারী শরীরকে গর্ভাধারণক্ষম করে তোলার জন্যই ইউটেরাসের আস্তরণটি পুরু হয়। যদি গর্ভাবস্থা না আসে, তবে এই আস্তরণ রক্তের আকারে ঝরে পড়ে। প্রতি মাসেই। প্রক্রিয়া চলে তিন থেকে আটদিন। এর সঙ্গে অশুদ্ধতা বা শুদ্ধতার সম্পর্ক টানা অশিক্ষা ও কুসংস্কার। সহজ কথায় মা হতে পারার জন্যই পিরিয়ডস। তা ঘিরে সম্মান ও সহযোগিতার বদলে মিলছে অসহযোগিতা আর হয়রানি।
শিক্ষা অর্জনের পথেই ছাত্রীরা অশিক্ষা ও সুশিক্ষার ফারাক করতে শিখবে এটাই প্রত্যাশিত। জামায় লাল দাগের সঙ্গে লজ্জা ও অসম্মানের কোনও সম্পর্ক থাকতেই পারে না– এটি কথায় ও কাজে নিয়ত প্রচার করে এগিয়ে যেতে হবে। বিদ্যালয়ের ভূমিকা সেখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক ও শিক্ষিকা নিজেই যদি পিরিয়ডসের সময় ছুটি দেওয়াকে স্বাভাবিক বলে মেনে চলতে শুরু করেন বা মেয়েরা এই সময় বিদ্যালয়ে থাকতে অনিচ্ছুক তাই তাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে এই অজুহাতে বিশ্বাসী হয়ে পড়েন তবে বিপদ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পিরিয়ড ‘শরীর খারাপের’ তকমা পেয়েছে। যা বলামাত্রই ছুটির ঘণ্টা। যা বলামাত্রই ফিসফিস গোপনীয়তা। এ থেকে রেহাই পেতে সকলেই চায়। তার পরিকল্পনাও অনেক হয়তো। আখেরে ভাবনার বদলের সেই ছাপটা ধরা যাচ্ছে না। পিরিয়ড প্রাইভেসি এই পর্যায়ের হওয়া কাম্য নয় যে শব্দটাই জোরে উচ্চারণ করলেই মানুষ আতঁকে উঠবে। যেখানে বাচ্চাদের মুখে মুখে বিবাহ অত সহজেই উচ্চারিত। বিদ্যালয়েও বাল্যবিবাহ নিয়ে যাবতীয় শিবির বেশ ঘটা করেই হয় যা হওয়া উচিত। তবে পিরিয়ডস সচেতনতার ক্ষেত্রে এক প্রছন্ন আড়ষ্টতা, গা বাঁচিয়ে এড়িয়ে যাওয়ার বিষয় নজরে আসার মতো। এই বিষয়ে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের সোজা উত্তর ভেন্ডিং মেশিন আছে। মেয়েরা কয়েন দিয়ে প্যাড সংগ্রহ করে। তথ্য বলছে প্রান্তিক এলাকায় মেশিনের প্রক্রিয়ার চেয়ে ব্যাগের মধ্যে প্যাড রাখাতে স্বচ্ছন্দ। বিদ্যালয়ে মেয়েদের মেশিনে অভ্যস্ত করে তোলার জন্য বাড়তি নজর দেওয়াটা সময়ের অপচয় বলেই মনে করা হয়। ‘ওরা পারবে না’ এই বক্তব্য আসলে দ্বিপাক্ষিক। ওদের পারার জন্য প্রতিষ্ঠানের আন্তরিক সহযোগিতা খুব দরকার হয়ে পড়ে। এটি পাওয়ার অধিকার প্রত্যেক ছাত্রীর সমান ভাবে রয়েছে।
পিরিয়ডসের দিনে মেয়েদের ঘরে না পাঠিয়ে বিদ্যালয়ে ধরে রাখার সমাধান কী! সহজ উপায়। একটি মেডিক্যাল রুম, ভালো মানের স্যানিটারি ন্যাপকিন সরবরাহ, অ্যান্টি স্পাজমোডিক পেইন কিলারের সহজলভ্যতা, পরিচ্ছন্ন বাথরুম, পর্যাপ্ত জলের সরবরাহ। মুশকিল কাজ একেবারেই নয়। সরকারি উদ্যোগে বিদ্যালয়ের পোশাকের সঙ্গে স্যানিটারি ন্যাপকিন দেওয়া যেতে পারে। ছেলে-মেয়ে উভয়েই বিষয়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠুক। সপ্তাহে থাক এমএইচএম ম্যানেজমেন্টের একটি করে ক্লাস। ভুল তথ্য ভাঙার ক্ষেত্রে সঠিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাই একমাত্র পথ। মানসিক সুস্থতার অধিকার ও শারীরিক সীমাবদ্ধতা জয় শিক্ষার একটি অঙ্গ। মেয়েদের প্রাথমিক দাবি মর্যাদার পিরিয়ডসের দিনযাপন। বৈষম্যের বেড়া টপকে সুশিক্ষা ও সুচিন্তার মার্গদর্শন। প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ যেমন নিয়ম। তেমনই পিরিয়ডসের দিন বিদ্যালয়ে আসাটাও সহজ ও স্বাভাবিক নিয়ম হোক। প্রতিদিন নিয়ম করে ব্রাশ করাতে যেমন লজ্জা নেই, আছে পরিচ্ছন্নতার পাঠ, তেমনই পিরিয়ডসের দিনে বিদ্যালয়ে প্যাড বদলে নিয়ে ক্লাস শেষ করে নেওয়ার মধ্যে দ্বিধা বা সঙ্কোচ নেই, আছে সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকার পাঠ। সেক্ষেত্রে শিক্ষক ছাত্রীর বোঝাপাড়াটা খুব দরকারি। সবচেয়ে বেশি জরুরি সহপাঠীদের উত্যক্ত বা জ্বালাতন করার ভয় থেকে ছাত্রীদের এসময় মুক্তি দেওয়া। মেন্সট্রুয়াল হাইজিন নিয়ে কাজ করা মডেল বিদ্যালয়ে সংগৃহীত নানা তথ্যের মধ্যে এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ।