মমতা শঙ্কর ক্যামেরার সামনে বাড়ির পুরুষ– বিশেষ করে বাবা-দাদা-পুত্রসন্তানদের দিয়ে ন্যাপকিন না আনানোর কথা বলেছেন। যদিও ছাড় দিয়েছেন স্বামীকে। কারণটা ঠিক বোধগম্য নয়। মনে হয়, স্বামী যেহেতু নারীর শরীর ভোগের ছাড়পত্র পান, তাই রজঃস্বলা নারী তাকে ন্যাপকিন এনে দেওয়ার কথা বলতেই পারেন। উনি বাচ্চাদের ‘ব্যাড টাচ’, ‘গুড টাচ’– আলাদা করে শেখাতে অনীহা প্রদর্শন করেছেন, বলেছেন ওসব ওরা নিজে থেকেই শিখবে। একটি কাঁচা পাতা গাছ থেকে ছিড়ে পড়লেই যাদের ব্যথা পাওয়ার কথা ছিল, তারা যখন সরকারি পুরস্কারের আড়ালে নিজেদের জীবনের গ্লোরিয়াস ভূমিকা নিয়ে দিবাস্বপ্ন দেখেন, তখন এমন কিছু আলটপকা ভাবনা ছড়িয়ে দেন।
প্রচ্ছদ: দীপঙ্কর ভৌমিক
সমাজমাধ্যমে সদ্য-প্রকাশিত অভিনেত্রী, নৃত্যশিল্পী মমতা শঙ্করের এক সাক্ষাৎকারকে কেন্দ্র করে শোরগোল! যাঁরা সমাজে যশস্বী, তাঁদের কাছ থেকে সমাজ ভিন্ন কিছু শুনতে প্রত্যাশী। সেই প্রত্যাশা ব্যর্থ হলে শোরগোল হবেই। এক্ষেত্রেও তাই-ই হয়েছে।
এর একটা উলটপুরাণও রয়েছে। সমাজের ভালো করতে চাওয়া যে কী বিপদজনক, তা শ্রীমতীর দেওয়া সাক্ষাৎকার শুনলেই বোঝা যাবে। আমাদের ইতিহাস বলে, শয়ে শয়ে কত রাজা জন্মেছেন, শক্তি প্রদর্শন করেছেন, তাঁদের রাজ্যসীমা বিস্তারের কাহিনি রক্তে দোলা দেয় ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার এ-ও সত্যি যে, কলিঙ্গ যুদ্ধে মাত্র এক লাখ মানুষের মৃত্যু দেখে এক রাজা রাজত্ব ছেড়ে ধর্মাশোক হয়েছেন। অর্থাৎ আমি বোঝাতে চাইছি, ‘লিবারেল’ ভাবনা সমাজে সবকালেই ছিল, আছে ও থাকবে। আবার তার ‘পাল্টা’ ও ‘সমর্থন’– দুই-ই থাকবে।
প্রথার বাইরে গিয়ে নতুন পথ ও মত তৈরি করা একজন সাধারণ (যাদের কাছে ইউটিউবার বা সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিরা ‘বুম’ হাতে আসেন না) মানুষের কাছে যতটা কঠিন, একজন প্রথিতযশার ক্ষেত্রে তা আরও বেশি কঠিন। কারণ উভয়ক্ষেত্রেই বেশ কিছু সংঘাত তার মধ্যে চলতে থাকে। এই সংঘাত মমতা শঙ্করের মধ্যেও চলেছে। মানুষের মধ্যের এই সংঘাতগুলির সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রেক্ষিতও ভিন্ন ভিন্ন হয়, আবার প্রতিটি সংঘাতের মধ্যেই স্বার্থ ও আদর্শ থাকে। আরও গভীরভাবে ভাবলে দেখবেন প্রতিটি স্বার্থের মধ্যে যেমন আদর্শ থাকে, তেমন প্রতিটি আদর্শের মধ্যেও থাকে স্বার্থ। এবং এর ফলে একপ্রকার অদৃশ্য গণ্ডি প্রকাশ পায়। যখন স্বার্থের মধ্যে আদর্শ আসে তখন আদর্শের গলা টিপে ধরা হয় আর যখন আদর্শের মধ্যে স্বার্থ আসে, তখন তা বৃহত্তর গণ্ডির আবহ রচনা করে– যা সমাজ তথা দেশকে নতুন কিছু দিতে সমর্থ হয়। আরও পরিষ্কার করে বললে, সমাজ-সময়-দেশকে সমৃদ্ধ করে।
এক্ষেত্রে মমতা শঙ্কর ক্যামেরার সামনে বাড়ির পুরুষ– বিশেষ করে বাবা-দাদা-পুত্রসন্তানদের দিয়ে ন্যাপকিন না আনানোর কথা বলেছেন। যদিও ছাড় দিয়েছেন স্বামীকে। কারণটা ঠিক বোধগম্য নয়। মনে হয়, স্বামী যেহেতু নারীর শরীর ভোগের ছাড়পত্র পান, তাই রজঃস্বলা নারী তাকে ন্যাপকিন এনে দেওয়ার কথা বলতেই পারেন। উনি বাচ্চাদের ‘ব্যাড টাচ’, ‘গুড টাচ’– আলাদা করে শেখাতে অনীহা প্রদর্শন করেছেন, বলেছেন ওসব ওরা নিজে থেকেই শিখবে। একটি কাঁচা পাতা গাছ থেকে ছিড়ে পড়লেই যাদের ব্যথা পাওয়ার কথা ছিল, তারা যখন সরকারি পুরস্কারের আড়ালে নিজেদের জীবনের গ্লোরিয়াস ভূমিকা নিয়ে দিবাস্বপ্ন দেখেন, তখন এমন কিছু আলটপকা ভাবনা ছড়িয়ে দেন। আমাদের দেশে যে সমস্ত সংস্কার এখনও স্বমহিমায় বিরাজমান, তার মধ্যে অন্যতম হল ‘ধর্ষণ’-এর শিকার হওয়া ‘মেয়েটির’ ধর্ষণ-উত্তীর্ণ জীবন। আমরা যারা কখনও-না-কখনও এই ধরনের ঘটনার মধ্য দিয়ে গিয়েছি, বাড়ির বড়দের বা প্রিয়জনদের জানিয়েও কোনও সুরাহা করতে ব্যর্থ হয়েছি বরং বিপরীত দিক থেকে ‘কাউকে বলিস না’, ‘চেপে যা’ গোছের আপ্তবাক্য আর কিছু বিভীষিকাময় শৈশব, কৈশোর, যৌবন, বার্ধক্য-স্মৃতি আমৃত্যু বহন করছি বা করব– তারা জানি যে কী মারাত্মক বার্তা তিনি সমাজ-দর্পণে তুলে ধরেছেন। তবুও বলব এই পরামর্শ একান্তভাবে তাঁর নিজের! যেহেতু পুরস্কার ক্ষমতা ও দায়িত্ব বাড়িয়ে তোলে, তাই সামাজিক সহ-নাগরিকরা হয়তো আরও প্রসারিত কিছু প্রত্যাশা করেছিলেন।
অসুবিধা নেই, কিছু কথা বানের জলে ভেসে যায়। এই সাক্ষাৎকারের বেশ কিছু কথা তেমনই। কালের স্রোতে ভেসে থাকার মতো নয়।
গুড টাচ-ব্যাড টাচ যখন শিশুদের শেখানো হয় (মেয়ে এবং ছেলে উভয়কেই) তখন পুরুষ এবং মহিলা দু’টি শিশুকেই শেখানো হয়– অর্থাৎ, ধর্ষিত এবং ধর্ষক। ফলে খারাপ/ভালো, ন্যায়/অন্যায় বোধ নিয়েই সব লিঙ্গের শিশুদের বড় হওয়ার সুযোগ থাকে। আর থাকে মা-বাবাদের সামাজিক ট্যাবু ভেঙে বেরিয়ে আসার গল্প। আমাদের দেশে ‘অ্যাবিউজ’ শব্দের খুব থলথলে মেদালো অর্থে ধরা হয়। ফলে ধর্ষণ, ধর্ষিতা, সতীত্ব, নারীত্ব নিয়ে সামাজিক ট্যারাবাঁকা চলন-বলনের মধ্যে কত অত্যাচার, নিপীড়ন-শোষণের কাহিনি ঘরের মধ্যেই গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটে, তা আমরা নিজেরাই জানি না। ফলে প্রাথমিক বিচারব্যবস্থার কোনও সুবিধা এইসব পরিবার পায় না। আদালত পর্যন্ত যাওয়া তো অনেক দূর। তাই যদি ছোটবেলা থেকে একটু একটু করে গণ্ডি ভাঙার গল্প বলা যায়, অন্তত কান সেই গল্প শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়, তাহলে শিশুটি সঙ্গে সঙ্গে মা-বাবা, কিছুটা আমরাও আশান্বিত হব না কি?
ন্যাপকিন কেনা নিয়েও কিছু অপ্রাসঙ্গিক কথা শুনলাম। কিছু প্রশ্ন– আমাদের দেশে ন্যাপকিন বিক্রেতা সবাই মহিলা? আমার তো জানা নেই। সবাই স্বামীর বয়সি? আমার তো জানা নেই! ওষুধের দোকানে বা বড় কোনও শপিং মলের স্টোরে যেখানে ন্যাপকিন বিক্রি হয়, বিক্রেতা হিসেবে সেখানে তো বিভিন্ন বয়সের পুরুষদের হামেশাই দেখা যায়। তারা বয়সে কেউ পুত্র-স্বামী-দাদা-বাবা-দাদুর বয়সিও হতে পারেন। তাহলে একজন নারী (মানে মমতা শঙ্কর অথবা তাঁর পরিচারিকা) সেখানে কী করে ন্যাপকিন কিনবেন? না কি দোকান থেকে না নিয়েই ফিরে আসবেন? নাকি নিজের ছেলে-দাদা-কাকা-বাবা ছাড়া আর সব পুরুষদের কাছে বিষয়টি বলা যাবে! সব গুলিয়ে দিলেন আপনি! আসলে আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে সনাতনী, পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা কিলবিল করছে। পদ্মশ্রী-প্রাপ্ত মমতা শঙ্কর তার বলিষ্ঠ উদাহরণ মাত্র। সত্যকে মূল্য না দিয়ে শৌখিন মজদুরি– ভালো নয়। ভালো নয়।
আমাদের মতো মেয়েদের জন্য নির্দিষ্ট স্কুলগুলিতে বিভিন্ন ব্যাঙ্ক-ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, এনজিও থেকে লোকজন আসেন। তাদের কাছ থেকে আমাদের বাচ্চাদের দেওয়ার জন্য ন্যাপকিন-ভেন্ডিং মেশিন আমরা চাই, তারা দেয়ও। সেক্ষেত্রে আমাদের বিবেচ্য বিষয় পুরুষ-মহিলা কার হাত থেকে ন্যাপকিন নিচ্ছি– তা নয়। আমরা জোর দিই ন্যাপকিন ব্যবহারের দিকে। সম্প্রতি বিভিন্ন পত্রিকায় উঠে এসেছে ভারতীয় মহিলাদের সারভাইকাল ক্যানসার বৃদ্ধির প্রবণতা আর আমরা এখনও লজ্জা-ট্যাবুর বশংবদ হয়ে থাকব? পশ্চিমবঙ্গে সরকারি স্কুলগুলির ভর্তির ফি ২৪০ টাকা। বহু ছাত্রীকে আমরা নিজেরা ২৪০ টাকা দিয়ে ভর্তি করাই, কারণ সেটুকু দেওয়ার ক্ষমতা তাদের থাকে না। এদের মানসিক স্বাস্থ্য, হীনমন্যতা, রাজনৈতিক অবহেলাকে আরও বেশি করে অনুপ্রাণিত আমরা করতে পারি না। বরং গলাটা ছাড়তে শেখাই, শেখাব– কখনও নিজের বিরুদ্ধে, কখনও সমাজের বিরুদ্ধে।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved